আসুন হাইতিবাসীর পাশে দাঁড়াই by কাজী জহিরুল ইসলাম
প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসে বিবিসি খুলি। রোজকার রুটিন। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ব্রেকিং নিউজ। হাইতিতে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়েছে। মৃতের সংখ্যা অনুমান করা হচ্ছে একশ’। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা বেড়ে দুশ’। এরপর হাজার। অফিসে এসে অনলাইন নিউজ খুলি। মাই গড, বলে কি? মৃতের সংখ্যা ত্রিশ হাজার! তারপর লাখ।
সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। দেশটির রাজধানী পোর্ট অ’প্রিন্সের প্রায় সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে এই মহাপ্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে। প্রেসিডেন্ট প্যালেস, উপাসনালয়, হাসপাতাল কিছুই বাদ নেই। গির্জার পুরোহিত প্রার্থনারত অবস্থায় শেষ। আমার কলিজায় কামড় পড়ে যখন দেখি হাইতিতে অবস্থিত আমাদের শান্তিরক্ষা মিশন মিনুস্তার প্রধান কার্যালয় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। মনে পড়ে যায় ইরাক ট্র্যাজেডির কথা। ১৯ আগস্ট, ২০০৩। বাগদাদের সেই ক্যানাল হোটেল। এমনি করেই আমাদের ইরাক মিশনের সদর দফতর ধসে পড়ে। মিশন প্রধান ব্রাজিলীয় নাগরিক ডি-মেলোসহ আমরা হারিয়েছি ১৬ জন সহকর্মীকে। ওটা তো ছিল সন্ত্রাসীদের আক্রমণ; কিন্তু এটা কোন সন্ত্রাসীর আক্রমণ? প্রকৃতি? কেন প্রকৃতি বৈরী হয়েছে দারিদ্র্যপীড়িত এক দ্বীপ দেশের অসহায় মানুষের প্রতি? কী ওদের অপরাধ? নাকি ধনী দেশগুলো নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য প্রকৃতির প্রতি যে বৈরী আচরণ করছে তারই খেসারত এই ভূমিকম্প?
এক মুহূর্তের মধ্যেই বিদ্যুত্ চমকের মতো আমার মাথায় খেলে গেল, আমার বন্ধু ওখানে আছে, আমার ভাই, আবেদীন ভাই, ডক্টর মোহাম্মদ হাসানুল আবেদীন খান (ফরহাদ)। তিনি তো পুলিশ কমিশনারের অর্থ উপদেষ্টা, হয়তো সদর দফতরেই ছিলেন। তার কী অবস্থা? পাগলের মতো ফোন করি; কিন্তু ফোন ব্যস্ত। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হই। ফোন যখন ব্যস্ত তিনি ভালো আছেন। দশ মিনিট পর আবার ফোন করি, তখনও ব্যস্ত। ত্রিশ মিনিট পর আবার। কী আশ্চর্য, এত লম্বা কল? হয়তো ভাবী ফোনে কান্নাকাটি করছেন। দুই ঘণ্টা পরেও যখন ফোন ব্যস্ত পাই তখন আমার সন্দেহ হয়। আবেদীন ভাই আমার আত্মীয়ের মতো, এই মানুষটির কোনো অনিষ্ট হয়েছে এই খবর আমি মেনে নিতে পারব না।
খোঁজ নেই আমাদের টেলিফোন শাখায়। ওরা জানায়, হাইতির সঙ্গে টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পুরো বিল্ডিং ধসে গেছে। মিশন প্রধানসহ অনেকেই ছিলেন বিল্ডিংয়ে। কারও কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আমার দু’চোখ থেকে হরহর করে পানি বেরিয়ে আসে। আবেদীন ভাইয়ের আত্মীয় আছেন সুদান মিশনে। তাকে ফোন করা যায়। কোনো এক কারণে তাকে ফোন করা আমার নিষেধ। কিন্তু আমাকে করতেই হবে। আমি তার এক্সটেনশনে ফোন করি। ডিসপ্লেতে আমার নাম দেখে তিনি ধরেন না। এবার ভিন্ন নম্বর থেকে তার মোবাইলে করি। তিনি ফোন ধরেন। ওহাব ভাই, ফরহাদ ভাই কেমন আছেন? যখন দালান ধসে পড়ছিল তিনি টের পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যান, তবে আহত হয়েছেন। কিছু সেলাই দিতে হয়েছে, এখন সুস্থ আছেন। খোলা আকাশের নিচে ওদের চিকিত্সা চলছে। আমি জিজ্ঞেস করি, অন্য বাঙালিরা? যোগাযোগই তো করতে পারছি না, আর কারও খবর জানি না। আমার মনে পড়ে আমাদের আরও কয়েকজন আছেন। মুনীর তরফদার কাজ করেন বাজেট সেকশনে, তাহমিনা কাজ করেন জিআইএস-এর প্রধান হিসেবে, আরও দু’জন সিভিল বাংলাদেশী কর্মকর্তা আছেন জানি, বেশিও থাকতে পারে। এছাড়া কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আছেন। কেমন আছেন তারা?
পরদিন বাংলাদেশী সংবাদপত্রগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজি। হাইতির ওপর তেমন কোনো খবরই নেই। কী আশ্চর্য, এতবড় একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল, বাংলাদেশে কোনো নিউজ নেই? আমাদের সময় একস্লিপ নিউজ করেছে। বাংলাদেশীরা সবাই ভালো আছে। নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে কর্মরত ডিফেন্স এটাচি ও শান্তিরক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামাল ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের সময়। তিনি জানান, হাইতি মিশনে ৬ জন বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। ভূমিকম্পের পরপরই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা সবাই সুস্থ আছেন। খবরটি পড়ে আমি বিস্মিত হই। ওখানে যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী সিভিল কর্মকর্তা কাজ করেন, এই তথ্যই নেই ব্রিগেডিয়ার জামাল তথা বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে। হায়রে ডিজিটাল বাংলাদেশ! নাকি এটা সামরিকসুলভ সিভিলিয়নদের প্রতি বৈরী আচরণ?
১৫ জানুয়ারি হাইতিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ। আমাদের মিশন সদর দফতরের নিচে চাপা পড়া সহকর্মীর সংখ্যা প্রায় একশ’; সম্ভবত এরা সবাই মৃত। এ পর্যন্ত ১৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
পোর্ট অ’প্রিন্সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য বিরাজ করছে। খোলা আকাশের নিচে রয়েছে ত্রিশ লাখ মানুষ, যা দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগণ। খাবার নেই, পানি নেই, বিদ্যুত্ নেই। শহর জুড়ে মানুষের আহাজারি। বিমান বন্দরের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে সাহায্য নিয়ে প্লেনগুলো আসতে পারছে। আমাদের সবার উচিত এখন অসহায় হাইতিবাসীর পাশে দাঁড়ানো। বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাঠানোর খবর এখনও পাইনি। হোক না ওরা ভিন্ন ভূ-খণ্ডের, ভিন্ন বর্ণের মানুষ। ওরা আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীর মানুষ। আমরা সবাই যদি একটি করে টাকা দেই, সেই টাকায় অসহায় হাইতিবাসীর জন্য কিছু খাবার কেনা যাবে। ভুপেন হাজারিকার সেই গান মনে পড়ে যায়, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু?’ সেই মানুষ যে কেউ হতে পারে, যে কোনো ভূ-খণ্ডের হতে পারে, যে কোনো বর্ণের হতে পারে। আমাদের ফোন কোম্পানিগুলো সবার কাছ থেকে একটি করে এসএমএস চাইতে পারে, সেখানে লেখা থাকবে শুধু একটিমাত্র শব্দ ‘ভালোবাসি’। আর কোটি বাঙালির এই ভালোবাসার এসএমএস থেকে পাওয়া সমুদয় অর্থে খাবার কিনে আমরা পাঠাতে পারি হাইতিবাসীর জন্য। আমার খুব জোরে বাতাসে গলা চড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে—‘একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু?’
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments