ঢাকার চারপাশে শিল্প-কারখানায় গ্যাস রেশনিং- এতে কি অবস্থা সামাল দেয়া যাবে?


বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহে সঙ্কট দেখা দিলেও এবং এ সঙ্কট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করলেও গ্যাস রেশনিং করে সঙ্কটের তীব্রতা লাঘবের চেষ্টা আগে কখনও হয়নি। কিন্তু এবার হচ্ছে। পেট্রোবাংলা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তিতাসের আওতাধীন রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরকে ৭টি অঞ্চলে ভাগ করে গ্যাস রেশনিং করা হবে।
এসব অঞ্চলে সপ্তাহে একদিন করে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এই গ্যাস রেশনিং চালু হচ্ছে বুধবার থেকে। নতুন সিদ্ধান্ত মোতাবেক বুধবার নরসিংদী থেকে ঘোড়াশাল, ভালুকা, জিঞ্জিরা, মুন্সীগঞ্জ ও তিতাসের বাড্ডা জোন; বৃহস্পতিবার সোনারগাঁও ও তিতাসের মিরপুর জোন; শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও টাঙ্গাইল; শনিবার তিতাসের টিকাটুলি ও মতিঝিল জোন; রোববার সাভার; সোমবার গাজীপুর (জয়দেবপুর থেকে মাওনা), মনিকগঞ্জ ও তিতাসের লালমাটিয়া জোন; মঙ্গলবার টঙ্গী, গাজীপুর (জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল) ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। গ্যাস বন্ধের দিন সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে। পেট্রোবাংলা আশা করছে, রেশনিংয়ের ফলে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হবে। তা দিয়ে আবাসিক এলাকার গ্যাস সঙ্কট কিছুটা কমবে। পেট্রোবাংলার এই আশা পূরণ হলে গ্যাসের চুলায় আগুনের শিখা বর্তমানের মিটিমিটি অবস্থা থেকে কিছুটা উজ্জ্বল হতে পারে। কিন্তু তাতে শিল্প-কারখানার গ্যাস সঙ্কটের তো কোনো সমাধান হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলা কার্যালয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রতিনিধিরা পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা গ্যাস সঙ্কট গত দু’সপ্তাহ যাবত্ তীব্রতর হওয়ায় তাদের শিল্পে যে নাভিশ্বাস দশার সৃষ্টি হয়েছে, সে কথা জানিয়ে তারা গিয়েছিলেন গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে দেন-দরবার করতে। তাদের দাবি, প্রয়োজনে দু’তিনটি সার কারখানা বন্ধ রেখে হলেও এসব কল-কারখানায় গ্যাস বরবরাহ বাড়ানো হোক। নইলে দেশের বস্ত্র ও পোশাক শিল্প একেবারে ধসে পড়বে। তাদের এই দাবির বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টার বদলে যদি সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখা হয়, তবে তাতে বস্ত্র ও পোশাক খাতের অন্তত কোনো লাভ হচ্ছে না। এতে গৃহস্থালী খাতেরও কতটুকু উপকার হয়, তা কিছুদিনের মধ্যেই জানা যাবে।

তবে এ ব্যাপারটা সবার মাথায় রাখতে হবে যে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতিজনিত সমস্যা একটি সার্বিক সঙ্কট। এখান থেকে ওখানে সরবরাহ কমিয়ে এবং বাড়িয়ে এ সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। মোটা দাগে যে বিপদগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে হেঁসেলে চুলা জ্বলছে না, ফিলিং স্টেশনগুলোতে ঠিকমত গ্যাস না পাওয়ায় সিএনজিচালিত বাহনগুলো নিয়ে ব্যবহারকারীরা ভীষণ বিপদে পড়েছেন, বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে টলমল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সার কারখানাগুলো কোনোটা আংশিক ও কোনোটা পুরোপুরি বন্ধ রাখায় কৃষি খাতে নতুন সঙ্কট দেখা দিতে যাচ্ছে, কয়েকটি বিদ্যুত্ কেন্দ্র বন্ধ রাখায় দৈনিক দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কম উত্পন্ন হচ্ছে। এগুলো প্রত্যেকটি অত্যন্ত প্রকট সমস্যা এবং অবিলম্বে এসব সমস্যার সমাধান দরকার। তার জন্য গ্যাসের উত্পাদন বাড়াতে হবে এবং গ্যাসের ওপর চাপ কমানোর জন্য বিকল্প জ্বালানি অধিক হারে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কথাগুলো আমরা আমাদের সম্পাদকীয় মন্তব্যে বহুবার বলেছি এবং আবারও বলছি। এছাড়া বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। এখন স্থলভাগে যেসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, নতুন কূপ বসিয়ে সেসবগুলোয় উত্তোলনের পরিমাণ বাড়ানো যায় কিনা, সে উদ্যোগ অবিলম্বে নেয়া দরকার। পাশাপাশি আমাদের বিদ্যুত্ উত্পাদন ব্যবস্থায় প্রায় শতভাগ গ্যাসনির্ভরতা অবশ্যই কমাতে হবে। এ নির্ভরতা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এর জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সবক্ষেত্রে রেশনিং কাজ দেয় না। আধপেটা খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে; কিন্তু যন্ত্রের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ অচল।

No comments

Powered by Blogger.