প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৯- সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক, অবাস্তব ও পশ্চাদ্মুখী by অধ্যাপক ড. মোঃ শামসুল হক
প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ (ঘধঃরড়হধষরুবফ) করা হবে। সে ক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার আইন ১৯৯২ সালে পাস করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হবে।
উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দারুণভাবে সঙ্কুচিত হবে। প্রতিষ্ঠাতারা (নতুন ও পুরাতন) সবাই নিরুত্সাহিত হবেন। নতুন আইনটি যেভাবে প্রণীত হয়েছে, সেটা বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, একটি সংস্থা (ঙত্মধহরুধঃরড়হ) কোন দর্শনের বা যুক্তির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে, সেটা বিবেচনায় আনা হয়নি। বেসরকারি সংস্থাকে অতি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তার কুফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই।
১. সিন্ডিকেটের সভাপতি ভিসি হলে তাকে হয় প্রতিষ্ঠাতাদের আজ্ঞাবহ থাকতে হবে, নতুবা পদে পদে তিনি বাধাগ্রস্ত হবেন। যদি ৪ বছর থাকেনও এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু থাকে তবে মেয়াদান্তে নতুন ভিসি যিনি হবেন তাকে ওইরকম শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার পরিবর্তনের সময় দলীয় ভিসি যেভাবে নিয়োগ দেয়া হয়, সেটারই প্রবর্তন হবে। একজন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে ভিসিকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠাতাদের নির্দেশ মতোই চলতে হবে। ভিসিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া বা নেয়া একটি বাস্তবতাবর্জিত ধারণা। ভিসি থাকবেন একাডেমিক কাউন্সিলের সভাপতি এবং শিক্ষা বিষয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক দায়িত্ব নিতে চাইলে ভিসিকে যোগ্যতার বলেই দেয়া হবে। আইন করে ক্ষমতা দিলে সেটা স্থায়ী হবে না।
২. ভিসিকে সভাপতি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় সম্বন্ধে ভিসির জ্ঞান সীমিত থাকতে পারে। যে কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ঋরহধহপব ঈড়সসরঃঃবব-র সভাপতি থাকেন না। আর্থিক লেনদেন ও তার দায়দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা একজন চাকুরে ভিসির নাও থাকতে পারে। ধরা যাক, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বল্প বা দীর্ঘকালীন অর্থ জোগাড় করতে হবে, সেক্ষেত্রে ভিসির গ্রহণযোগ্যতা একদমই থাকবে না। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পত্তি তিনি বন্ধক দিতে পারবেন না। যদি প্রতিষ্ঠাতাকেই অর্থ জোগাড় করতে হয়, তবে তাদের হাতেই সার্বিক ক্ষমতা থাকতে হবে।
৩. শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা এবং ছাত্রদের বেতন ইউজিসি নির্ধারণ করে দিবে। এটি একটি অবাস্তব প্রস্তাব, যেখানে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো অর্থ যোগান দেয়ার ক্ষমতা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভালো শিক্ষক নিয়োগ করতে হয়। এ জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একই বেতন কাঠামো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে পারে না। ছাত্রদের বেতনের বেলায়ও একই যুক্তি প্রযোজ্য।
৪. প্রস্তাবিত সিন্ডিকেটে ৯ সদস্যের মধ্যে ৭ জন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও একজন সরকার কর্তৃক মনোনীত হবে। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কেবল একজন সদস্য থাকবেন। সংখ্যার নিরিখে এটি একটি অবাস্তব প্রস্তাব। যদি শ’খানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে ৭০০ যোগ্য সদস্য বাছাই করতে হবে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের অবদান কতটুকু থাকবে সেটা অবশ্যই প্রশ্ন সাপেক্ষ।
দলীয় রাজনীতির নতুন ক্ষেত্র কি তৈরি করা হবে? যদি সেটাই হয়, তবে প্রতিষ্ঠাতারা যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারকেই শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করতে হবে। নতুন উদ্যোক্তারা নিরুত্সাহিত হবেন।
৫. স্বল্পকালীন সনদ দেয়ার প্রস্তাব দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো হলেও তাকে চিরস্থায়ী সনদ নিতে চাঁদা বা ঘুষ দিতে হবে। ভালো না করতে পারলেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা কঠিন কাজ। কেননা, শিক্ষার্থী ও স্নাতকদের ভবিষ্যত্ অনেকটাই নির্ভর করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার ওপর। যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিম্নমানের কারণে বন্ধ করা হয়েছিল তার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এদের ছাপানো চিঠির কাগজ ও সনদ নকল করা খুবই সহজ এবং তা হয়েছেও। বিশ্ববিদ্যালয় চালু রেখেই উন্নয়ন করতে হবে। বন্ধ করার চিন্তার পেছনে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব প্রকাশ পায়।
৬. শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের বিষয় প্রস্তাবিত আইনে অপপত্বফরঃধঃরড়হ ঈড়ঁহপরষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ছয়টি জবমরড়হধষ ঈড়ঁহপরষ রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এগুলো এক ধরনের ঘএঙ এবং এরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের দ্বারা তথ্যাদি সংগ্রহ করে এবং বিষয়ভিত্তিক উপদেশ দিয়ে থাকে। ৪-৫ বছর সময় লাগে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেয়ার জন্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো জধঃরহম নির্ধারিত করার ভাবনাকেই তারা বাতুলতা মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কলেজের অধ্যাপকরাও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘড়নবষ পুরস্কার পেয়েছে। অপরদিকে, ঐধত্াধত্ফ টহরাবত্ংরঃু ওই রকম কোনো ঈড়ঁহপরষ-এর ধার ধারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এসোসিয়েশন এ ব্যাপারে এরই মধ্যে একটি ছঅও ঈড়ঁহপরষ গঠনের কাজ প্রায় শেষ করেছে।
সমাপনী বক্তব্য
সর্বশেষ বলা উচিত যে, ১৯৯২ ও ১৯৯৮ সালের সংশোধিত আইন বলবত থাকাই বাঞ্ছনীয়। ওই আইনের বলে ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে এবং ভালোভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। কিছু কিছু খারাপ কাজ হয়েছে যেটা টএঈ বর্তমান আইনেই ব্যবস্থা নিতে পারে। টএঈ-তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুপাতিক প্রতিনিধি সংযুক্ত করতে হবে। পূর্বের আইনটিকে সংশোধনের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করা উচিত। সেক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে।
লেখক : ভিসি, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
No comments