টঙ্গীর তাবলিগি বিশ্ব ইজতেমা by জুলফিকার আহমদ কিসমতী
টঙ্গীতে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত তাবলিগি জামায়াতের বিশ্ব ইজতেমায় এবারও লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটছে। তীব্র শীত ও অন্য সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেই আল্লাহ প্রেমিকরা এই মহতী সমাবেশে যোগ দেন। ইজতেমার আখেরি মোনাজাত ২৪ জানুয়ারি রোববার।
এই দোয়া মোনাজাতে ও বিশাল নামাজের জামাতে শরিক হওয়ার জন্য ওইদিন টঙ্গীতে মানুষের ঢল নামে। এই মোনাজাত শেষে নতুন জামাত তৈরি ও দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য শত শত দল দেশ-বিদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। এসব দলে সব বয়সী লোকই থাকে। ছাত্র, শ্রমিক, চাষী, চাকরিজীবী, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ওলামা, তালাবা বিভিন্ন পেশার লোক। এমনকি সেসব বয়োবৃদ্ধ লোক যাদের হয়তো এ বয়সে বাড়ি-ঘরেই থাকা এবং নিজের আপনজনদের সেবা-খেদমত নেয়া প্রয়োজন, তারাও দ্বীনের মহব্বতে ও নিজেদের পরকালীন মুক্তির আশায় এসব দলে থাকেন এবং বিভিন্ন জামাতের সঙ্গে বের হয়ে পড়েন। জামাতের রাত-দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী নিজেদের নামাজ-কালামে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, জামাতের আমির ও আলেমগণ সঙ্গী-সাথীদের তালিমের দ্বারা সেগুলো সংশোধন করে দেন। তাবলিগি জামাতের দ্বারা অনেক ধর্মবিমুখ লোক যেমন ধর্মমুখী হন এবং অনেক লোক নিজেদের আমলের মানকে আরও বৃদ্ধি করার প্রেরণা পান, তেমনি সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে আরও দশটি মানুষকে দ্বীন ও শরীয়তের দিকে টেনে আনার এক পবিত্র প্রেরণার উদ্রেক হয়। বলাবাহুল্য, দ্বীন শেখার এই প্রেরণাই হচ্ছে মুসলিম জীবনের বড় ইমানী সম্পদ এবং ইসলামের বাণীকে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, সমাজ থেকে সমাজে এবং দেশ থেকে দেশান্তরে পৌঁছে দেয়ার আসল চালিকাশক্তি। তাবলিগি জামাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যই হলো, অর্থনৈতিক কোনো আকর্ষণ এই জামাতে রাখা হয়নি। নিছক আল্লাহ-রাসুলের মহব্বতেই নিজ পকেটের অর্থ ব্যয় করে এ কাজে আসতে যারা সম্মত, তারাই কেবল এখানে এসে থাকেন।
কোনো মহত্ আদর্শকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আদর্শিক কাজের সঙ্গে জড়িতদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ত্যাগ ও নিঃস্বার্থতা। তাবলিগি জামাতের প্রতি দেশ-বিদেশে অগনিত মানুষের আগ্রহ-আকর্ষণের পেছনে এই গুণাবলীগুলো বিশেষভাবে কাজ করছে। পেটের ধান্ধায় আজকের দিনের সদাব্যস্ত মানুষদের মধ্যে প্রায় দুর্লভ এসব গুণ সৃষ্টি করা কিংবা সৃষ্টি হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। তাবলিগি জামায়াতের নেতৃত্ব বৈষয়িক স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিরস ও শুষ্ক। তারপরও দেশ-বিদেশের অগনিত মানুষকে এর প্রতি পিপাসু করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। এই ফিতনার যুগেও এর প্রতি মহান দ্বীনী প্রচারের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোক্তাদের এটি যে একটি উজ্জ্বল অবদান, নিঃসন্দেহে তা স্বীকার করতে হবে। তাবলীগ একজন মানুষের মধ্যে দ্বীনি কাজের প্রেরণা এবং অপর মানুষকে দ্বীনের দিকে নিয়ে আসার জন্য যেই চারিত্রিক গুণাবলী সৃষ্টি করে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং সাহাবা-এ-কিরামের আদর্শে আজকের শোষিত-বঞ্চিত মানব সমাজে দ্বীনি পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নিপীড়ন দূর করে একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে এসব গুণের জুড়ি মেলে না। কিন্তু এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সমাজের যে পরিমাণ মানুষের মধ্যে উল্লিখিত গুণাবলী সৃষ্টি করে একটি দেশ ও সমাজকে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ও পূর্ণ ইসলামী সমাজ রূপে গড়ে তোলা যায়, এখনও সেই পরিমাণ লোক তৈরি হয়নি বলেই হয়তো মুসলিম বিশ্বে কাঙ্ক্ষিত সেই সমাজ ও শোষণমুক্ত ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না অথবা লোক তৈরি হলেও দ্বীনের দাবির ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিগত কোনো পার্থক্যের কারণে সেটি হচ্ছে না। বলতে কি, সেটি না হওয়ায় ইসলামী খিলাফত বা ইসলামী হুকুমতের অভাবেই জীবনের সব স্তরে, সমাজের সব বিভাগে বেদ্বীনি শক্তির অপতত্পরতা প্রাধান্য পায়। ফলে মানব কল্যাণে আমাদের এ জাতীয় সব বিরাট দ্বীনি কর্মতত্পরতা ওই লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছত ব্যর্থ অবস্থায়, অথচ এ জন্যই পৃথিবীতে নবী মোস্তফা (সা.)-এর আগমন ঘটেছিল। বলাবাহুল্য, ওই লক্ষ্যটি হলো, কোরআনের ভাষায় ‘এযহার-এ-দ্বীন’ ও ‘ইকামত-এ-দ্বীন’ অর্থাত্ আল্লাহর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা ও ন্যায় বিধানকে মানুষের কল্যাণে মানব রচিত সব বিধি-ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করা, যা সূরা-এ-সাফ এবং অন্যান্য সূরায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। ফলে মুসলিমদের কষ্টোপার্জিত অর্থ আল্লাহর দ্বীনের কাজের বদলে এবং মুসলমানদের বাঁচার অধিকার ও তাদের জীবনমান উন্নতকরণের কাজে ব্যয়িত না হয়ে সমাজের একশ্রেণীর চরিত্রহীন নেতৃত্বের ভোগবিলাসে ব্যয়িত হচ্ছে, অপচয় হয়ে যাচ্ছে তাদের স্বেচ্ছাচারী অন্য শয়তানি প্রবণতা ও অপর মুসলিম ভাইয়ের অধিকার হরণের হিংস্রতাপূর্ণ যুদ্ধে।
তাবলিগ বা দ্বীনি দাওয়াতের দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর একাধিক আয়াত ও একাধিক হাদিসের দ্বারা অর্পিত। তার মধ্যে বিখ্যাত আয়াতটি হলো—‘তা’মুরুনা বিল মারুফে ওয়াতানহাওনা আনিল মুনকার’—‘তোমরা কল্যাণের দিকে মানুষকে নির্দেশ করবে আর মন্দ ও গর্হিত কাজ থেকে তাদের বিরত রাখবে।’
বস্তুত : এ আয়াত এবং এ জাতীয় আরও যেসব আয়াত ও মহানবীর (সা.) হাদিসের নির্দেশের ভিত্তিতে যুগে যুগে মুসলমানেরা তাবলিগ বা ইসলামী দাওয়াতের কাজ করেছেন, পালন করেছেন দ্বীন প্রচার ও বিশ্বময় ইসলাম বিস্তারের দায়িত্ব, তারা দ্বীনকে খণ্ডিতভাবে না দেখে একে পরিপূর্ণ আকারেই দেখেছেন এবং পরিপূর্ণভাবেই বিশ্বের মানুষের সমনে তুলে ধরে মানব সমাজে এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। ইসলামকে খণ্ডিতভাবে যারা দেখেছিল, তাদের উদ্দেশে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কি আমার বিধান গ্রন্থের কিছু অংশ বিশ্বাস কর আর কিছুকে অবিশ্বাস কর?’ আল্লাহ অন্যত্র আরও বলেছেন, ‘তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ কর।’ আরও ইরশাদ হয়েছে,—মাইয়াবতাগী গায়রাল ইসলামে দ্বীনান ফালাই ইউকবাল—‘যারা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর অনুসন্ধান করে, তা কখনও গ্রহণ করা হবে না।’ সেই হিসেবে বোঝা যায়, দ্বীনের কিছু হুকুম-আহকামের তাবলিগ দ্বারা এ সংক্রান্ত দায়িত্ব মুসলমানদের স্কন্ধ থেকে দূর হবে না বরং পুরো কোরআনে যা কিছু হুকুম-আহকাম আছে সবগুলোর তাবলিগ এবং এগুলোর হুকুমেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রতিষ্ঠার তাবলীগ করা কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
সমাজের আল্লাহর দ্বীনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই তাবলিগ-এ-দ্বীন আবশ্যক। এ কাজের ইহজাগতিক ও পরকালীন ‘হাসানা’ বা সুফল পেতে হলে মন্দের প্রচার শক্তির চেয়ে কল্যাণের প্রচারশক্তি আরও শক্তিশালী হওয়া ছাড়া দ্বীনি লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এদিকটিও এ যুগের তাবলিগ-এ-দ্বীনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের বিচার-বিবেচনায় থাকা কর্তব্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটাও মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় শক্তির আসনে যাওয়া ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। কেননা, মানব সমাজকে সুষ্ঠু পথে পরিচালনা, তাদের চিন্তা-চেতনা ও আকিদা বিশ্বাসের পরিবর্তন সাধন এবং সত্ ও মহত্ কাজে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার যে ক’টি বলিষ্ঠ মাধ্যম আছে, তার মধ্যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, জনশিক্ষা, প্রচার মাধ্যম ও শাসন ব্যবস্থা সবেরই নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রণকই থাকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। সেক্ষেত্রে এ তিনটি মস্তবড় মাধ্যমকে যদি উপেক্ষা করে তাবলিগি দায়িত্ব পালন করা হয়, তাহলে সেটি হবে অসম প্রতিযোগিতা। অথচ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা ‘মুনকার-এর শক্তির প্রতি লক্ষ্য রেখে যথাসাধ্য নিজেদের প্রস্তুতি নাও।’ এটা স্পষ্ট কথা যে, মারুফ তথা ভালো ও কল্যাণের প্রচারে গতি যদি ঘণ্টায় দশ মাইল হয় আর সে ক্ষেত্রে ‘মুনকার’ বা মন্দের প্রচারের গতি যদি হয় দশ হাজার মাইল, তখন এই দূরত্ব কী করে অতিক্রম করা যাবে? এই বাস্তবতাটি সামনে থাকলে আমার মনে হয় এ সংক্রান্ত অনেক সমস্যারই শুধু সমাধান হতো না, দ্বীনি তাবলিগের মূল লক্ষ্য অর্জনও বহুলাংশে ত্বরান্বিত হতো।
No comments