রাজনীতির বাজারে উত্তাপ
শীত সবকিছু ঠাণ্ডা করে দিলেও বাজার এখন গরম। প্রতিদিন প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে। এই পণ্যমূল্য নিয়ে জোট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিদিন গীবত্ শুনেছি। নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতিতে পণ্যের দাম কমাবার সোনালি প্রতিশ্রুতি শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আহা! দাম কি সত্যি আসবে নাগালের মধ্যে?
হিমশিম নাগরিকেরা বাজারে গিয়ে থ’ বনে যাচ্ছে। বাজারে উত্তাপ বটে। তবে নাগরিকরা হিমশীতল হয়ে যাচ্ছে। জীবনমানে অবিরাম কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ক্যালোরি বা পুষ্টির সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। সীমিত আয়ে তো কিছুই কেনা যাচ্ছে না। এখন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিঅলারা সুর ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলছেন, জিনিসপত্রের দাম কমেছে। ভাগ্যক্রমে তাকে বাজার করতে হয় না। দাম বাড়া-কমার হিসাব তিনি রাখেন না। ফলে বলে দিলেই হলো। পত্রপত্রিকাগুলো তার বক্তব্য প্রচার করে মানুষকে আরও হতাশ করছে। তারা এখন বলছেন, জিনিসপত্রের দামের তুলনা করে লাভ নেই। অর্থাত্ বললে বলেছিলাম দাম কমাবার কথা, এখন পারছি না। কিন্তু তুলনা কেন করবেন। মানুষ তো ঠিকই কিনে খাচ্ছে। কেউ তো না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। তা হলে এতো কথা কিসের! কারণ যে যায় লঙ্কায় সে-ই রাবণ হয়ে যায়।
কিন্তু নাগরিকের কোনো প্রতিকার নেই। সরকার কথা রাখেনি, তাই বলে সরকারকে ফেলে দেয়ার কোনো হাতিয়ার নেই তাদের কাছে। সে শুধু অপেক্ষা করে, আবার যখন নির্বাচন আসবে, তখন দেখা যাবে। নির্বাচন তো কতদূর!
কিন্তু যত দূরই হোক, তা ওই একদিনের বাদশাহ্। কিন্তু সে বাদশাহীও অনেক সময় থাকে না। নাগরিকের রায় উল্টে দেয়ার নানান কৌশল নিয়ে বসে থাকে রাজনীতি নটেরা। তারা নানা কৌশলে নাগরিকের রায় উল্টে দেয়। হতাশা বদলে নাগরিক সে ষড়যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
কিন্তু সব সময় কি করে? বেশিরভাগ সময়ই করে। কিন্তু ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমরা লক্ষ্য করি, কখনও অতিষ্ঠ নাগরিক হঠাত্ করেই রুখে দাঁড়ায় এবং সমস্ত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষার মতো করে সমাজ-সংসার-সরকার সাজায়। ১৯৭০ সালে আমরা তেমনি দেখেছি। নাগরিক ভোট দিয়ে নিশ্চিত করেছিল, তারা কি চায়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা দাঁড়িয়েছিল নাগরিকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিপক্ষে। তারা উপেক্ষা করতে চেয়েছিল নাগরিক আকাঙ্ক্ষা। ১৯৭১ সালে তাই সব মানুষ এক জোট হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে সে আকাঙ্ক্ষা নস্যাত্ করে দিয়েছিল। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের তাড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার দাঁড়িয়েছিল জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিপক্ষে। ন্যুব্জপিষ্ট হয়ে গিয়েছিল নাগরিকরা। কেড়ে নেয়া হয়েছিল তাদের সব ধরনের মৌলিক ও মানবিক অধিকার। চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র কত কি যে হচ্ছিল। নাগরিকরা জ্বলে ওঠেনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সারা দেশের মানুষ একযোগে ঘুরে দাঁড়িয়ে রুখে দিয়েছিল সব ষড়যন্ত্র। নাগরিক প্রতিরোধে ছন্নেছার হয়ে গিয়েছিল সব অপশক্তি।
আবার ১৯৮২ সালে নাগরিকদের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিল সেনাবাহিনী প্রধান। নাগরিকরা ফুঁসেছে। কিন্তু একসঙ্গে প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্টি করেনি। নানা অপশাসন-দুঃশাসন মুখ বুজেই সহ্য করেছে। কিন্তু ১৯৯০ সালে এক ধাক্কার স্বৈরশাসকদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে।
এই যে নাগরিক সব সময় প্রতিবাদমুখর নয়, সব সময় সংঘশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে না, অপশাসকরা তার সুযোগ গ্রহণ করে। তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ক্ষমতার আস্বাদ গ্রহণ করতে থাকে। তারা রাবণ হয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই উপলব্ধি করতে চায় না যে, ভেতরে ভেতরে মসনদে নিচেকার মাটি নরম হতে শুরু করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত ঝপ করে বসে পড়ে।
সরকার নাগরিকদের কাছে দেয়া ওয়াদার বরখেলাপ করছে। ভিন দেশের সঙ্গে চুক্তি করে এসেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল একটি প্রেস কনফারেন্স করে চুপটি মেরে শীত পোহাচ্ছে। নাগরিকের নিজের প্রস্তুতি সম্পন্ন হচ্ছে। যে কোনো সময় হয়তো ’৭১, ’৭৫ ও ’৯০-এর মতো এই বিশাল উত্থান ঘটিয়ে দেবে, কে বলতে পারে।
পরাভবের নিয়তি
পরাজয় কি কেউ চায়? নাঃ! আমরা কেউই পরাজয় চাই না। কেবলই জয়ী হতে চাই। চাকরি প্রার্থীর লাইনে জয়ী হতে চাই, স্কুলে ভর্তিতে জয়ী হতে চাই, টেন্ডারে জয়ী হতে চাই, খেলায়-জুয়ায় জয়ী হতে চাই। নির্বাচনে জয়ী হতে চাই। প্রেমে জয়ী হতে চাই। এমনকি লটারিতেও জয়ী হতে চাই। কিন্তু নগরীতে পরাভবই অধিকাংশ মানুষের নিয়তি। জয়ী হয় কেউ কেউ। একটি চাকরির জন্য পঞ্চাশজন প্রার্থী। চাকরি তো একজনেরই হবে। অর্থাত্ জয়ী হবেন একজন। এসব জয়ের জন্য মেধা বা দক্ষতা এখন আর বিবেচ্য বিষয় নেই। ফলে এ প্রতিযোগিতার ধারা প্রবাহিত হচ্ছে রাজনীতির বিবেচনায়। সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজে তৃতীয় শ্রেণীর একেকটি চাকরির জন্য একাধিক মন্ত্রী-এমপি-হুইপ স্বাক্ষর করেছেন, ফোন করেছেন। চাকরি দাতাকে নানাভাবে প্রভাহিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চাকরি যিনি দেবেন, ধরে নেয়া যাক, তিনিও একজন আওয়ামী লীগের লোক। কিন্তু কোন মন্ত্রী-এমপি হুইপ বা প্রভাবশালীর কথা তিনি শুনবেন? তার বিপদ ভিন্ন। কার কথা শুনে কার রোষানলে পড়েন। এ রকম অনন্যোপায় পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। তদবিরকারীদের এটাও এক ধরনের জয়। আমি যদি খেতে না পারব, তবে তোকেও খেতে দেব না। কিন্তু যারা এতসব সুপারিশ তদবির জোগাড় করতে পারেনি, যারা মন্ত্রীকে চেনে না, এমপি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি, তাদের হারটা বড় করুণ। যারা অতসব সুপারিশ নিয়েও শেষ পর্যন্ত চাকরিটি পায়নি, তাদের এখনও আশা আছে। এই প্রক্রিয়া যখন শুরু হবে, তখন সে আবারও আসবে একই প্রক্রিয়ায়। কিন্তু যে শুধু যোগ্যতা-দক্ষতার ওপর ভর করে চাকরির দরখাস্ত দিয়েছিল, তার কোনো আশা আর অবশিষ্ট রইল না। প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার আগেই তার হার নিশ্চিত হয়ে গেল।
এখন অধিকাংশ নাগরিক এভাবেই হেরে যাচ্ছে। পরাভবের বেদনায় নীল হয়ে ক্ষোভ সঞ্চয় করছে। এরা সংখ্যায় অধিক। নৈতিক শক্তিতে বেশি বলীয়ান। এই ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত সামাল দেয়া সম্ভব হবে তো?
ফুটনোট
সড়ক দুর্ঘটনায় এক জ্যোতিষীর পা ভেঙেছে শুনে মন্তব্য করলেন জনৈক নাগরিক, ‘অন্যের ভাগ্য গুনতে গুনতে বেচারা নিজের ভাগ্য গুনে দেখার সময়ই পায়নি।’
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
No comments