কালের পুরাণ-দেশ চালাচ্ছে কে? by সোহরাব হাসান
এত দিন আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে যে মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করত, সেই অস্ত্রটিই এবার বিএনপি আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সরকার কারা চালাচ্ছে? গোয়েন্দারা কি সরকার চালাচ্ছে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদেরা দেশ চালাচ্ছেন না।’
আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, বিএনপি সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট দল। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান গোয়েন্দা বিভাগকে কাজে লাগিয়ে দেশ চালিয়েছেন, দল গঠন করেছেন এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ভাগিয়ে নিয়েছেন। সামরিক শাসকেরা যেহেতু অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় আসেন, সেহেতু গোয়েন্দা বিভাগ ও আমলাদের ওপরই নির্ভর করেন। কিন্তু বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারও যদি তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়, সেটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। ৬৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী দলটির জন্য বড্ড বেমানান।
২৭ মার্চ রূপসী বাংলা হোটেলে (সাবেক শেরাটন) বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনুষ্ঠান নিয়ে আসলে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে সরকার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখও বন্ধ। বিএনপির মুখে যা শুনেছি তার সারমর্ম হলো, সাংবাদিক শফিক রেহমানের পাঁচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সংগঠন জি-৯ রূপসী বাংলা হোটেলের বলরুম ভাড়া করেছিল। কিন্তু সোমবার রাতে হোটেলের একজন কর্মকর্তা তাঁকে জানিয়ে দেন, অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হবে না। খুদে বার্তায় ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ‘স্যার, কয়েক মিনিট আগে মোবাইল ফোনে আমি আপনাকে বলেছি যে, আমরা আপনাদের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতে পারছি না। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট অব বাংলাদেশ থেকে নির্দেশিত হয়ে আপনাকে এটা অবহিত করছি। আমরা এ জন্য দুঃখিত।’
খালেদা জিয়া কেবল বিএনপির চেয়ারপারসন নন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলেরও নেতা। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদলীয় নেতাকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করা হয়। তাঁর কোনো অনুষ্ঠান এভাবে গোয়েন্দা সংস্থা বাতিল করতে পারে না।
এ কথা ঠিক, খালেদা জিয়া যেদিন নিজের ও তাঁর স্বামীর জীবন ও কর্মের ওপর লিখিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সময় নির্ধারণ করেছেন, সেদিন সেই হোটেলে অনেক সম্মানিত বিদেশি নাগরিক ছিলেন। তাঁরা এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য দেওয়া সম্মাননা গ্রহণ করতে। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সরকারের। গোয়েন্দা বিভাগের কাছে বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো খবর থাকলে সরকারকে জানাবে। সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। প্রথমে তারা বিরোধীদলীয় নেতাকে অনুষ্ঠান পেছানোর অনুরোধ জানাবে। সেই অনুরোধ রাখা না হলে সরকার প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বা সংবাদ সম্মেলন করে কেন অনুষ্ঠান বাতিল করা হলো তা ব্যাখ্যা করবে। এটিই হলো একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
কিন্তু গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব নেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, দেশটা চালাচ্ছে কে? সরকার কার ওপর নির্ভরশীল—জনগণ না গোয়েন্দা বিভাগ? সংশ্লিষ্ট মহলকে মনে করিয়ে দিতে চাই, গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কারণেই দেশের দু-দুজন রাষ্ট্রপতি নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
এর আগে ২৬ মার্চ ভোরে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতেও বাধা দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। তাঁর বাড়ির চারপাশে নাকি ট্রাক ফেলে বাইরে যাওয়ার পথ বন্ধ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিরোধীদলীয় নেতার শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ছিল সকাল সাড়ে ছয়টা। সে ক্ষেত্রে সরকার তাঁকে বলতে পারে, নির্ধারিত সময়ের আগে আপনি সেখানে যাবেন না। কিন্তু তিনি কখন বাড়ি থেকে বের হবেন, কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন, সেসব নিশ্চয়ই সরকার ঠিক করে দিতে পারে না। বাড়ি থেকে কে কখন বের হবেন বা বাড়িতে ঢুকবেন, সেটি দেখার দায়িত্ব পুলিশের নয়।
স্বাধীনতার মাসে আমরা বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের জন্য সম্মাননা জানাতে। তাঁরা এলেন, সম্মাননাও নিলেন। কিন্তু তাঁরা যে দেশটির অভ্যুদয়ে জড়িত ছিলেন, যে দেশটি নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ও আবেগ আছে, ৪০ বছর পর সেই দেশটিতে এসে কী দেখলেন, কী শুনলেন? তাঁরা দেখলেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাদা-ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা নেই (বিদেশি নাগরিকদের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের কেউ যাননি)। সংসদে এক নেত্রী উপস্থিত থাকলে অপর নেত্রী গরহাজির থাকেন। জনসভায় তাঁরা একে অপরকে বিদেশের দালাল বলে গালাগাল করে আনন্দ পান।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সেদিন (বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের খেলার দিন) তিনি ক্রিকেট প্রেমিক হয়ে গেলেন। কাকে তিনি উৎসাহ দিতে মাঠে গেলেন। জীবনে কোনো দিন তাঁকে মাঠে যেতে দেখিনি। আমাদের দল মাত্র দুই রানে হেরেছে। যদি তিনি মাঠে না যেতেন...।’
আমরা যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিক, অন্তর্দ্রষ্টা নন। কার অন্তরে কী আছে, সেটি তিনি কী করে জানলেন? খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের রাজনীতি নিয়ে হাজারো সমালোচনা তিনি করতে পারেন। আমরাও করি। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ কেন? ঢিল ছুড়লে যে পাটকেল খেতে হয়, সদ্যসমাপ্ত সংসদ অধিবেশনই তার প্রমাণ। রাজনীতিকে বিদ্বেষ ও কলুষমুক্ত করতে হলে শুরুটা আসতে হবে শীর্ষ পর্যায় থেকেই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
২৭ মার্চ রূপসী বাংলা হোটেলে (সাবেক শেরাটন) বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনুষ্ঠান নিয়ে আসলে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে সরকার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখও বন্ধ। বিএনপির মুখে যা শুনেছি তার সারমর্ম হলো, সাংবাদিক শফিক রেহমানের পাঁচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সংগঠন জি-৯ রূপসী বাংলা হোটেলের বলরুম ভাড়া করেছিল। কিন্তু সোমবার রাতে হোটেলের একজন কর্মকর্তা তাঁকে জানিয়ে দেন, অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হবে না। খুদে বার্তায় ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ‘স্যার, কয়েক মিনিট আগে মোবাইল ফোনে আমি আপনাকে বলেছি যে, আমরা আপনাদের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতে পারছি না। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট অব বাংলাদেশ থেকে নির্দেশিত হয়ে আপনাকে এটা অবহিত করছি। আমরা এ জন্য দুঃখিত।’
খালেদা জিয়া কেবল বিএনপির চেয়ারপারসন নন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলেরও নেতা। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদলীয় নেতাকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করা হয়। তাঁর কোনো অনুষ্ঠান এভাবে গোয়েন্দা সংস্থা বাতিল করতে পারে না।
এ কথা ঠিক, খালেদা জিয়া যেদিন নিজের ও তাঁর স্বামীর জীবন ও কর্মের ওপর লিখিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সময় নির্ধারণ করেছেন, সেদিন সেই হোটেলে অনেক সম্মানিত বিদেশি নাগরিক ছিলেন। তাঁরা এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য দেওয়া সম্মাননা গ্রহণ করতে। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সরকারের। গোয়েন্দা বিভাগের কাছে বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো খবর থাকলে সরকারকে জানাবে। সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। প্রথমে তারা বিরোধীদলীয় নেতাকে অনুষ্ঠান পেছানোর অনুরোধ জানাবে। সেই অনুরোধ রাখা না হলে সরকার প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বা সংবাদ সম্মেলন করে কেন অনুষ্ঠান বাতিল করা হলো তা ব্যাখ্যা করবে। এটিই হলো একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
কিন্তু গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব নেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, দেশটা চালাচ্ছে কে? সরকার কার ওপর নির্ভরশীল—জনগণ না গোয়েন্দা বিভাগ? সংশ্লিষ্ট মহলকে মনে করিয়ে দিতে চাই, গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কারণেই দেশের দু-দুজন রাষ্ট্রপতি নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
এর আগে ২৬ মার্চ ভোরে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতেও বাধা দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। তাঁর বাড়ির চারপাশে নাকি ট্রাক ফেলে বাইরে যাওয়ার পথ বন্ধ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিরোধীদলীয় নেতার শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ছিল সকাল সাড়ে ছয়টা। সে ক্ষেত্রে সরকার তাঁকে বলতে পারে, নির্ধারিত সময়ের আগে আপনি সেখানে যাবেন না। কিন্তু তিনি কখন বাড়ি থেকে বের হবেন, কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন, সেসব নিশ্চয়ই সরকার ঠিক করে দিতে পারে না। বাড়ি থেকে কে কখন বের হবেন বা বাড়িতে ঢুকবেন, সেটি দেখার দায়িত্ব পুলিশের নয়।
স্বাধীনতার মাসে আমরা বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের জন্য সম্মাননা জানাতে। তাঁরা এলেন, সম্মাননাও নিলেন। কিন্তু তাঁরা যে দেশটির অভ্যুদয়ে জড়িত ছিলেন, যে দেশটি নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ও আবেগ আছে, ৪০ বছর পর সেই দেশটিতে এসে কী দেখলেন, কী শুনলেন? তাঁরা দেখলেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাদা-ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা নেই (বিদেশি নাগরিকদের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের কেউ যাননি)। সংসদে এক নেত্রী উপস্থিত থাকলে অপর নেত্রী গরহাজির থাকেন। জনসভায় তাঁরা একে অপরকে বিদেশের দালাল বলে গালাগাল করে আনন্দ পান।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সেদিন (বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের খেলার দিন) তিনি ক্রিকেট প্রেমিক হয়ে গেলেন। কাকে তিনি উৎসাহ দিতে মাঠে গেলেন। জীবনে কোনো দিন তাঁকে মাঠে যেতে দেখিনি। আমাদের দল মাত্র দুই রানে হেরেছে। যদি তিনি মাঠে না যেতেন...।’
আমরা যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিক, অন্তর্দ্রষ্টা নন। কার অন্তরে কী আছে, সেটি তিনি কী করে জানলেন? খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের রাজনীতি নিয়ে হাজারো সমালোচনা তিনি করতে পারেন। আমরাও করি। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ কেন? ঢিল ছুড়লে যে পাটকেল খেতে হয়, সদ্যসমাপ্ত সংসদ অধিবেশনই তার প্রমাণ। রাজনীতিকে বিদ্বেষ ও কলুষমুক্ত করতে হলে শুরুটা আসতে হবে শীর্ষ পর্যায় থেকেই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments