কালের পুরাণ-ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কত দূর? by সোহরাব হাসান
মোহাম্মদ হানিফ বেঁচে থাকলে সাদেক হোসেন খোকাকে নির্ঘাত ঈর্ষা করতেন। মোহাম্মদ হানিফ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমল মিলে মেয়র ছিলেন আট বছরের মতো। আর সাদেক হোসেন খোকা বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মিলে প্রায় নয় বছর পার করছেন।
২০০২ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়। সাদেক হোসেন দায়িত্ব নেন ১৫ মে। দিনপঞ্জির হিসাবে আগামী ১৪ মে তাঁর অভিষেকের নয় বছর পূর্ণ হবে। বাংলাদেশে আর কোনো মেয়র বা নির্বাচিত প্রতিনিধির এমন সৌভাগ্য হয়েছে কি না সন্দেহ।
অনেকে বলেন, সাদেক হোসেন এখন ফুলটাইম রাজনীতিক, পার্টটাইম মেয়র। ঢাকা সিটি বিএনপির সভাপতির পদ ফিরে পেতে ফুলটাইম দলকে সময় দিতে হয় সাদেক হোসেনকে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা ঢাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ-দুর্দশার জন্য সাদেক হোসেনকেই দোষারোপ করেন। ঢাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা অবর্ণনীয়, রাস্তার বাতিগুলো কখনো জ্বলে, কখনো নেভে, মশার অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে না সরকার, না মেয়রের কার্যকর কোনো উদ্যোগ আছে। মেয়রের অভিযোগ, সরকার প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না দেওয়ায় তিনি সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকাজ করতে পারছেন না। অন্যদিকে, সরকার দুষছেন মেয়রকে। এই দোষাদোষিতে পড়ে রাজধানীর দেড় কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ।
সংবিধানের ৭ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের মালিক জনগণ। যদিও ভোটের দিন ছাড়া সেই জনগণের কোনো উপস্থিতি নেই দেশ পরিচালনায়। দেশ অনেক বড়, তার ভবিষ্যৎ নীতি-কৌশল ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছে সংসদের বিশেষ কমিটি। আমরা আদার ব্যাপারি এ বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে আপাতত সিটি করপোরেশন নিয়েই ভাবি। প্রথম প্রশ্ন হলো, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মালিক কে? সরকার, মেয়র, না ঢাকার জনগণ? যদি সরকার মালিক হয়ে থাকে, তবে ইচ্ছেমতো সিটি করপোরেশন চালাবে। যদি মেয়র মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর ইচ্ছেমতো চালাবেন। কিন্তু জনগণ যদি মালিক হয়ে থাকে, সিটি করপোরেশন পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনসহ সব স্থানীয় সরকার সংস্থার মেয়াদ পাঁচ বছর। প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক দুর্যোগে তিন মাস, ছয় মাস না-হয় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। তাই বলে চার বছর! আরেকটি মেয়াদের কাছাকাছি? যেখানে সরকার সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে বিএনপির নামধাম মুছে ফেলতে চাইছে, সেখানে বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়রকে দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন চালানোর রহস্যটা কী? দেশের সর্ববৃহৎ সিটি করপোরেশন, যেটি ১৫ জন সাংসদের নির্বাচনী এলাকা, সেই সংস্থাটি এভাবে স্থবির, অকার্যকর ও অপাঙেক্তয় করে রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে?
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তোড়জোড় শোনা গিয়েছিল। ২০০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেছিলেন, আগামী এপ্রিলেই নির্বাচন হবে। তারপর আরও দুটি এপ্রিল চলে গেলেও নির্বাচনের কোনো লক্ষণ নেই।
তখন সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, আদালতে মামলা থাকার কারণে নির্বাচন হতে পারছে না। কিন্তু ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট সেই রিটের নিষ্পত্তি করে বলেছেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই।’
এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এও বলেছিলেন, ‘আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও আমরা নির্বাচন করব। আদালত যদি নির্বাচন বাতিল করে, বাতিল হবে। কিন্তু আমরা নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর।’ সর্বশেষ গত বছরের ৮ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও বলেছিলেন, আগামী বছর (২০১১) জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে। কিন্তু তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে পারেনি সরকারের অসহযোগিতার কারণে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ধারণা করা যায়, আওয়ামী লীগ আগামী আড়াই বছরের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন বিএনপির কাছে লিজ দিয়েছে। না হলে যে নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের ১৫ জন সাংসদ আছেন, সেই এলাকায় নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে এত ভয় কেন? তাহলে কি সরকার ধরেই নিয়েছে যে তাদের পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে? আর সরে গেলেও তো নির্বাচন না দিয়ে পারে না। নির্বাচন হলো জনরায়। সেখানে কে হারবে কে জিতবে, সেটি দেখে তো নির্বাচনের তারিখ ঠিক হতে পারে না। যেকোনো সংস্থায় নির্ধারিত মেয়াদের পর নির্বাচন হতে হবে।
আর নির্বাচন করার মালিক তো নির্বাচন কমিশন, সরকার নয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশন অসহায়। জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করে তারা যে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করেছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের প্রশ্ন, দেশের এই বৃহত্তম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচন নিয়ে সরকার কেন টালবাহানা করছে? জাতীয় সংসদে তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন তাদের হাতে। তার পরও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিতে ভয় কেন? সরকার যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, যেখানে হারের ভয় আছে সেখানে আর নির্বাচন করবে না, সেটি নিজের পায়ে কুড়াল মারা ছাড়া কিছু নয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল পরাজিত হলেই সরকার পড়ে যাবে না। ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফ জয়ী হয়েছিলেন। তাতে কি বিএনপি সরকারের পতন ঘটেছিল? আওয়ামী লীগ আমলে খুলনা ও রাজশাহীতে বিএনপির মেয়র ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে একাধিকবার কলকাতা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস থেকে। কংগ্রেস আমলে দিল্লির মেয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বিজিপির এক নেতা। তাতে কি কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটেছে? ঘটেনি। তাহলে আওয়ামী লীগ ভয় পাচ্ছে কেন? ঢাকা মহানগরে মেয়র পদে প্রার্থী দেওয়ার মতো লোক নাকি আওয়ামী লীগে নেই। এটি কি দেশের সর্ববৃহৎ দলটির দেউলিয়াত্ব নয়? এই দেউলিয়াত্ব দিয়ে দলকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন না করে সরকার যে মস্ত বড় ভুল করেছে, তার ফল হয়তো আগামী নির্বাচনে পাবে। নির্বাচন করলে বরং তারা বুঝতে পারত তাদের দুর্বলতা কোথায়, মানুষ তাদের ওপর কতটা ক্ষুব্ধ। সামনে সরকারের আড়াই বছর আছে। এই সময়ে ভুল ও দুর্বলতাগুলো সংশোধনের চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনেরা কখনোই নিজেদের দুর্বলতা-ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না। এটি এক মহাব্যাধি।
বর্তমানে সংবিধান সংশোধন তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিয়েছেন। সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে এই চ্যালেঞ্জটিও নিতে পারে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কথা কেবল মুখে বললে মানুষ বিশ্বাস করবে না। কাজে প্রমাণ দিতে হবে এবং তার মোক্ষম সুযোগ হলো অবিলম্বে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
সরকার ঢাকার দেড় কোটি মানুষকে তাদের ন্যায়সংগত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। অবিলম্বে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হোক। বিরোধী দল যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ তুলেছে, আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, তারও মোক্ষম জবাব হবে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তফসিল ঘোষণা করলে সবাই নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়বে, তখন বিরোধী দলের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি গুরুত্ব হারাবে।
নির্বাচন না দিয়ে সরকার আরেকটি কাজ করতে পারে, সেটি হলো সাদেক হোসেনকে আমৃত্যু মেয়র পদে রাখার জন্য জাতীয় সংসদে একটি বিল আনা। সংসদে তাদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তা ছাড়া এ রকম একটি বিলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিএনপির সাংসদেরাও হ্যাঁ ভোট দেবেন।
সরকার কোনটি করবে, তা নীতি-নির্ধারকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। তবে একটি কথা জোর দিয়ে বলা যায়, তারা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিতে যত গড়িমসি করবে, জনমত ততই বিপক্ষে যাবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।অনেকে বলেন, সাদেক হোসেন এখন ফুলটাইম রাজনীতিক, পার্টটাইম মেয়র। ঢাকা সিটি বিএনপির সভাপতির পদ ফিরে পেতে ফুলটাইম দলকে সময় দিতে হয় সাদেক হোসেনকে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা ঢাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ-দুর্দশার জন্য সাদেক হোসেনকেই দোষারোপ করেন। ঢাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা অবর্ণনীয়, রাস্তার বাতিগুলো কখনো জ্বলে, কখনো নেভে, মশার অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে না সরকার, না মেয়রের কার্যকর কোনো উদ্যোগ আছে। মেয়রের অভিযোগ, সরকার প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না দেওয়ায় তিনি সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকাজ করতে পারছেন না। অন্যদিকে, সরকার দুষছেন মেয়রকে। এই দোষাদোষিতে পড়ে রাজধানীর দেড় কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ।
সংবিধানের ৭ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের মালিক জনগণ। যদিও ভোটের দিন ছাড়া সেই জনগণের কোনো উপস্থিতি নেই দেশ পরিচালনায়। দেশ অনেক বড়, তার ভবিষ্যৎ নীতি-কৌশল ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছে সংসদের বিশেষ কমিটি। আমরা আদার ব্যাপারি এ বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে আপাতত সিটি করপোরেশন নিয়েই ভাবি। প্রথম প্রশ্ন হলো, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মালিক কে? সরকার, মেয়র, না ঢাকার জনগণ? যদি সরকার মালিক হয়ে থাকে, তবে ইচ্ছেমতো সিটি করপোরেশন চালাবে। যদি মেয়র মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর ইচ্ছেমতো চালাবেন। কিন্তু জনগণ যদি মালিক হয়ে থাকে, সিটি করপোরেশন পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনসহ সব স্থানীয় সরকার সংস্থার মেয়াদ পাঁচ বছর। প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক দুর্যোগে তিন মাস, ছয় মাস না-হয় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। তাই বলে চার বছর! আরেকটি মেয়াদের কাছাকাছি? যেখানে সরকার সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে বিএনপির নামধাম মুছে ফেলতে চাইছে, সেখানে বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়রকে দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন চালানোর রহস্যটা কী? দেশের সর্ববৃহৎ সিটি করপোরেশন, যেটি ১৫ জন সাংসদের নির্বাচনী এলাকা, সেই সংস্থাটি এভাবে স্থবির, অকার্যকর ও অপাঙেক্তয় করে রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে?
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তোড়জোড় শোনা গিয়েছিল। ২০০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেছিলেন, আগামী এপ্রিলেই নির্বাচন হবে। তারপর আরও দুটি এপ্রিল চলে গেলেও নির্বাচনের কোনো লক্ষণ নেই।
তখন সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, আদালতে মামলা থাকার কারণে নির্বাচন হতে পারছে না। কিন্তু ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট সেই রিটের নিষ্পত্তি করে বলেছেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই।’
এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এও বলেছিলেন, ‘আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও আমরা নির্বাচন করব। আদালত যদি নির্বাচন বাতিল করে, বাতিল হবে। কিন্তু আমরা নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর।’ সর্বশেষ গত বছরের ৮ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও বলেছিলেন, আগামী বছর (২০১১) জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে। কিন্তু তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে পারেনি সরকারের অসহযোগিতার কারণে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ধারণা করা যায়, আওয়ামী লীগ আগামী আড়াই বছরের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন বিএনপির কাছে লিজ দিয়েছে। না হলে যে নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের ১৫ জন সাংসদ আছেন, সেই এলাকায় নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে এত ভয় কেন? তাহলে কি সরকার ধরেই নিয়েছে যে তাদের পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে? আর সরে গেলেও তো নির্বাচন না দিয়ে পারে না। নির্বাচন হলো জনরায়। সেখানে কে হারবে কে জিতবে, সেটি দেখে তো নির্বাচনের তারিখ ঠিক হতে পারে না। যেকোনো সংস্থায় নির্ধারিত মেয়াদের পর নির্বাচন হতে হবে।
আর নির্বাচন করার মালিক তো নির্বাচন কমিশন, সরকার নয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশন অসহায়। জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করে তারা যে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করেছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের প্রশ্ন, দেশের এই বৃহত্তম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচন নিয়ে সরকার কেন টালবাহানা করছে? জাতীয় সংসদে তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন তাদের হাতে। তার পরও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিতে ভয় কেন? সরকার যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, যেখানে হারের ভয় আছে সেখানে আর নির্বাচন করবে না, সেটি নিজের পায়ে কুড়াল মারা ছাড়া কিছু নয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল পরাজিত হলেই সরকার পড়ে যাবে না। ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফ জয়ী হয়েছিলেন। তাতে কি বিএনপি সরকারের পতন ঘটেছিল? আওয়ামী লীগ আমলে খুলনা ও রাজশাহীতে বিএনপির মেয়র ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে একাধিকবার কলকাতা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস থেকে। কংগ্রেস আমলে দিল্লির মেয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বিজিপির এক নেতা। তাতে কি কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটেছে? ঘটেনি। তাহলে আওয়ামী লীগ ভয় পাচ্ছে কেন? ঢাকা মহানগরে মেয়র পদে প্রার্থী দেওয়ার মতো লোক নাকি আওয়ামী লীগে নেই। এটি কি দেশের সর্ববৃহৎ দলটির দেউলিয়াত্ব নয়? এই দেউলিয়াত্ব দিয়ে দলকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন না করে সরকার যে মস্ত বড় ভুল করেছে, তার ফল হয়তো আগামী নির্বাচনে পাবে। নির্বাচন করলে বরং তারা বুঝতে পারত তাদের দুর্বলতা কোথায়, মানুষ তাদের ওপর কতটা ক্ষুব্ধ। সামনে সরকারের আড়াই বছর আছে। এই সময়ে ভুল ও দুর্বলতাগুলো সংশোধনের চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনেরা কখনোই নিজেদের দুর্বলতা-ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না। এটি এক মহাব্যাধি।
বর্তমানে সংবিধান সংশোধন তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিয়েছেন। সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে এই চ্যালেঞ্জটিও নিতে পারে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কথা কেবল মুখে বললে মানুষ বিশ্বাস করবে না। কাজে প্রমাণ দিতে হবে এবং তার মোক্ষম সুযোগ হলো অবিলম্বে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
সরকার ঢাকার দেড় কোটি মানুষকে তাদের ন্যায়সংগত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। অবিলম্বে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হোক। বিরোধী দল যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ তুলেছে, আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, তারও মোক্ষম জবাব হবে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তফসিল ঘোষণা করলে সবাই নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়বে, তখন বিরোধী দলের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি গুরুত্ব হারাবে।
নির্বাচন না দিয়ে সরকার আরেকটি কাজ করতে পারে, সেটি হলো সাদেক হোসেনকে আমৃত্যু মেয়র পদে রাখার জন্য জাতীয় সংসদে একটি বিল আনা। সংসদে তাদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তা ছাড়া এ রকম একটি বিলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিএনপির সাংসদেরাও হ্যাঁ ভোট দেবেন।
সরকার কোনটি করবে, তা নীতি-নির্ধারকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। তবে একটি কথা জোর দিয়ে বলা যায়, তারা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিতে যত গড়িমসি করবে, জনমত ততই বিপক্ষে যাবে।
sohrab03@dhaka.net
No comments