সমুদ্রসীমা জয়: সম্ভাবনা ও করণীয়
১৮ মার্চ, রোববার ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘সমুদ্রসীমা জয়: সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো। আলোচনা
মতিউর রহমান
মতিউর রহমান
সমুদ্রসীমা বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। সম্প্রতি হামবুর্গে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্রসীমা নিয়ে একটি ইতিবাচক রায় হয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় অর্জন। এ জন্য সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমরা অভিনন্দন জানাই। এ রায়ের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের একটি স্থায়ী নিষ্পত্তি হলো। ভারতের সঙ্গেও ২০১৪ সালের মধ্যে সমাধান হবে বলে আশা করছি। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের পক্ষে রায়, আমাদের জন্য অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আমরা আশা করি, ভারতের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের মতো একই ধরনের রায় পাব। আমাদের সমুদ্রসীমায় তেল, গ্যাসসহ যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তা যেন দেশের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন নিয়ে তর্কবিতর্ক আছে। আমরা আশা করি, এ ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করা হবে। এ বিষয়ে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে। আমরা চাই আরও বেশি বেশি আলোচনা হোক। এখন আলোচনা শুনব খুরশেদ আলমের কাছ থেকে।
মো. খুরশেদ আলম
এটি একটি সময়োপযোগী আলোচনা। আপনারা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন কোনো দিক থেকেই সমুদ্র খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। আমরা অনেক দেরিতে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছি। আমরা আশির দশকে বা তারও পর যদি সচেতন হতাম, তাহলে অনেক সহজভাবে বিষয়টি সমাধান হতে পারত। তালপট্টি নিয়ে যখন সমস্যা হলো, তখন আমি ছিলাম। তালপট্টির পশ্চিম দিকে নদী ও সাগর আছে। সেটা আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। এসব বিষয় নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি। ১৫ বছর আগে পত্রিকায় লিখেছি। তবে দুঃখের বিষয়, নীতিনির্ধারণী মহল থেকে কোনো সাড়া পাইনি। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে জানি ১৩০ মাইলের বেশি সাগর আমরা পাচ্ছি না। এমন নয় যে সমস্যাটি আজকে সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তখন থেকেই নীতিনির্ধারণী মহল জানত যে ১৩০ মাইলের বেশি সমুদ্রসীমা আমরা পাব না। তখন থেকে বিষয়টি কারও কাছে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু আমি লিখেছি। ১০ বছর আগে প্রথম আলোয় লিখেছি। আমি চেয়েছিলাম দেশের মানুষ জানুক। কারণ, তারা জানলে নীতিনির্ধারণী মহলের ওপর চাপ তৈরি করবে।
আমরা আদালতে কী বক্তব্য দিয়েছি, তা স্পষ্টভাবে বলতে চাই। আমাদের বক্তব্য, মিয়ানমারের বক্তব্য ও ১৪ তারিখে সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক রায়—সবই ওয়েবসাইটে আছে। আপনারা যেকোনো বিষয় জানতে চাইলে ওয়েবসাইট দেখুন। আমাকেও প্রশ্ন করতে পারেন। জয় যেটি এসেছে, সেটি দেশের জয়, সবার জয়। সংবাদের হেডলাইন করার জন্য এমন কোনো বক্তব্য দেবেন না, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কারণ, এ দেশের মানুষ সমুদ্র এবং এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে তারা জানে না। জানার তেমন কোনো সুযোগও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র নিয়ে আমি একটি সেমিনার করেছি। তারা স্বীকার করেছে এ বিষয় নিয়ে তাদের খুব বেশি জানা নেই।
এ বিষয়ের ওপর তাদের কোনো পাঠক্রমও নেই। জাতিগতভাবে আমাদের এই সীমাবদ্ধতা আছে। সমুদ্র-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আমার কাছে আছে। ওয়েবসাইটে আছে। রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিতর্ক আছে। এসব যুক্তিতর্কের সব উত্তর আমাদের কাছে আছে। আপনারা যেকোনো জায়গা থেকে জেনে নিতে পারেন। কিন্তু অনুরোধ করব, না জেনে, না বুঝে এমন কোনো মন্তব্য করবেন না, যাতে জাতি বিভ্রান্ত হয়। এত বড় অর্জন ম্লান হয়ে যায়।
কৌশলগত কারণে আমরা আদালতের কাছে সমুদ্রসীমা কিছুটা বেশি চেয়েছি। সবটা টিকবে না জেনেও অধিক তথ্য-উপাত্ত আমরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছি। আমরা চেয়েছি আমাদের ন্যায্যটা যেন ঠিক থাকে। ১৯৭৪ সালে জলসীমা-বিষয়ক একটি আইন সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে দেশবাসী জানে না। এই আইনের মাধ্যমে আমরা ১২ মাইল সমুদ্র জলসীমা চেয়েছিলাম। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের মতৈক্য হয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও মিয়ানমার সমুদ্রসীমা থেকে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু এটা ছিল একটি সম্মত কার্যবিবরণী। ১৯৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত এই সম্মত কার্যবিবরণীকে চুক্তিতে পরিণত করা হয়নি। কেন করা হয়নি তার উত্তর আমাদের কাছে নেই। যদি করা হতো, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দুই দেশ এটা মানতে বাধ্য হতো। তাহলে আজ আর বিষয়টি এত জটিল হতো না।
১৯৮২ সালের ১০ ডিসেম্বর বর্তমান আইন স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরের পর আর অনুস্বাক্ষর করা হয়নি। ২০০১ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের শেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে ১২ জুলাই অনুস্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয়। অনুস্বাক্ষর এই জন্য জরুরি যে, ২০০ মাইলের বাইরে আমরা মহীসোপান দাবি করতে চাই। ২০০ মাইলের বেশি দাবি করতে চাইলে, অনুস্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জাতিসংঘের কাছে দাবি উপস্থাপন করতে হয়। দাবি উপস্থাপনের শেষ সময় ছিল ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট। বিশেষ দুটি জরিপ ছাড়া এই দাবি উপস্থাপন করা সম্ভব ছিল না। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম আমি জরিপ করার জন্য চেষ্টা করি। সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত আমরা বলি, জরিপ ছাড়া দাবি উপস্থাপন করলে এ থেকে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। তিন হাজার কিলোমিটার জরিপ করার জন্য সরকার আমাদের ৮০ কোটি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা ২৫ কোটি টাকা দিয়ে জরিপটি শেষ করেছি। আইনে আছে বেজ লাইন থেকে ৩৫০ কিলেমিটার পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু আমাদের বেজ লাইনে সমস্যা থাকায় অন্য একটি পদ্ধতিতে আরও বেশি দাবি করি। সেটি হলো, সমুদ্রের দুই হাজার ৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু এটি করার জন্য আমাদের জরিপ করার জাহাজ ছিল না। ১৯৮০ সাল থেকে সব রকম চেষ্টা করার পরও নৌবাহিনীর সঙ্গে একটি জরিপ-জাহাজ যুক্ত করা যায়নি। অবশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি জরিপ-জাহাজ কেনার অনুমতি দেন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাহাজটি বাংলাদেশে আসে। অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুই হাজার ৫০০ মিটার জরিপ করা হয়। এ জন্য আমাদের আরও ১০০ কিলোমিটার বেশি দাবি করার সুযোগ তৈরি হয়।
তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৮০ থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থাৎ ২৫০ মাইলের বেশি আমরা মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করি। অথচ মিয়ানমার পুরো অঞ্চল দাবি করে নথিপত্র জমা দিয়েছে ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং ভারত জমা দেয় ২০০৯ সালের ১১ মে। ২০১০ সালে যদি আমরা এ কাজটি না করতে পারতাম, তাহলে আমাদের আজকের এই অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। ২০০৯ সালে ভারত মিয়ানমারের জন্য মহীসোপানের কিছু অংশ রাখে, বাংলাদেশের জন্য কোনো অংশ না রেখে পুরো মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করে।
এখন ব্লক নিয়ে কথা হচ্ছে। নৌসীমা ঠিক না করে ২০০৫ সালে ব্লক করা হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। আমরা কেন আদালতে গেলাম? ভারত ও মিয়ানমার আমাদের বলল, প্রকৃতিগতভাবে তোমরা যে অংশ পেয়েছ, এর বেশি তোমরা পাবে না। কারণ, প্রকৃতির ওপর আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। অর্থাৎ সমদূরত্বের ভিত্তিতে তোমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে।
আমরা ভারত ও মিয়ানমারের যুক্তি গ্রহণ করি নাই। আদালতে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যাখ্যা করি। এবং আদালতকে বোঝাতে চেষ্টা করি, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ তার ন্যায্যতা হারাবে। আমরা অবতলতার (কনকেভিটি) ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির কথা বলি। এবং এভাবে যেসব দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে তাদের রায় সমনে নিয়ে আসি। জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কের অবস্থান ঠিক আমাদের মতো।
এ ক্ষেত্রে আমরা বলি, ১৯৬৭ সালে জার্মান আমাদের যুক্তির পক্ষে রায় পেয়ে থাকলে ২০১২ সালে এসে আমরা কেন পাব না? শুধু জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক নয়, আমরা গিনি, গিনি বিসাও, শারজাহ, মোনাকো, ব্রুনাইসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিই। এ দেশগুলো আমাদের যুক্তির পক্ষে রায় পেয়েছে। কারণ, তাদের অবস্থান আমাদের মতো ছিল। তাহলে আমরা কেন পাব না? অন্যদিকে মিয়ানমারের আইনজীবীরাও তাঁদের পক্ষে অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। বিশ্বের ২১ জন বিশেষজ্ঞ বিচারক আমাদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, অনেক বিচার-বিবেচনা করে এই রায় দিয়েছেন। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক রায় আছে। আমি বলব, সেগুলো আপনারা পড়ুন এবং বুঝুন। তারপর আমাদের রায় নিয়ে মন্তব্য করুন। কোনো কিছু না জেনে, না বুঝে ধারণাপ্রসূত বিরূপ মন্তব্য করলে ওই সব বিচারককে অসম্মান করা হবে। কারণ, তাঁদের জন্য আমাদের এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে।
আমরা ১৩০ মাইলের বাইরে আরও ২০০ মাইল গভীর সমুদ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের ২০০ মাইল গভীর সমুদ্রে যেতে হলে মিয়ানমারের ইইজেড পার হয়ে যেতে হয়। এক দেশের ইইজেড অতিক্রম করে অন্য দেশের গভীর সমুদ্রে যাওয়ার নজির বিশ্বে একটিও নেই। ২০০ মাইল মহীসোপানের আমাদের দাবি আদালত এখানেই বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আদালত সেটা করেননি। কেন যেন সবকিছু আমাদের পক্ষে ছিল। মিয়ানমারের আইনজীবীরা আরও একটি শক্ত যুক্তি উপস্থাপন করলেন। তাঁরা বললেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘে সমুদ্রসীমার দাবি তুলেছে। সে দাবিতে তারা মহীসোপানের কথা বলেনি। তাহলে কেন এখন তাদের মহীসোপানের দাবি গ্রহণ করা হবে। আমাদের ১৩০ মাইল নৌসীমা নির্ধারণ হয়ে গেছে। ধারা ৭৬-৭৮-এ বলা আছে, একবার নৌসীমা নির্ধারণের পর আর কোনো দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত কোনো আদালত মহীসোপানের বিভাজন করেননি। কানাডা ও ফ্রান্সের একটি মামলায় মহীসোপানের দাবি আদালত গ্রহণ করেননি।
এত কিছুর পরও আমরা আমাদের দাবির পক্ষে অনড় থাকি। এ ক্ষেত্রে আদালতকে আমরা রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার প্রসঙ্গ টেনে বলি, মহামান্য আদালত, বিধাতার সময়ের কোনো শেষ নেই। তার হাতে সময় অনন্ত। তার কাছে রাত-দিন বলে কিছু নেই। কিন্তু মানুষের সময় সংক্ষিপ্ত। তার রাত-দিন হয়, তার মৃত্যু হয়। মহামান্য আদালত, আপনারা যদি আমাদের সমাধান না দেন, তাহলে আমরা কার কাছে যাব? কে আমাদের কথা শুনবে? কে আমাদের সমাধান দেবে? আপনারা সমাধান না দিলে তিন দেশের মধ্যে জীবনভর বিরোধ থেকে যাবে। তখন আদালত আমাদের যুক্তিকে যুক্তিযুক্ত মনে করে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেন। সবশেষে আমি দেশের মানুষকে বলব, সমুদ্রসীমা জয় নিয়ে কোনো অপব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাব।
মতিউর রহমান
আমরা খুরশেদ আলমের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়, রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক এবং সমুদ্রবিষয়ক অনেক তথ্য জানলাম। এবার শুনব এম এইচ খানের কাছ থেকে।
এম এইচ খান
প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে মতৈক্য হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কেন এত দিন পড়েছিল? পড়ে থাকার কারণ হলো, সরকারের এ বিষয়ে কোনো ভাবনা ছিল না, সদিচ্ছা ছিল না। বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার একসঙ্গে সমন্বয় না ঘটলে কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। আমি বলব, রাজনৈতিক উদাসীনতার কারণে এত দেরি হয়েছে। অনেকে মনে করে এটা নৌবাহিনীর দায়িত্ব। কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে, নৌবাহিনী হচ্ছে সরকারের একটি অংশ। তারা পরামর্শ দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী সিদ্ধান্ত আসতে হবে সরকারের কাছ থেকে।
আজকে যে জরিপ-জাহাজের কথা বলা হচ্ছে, আমি নিশ্চিত, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৬ সালে এই জাহাজ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হতো। তাঁর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। জরিপ ছাড়া সমুদ্রবিষয়ক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। নৌবাহিনীর জন্য এ জাহাজটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও আমি ব্যর্থ হই। ১৯৭৬ সালে জরিপ-জাহাজ থাকলে আজকে বাংলাদেশের জন্য সমুদ্রসীমার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত। বাংলাদেশের মানুষ অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। আমার খুব অবাক লাগে, সমুদ্র নামের এত বড় একটি সম্পদ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ক্রিকেটে জয়লাভের পর জনসাধারণের উচ্ছ্বাস দেখে অভিভূত হয়েছি। কিন্তু সমুদ্র নিয়ে এত বড় একটা অর্জন হওয়ার পরও তাদের খুব বেশি সাড়া দেখলাম না। ওশানোগ্রাফি ও ম্যানেজমেন্ট অব দ্য সি নামে সমুদ্র-বিষয়ক দুটো বিশেষ বিষয় আছে। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়ানো হয় না। এত কিছুর পরও আন্তর্জাতিক আদালতের রায় আমাদের পক্ষে গেছে। আমি মনে করি এটি একটি বড় প্রাপ্তি। এখন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সীমা বুঝে নিতে হবে। বন্ধু বন্ধু করে কোনো লাভ নেই। কেউ কারও বন্ধু নয়। নিজেই নিজের বন্ধু। এটি কোনো আবেগতাড়িত বিষয় নয়। তাই এ ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের অধিকার আমাদের বুঝে নিতে হবে।
মতিউর রহমান
এম এইচ খানের আলোচনার মাধ্যমে জানা গেল, ১৯৭৪ সাল থেকে প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত উদ্যোগের অভাব লক্ষ করা গেছে। ফলে এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এখন এ বিষয়ের ওপর বলবেন হাবিবুর রহমান।
হাবিবুর রহমান
সাধারণভাবে এ বিষয়টি মানুষ কম জানে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার সময় অনেক পরিভাষাগত শব্দ ব্যবহার করা হয়। ফলে এ বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়। বিষয়টিকে আরও সহজভাবে কী করে জনসাধারণের মধ্যে আনা যায়, সেটি ভাবতে হবে। উপকূল থেকে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন এবং মহীসোপানসহ মোট ৪৬০ মাইল পর্যন্ত আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০ মাইল পর্যন্ত আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ জায়গাটি আমরা আমাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারব। অবশিষ্ট ২৬০ মাইল ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক বিধিবিধান রয়েছে। এই ২৬০ মাইল মহীসোপান আমরা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করতে পারব না। ধারা ৮২-তে বলা আছে, মহীসোপান ব্যবহার করতে হলে একটি অংশ দিতে হবে। এখান থেকে যে সম্পদ আহরিত হবে, আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষকে পাঁচ বছর করে ১২ বছর যাবৎ কিছু কিছু দিতে হবে। ১২ বছর পর ৭ শতাংশ হারে নিয়মিতভাবে দিতে হবে। আমি মনে করি, এই রায়ের ফলে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই রায়ের পর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার কোনো দেশই একচেটিয়াভাবে বঙ্গোপসাগরের কোনো অংশ দাবি করতে পারবে না। নেদারল্যান্ডসের দি হেগে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে এ বিষয়টি উঠবে। ভারতের হাইকমিশনার আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
বদরুল ইমাম
সমুদ্র বিষয়ে বিভাগ খুলতে কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে?
মো. খুরশেদ আলম
ওশানোগ্রাফি বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে এ বিষয়টি পড়ানোর জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়াতে রাজি হয়েছে। সিনেটের অনুমোদন পেলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওশানোগ্রাফি বিষয়টি পড়ানো হবে। ওশানোগ্রাফি পড়াটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সাগরে শুধু তেল-গ্যাস ও মাছ ছাড়া অনেক সম্পদ আছে, যা আমাদের দেশের মানুষ জানে না। যেমন—সালফাইট, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি মূল্যবান সম্পদ সাগরে পাওয়া যেতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম
হাবিবুর রহমানের আলোচনা থেকে গভীর সমুদ্র ব্যবহারের কিছু আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের বিষয় জানতে পারলাম। এখন বলবেন জিয়াউদ্দিন আহমদ।
এ এ জিয়াউদ্দিন আহমদ
এই রায়ের ফলে ৩৮ বছরের ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হলো। ফলে আমাদের সম্ভাবনা ও করণীয় জায়গাটি আরও অনেক বেশি বিস্তৃত হলো। আমাদের বিশাল সমুদ্রসৈকত রয়েছে। এর আয়তন আরও বৃদ্ধি পাবে। তেল-গ্যাসসহ সমুদ্রের বিভিন্ন সম্পদ আহরণ, সমুদ্রসৈকতসহ সমুদ্রের নানা ধরনের জরিপকাজের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলা নিজস্ব উদ্যোগে খুব কম সময়ে ও কম ব্যয়ে সফলভাবে গ্যাস উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করতে হবে এবং পেট্রোবাংলাকে ঢেলে সাজাতে হবে; যাতে পেট্রোবাংলা সব ধরনের কাজ করতে সক্ষম হয়। আমরা সাগরের এত কাছে থেকেও এর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। আমাদের নোয়ামিতে (ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট) সামুদ্রিক বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। আমাদের দেশে এখনো ওশানোগ্রাফি পড়ানো হয় না। অথচ কুয়েতের মতো দেশ এ বিষয়ে আমাদের থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সেখানে ওশানোগ্রাফির জন্য অনেক বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভারতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে অনেক বছর আগে থেকে পড়ানো হচ্ছে। আর আমরা? আমরা এখনো পড়ানোর বিষয়টি চিন্তাভাবনা করছি।
আমাদের এখানে জিওগ্রাফিক্যাল, ফিজিক্যাল, বায়োলজিক্যাল ও কেমিক্যাল ওশানোগ্রাফি, ওসান ইঞ্জিনিয়ারিং, ল অব দ্য সি, মেরিন পলিউশন ইত্যাদি বিষয় তিন মাসের একটি কোর্সের মধ্যে দেওয়া হয়েছে। ওশানোগ্রাফির ওপর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা উচ্চতর ডিগ্রি চালু করার চেষ্টা করছি। আমরা যদি এ বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে না পারি, তাহলে এত বড় অর্জন আমাদের কোনো কাজে আসবে না। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের ওশানোগ্রাফি ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। নৌশক্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি করতে হবে।
এম. শাহ আলম
কোনো কোনো পত্রিকা পড়ে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। সমুদ্রজয় সম্পর্কে তারা কী বলতে চাইছে, আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনেকে এ বিজয়কে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। আবার অনেকে বলার চেষ্টা করেছে, আমরা তাহলে ব্লক হারালাম কি না। আমাদের মূল বিষয় ছিল কোন পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে। সেদিক থেকে আমরা একটি সঠিক দিক নির্দেশনা পেয়েছি। বলা যেতে পারে, এত দিন যা আশা করেছিলাম, তেমনই পেয়েছি। এখন ব্লকসহ যাবতীয় বিষয় ঠিক করে নিতে হবে। আমি মনে করি, ওয়েবসাইটসহ নানা উৎস থেকে এ বিষয়ে আমাদের আরও অনেক জানতে হবে।
মো. খুরশেদ আলম
আমি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি না। সত্যিকার অর্থে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা যদি সঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে আজকের এই অর্জন কোনো দিন সম্ভব হতো না। সরকারে আসার মাত্র চার মাসের মধ্যে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি পাঁচ মাসের মধ্যে সব কাগজপত্র তৈরি করেছি। ভারত ও মিয়ানমার কাউকে জানতে দিইনি। তারা যদি জানত তাহলে এই আদালত থেকে নিজেদের আগেই সরিয়ে নিত। চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশই এভাবে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।
একবার সরিয়ে নিলে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আমাদের আর কোনো দিন আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকত না। আমরা গোপনীয়তা, বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ, দিনের পর দিন অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ কাজটি করেছি। কোথাও একটু ভুল হলে সব শেষ হয়ে যেত।
বদরুল ইমাম
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে দেওয়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা রায় বাংলাদেশের পক্ষে গেছে। এর জন্য বাংলাদেশ সরকারি প্রশাসন কৃতিত্বের দাবিদার, বিশেষ করে যে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ দল যথার্থ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের দাবিটি উপস্থাপন করেছে, তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। রায়ের বিষয়বস্তু যথেষ্ট কারিগরি। তাই অনেকের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব থাকতে পারে। আজকের বিশেষ আলোচক খুরশেদ আলম তাঁর সচিত্র বক্তব্যে সুস্পষ্ট করে রায়ের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেছেন। সে জন্য আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। দেশের গ্যাস সম্পদ বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহের কারণে আমি সেই পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্র-রায়ের বিষয়টির ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী সমদূরত্বের নীতির (যা কিনা মিয়ানমার চেয়েছিল) পরিবর্তে ন্যায়পরায়ণতার নীতি অবলম্বন করাতে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে সমুদ্রসীমাটি ২১৫ ডিগ্রি লাইন বরাবর টানা হয়েছে, তা বাংলাদেশের প্রস্তাবিত লাইনের অনুরূপ, তবে তা কিছুটা পশ্চিমে এনে টানা হয়। ফলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লকগুলোর চারটি সম্পূর্ণভাবে এবং চারটি আংশিকভাবে মিয়ানমারের পক্ষে চলে যাবে। আপাতদৃষ্টিতে দেশের সাগরবক্ষে গ্যাস ব্লক হারানো বলে মনে হলেও আজকের আলোচনা থেকে এটি বোঝা গেল যে ওই সব গ্যাস ব্লকের ওপর বাংলাদেশের দাবি অযৌক্তিক ছিল বলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নির্ধারণ করে।
তাই এটি প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ ইতিপূর্বে তার গভীর সমুদ্রসীমা নির্ধারণে দেশের সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়নি। পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ওই সব সমুদ্র ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাতে মিয়ানমার আপত্তি তোলে। বর্তমানে বাংলাদেশকে নতুন করে তার সমুদ্র ব্লকগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এটি কেবল পূর্বে মিয়ানমারের জন্যই নয়, পশ্চিমে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র ব্লক নির্ধারণেও এসব বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। তবে এই রায়ের মধ্য দিয়ে সমুদ্র ব্লকগুলো নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের অবসান হয়েছে বিধায় এখন বাংলাদেশ তার নিষ্কণ্টক সমুদ্র অঞ্চলে পুরোদমে গ্যাস অনুসন্ধান করবে বলে আমরা আশা করি।
আনু মুহাম্মদ
২০০৮ সালে এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের বাইরে একধরনের উদ্যোগ ছিল। ওই সময় আমরা জানতে পারি, ভারত ও মিয়ানমার তাদের নথিপত্র জমা দিয়েছে। বাংলাদেশের সময় ছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত। এ বিষয়ে সরকারের কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই। কোনো ধরনের জরিপ নেই। ওই সময় আমরা খুব শঙ্কা বোধ করি। বিষয়টির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ যিনি, তিনি ছিলেন খুরশেদ আলম। শেষ পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ের ওপর একটি সাফল্য আমাদের এনে দিয়েছেন। আজকের এই দিনে তাঁকে আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই। ২০০৮ সালে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য জনমত গঠন করা হয়। এ বিষয়ের ওপর একটি কমিটি গঠন করা হয়। খুরশেদ আলম ছিলেন এ কমিটির সদস্যসচিব। ওই সময় আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। আমরা আনন্দিত যে ২০১১ সালে ভয়াবহ বিপর্যয় হয়নি। যেটা হতে পারত।
আরেক দিক থেকে এ বিজয় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ওপর নির্ভর করবে ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে কীভাবে নিষ্পত্তি হবে। মিয়ানমারের তুলনায় ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা আরও কঠিন। ভারতের হাইকমিশনার যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কথা বলেছেন, সেখানে আমি শঙ্কিত। কারণ, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অভিজ্ঞতা আমাদের মোটেই ভালো নয়। তবে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আমরা যে রায় পেয়েছি, সেটি একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এ ধরনের মামলার জন্য যে ধরনের কাগজপত্র তৈরি করা দরকার, মিয়ানমারের সঙ্গে মামলা করতে গিয়ে তার প্রায় সবই আমাদের প্রস্তুত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের বক্তব্যও একটি শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আইনি ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনোভাবে ভারতের সঙ্গে সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে আরেকটি দিক প্রমাণিত, বাংলাদেশের মানুষ যদি সুযোগ পায় তাহলে তারা সবকিছু পারে। তার একটি বড় উদাহরণ খুরশেদ আলম। ২০০৮ সালে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সমুদ্র জরিপ করা সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশের মানুষই অতি অল্প খরচে, অল্প সময়ে এ কাজ করেছে। আমাদের যে জাতীয় হীনম্মন্যতা আছে, যেমন—বিদেশি সাহায্য, বিদেশি নির্ভরতা, বিশ্বব্যাংক কী বলে, ইত্যাদি। এ রায় এই সবকিছুর বিরুদ্ধে বিজয়। সম্ভাবনার মধ্যে একটি হলো, এর মাধ্যমে আমাদের একটি আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ শুধু নদীমাতৃক দেশ নয়, সমুদ্রমাতৃকও। সেদিক থেকে সমুদ্র যতটুকু গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল, তা পায়নি। আমি মনে করি, এখন এই রায়ের ফলে সমুদ্র জনসাধারণের কাছে ভিন্নমাত্রা পাবে।
আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে, সমুদ্রে যে সম্পদ আছে, এর ওপর জনগণের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা। এই দুটো সম্ভাবনা নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী, পাশাপাশি আতঙ্কিত। উদ্বেগের কারণ, দেশে ও বিদেশের অভিজ্ঞতা হলো, সম্পদ পেলেই জনগণ সেই সম্পদের ব্যবহার করতে পারবে তা নয়, সম্পদ পেলেই তার ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়। কারণ, রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সমুদ্রে তেল-গ্যাস ইজারা দেওয়ায় আর কোনো বাধা রইল না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক তেল কোম্পানি কনোকোফিলিপস যে চুক্তির ভিত্তিতে আমাদের সমুদ্রের গ্যাসক্ষেত্র ইজারা নিয়েছে, তাতে এ দেশের জনগণের কোনো লাভ হবে না। লাভ হবে কনোকোফিলিপসের। এ ধরনের ইজারা নেওয়ার জন্য অনেক কোম্পানি অপেক্ষা করছে। আমরা যে সুযোগ পেলে সব ধরনের কাজ করতে পারি, এই বিশ্বাসটুকু আমাদের নীতিনির্ধারণী মহলে নেই। এটিও আতঙ্কের একটি বড় কারণ। অথচ সমুদ্রে যে সম্পদ আছে, তার ওপর যদি জনসাধারণের সঠিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে কয়েকটি প্রজন্ম সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে চলতে পারবে। এখন এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের জাতীয় সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। নৌশক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। সমুদ্রের ওপর গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।
বর্তমানে আমাদের যে পরিমাণ সমুদ্রসীমা আছে এবং ভারতের কাছ থেকে পাওয়ার পর আরও যে পরিমাণ হবে, তা কাজে লাগানোর মতো প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ আমাদের নেই। এ জন্য পেট্রোবাংলাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিদেশে আমাদের অনেক দক্ষ মানবসম্পদ আছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের মানবসম্পদ থেকে আমাদের মানবসম্পদ অনেক বেশি দক্ষ ও যোগ্য। তারা অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেক ভালো মানের কাজ করে। তাই যেকোনো সস্তা অজুহাত দেখিয়ে যেন দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া না হয়, সেদিকটি আমাদের ভাবতে হবে। আরও একটি আতঙ্কের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তারা আমাদের জঙ্গিবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। এ জন্য বঙ্গোপসাগরে তাদের ঘাঁটি তৈরি করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর যেখানেই গেছে, সেখানে হত্যা, লুটপাট, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছু আসেনি। এ ক্ষেত্রে এখন আমাদের প্রধান করণীয় হলো সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব রাখা। দীর্ঘমেয়াদে কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
এম এইচ খান
একটি বিষয় আমি জোর দিয়েবলতে চাই, আমাদের দেশের সমুদ্রবিষয়ক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক গুণবাড়াতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নতি না হলে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব না। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে সমুদ্রের ওপর ব্যাপক গবেষণা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনই ওশানোগ্রাফি, ওশানো ইঞ্জিনিয়ারিং, ল অব দ্য সি ইত্যাদি বিষয় চালু করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
এম এইচ খান
রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.), নৌবাহিনীর
সাবেক প্রধান (১৯৭৩-১৯৭৯)
মো. খুরশেদ আলম
রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.),
অতিরিক্ত সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এ এ জিয়াউদ্দিন আহমদ
চেয়ারম্যান, নোয়ামি (ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট)
ও অধ্যাপক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
হাবিবুর রহমান
অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আনু মুহাম্মদ
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এম. শাহ আলম
চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), আইন কমিশন
বদরুল ইমাম
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সঞ্চালক
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
আব্দুল কাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
মো. খুরশেদ আলম
এটি একটি সময়োপযোগী আলোচনা। আপনারা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন কোনো দিক থেকেই সমুদ্র খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। আমরা অনেক দেরিতে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছি। আমরা আশির দশকে বা তারও পর যদি সচেতন হতাম, তাহলে অনেক সহজভাবে বিষয়টি সমাধান হতে পারত। তালপট্টি নিয়ে যখন সমস্যা হলো, তখন আমি ছিলাম। তালপট্টির পশ্চিম দিকে নদী ও সাগর আছে। সেটা আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। এসব বিষয় নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি। ১৫ বছর আগে পত্রিকায় লিখেছি। তবে দুঃখের বিষয়, নীতিনির্ধারণী মহল থেকে কোনো সাড়া পাইনি। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে জানি ১৩০ মাইলের বেশি সাগর আমরা পাচ্ছি না। এমন নয় যে সমস্যাটি আজকে সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তখন থেকেই নীতিনির্ধারণী মহল জানত যে ১৩০ মাইলের বেশি সমুদ্রসীমা আমরা পাব না। তখন থেকে বিষয়টি কারও কাছে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু আমি লিখেছি। ১০ বছর আগে প্রথম আলোয় লিখেছি। আমি চেয়েছিলাম দেশের মানুষ জানুক। কারণ, তারা জানলে নীতিনির্ধারণী মহলের ওপর চাপ তৈরি করবে।
আমরা আদালতে কী বক্তব্য দিয়েছি, তা স্পষ্টভাবে বলতে চাই। আমাদের বক্তব্য, মিয়ানমারের বক্তব্য ও ১৪ তারিখে সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক রায়—সবই ওয়েবসাইটে আছে। আপনারা যেকোনো বিষয় জানতে চাইলে ওয়েবসাইট দেখুন। আমাকেও প্রশ্ন করতে পারেন। জয় যেটি এসেছে, সেটি দেশের জয়, সবার জয়। সংবাদের হেডলাইন করার জন্য এমন কোনো বক্তব্য দেবেন না, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কারণ, এ দেশের মানুষ সমুদ্র এবং এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে তারা জানে না। জানার তেমন কোনো সুযোগও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র নিয়ে আমি একটি সেমিনার করেছি। তারা স্বীকার করেছে এ বিষয় নিয়ে তাদের খুব বেশি জানা নেই।
এ বিষয়ের ওপর তাদের কোনো পাঠক্রমও নেই। জাতিগতভাবে আমাদের এই সীমাবদ্ধতা আছে। সমুদ্র-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আমার কাছে আছে। ওয়েবসাইটে আছে। রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিতর্ক আছে। এসব যুক্তিতর্কের সব উত্তর আমাদের কাছে আছে। আপনারা যেকোনো জায়গা থেকে জেনে নিতে পারেন। কিন্তু অনুরোধ করব, না জেনে, না বুঝে এমন কোনো মন্তব্য করবেন না, যাতে জাতি বিভ্রান্ত হয়। এত বড় অর্জন ম্লান হয়ে যায়।
কৌশলগত কারণে আমরা আদালতের কাছে সমুদ্রসীমা কিছুটা বেশি চেয়েছি। সবটা টিকবে না জেনেও অধিক তথ্য-উপাত্ত আমরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছি। আমরা চেয়েছি আমাদের ন্যায্যটা যেন ঠিক থাকে। ১৯৭৪ সালে জলসীমা-বিষয়ক একটি আইন সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে দেশবাসী জানে না। এই আইনের মাধ্যমে আমরা ১২ মাইল সমুদ্র জলসীমা চেয়েছিলাম। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের মতৈক্য হয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও মিয়ানমার সমুদ্রসীমা থেকে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু এটা ছিল একটি সম্মত কার্যবিবরণী। ১৯৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত এই সম্মত কার্যবিবরণীকে চুক্তিতে পরিণত করা হয়নি। কেন করা হয়নি তার উত্তর আমাদের কাছে নেই। যদি করা হতো, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দুই দেশ এটা মানতে বাধ্য হতো। তাহলে আজ আর বিষয়টি এত জটিল হতো না।
১৯৮২ সালের ১০ ডিসেম্বর বর্তমান আইন স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরের পর আর অনুস্বাক্ষর করা হয়নি। ২০০১ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের শেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে ১২ জুলাই অনুস্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয়। অনুস্বাক্ষর এই জন্য জরুরি যে, ২০০ মাইলের বাইরে আমরা মহীসোপান দাবি করতে চাই। ২০০ মাইলের বেশি দাবি করতে চাইলে, অনুস্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জাতিসংঘের কাছে দাবি উপস্থাপন করতে হয়। দাবি উপস্থাপনের শেষ সময় ছিল ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট। বিশেষ দুটি জরিপ ছাড়া এই দাবি উপস্থাপন করা সম্ভব ছিল না। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম আমি জরিপ করার জন্য চেষ্টা করি। সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত আমরা বলি, জরিপ ছাড়া দাবি উপস্থাপন করলে এ থেকে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। তিন হাজার কিলোমিটার জরিপ করার জন্য সরকার আমাদের ৮০ কোটি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা ২৫ কোটি টাকা দিয়ে জরিপটি শেষ করেছি। আইনে আছে বেজ লাইন থেকে ৩৫০ কিলেমিটার পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু আমাদের বেজ লাইনে সমস্যা থাকায় অন্য একটি পদ্ধতিতে আরও বেশি দাবি করি। সেটি হলো, সমুদ্রের দুই হাজার ৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু এটি করার জন্য আমাদের জরিপ করার জাহাজ ছিল না। ১৯৮০ সাল থেকে সব রকম চেষ্টা করার পরও নৌবাহিনীর সঙ্গে একটি জরিপ-জাহাজ যুক্ত করা যায়নি। অবশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি জরিপ-জাহাজ কেনার অনুমতি দেন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাহাজটি বাংলাদেশে আসে। অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুই হাজার ৫০০ মিটার জরিপ করা হয়। এ জন্য আমাদের আরও ১০০ কিলোমিটার বেশি দাবি করার সুযোগ তৈরি হয়।
তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৮০ থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থাৎ ২৫০ মাইলের বেশি আমরা মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করি। অথচ মিয়ানমার পুরো অঞ্চল দাবি করে নথিপত্র জমা দিয়েছে ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং ভারত জমা দেয় ২০০৯ সালের ১১ মে। ২০১০ সালে যদি আমরা এ কাজটি না করতে পারতাম, তাহলে আমাদের আজকের এই অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। ২০০৯ সালে ভারত মিয়ানমারের জন্য মহীসোপানের কিছু অংশ রাখে, বাংলাদেশের জন্য কোনো অংশ না রেখে পুরো মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করে।
এখন ব্লক নিয়ে কথা হচ্ছে। নৌসীমা ঠিক না করে ২০০৫ সালে ব্লক করা হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। আমরা কেন আদালতে গেলাম? ভারত ও মিয়ানমার আমাদের বলল, প্রকৃতিগতভাবে তোমরা যে অংশ পেয়েছ, এর বেশি তোমরা পাবে না। কারণ, প্রকৃতির ওপর আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। অর্থাৎ সমদূরত্বের ভিত্তিতে তোমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে।
আমরা ভারত ও মিয়ানমারের যুক্তি গ্রহণ করি নাই। আদালতে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যাখ্যা করি। এবং আদালতকে বোঝাতে চেষ্টা করি, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ তার ন্যায্যতা হারাবে। আমরা অবতলতার (কনকেভিটি) ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির কথা বলি। এবং এভাবে যেসব দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে তাদের রায় সমনে নিয়ে আসি। জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কের অবস্থান ঠিক আমাদের মতো।
এ ক্ষেত্রে আমরা বলি, ১৯৬৭ সালে জার্মান আমাদের যুক্তির পক্ষে রায় পেয়ে থাকলে ২০১২ সালে এসে আমরা কেন পাব না? শুধু জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক নয়, আমরা গিনি, গিনি বিসাও, শারজাহ, মোনাকো, ব্রুনাইসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিই। এ দেশগুলো আমাদের যুক্তির পক্ষে রায় পেয়েছে। কারণ, তাদের অবস্থান আমাদের মতো ছিল। তাহলে আমরা কেন পাব না? অন্যদিকে মিয়ানমারের আইনজীবীরাও তাঁদের পক্ষে অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। বিশ্বের ২১ জন বিশেষজ্ঞ বিচারক আমাদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, অনেক বিচার-বিবেচনা করে এই রায় দিয়েছেন। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক রায় আছে। আমি বলব, সেগুলো আপনারা পড়ুন এবং বুঝুন। তারপর আমাদের রায় নিয়ে মন্তব্য করুন। কোনো কিছু না জেনে, না বুঝে ধারণাপ্রসূত বিরূপ মন্তব্য করলে ওই সব বিচারককে অসম্মান করা হবে। কারণ, তাঁদের জন্য আমাদের এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে।
আমরা ১৩০ মাইলের বাইরে আরও ২০০ মাইল গভীর সমুদ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের ২০০ মাইল গভীর সমুদ্রে যেতে হলে মিয়ানমারের ইইজেড পার হয়ে যেতে হয়। এক দেশের ইইজেড অতিক্রম করে অন্য দেশের গভীর সমুদ্রে যাওয়ার নজির বিশ্বে একটিও নেই। ২০০ মাইল মহীসোপানের আমাদের দাবি আদালত এখানেই বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আদালত সেটা করেননি। কেন যেন সবকিছু আমাদের পক্ষে ছিল। মিয়ানমারের আইনজীবীরা আরও একটি শক্ত যুক্তি উপস্থাপন করলেন। তাঁরা বললেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘে সমুদ্রসীমার দাবি তুলেছে। সে দাবিতে তারা মহীসোপানের কথা বলেনি। তাহলে কেন এখন তাদের মহীসোপানের দাবি গ্রহণ করা হবে। আমাদের ১৩০ মাইল নৌসীমা নির্ধারণ হয়ে গেছে। ধারা ৭৬-৭৮-এ বলা আছে, একবার নৌসীমা নির্ধারণের পর আর কোনো দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত কোনো আদালত মহীসোপানের বিভাজন করেননি। কানাডা ও ফ্রান্সের একটি মামলায় মহীসোপানের দাবি আদালত গ্রহণ করেননি।
এত কিছুর পরও আমরা আমাদের দাবির পক্ষে অনড় থাকি। এ ক্ষেত্রে আদালতকে আমরা রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার প্রসঙ্গ টেনে বলি, মহামান্য আদালত, বিধাতার সময়ের কোনো শেষ নেই। তার হাতে সময় অনন্ত। তার কাছে রাত-দিন বলে কিছু নেই। কিন্তু মানুষের সময় সংক্ষিপ্ত। তার রাত-দিন হয়, তার মৃত্যু হয়। মহামান্য আদালত, আপনারা যদি আমাদের সমাধান না দেন, তাহলে আমরা কার কাছে যাব? কে আমাদের কথা শুনবে? কে আমাদের সমাধান দেবে? আপনারা সমাধান না দিলে তিন দেশের মধ্যে জীবনভর বিরোধ থেকে যাবে। তখন আদালত আমাদের যুক্তিকে যুক্তিযুক্ত মনে করে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেন। সবশেষে আমি দেশের মানুষকে বলব, সমুদ্রসীমা জয় নিয়ে কোনো অপব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাব।
মতিউর রহমান
আমরা খুরশেদ আলমের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়, রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক এবং সমুদ্রবিষয়ক অনেক তথ্য জানলাম। এবার শুনব এম এইচ খানের কাছ থেকে।
এম এইচ খান
প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে মতৈক্য হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কেন এত দিন পড়েছিল? পড়ে থাকার কারণ হলো, সরকারের এ বিষয়ে কোনো ভাবনা ছিল না, সদিচ্ছা ছিল না। বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার একসঙ্গে সমন্বয় না ঘটলে কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। আমি বলব, রাজনৈতিক উদাসীনতার কারণে এত দেরি হয়েছে। অনেকে মনে করে এটা নৌবাহিনীর দায়িত্ব। কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে, নৌবাহিনী হচ্ছে সরকারের একটি অংশ। তারা পরামর্শ দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী সিদ্ধান্ত আসতে হবে সরকারের কাছ থেকে।
আজকে যে জরিপ-জাহাজের কথা বলা হচ্ছে, আমি নিশ্চিত, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৬ সালে এই জাহাজ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হতো। তাঁর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। জরিপ ছাড়া সমুদ্রবিষয়ক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। নৌবাহিনীর জন্য এ জাহাজটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও আমি ব্যর্থ হই। ১৯৭৬ সালে জরিপ-জাহাজ থাকলে আজকে বাংলাদেশের জন্য সমুদ্রসীমার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত। বাংলাদেশের মানুষ অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। আমার খুব অবাক লাগে, সমুদ্র নামের এত বড় একটি সম্পদ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ক্রিকেটে জয়লাভের পর জনসাধারণের উচ্ছ্বাস দেখে অভিভূত হয়েছি। কিন্তু সমুদ্র নিয়ে এত বড় একটা অর্জন হওয়ার পরও তাদের খুব বেশি সাড়া দেখলাম না। ওশানোগ্রাফি ও ম্যানেজমেন্ট অব দ্য সি নামে সমুদ্র-বিষয়ক দুটো বিশেষ বিষয় আছে। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়ানো হয় না। এত কিছুর পরও আন্তর্জাতিক আদালতের রায় আমাদের পক্ষে গেছে। আমি মনে করি এটি একটি বড় প্রাপ্তি। এখন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সীমা বুঝে নিতে হবে। বন্ধু বন্ধু করে কোনো লাভ নেই। কেউ কারও বন্ধু নয়। নিজেই নিজের বন্ধু। এটি কোনো আবেগতাড়িত বিষয় নয়। তাই এ ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের অধিকার আমাদের বুঝে নিতে হবে।
মতিউর রহমান
এম এইচ খানের আলোচনার মাধ্যমে জানা গেল, ১৯৭৪ সাল থেকে প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত উদ্যোগের অভাব লক্ষ করা গেছে। ফলে এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এখন এ বিষয়ের ওপর বলবেন হাবিবুর রহমান।
হাবিবুর রহমান
সাধারণভাবে এ বিষয়টি মানুষ কম জানে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার সময় অনেক পরিভাষাগত শব্দ ব্যবহার করা হয়। ফলে এ বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়। বিষয়টিকে আরও সহজভাবে কী করে জনসাধারণের মধ্যে আনা যায়, সেটি ভাবতে হবে। উপকূল থেকে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন এবং মহীসোপানসহ মোট ৪৬০ মাইল পর্যন্ত আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০ মাইল পর্যন্ত আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ জায়গাটি আমরা আমাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারব। অবশিষ্ট ২৬০ মাইল ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক বিধিবিধান রয়েছে। এই ২৬০ মাইল মহীসোপান আমরা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করতে পারব না। ধারা ৮২-তে বলা আছে, মহীসোপান ব্যবহার করতে হলে একটি অংশ দিতে হবে। এখান থেকে যে সম্পদ আহরিত হবে, আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষকে পাঁচ বছর করে ১২ বছর যাবৎ কিছু কিছু দিতে হবে। ১২ বছর পর ৭ শতাংশ হারে নিয়মিতভাবে দিতে হবে। আমি মনে করি, এই রায়ের ফলে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই রায়ের পর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার কোনো দেশই একচেটিয়াভাবে বঙ্গোপসাগরের কোনো অংশ দাবি করতে পারবে না। নেদারল্যান্ডসের দি হেগে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে এ বিষয়টি উঠবে। ভারতের হাইকমিশনার আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
বদরুল ইমাম
সমুদ্র বিষয়ে বিভাগ খুলতে কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে?
মো. খুরশেদ আলম
ওশানোগ্রাফি বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে এ বিষয়টি পড়ানোর জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়াতে রাজি হয়েছে। সিনেটের অনুমোদন পেলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওশানোগ্রাফি বিষয়টি পড়ানো হবে। ওশানোগ্রাফি পড়াটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সাগরে শুধু তেল-গ্যাস ও মাছ ছাড়া অনেক সম্পদ আছে, যা আমাদের দেশের মানুষ জানে না। যেমন—সালফাইট, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি মূল্যবান সম্পদ সাগরে পাওয়া যেতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম
হাবিবুর রহমানের আলোচনা থেকে গভীর সমুদ্র ব্যবহারের কিছু আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের বিষয় জানতে পারলাম। এখন বলবেন জিয়াউদ্দিন আহমদ।
এ এ জিয়াউদ্দিন আহমদ
এই রায়ের ফলে ৩৮ বছরের ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হলো। ফলে আমাদের সম্ভাবনা ও করণীয় জায়গাটি আরও অনেক বেশি বিস্তৃত হলো। আমাদের বিশাল সমুদ্রসৈকত রয়েছে। এর আয়তন আরও বৃদ্ধি পাবে। তেল-গ্যাসসহ সমুদ্রের বিভিন্ন সম্পদ আহরণ, সমুদ্রসৈকতসহ সমুদ্রের নানা ধরনের জরিপকাজের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলা নিজস্ব উদ্যোগে খুব কম সময়ে ও কম ব্যয়ে সফলভাবে গ্যাস উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করতে হবে এবং পেট্রোবাংলাকে ঢেলে সাজাতে হবে; যাতে পেট্রোবাংলা সব ধরনের কাজ করতে সক্ষম হয়। আমরা সাগরের এত কাছে থেকেও এর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। আমাদের নোয়ামিতে (ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট) সামুদ্রিক বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। আমাদের দেশে এখনো ওশানোগ্রাফি পড়ানো হয় না। অথচ কুয়েতের মতো দেশ এ বিষয়ে আমাদের থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সেখানে ওশানোগ্রাফির জন্য অনেক বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভারতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে অনেক বছর আগে থেকে পড়ানো হচ্ছে। আর আমরা? আমরা এখনো পড়ানোর বিষয়টি চিন্তাভাবনা করছি।
আমাদের এখানে জিওগ্রাফিক্যাল, ফিজিক্যাল, বায়োলজিক্যাল ও কেমিক্যাল ওশানোগ্রাফি, ওসান ইঞ্জিনিয়ারিং, ল অব দ্য সি, মেরিন পলিউশন ইত্যাদি বিষয় তিন মাসের একটি কোর্সের মধ্যে দেওয়া হয়েছে। ওশানোগ্রাফির ওপর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা উচ্চতর ডিগ্রি চালু করার চেষ্টা করছি। আমরা যদি এ বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে না পারি, তাহলে এত বড় অর্জন আমাদের কোনো কাজে আসবে না। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের ওশানোগ্রাফি ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। নৌশক্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি করতে হবে।
এম. শাহ আলম
কোনো কোনো পত্রিকা পড়ে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। সমুদ্রজয় সম্পর্কে তারা কী বলতে চাইছে, আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনেকে এ বিজয়কে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। আবার অনেকে বলার চেষ্টা করেছে, আমরা তাহলে ব্লক হারালাম কি না। আমাদের মূল বিষয় ছিল কোন পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে। সেদিক থেকে আমরা একটি সঠিক দিক নির্দেশনা পেয়েছি। বলা যেতে পারে, এত দিন যা আশা করেছিলাম, তেমনই পেয়েছি। এখন ব্লকসহ যাবতীয় বিষয় ঠিক করে নিতে হবে। আমি মনে করি, ওয়েবসাইটসহ নানা উৎস থেকে এ বিষয়ে আমাদের আরও অনেক জানতে হবে।
মো. খুরশেদ আলম
আমি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি না। সত্যিকার অর্থে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা যদি সঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে আজকের এই অর্জন কোনো দিন সম্ভব হতো না। সরকারে আসার মাত্র চার মাসের মধ্যে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি পাঁচ মাসের মধ্যে সব কাগজপত্র তৈরি করেছি। ভারত ও মিয়ানমার কাউকে জানতে দিইনি। তারা যদি জানত তাহলে এই আদালত থেকে নিজেদের আগেই সরিয়ে নিত। চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশই এভাবে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।
একবার সরিয়ে নিলে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আমাদের আর কোনো দিন আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকত না। আমরা গোপনীয়তা, বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ, দিনের পর দিন অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ কাজটি করেছি। কোথাও একটু ভুল হলে সব শেষ হয়ে যেত।
বদরুল ইমাম
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে দেওয়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা রায় বাংলাদেশের পক্ষে গেছে। এর জন্য বাংলাদেশ সরকারি প্রশাসন কৃতিত্বের দাবিদার, বিশেষ করে যে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ দল যথার্থ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের দাবিটি উপস্থাপন করেছে, তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। রায়ের বিষয়বস্তু যথেষ্ট কারিগরি। তাই অনেকের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব থাকতে পারে। আজকের বিশেষ আলোচক খুরশেদ আলম তাঁর সচিত্র বক্তব্যে সুস্পষ্ট করে রায়ের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেছেন। সে জন্য আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। দেশের গ্যাস সম্পদ বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহের কারণে আমি সেই পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্র-রায়ের বিষয়টির ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী সমদূরত্বের নীতির (যা কিনা মিয়ানমার চেয়েছিল) পরিবর্তে ন্যায়পরায়ণতার নীতি অবলম্বন করাতে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে সমুদ্রসীমাটি ২১৫ ডিগ্রি লাইন বরাবর টানা হয়েছে, তা বাংলাদেশের প্রস্তাবিত লাইনের অনুরূপ, তবে তা কিছুটা পশ্চিমে এনে টানা হয়। ফলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লকগুলোর চারটি সম্পূর্ণভাবে এবং চারটি আংশিকভাবে মিয়ানমারের পক্ষে চলে যাবে। আপাতদৃষ্টিতে দেশের সাগরবক্ষে গ্যাস ব্লক হারানো বলে মনে হলেও আজকের আলোচনা থেকে এটি বোঝা গেল যে ওই সব গ্যাস ব্লকের ওপর বাংলাদেশের দাবি অযৌক্তিক ছিল বলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নির্ধারণ করে।
তাই এটি প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ ইতিপূর্বে তার গভীর সমুদ্রসীমা নির্ধারণে দেশের সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়নি। পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ওই সব সমুদ্র ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাতে মিয়ানমার আপত্তি তোলে। বর্তমানে বাংলাদেশকে নতুন করে তার সমুদ্র ব্লকগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এটি কেবল পূর্বে মিয়ানমারের জন্যই নয়, পশ্চিমে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র ব্লক নির্ধারণেও এসব বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। তবে এই রায়ের মধ্য দিয়ে সমুদ্র ব্লকগুলো নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের অবসান হয়েছে বিধায় এখন বাংলাদেশ তার নিষ্কণ্টক সমুদ্র অঞ্চলে পুরোদমে গ্যাস অনুসন্ধান করবে বলে আমরা আশা করি।
আনু মুহাম্মদ
২০০৮ সালে এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের বাইরে একধরনের উদ্যোগ ছিল। ওই সময় আমরা জানতে পারি, ভারত ও মিয়ানমার তাদের নথিপত্র জমা দিয়েছে। বাংলাদেশের সময় ছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত। এ বিষয়ে সরকারের কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই। কোনো ধরনের জরিপ নেই। ওই সময় আমরা খুব শঙ্কা বোধ করি। বিষয়টির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ যিনি, তিনি ছিলেন খুরশেদ আলম। শেষ পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ের ওপর একটি সাফল্য আমাদের এনে দিয়েছেন। আজকের এই দিনে তাঁকে আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই। ২০০৮ সালে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য জনমত গঠন করা হয়। এ বিষয়ের ওপর একটি কমিটি গঠন করা হয়। খুরশেদ আলম ছিলেন এ কমিটির সদস্যসচিব। ওই সময় আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। আমরা আনন্দিত যে ২০১১ সালে ভয়াবহ বিপর্যয় হয়নি। যেটা হতে পারত।
আরেক দিক থেকে এ বিজয় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ওপর নির্ভর করবে ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে কীভাবে নিষ্পত্তি হবে। মিয়ানমারের তুলনায় ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা আরও কঠিন। ভারতের হাইকমিশনার যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কথা বলেছেন, সেখানে আমি শঙ্কিত। কারণ, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অভিজ্ঞতা আমাদের মোটেই ভালো নয়। তবে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আমরা যে রায় পেয়েছি, সেটি একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এ ধরনের মামলার জন্য যে ধরনের কাগজপত্র তৈরি করা দরকার, মিয়ানমারের সঙ্গে মামলা করতে গিয়ে তার প্রায় সবই আমাদের প্রস্তুত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের বক্তব্যও একটি শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আইনি ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনোভাবে ভারতের সঙ্গে সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে আরেকটি দিক প্রমাণিত, বাংলাদেশের মানুষ যদি সুযোগ পায় তাহলে তারা সবকিছু পারে। তার একটি বড় উদাহরণ খুরশেদ আলম। ২০০৮ সালে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সমুদ্র জরিপ করা সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশের মানুষই অতি অল্প খরচে, অল্প সময়ে এ কাজ করেছে। আমাদের যে জাতীয় হীনম্মন্যতা আছে, যেমন—বিদেশি সাহায্য, বিদেশি নির্ভরতা, বিশ্বব্যাংক কী বলে, ইত্যাদি। এ রায় এই সবকিছুর বিরুদ্ধে বিজয়। সম্ভাবনার মধ্যে একটি হলো, এর মাধ্যমে আমাদের একটি আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ শুধু নদীমাতৃক দেশ নয়, সমুদ্রমাতৃকও। সেদিক থেকে সমুদ্র যতটুকু গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল, তা পায়নি। আমি মনে করি, এখন এই রায়ের ফলে সমুদ্র জনসাধারণের কাছে ভিন্নমাত্রা পাবে।
আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে, সমুদ্রে যে সম্পদ আছে, এর ওপর জনগণের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা। এই দুটো সম্ভাবনা নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী, পাশাপাশি আতঙ্কিত। উদ্বেগের কারণ, দেশে ও বিদেশের অভিজ্ঞতা হলো, সম্পদ পেলেই জনগণ সেই সম্পদের ব্যবহার করতে পারবে তা নয়, সম্পদ পেলেই তার ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়। কারণ, রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সমুদ্রে তেল-গ্যাস ইজারা দেওয়ায় আর কোনো বাধা রইল না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক তেল কোম্পানি কনোকোফিলিপস যে চুক্তির ভিত্তিতে আমাদের সমুদ্রের গ্যাসক্ষেত্র ইজারা নিয়েছে, তাতে এ দেশের জনগণের কোনো লাভ হবে না। লাভ হবে কনোকোফিলিপসের। এ ধরনের ইজারা নেওয়ার জন্য অনেক কোম্পানি অপেক্ষা করছে। আমরা যে সুযোগ পেলে সব ধরনের কাজ করতে পারি, এই বিশ্বাসটুকু আমাদের নীতিনির্ধারণী মহলে নেই। এটিও আতঙ্কের একটি বড় কারণ। অথচ সমুদ্রে যে সম্পদ আছে, তার ওপর যদি জনসাধারণের সঠিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে কয়েকটি প্রজন্ম সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে চলতে পারবে। এখন এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের জাতীয় সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। নৌশক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। সমুদ্রের ওপর গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।
বর্তমানে আমাদের যে পরিমাণ সমুদ্রসীমা আছে এবং ভারতের কাছ থেকে পাওয়ার পর আরও যে পরিমাণ হবে, তা কাজে লাগানোর মতো প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ আমাদের নেই। এ জন্য পেট্রোবাংলাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিদেশে আমাদের অনেক দক্ষ মানবসম্পদ আছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের মানবসম্পদ থেকে আমাদের মানবসম্পদ অনেক বেশি দক্ষ ও যোগ্য। তারা অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেক ভালো মানের কাজ করে। তাই যেকোনো সস্তা অজুহাত দেখিয়ে যেন দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া না হয়, সেদিকটি আমাদের ভাবতে হবে। আরও একটি আতঙ্কের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তারা আমাদের জঙ্গিবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। এ জন্য বঙ্গোপসাগরে তাদের ঘাঁটি তৈরি করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর যেখানেই গেছে, সেখানে হত্যা, লুটপাট, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছু আসেনি। এ ক্ষেত্রে এখন আমাদের প্রধান করণীয় হলো সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব রাখা। দীর্ঘমেয়াদে কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
এম এইচ খান
একটি বিষয় আমি জোর দিয়েবলতে চাই, আমাদের দেশের সমুদ্রবিষয়ক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক গুণবাড়াতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নতি না হলে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব না। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে সমুদ্রের ওপর ব্যাপক গবেষণা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনই ওশানোগ্রাফি, ওশানো ইঞ্জিনিয়ারিং, ল অব দ্য সি ইত্যাদি বিষয় চালু করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
এম এইচ খান
রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.), নৌবাহিনীর
সাবেক প্রধান (১৯৭৩-১৯৭৯)
মো. খুরশেদ আলম
রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.),
অতিরিক্ত সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এ এ জিয়াউদ্দিন আহমদ
চেয়ারম্যান, নোয়ামি (ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট)
ও অধ্যাপক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
হাবিবুর রহমান
অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আনু মুহাম্মদ
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এম. শাহ আলম
চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), আইন কমিশন
বদরুল ইমাম
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সঞ্চালক
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
আব্দুল কাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
No comments