নাটকের ক্লাস: আবদুল্লাহেল মাহমুদ-নাটক নামানো যায় না
আনন্দ-এর পাঠকদের জন্য এবার শুরু হলো নাটকের ক্লাস। নাটক করতে হলে যে যে বিষয়ে জেনে নেওয়া খুবই জরুরি, সে বিষয়গুলোর ওপরই আলোকপাত করা হবে। নাটককে জেনে-বুঝে তারপর নাটকের অংশ হওয়ার সুযোগ করে দিতেই এ ক্লাসের আয়োজন
মহড়া কক্ষজুড়ে থমথমে ভাব। উত্তেজিত নির্দেশক, ‘না এভাবে চলে না। সময়মতো উপস্থিত থাকব না আবার বড় বড় চরিত্রে অভিনয় করতে চাই, কত আবদার! এক সপ্তাহ হয়ে গেল কেউ ভালো করে নাটকটাও পড়েনি। এ রকম হলে সময়মতো নাটক নামানো যাবে না।’
নির্দেশক একনাগাড়ে কথা বলে উত্তেজনা প্রশমন করলেন। নাট্যকার এতক্ষণ পাশে বসে নির্দেশকের দুরবস্থা লক্ষ করছিলেন। নির্দেশক থামতেই বলে উঠলেন, ‘আসলে আমাদের ভাবনাটাই ভুল।’
নির্দেশক তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন, কী বলতে চাইছেন?
নাট্যকার যেন এই সুযোগটিই খুঁজছিলেন, ‘ওই যে একটু আগে বলছিলেন নাটক নামানোর কথা। নাটক নামানোর জিনিস নয়। এখানেই আমরা প্রথম ভুলটা করি। নাটক মাথা থেকে বোঝা নামানোর মতো বিষয় নয়। নাটক একটি শিল্প, একটি সৃষ্টি। আর এই সৃষ্টির কাজটি করতে হয় বারবার নতুন করে। আর সে জন্য যে কাজটি জরুরি, তা হলো নাট্যকারের লেখা নাটকটি মগজে ধারণ করা, মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া নয়।’
নির্দেশক ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন, ‘দেরি করে আসা আর অনুপস্থিতির জন্য আমি রিহার্সেলটা শুরু করতে পারছি না, আপনি তত্ত্বজ্ঞান দিচ্ছেন!’
নাট্যকার বাতাস বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। নাট্যকারের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নির্দেশক একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘রিহার্সেল যখন শুরু করতে পারছি না, তখন আপনার কথাই শোনা যাক।’
নাট্যকার একটি কলেজে সাহিত্য পড়ান। সুযোগ পেলেই একটু-আধটু মাস্টারি করতে ভালোবাসেন। সুযোগ পেয়ে ক্লাস লেকচারের মতো বলতে শুরু করলেন, একজন পাঠক কিংবা পাঠিকা তিনি ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, আমলা, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ যা-ই হোন না কেন, পড়ার সময় তিনি টেক্সট বা কথাবস্তুর একটা বিশ্লেষণ করে থাকেন। তিনি তাঁর মতো করে নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করান। কেউ তা করেন গভীর অভিনিবেশসহ, আবার কেউ বা হালকাভাবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা-নির্বিশেষে জগৎজুড়ে পাঠপ্রক্রিয়ার এটাই সাধারণ রীতি। সবার পাঠ বিশ্লেষণই আলাদা। একই গল্প কাহিনির পাঠ বিশ্লেষণ পাঠকভেদে ভিন্ন ভিন্ন। এর একটি প্রধান কারণ হলো, প্রত্যেকের পাঠের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য। একজন গৃহিণী যখন অলস দুপুরে গল্প পড়তে পড়তে পাঠ বিশ্লেষণ করেন, তাঁর সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিশ্লেষণের পার্থক্য আছে। আবার একজন পরীক্ষার্থীর পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত রক্তকরবী কিংবা রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের বিশ্লেষণের সঙ্গে একজন অভিনেতা বা নির্দেশকের বিশ্লেষণেও রয়েছে বিশাল পার্থক্য।
একজন গৃহিণী পড়েন সময় কাটানোর জন্য, তাঁর উদ্দেশ্য পাঠের আনন্দ। একজন শিক্ষক পড়েন পাঠদানের উদ্দেশ্যে। একজন পরীক্ষার্থী ইব্রাহিম কার্দি ও জোহরা বেগমের চরিত্র, দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ করেন প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য। কিন্তু একজন নির্দেশক বা অভিনেতা কেন পড়েন?
একজন অভিনয়শিল্পী কিংবা নির্দেশক পাঠ বিশ্লেষণ করেই কাজ শেষ করতে পারেন না। তাঁদের যেতে হয় আরও অনেক দূর। এর পেছনের প্রধান কারণটি হলো নাটক লেখার উদ্দেশ্য। গল্প, কবিতা, উপন্যাস যেমন পাঠ করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়, নাটকের ক্ষেত্রে তা হয় না। মুদ্রিত হলেই নাটক পূর্ণতা পায় না। নাটককে উপস্থাপন করতে হয় পাঠক-পাঠিকার বিকল্প বিপুল দর্শক-শ্রোতার সামনে। দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব নাটকই লেখা হয় অভিনয়ের জন্য, মঞ্চায়নের জন্য। তা মঞ্চে, পথে, ফুটপাতে, রেডিও, টেলিভিশন যেখানেই হোক, তার শেষ গন্তব্য অভিনয় ড্রামাকে থিয়েটার হতে হয়। অভিনয় করে দেখাতে হয়। অর্থাৎ নাটক একটি প্রয়োগ শিল্প।
অর্থাৎ নাট্যকারের সৃষ্টি সম্পূর্ণ নয়। নাট্যকার যে কাজটি করেন তা হলো, সৃষ্টি আর নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী আর দর্শক-শ্রোতা সবাই মিলে তা পুনঃসৃষ্টি করেন। একজন নির্দেশককে নাটকটি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমন্বয়ে দর্শক-শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করতে হয়, নাটকটির একটি ব্যাখ্যা দিতে হয়। আবার একজন অভিনয়শিল্পীকে অভিনয়ের চরিত্রটিকে বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সঙ্গে শত শত দর্শকের সামনে তুলে ধরতে হয়। আর এ কাজ করতে গিয়ে নির্দেশক, অভিনয়শিল্পীকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয়। আর তা ধারণ করতে হয় মগজে।
অভিনয়শিল্পীকে অনুশীলন করতে হয় নিয়মিত। যত দিন নাটকটি অভিনীত হয়, অন্তত তত দিন। এখানেই অভিনয়শিল্পীর নাটক পাঠ ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব।
অনেকেই হয়তো পাণ্ডুলিপিবিহীন ইমপ্রোভাইজড নাটকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সেখানেও অভিনয়শিল্পীকে অভিনয় বিষয়টির বিশ্লেষণ করতে হয়। অভিনয়শিল্পীর নাটক পাঠ ও বিশ্লেষণ তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নাট্যকার কথা বলতে বলতে বললেন, ‘এবার চা না হলে আর চলছে না।’
সবাই মনে মনে তা-ই চাইছিল।
নির্দেশক একনাগাড়ে কথা বলে উত্তেজনা প্রশমন করলেন। নাট্যকার এতক্ষণ পাশে বসে নির্দেশকের দুরবস্থা লক্ষ করছিলেন। নির্দেশক থামতেই বলে উঠলেন, ‘আসলে আমাদের ভাবনাটাই ভুল।’
নির্দেশক তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন, কী বলতে চাইছেন?
নাট্যকার যেন এই সুযোগটিই খুঁজছিলেন, ‘ওই যে একটু আগে বলছিলেন নাটক নামানোর কথা। নাটক নামানোর জিনিস নয়। এখানেই আমরা প্রথম ভুলটা করি। নাটক মাথা থেকে বোঝা নামানোর মতো বিষয় নয়। নাটক একটি শিল্প, একটি সৃষ্টি। আর এই সৃষ্টির কাজটি করতে হয় বারবার নতুন করে। আর সে জন্য যে কাজটি জরুরি, তা হলো নাট্যকারের লেখা নাটকটি মগজে ধারণ করা, মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া নয়।’
নির্দেশক ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন, ‘দেরি করে আসা আর অনুপস্থিতির জন্য আমি রিহার্সেলটা শুরু করতে পারছি না, আপনি তত্ত্বজ্ঞান দিচ্ছেন!’
নাট্যকার বাতাস বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। নাট্যকারের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নির্দেশক একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘রিহার্সেল যখন শুরু করতে পারছি না, তখন আপনার কথাই শোনা যাক।’
নাট্যকার একটি কলেজে সাহিত্য পড়ান। সুযোগ পেলেই একটু-আধটু মাস্টারি করতে ভালোবাসেন। সুযোগ পেয়ে ক্লাস লেকচারের মতো বলতে শুরু করলেন, একজন পাঠক কিংবা পাঠিকা তিনি ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, আমলা, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ যা-ই হোন না কেন, পড়ার সময় তিনি টেক্সট বা কথাবস্তুর একটা বিশ্লেষণ করে থাকেন। তিনি তাঁর মতো করে নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করান। কেউ তা করেন গভীর অভিনিবেশসহ, আবার কেউ বা হালকাভাবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা-নির্বিশেষে জগৎজুড়ে পাঠপ্রক্রিয়ার এটাই সাধারণ রীতি। সবার পাঠ বিশ্লেষণই আলাদা। একই গল্প কাহিনির পাঠ বিশ্লেষণ পাঠকভেদে ভিন্ন ভিন্ন। এর একটি প্রধান কারণ হলো, প্রত্যেকের পাঠের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য। একজন গৃহিণী যখন অলস দুপুরে গল্প পড়তে পড়তে পাঠ বিশ্লেষণ করেন, তাঁর সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিশ্লেষণের পার্থক্য আছে। আবার একজন পরীক্ষার্থীর পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত রক্তকরবী কিংবা রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের বিশ্লেষণের সঙ্গে একজন অভিনেতা বা নির্দেশকের বিশ্লেষণেও রয়েছে বিশাল পার্থক্য।
একজন গৃহিণী পড়েন সময় কাটানোর জন্য, তাঁর উদ্দেশ্য পাঠের আনন্দ। একজন শিক্ষক পড়েন পাঠদানের উদ্দেশ্যে। একজন পরীক্ষার্থী ইব্রাহিম কার্দি ও জোহরা বেগমের চরিত্র, দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ করেন প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য। কিন্তু একজন নির্দেশক বা অভিনেতা কেন পড়েন?
একজন অভিনয়শিল্পী কিংবা নির্দেশক পাঠ বিশ্লেষণ করেই কাজ শেষ করতে পারেন না। তাঁদের যেতে হয় আরও অনেক দূর। এর পেছনের প্রধান কারণটি হলো নাটক লেখার উদ্দেশ্য। গল্প, কবিতা, উপন্যাস যেমন পাঠ করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়, নাটকের ক্ষেত্রে তা হয় না। মুদ্রিত হলেই নাটক পূর্ণতা পায় না। নাটককে উপস্থাপন করতে হয় পাঠক-পাঠিকার বিকল্প বিপুল দর্শক-শ্রোতার সামনে। দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব নাটকই লেখা হয় অভিনয়ের জন্য, মঞ্চায়নের জন্য। তা মঞ্চে, পথে, ফুটপাতে, রেডিও, টেলিভিশন যেখানেই হোক, তার শেষ গন্তব্য অভিনয় ড্রামাকে থিয়েটার হতে হয়। অভিনয় করে দেখাতে হয়। অর্থাৎ নাটক একটি প্রয়োগ শিল্প।
অর্থাৎ নাট্যকারের সৃষ্টি সম্পূর্ণ নয়। নাট্যকার যে কাজটি করেন তা হলো, সৃষ্টি আর নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী আর দর্শক-শ্রোতা সবাই মিলে তা পুনঃসৃষ্টি করেন। একজন নির্দেশককে নাটকটি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমন্বয়ে দর্শক-শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করতে হয়, নাটকটির একটি ব্যাখ্যা দিতে হয়। আবার একজন অভিনয়শিল্পীকে অভিনয়ের চরিত্রটিকে বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সঙ্গে শত শত দর্শকের সামনে তুলে ধরতে হয়। আর এ কাজ করতে গিয়ে নির্দেশক, অভিনয়শিল্পীকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয়। আর তা ধারণ করতে হয় মগজে।
অভিনয়শিল্পীকে অনুশীলন করতে হয় নিয়মিত। যত দিন নাটকটি অভিনীত হয়, অন্তত তত দিন। এখানেই অভিনয়শিল্পীর নাটক পাঠ ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব।
অনেকেই হয়তো পাণ্ডুলিপিবিহীন ইমপ্রোভাইজড নাটকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সেখানেও অভিনয়শিল্পীকে অভিনয় বিষয়টির বিশ্লেষণ করতে হয়। অভিনয়শিল্পীর নাটক পাঠ ও বিশ্লেষণ তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নাট্যকার কথা বলতে বলতে বললেন, ‘এবার চা না হলে আর চলছে না।’
সবাই মনে মনে তা-ই চাইছিল।
No comments