স্মরণ-সেই মহত্তম মানুষটির কথা by আখতার হুসেন
ভাই-বোনসহ মোট ১২ জন পোষ্যের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরের একেবারে শেষাশেষি, কনকনে শীতের এক ভোরে। তখনো কমলাপুর রেলস্টেশন হয়নি। ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ও ওয়েটিং রুমে শুয়ে রাত কাটাই আর দিনের বেলা চাকরির সন্ধান করি।
১৫ দিনের মাথায় ভীরু পদবিক্ষেপে গিয়ে উঠেছিলাম দৈনিক সংবাদ-এর দোতলার সেই কক্ষটিতে, যেখানের একটা ঘরে বসতেন শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, তার পাশের কামরায় বসতেন রণেশ দাশগুপ্ত ও বজলুর রহমান। তখনো আমাদের সত্যেন দা জেল থেকে বের হননি। বেরোবেন বেরোবেন বলে শুনছি। তখন তাঁর উপন্যাস ভোরের বিহঙ্গী মাত্র পড়েছি।
১৯৬৭ সালের শেষাশেষি বিকেলে হঠাৎ করেই আমাদের কবিবন্ধু শশাঙ্ক পাল এসে জানাল, গতকাল তারা পুরান ঢাকায় জেল থেকে সদ্য বেরোনো সত্যেন দাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। একেবারেই ঘরোয়াভাবে। পরের দিন দুপুরের দিকে যথারীতি সংবাদ-এ যেতেই সত্যেন দার সঙ্গে দেখা। রণেশ দার পাশেই তাঁর বসার ব্যবস্থা। সামনে দুটো চেয়ার এবং এক চিলতে একটা টেবিল। বজলু ভাই-ই সত্যেন দার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শুনে সত্যেন দা বললেন, ‘আপনি তো লেখেন। ছড়াও দেখেছি। একটা গল্পও দেখলাম সেদিন। ভালো তো! কথা বলব আমরা।’ প্রথম দিনের আলাপ এ পর্যন্তই। একহারা গড়নের মানুষটির পোশাক-আশাক, গায়ের সাধারণ চাদর এবং কথা বলার ভঙ্গি ভয়ানকভাবে আকর্ষণ করে বসে আমাকে।
ঠিক এই ঘটনার দুই কী তিন দিন পরের কথা। আমরা তখন মেসের জীবন যাপন করছি ৩৬ নারিন্দা লেনে ‘প্রেস শ্রমিকের জারি’র লেখক-গায়ক সাইদুল ইসলামের পরিবারের ভাড়া বাসায় ভাগাভাগি করে। আমার রুমমেট দৈনিক ইত্তেফাক-এ তখন কর্মরত সাব-এডিটর ইয়াহিয়া বখত। তিনিই এসে বললেন সেদিন, ‘আজ বিকেলে সত্যেন দা আসবেন আমাদের রুমে।’ এলেন সত্যেন দা সময়মতোই। তাঁর সঙ্গে এলেন আরও ছয়জন হারমোনিয়াম-তবলা সমেত—উদীচীর বর্তমান সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ, রিজিয়া বেগম (প্রয়াত), বদরুল আহসান খান, আদমজীর গায়ক ও শ্রমিকনেতা খালেক ভাইয়ের কথা আমার এখনো মনে আছে। আমাদের মেসের কামরার মেঝের ওপর শীতলপাটি বিছিয়ে সেদিন যে গানটি শেখানো হয়েছিল, তার রচয়িতা সত্যেন দা। এখনো মনে পড়ে তার প্রথম চরণ: ‘ওরে ওরে বঞ্চিত সবহারা দল’। সুর শিখিয়ে দিচ্ছিলেন সত্যেন দা নিজেই। এভাবেই ৩৬ নারিন্দা লেনের সেই মেসের ছোট কামরায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ভ্রূণের সঞ্চার। বামপন্থার দিকে তখন তরুণ সমাজের আকর্ষিত হওয়ার মূল কারণটা ছিল সত্যেন দা-দের মতো অনুসরণযোগ্য চরিত্রের কিছু ব্যক্তিপুরুষ। কী বিপুল তাঁদের ব্যক্তিগত পঠনপাঠন, ততোধিক সাধারণ জীবনযাপন এবং নিজেদের অর্জিত সেই শিক্ষা ও জীবনাচার অন্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করার মিশনারিসুলভ উদ্দীপনা! আজকের সমাজে এই গুণটিরই ভয়ানক অভাব।
কখনো তাঁকে সহজে রিকশায় চড়ানো যেত না। নারিন্দার মুনীর হোসেন লেন থেকে হেঁটে সংবাদ-এ যাচ্ছেন, সেখান থেকে হেঁটে উদীচীতে আসছেন। উদীচী থেকে বেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ডিন জহুরুল হকের বাসায় যাচ্ছেন বরাবরের মতো হেঁটে। জিনারদী রেলস্টেশন থেকে নেমে রায়পুরার কৃষক সম্মেলনে যাচ্ছেন উদীচীর দলবল নিয়ে। ১০-১২ মাইলের পথ। তাঁকে কোনোমতেই রিকশায় চাপানো গেল না। গান গাইছেন ‘আব কমর বান্দ, তইয়ার হো লাখো কোটি ভাইও’। তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন এখনকার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
কত পরিবারকে যে তিনি সাহায্য করেছেন নিজের সামান্য আয়ের পয়সা বাঁচিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমাদের পুরো পরিবার কুলাউড়ায় আটকা পড়েছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা সিলেটের শাহাজীবাজারে রেললাইন তুলে ফেলেছিল বলে তাদের রেলপথে আনা যাচ্ছিল না। এ কথা বলতেই সত্যেন দা কোথা থেকে কেমন করে আমাকে এক হাজার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট থেকে বিমানে করে আমাদের পুরো পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। কত ঋণ সত্যেন দার কাছে! সেই সত্যেন দা আমাদের পিতৃহীন করে দিয়ে চিরকালের জন্য চলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লিতে। জীবন ও জীবিকার ধান্ধায় আমি তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে। তাঁকে সেখান থেকে চিঠি লিখি। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন বলে একজন লোক রেখে তাকে দিয়ে তাঁর লেখার অনুলিখন করাচ্ছিলেন। আমি যখন চিঠি লিখে জানালাম, ‘সত্যেন দা আপনার টাকার দরকার হলে বলবেন।’ জানাচ্ছেন, ‘হ্যাঁ, প্রতি মাসে এই পরিমাণ টাকা পাঠালে ভালো হয়।’ খুবই সামান্য টাকা। পাঠাই। কিন্তু যখন জানতে পারেন আমি এখানে কঠোর শ্রম করি, অড জবস করি, তখন তিনি সে টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘তুমি আর টাকা পাঠাবে না।’ আমিও নাছোড় ছিলাম। শুনিনি তাঁর কথা।
কথা হয়েছিল ১৯৮১ সালে, আমি তখনকার পশ্চিম জার্মানি থেকে সোজা কলকাতা যাব এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় ফিরব। কিন্তু এর দিন কয়েক পরই খবর পেয়েছিলাম সত্যেন দা আর নেই।
আজ ২৮ মার্চ সত্যেন দার ১০৬তম জন্মবার্ষিকী। ১০৭তম জন্মদিন। আমার মৃত্যুর পর আমি যেন সত্যেন দার কাছে যাই। তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে যেন থাকি।
আখতার হুসেন
১৯৬৭ সালের শেষাশেষি বিকেলে হঠাৎ করেই আমাদের কবিবন্ধু শশাঙ্ক পাল এসে জানাল, গতকাল তারা পুরান ঢাকায় জেল থেকে সদ্য বেরোনো সত্যেন দাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। একেবারেই ঘরোয়াভাবে। পরের দিন দুপুরের দিকে যথারীতি সংবাদ-এ যেতেই সত্যেন দার সঙ্গে দেখা। রণেশ দার পাশেই তাঁর বসার ব্যবস্থা। সামনে দুটো চেয়ার এবং এক চিলতে একটা টেবিল। বজলু ভাই-ই সত্যেন দার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শুনে সত্যেন দা বললেন, ‘আপনি তো লেখেন। ছড়াও দেখেছি। একটা গল্পও দেখলাম সেদিন। ভালো তো! কথা বলব আমরা।’ প্রথম দিনের আলাপ এ পর্যন্তই। একহারা গড়নের মানুষটির পোশাক-আশাক, গায়ের সাধারণ চাদর এবং কথা বলার ভঙ্গি ভয়ানকভাবে আকর্ষণ করে বসে আমাকে।
ঠিক এই ঘটনার দুই কী তিন দিন পরের কথা। আমরা তখন মেসের জীবন যাপন করছি ৩৬ নারিন্দা লেনে ‘প্রেস শ্রমিকের জারি’র লেখক-গায়ক সাইদুল ইসলামের পরিবারের ভাড়া বাসায় ভাগাভাগি করে। আমার রুমমেট দৈনিক ইত্তেফাক-এ তখন কর্মরত সাব-এডিটর ইয়াহিয়া বখত। তিনিই এসে বললেন সেদিন, ‘আজ বিকেলে সত্যেন দা আসবেন আমাদের রুমে।’ এলেন সত্যেন দা সময়মতোই। তাঁর সঙ্গে এলেন আরও ছয়জন হারমোনিয়াম-তবলা সমেত—উদীচীর বর্তমান সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ, রিজিয়া বেগম (প্রয়াত), বদরুল আহসান খান, আদমজীর গায়ক ও শ্রমিকনেতা খালেক ভাইয়ের কথা আমার এখনো মনে আছে। আমাদের মেসের কামরার মেঝের ওপর শীতলপাটি বিছিয়ে সেদিন যে গানটি শেখানো হয়েছিল, তার রচয়িতা সত্যেন দা। এখনো মনে পড়ে তার প্রথম চরণ: ‘ওরে ওরে বঞ্চিত সবহারা দল’। সুর শিখিয়ে দিচ্ছিলেন সত্যেন দা নিজেই। এভাবেই ৩৬ নারিন্দা লেনের সেই মেসের ছোট কামরায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ভ্রূণের সঞ্চার। বামপন্থার দিকে তখন তরুণ সমাজের আকর্ষিত হওয়ার মূল কারণটা ছিল সত্যেন দা-দের মতো অনুসরণযোগ্য চরিত্রের কিছু ব্যক্তিপুরুষ। কী বিপুল তাঁদের ব্যক্তিগত পঠনপাঠন, ততোধিক সাধারণ জীবনযাপন এবং নিজেদের অর্জিত সেই শিক্ষা ও জীবনাচার অন্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করার মিশনারিসুলভ উদ্দীপনা! আজকের সমাজে এই গুণটিরই ভয়ানক অভাব।
কখনো তাঁকে সহজে রিকশায় চড়ানো যেত না। নারিন্দার মুনীর হোসেন লেন থেকে হেঁটে সংবাদ-এ যাচ্ছেন, সেখান থেকে হেঁটে উদীচীতে আসছেন। উদীচী থেকে বেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ডিন জহুরুল হকের বাসায় যাচ্ছেন বরাবরের মতো হেঁটে। জিনারদী রেলস্টেশন থেকে নেমে রায়পুরার কৃষক সম্মেলনে যাচ্ছেন উদীচীর দলবল নিয়ে। ১০-১২ মাইলের পথ। তাঁকে কোনোমতেই রিকশায় চাপানো গেল না। গান গাইছেন ‘আব কমর বান্দ, তইয়ার হো লাখো কোটি ভাইও’। তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন এখনকার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
কত পরিবারকে যে তিনি সাহায্য করেছেন নিজের সামান্য আয়ের পয়সা বাঁচিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমাদের পুরো পরিবার কুলাউড়ায় আটকা পড়েছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা সিলেটের শাহাজীবাজারে রেললাইন তুলে ফেলেছিল বলে তাদের রেলপথে আনা যাচ্ছিল না। এ কথা বলতেই সত্যেন দা কোথা থেকে কেমন করে আমাকে এক হাজার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট থেকে বিমানে করে আমাদের পুরো পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। কত ঋণ সত্যেন দার কাছে! সেই সত্যেন দা আমাদের পিতৃহীন করে দিয়ে চিরকালের জন্য চলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লিতে। জীবন ও জীবিকার ধান্ধায় আমি তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে। তাঁকে সেখান থেকে চিঠি লিখি। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন বলে একজন লোক রেখে তাকে দিয়ে তাঁর লেখার অনুলিখন করাচ্ছিলেন। আমি যখন চিঠি লিখে জানালাম, ‘সত্যেন দা আপনার টাকার দরকার হলে বলবেন।’ জানাচ্ছেন, ‘হ্যাঁ, প্রতি মাসে এই পরিমাণ টাকা পাঠালে ভালো হয়।’ খুবই সামান্য টাকা। পাঠাই। কিন্তু যখন জানতে পারেন আমি এখানে কঠোর শ্রম করি, অড জবস করি, তখন তিনি সে টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘তুমি আর টাকা পাঠাবে না।’ আমিও নাছোড় ছিলাম। শুনিনি তাঁর কথা।
কথা হয়েছিল ১৯৮১ সালে, আমি তখনকার পশ্চিম জার্মানি থেকে সোজা কলকাতা যাব এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় ফিরব। কিন্তু এর দিন কয়েক পরই খবর পেয়েছিলাম সত্যেন দা আর নেই।
আজ ২৮ মার্চ সত্যেন দার ১০৬তম জন্মবার্ষিকী। ১০৭তম জন্মদিন। আমার মৃত্যুর পর আমি যেন সত্যেন দার কাছে যাই। তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে যেন থাকি।
আখতার হুসেন
No comments