মুক্তিযুদ্ধ ও মৈত্রী সম্মাননা-কৃতজ্ঞ জাতির বিনম্র আয়োজন
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল আমাদের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম কালপর্ব যেমন, তেমনি ঘোরতর সংকটের সময়ও ছিল সেটি। সে সময় বাংলার আপামর মানুষ মুক্তির মহীয়ান শপথে উজ্জীবিত হয়ে মরণপণ যুদ্ধে নেমে পড়েছিল, ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য। আবার ওই সময়টিতেই বাংলার মানুষের ওপর নেমে এসেছিল গণহত্যা, মৃত্যু পরোয়ানা,
অত্যাচার, ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের খড়্গও। কোটি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছিল আবাসভূমি থেকে, আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী ভারতের রাজ্যগুলোতে। মুক্তিযুদ্ধ এত বহুমাত্রিক যে, যুদ্ধ ও যুদ্ধের ছায়া কেবল বাংলাদেশ-ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলো নয় বরং প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বহু দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। সময়টি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের_ দ্বিমেরু বিভক্ত পৃথিবীতে দেশগুলো দুই শিবিরে বিভক্ত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিস্তৃত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত। বাঙালির জন্য পরম সৌভাগ্য যে, সেদিন আমাদের জাতির মুক্তির অভীপ্সা ও লড়াই পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল, সবার আন্তরিক সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল। এমনকি বৈশ্বিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের কারণে যে দেশের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন সেসব দেশেও তীব্র গণসমর্থন তৈরি হয়েছিল। নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিকরা বাংলাদেশের সমর্থনে জোর আওয়াজ উঠিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, শত বাধা-বিপত্তিকে মাথা পেতে নিয়ে যারা সেদিন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তারা আমাদের পরম বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সে বন্ধুদের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, থাকবেও চিরকাল। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদের স্বীকৃতি এতকাল মেলেনি। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্মাননার উদ্যোগ আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের ৪১ বছর পূর্তিতে বর্তমান সরকার সম্মাননার উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে যে বিদেশি বন্ধুর অবদান সর্বাগ্রে সেই ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা জানানো হয় রাষ্ট্রীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এবার মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা জানানো হলো ৮৩ জন বিদেশি বন্ধু ও তাদের প্রতিনিধিকে। এমন আয়োজন শুধু প্রশংসনীয় নয়, জাতির জন্য গৌরবের। আত্মসম্মানসম্পন্ন একটি জাতির কর্তব্য তার সংকটের বন্ধুকে স্মরণ করা ও সম্মান জানানো। এ কথা সত্য, যারা ১৯৭১-এ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই তা করেছেন। কিন্তু সম্মাননা জানানো আমাদের দায়িত্ব। জাতির অগ্রযাত্রার পথে ছোট-বড় সব অবদানকে স্বীকার করার মধ্য দিয়েই জাতির অগ্রযাত্রা নিশ্চিত হতে পারে। আগামী প্রজন্মের কাছে যথার্থ উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে। মঙ্গলবার একটি জাঁকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অতিথিদের সম্মান জানিয়েছেন। প্রশংসনীয় এ উদ্যোগ আরও অর্থপূর্ণ হতে পারত যদি একটি গণজমায়েতের মধ্যে মুহুর্মুহু করতালি ও অভিবাদনের মাধ্যমে এ সম্মাননা জানানো যেত। অনুষ্ঠানটি ভালো হলেও প্রত্যাশিত মাত্রায় নিখুঁত হতে পারেনি, আয়োজনের কিছু সীমাবদ্ধতাও অনেকের নজর কেড়েছে। তা সত্ত্বেও সরকারের এ উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালের বন্ধুদের চিনে নিতে অত্যন্ত সহায়ক এ অনুষ্ঠান। পাশাপাশি, আমাদের জাতীয় বীর, জাতির সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর যে রীতি আছে তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি পাক সেটিও আমরা আশা করি।
No comments