বন্যরা যে কারণে বনে সুন্দর by জামান সরদার

গত রোববার নয়াদিলি্লতে দ্বিতীয় দফায় অনশনে বসেছিলেন আন্না হাজারে। ভারতীয় এই নাগরিক সমাজ নেতার কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। কিন্তু তাকে উপলক্ষ করে আরও কিছু বিস্মৃত বিষয় মনে পড়ে গেল। তিনি গত বছর যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ কয়েকটি ইস্যুতে অনশনে বসেছিলেন, তার ঢেউ সীমান্তের এ পারেও লেগেছিল।


কেবল সংবাদমাধ্যমে নয়, সংবাদ ও বিশ্লেষণ নয়। বহুল আলোচিত সুশীল সমাজের একটি অংশ তাকে অনুসরণ করে অনশন ও অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি দিয়েছিল। মাসতিনেক বিরতি দিয়ে আন্না হাজারে আবার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন। সে সূত্র ধরে আমাদের সেই আন্দোলনের খবরও যদি কারও জানতে ইচ্ছা করে, দোষ দেওয়া যায়?
ওদিকে কেবল গত রোববার নয়াদিলি্লতে নয়, ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে মুম্বাইতেও অনশনে বসেছিলেন আন্না হাজারে। কিন্তু আগের মতো সাড়া মেলেনি। তাকে ঘিরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ভিড় আগেরবার দেখা গিয়েছিল, এবার যেন তার ছিটেফোঁটা মেলেনি। 'টিম আন্না'খ্যাত বিভিন্ন পেশায় খ্যাতিমান নাগরিকদেরও অনশনে যোগ দেওয়ার বদলে অন্য কাজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। তার মানে, আন্না হাজারেকে ঘিরে প্রত্যাশার যে রঙিন বেলুন ফুলে উঠেছিল, সেটা কি ফুটো হয়ে গেছে?
বুধবারের আনন্দবাজারের ভাষ্য, রাজনীতিকদের মারপ্যাঁচে হেরে গেছেন আন্না। লোকপাল বিল আটকে থাকায়, রোববারের অনশন কর্মসূচি থেকে টিম আন্নার ভগ্নাংশ থেকে লোকসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে, তাতে কিছু 'আপত্তিকর' শব্দও ছিল। সে নিয়ে লোকসভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। আমাদের তুলনায় বিষয়টি কৌতুককর বটে। এখানে দেখা যাচ্ছে, সংসদের ভাষা নিয়ে নাগরিক সমাজ উদ্বিগ্ন। আর ভারতে নাগরিক সমাজের ভাষা নিয়ে সংসদে নিন্দা। তবে আনন্দবাজার জানাচ্ছে, সেই 'ঔদ্ধত্যে'র জবাবে লোকসভা থেকে সতর্কবার্তা পাঠানো হলেও আন্না ও তার টিম যাতে 'বীরের' মর্যাদা না পান, সে জন্য লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। নাম উল্লেখ পর্যন্ত না করে স্পিকার শুধু বলেছেন, 'গোটা দেশের দৃষ্টিভঙ্গি সংসদে প্রতিফলিত হয়। তাই সংসদের মর্যাদা খাটো করতে পারে, এমন মন্তব্য অভিপ্রেত নয়।' বিশ্লেষকরা বলছেন, পাতলা জমায়েত কেবল নয়, টিম আন্নার ভাষাতেও স্পষ্ট হচ্ছে যে ওই নাগরিক আন্দোলনের দম ফুরিয়েছে। কে না জানে যে পায়ের তলায় মাটি যত নরম হতে থাকে, মুখের ভাষা তত কঠিন হয়ে ওঠে।
কেন এবং কীভাবে আন্না হাজারেকে কোণঠাসা করা হয়েছে? প্রথমটি ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন। আন্না হাজারের প্রাথমিক লক্ষ্য যদিও কেবল কংগ্রেস ছিল, তাতে বিপদের আঁচ পেয়েছিল সব রাজনৈতিক দলই। এমনকি আন্না হাজারে যে রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ ছিল সেই বিজেপিও। গত বছর তিনি যখন কংগ্রেস বিরোধিতায় মুখর, তখনই তার হাত থেকে বিরোধী রাজনীতির লাগাম ছিনিয়ে নিতে রথযাত্রায় বেরিয়েছিলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। অন্যদিকে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আরএসএস-বিজেপির সঙ্গে আন্নার ঘনিষ্ঠতার কথা প্রচার করা হয়েছে জোরেশোরে। কংগ্রেস, বিজেপি তো বটেই, তখন দিলিল্গতে এক সংবাদমাধ্যমের 'সেরা রাজনীতিক'-এর পুরস্কার নিতে এসে মঞ্চে আন্নাকে দেখামাত্রই চলে গিয়েছিলেন ওপারের দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার লোকসভায় সব রাজনৈতিক দল ভেদাভেদ ভুলে আক্রমণ শানিয়েছে আন্নার বিরুদ্ধে।
এসব রাজনীতির হিসাব। সমর্থকরা কোথায় গেল? আসল সংকট বোধহয় অন্যত্র। আন্না নাগরিক সমাজের সীমারেখা অতিক্রম করে রাজনীতিকের ভূমিকা নিতে গিয়েছিলেন। কথায় আছে, গণতন্ত্র রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে প্রয়োজন আরও বেশি গণতন্ত্র। কথাটি যে রাজনীতির ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য, ভারতীয় নাগরিক নেতা আন্না হাজারে তা আরেকবার প্রমাণ করলেন। আর আমাদের দেশে তো রাজনীতির বাইরে থেকে
রাজনীতিকে শোধরানোর চেষ্টা বহুবারই ব্যর্থ হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.