ছাত্ররাজনীতি-আবার শিরোনামে ছাত্রলীগ by মাহমুদুর রহমান মান্না

আবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। গত ২৭ এপ্রিল ‘নিজ সমর্থকদের কোপালেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা’ শিরোনামে প্রথম আলো লিখেছে, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের রণহুংকার, আহতের আর্তনাদ, চাপাতি-রামদার ঝনঝনানি আর গুলির শব্দে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে ঘুম ভাঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের


ছাত্রদের। সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চর দখলের কায়দায় এই উন্মত্ততা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সাধারণ ছাত্ররা। হলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছাত্রলীগের কর্মীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়েছেন নিজ সংগঠনের কর্মীদের। কেটে দিয়েছেন অনেকের হাত-পায়ের রগ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আমজাদ আলী বলেন, আহত ৪৪ জনকে হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিন মাহি ও লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মারুফ হাসানকে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। মাহির হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। তাঁর গায়ে গুলিও লেগেছে।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটাই সম্ভবত অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের ঘটনা। ইতিপূর্বে এই সরকারের আমলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের রেশ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র স্যার এ এফ রহমান হলের আবু বকর খুন হয়েছিলেন। মুহসীন হলের এই ঘটনায় কেউ মারা যাননি সত্যি, কিন্তু এই ঘটনায় যেভাবে উভয় পক্ষ যুদ্ধে নেমেছে, তা সচরাচর মুম্বাই ছবির দৃশ্যে দেখে থাকি আমরা। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, সোমবার রাতেই উত্তেজনা দেখে হল কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম হলের নেতাদের নিয়ে রাত দেড়টায় সভায় বসে। হলের বাইরে মোতায়েন করা হয় পুলিশ। প্রায় তিন ঘণ্টা সভা চলে। সবাইকে সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে মতৈক্যে পৌঁছানোর পর সাড়ে চারটায় সভা শেষ হয়। পুলিশ, প্রক্টোরিয়াল টিম ও হল কর্তৃপক্ষ চলে যায়। এর আধা ঘণ্টা পরই শুরু হয় সংঘর্ষ।
একানব্বইয়ে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর এ রকম ভয়াবহ একটি সংঘর্ষ হয়েছিল ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। মুম্বাই সিনেমার কায়দায় রাতের বেলা হলের পাইপ বেয়ে ভেতরে ঢুকে এবং বাইরে থেকে গোলাগুলি করে এক পক্ষ হামলা চালিয়েছিল আরেক পক্ষের ওপর, যাতে দুজন নিহত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া তখন দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি ছাত্রদলের বিবদমান উভয় গ্রুপকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। তখনকার পত্রিকার সংবাদ দেখে মনে হয়েছিল বিবাদ মিটে গেছে, বেগম জিয়া আশ্বস্ত হয়েছেন। কিন্তু আধিপত্য বিস্তারের লড়াই এত তীব্র ছিল যে মূল দলের চেয়ারপারসনের কথা বিবেচনা করার সময় পায়নি তারা। হায় রে আধিপত্য। হায় রে ক্ষমতা!
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম ক্যাম্পাসসহ আশপাশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় টেন্ডারবাজিতে জড়িত। হলের স্থগিত কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ আলী তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অভিযোগ আছে, একপর্যায়ে মুহাম্মদ আলী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদের কথা শুনতেন না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাদের মদদে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে হলে মাহির উত্থান হয়। মাহির পক্ষ শক্তিশালী হওয়ায় ভবিষ্যতে টেন্ডারবাজি ও হল নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হতে পারে—এ আশঙ্কায় ভুগতে থাকেন হল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। আর এ কারণেই সাবেক নেতা শফিকের নির্দেশে একজোট হয়ে তাঁরা মাহির কর্মীদের ওপর হামলা করেন।
কে এই শফিক? বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শফিক। তিনি ২০০০ সালের ২৬ জুন শিক্ষা ভবনে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে গুলি চালালে সেখানকার পাঁচ কর্মচারী আহত হন। এতে ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা শফিকসহ ছাত্রলীগের চার ক্যাডারকে আটক করে পিটুনি দেন। শফিকের কাছ থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছবিসহ প্রকাশিত হয়। জানা যায়, শফিক এর আগে আরও দুটি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেগুলোর সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পর্ক আদর্শিকভাবে সাংঘর্ষিক।
শাহবাগ থানার সূত্র জানায়, চারদলীয় জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চুপ থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার টেন্ডারবাজি শুরু করেন শফিক। তাঁর হয়ে টেন্ডারবাজিতে অংশ নিতেন মুহসীন হল ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি শেখ মুহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিনের কর্মীরা। বিনিময়ে শফিক নিয়মিত তাঁদের টাকা দিতেন।
জানা যায়, কয়েক দিন আগেও মুহসীন হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল এবং তাঁদের দুই গ্রুপের মধ্যে দু-একটি সংঘর্ষও হয়েছিল। এখন মাহির উত্থানে শফিকের পরামর্শে তাঁরা এক হয়ে যান। কারণ, সামনে আছে মোট ২১ কোটি টাকার টেন্ডার। ২৬ তারিখ দিবাগত রাতের সংঘর্ষের মূল কারণ সেটিই।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত যত সংঘাত, কোপাকুপির ঘটনা ঘটেছে, তার মূলে যে আধিপত্যবাদ ও টেন্ডারবাজি, এ কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়াবহ ছাত্র সংঘর্ষের পর এ কথা স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তখন হলের ছাদ থেকে ছাত্রকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে যে সংঘর্ষ হয়েছিল, তার কথা এখনো কেউ বিস্মৃত হয়নি। এ এফ রহমান হলের বকর মারা যাওয়ার সময়ও বোঝা গিয়েছিল, এটা ছিল আধিপত্যের জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দল। না হলে ছাত্রলীগ তার হল শাখা এবং তার নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিল কেন?
গত আড়াই বছরে মানুষ দুশ্চিন্তায় পড়েছে ছাত্রদের নিয়ে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। ছাত্ররা কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? আমাদের ভবিষ্যৎ কী? আমি এ কথা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করব না যে যখনই এ রকম ঘটনা ঘটছে, তখনই ছাত্রলীগ, মূল দল আওয়ামী লীগ অথবা সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা মুহসীন হলের ঘটনায় তাঁর ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এসব ব্যবস্থা কি কোনো কাজ দিয়েছে? একটি কমিটি বাতিল করে দেওয়া (সেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বা স্যার এ এফ রহমান হল যেটাই হোক) বা দু-চারজন নেতার বহিষ্কার কি পরবর্তী ঘটনা ঠেকাতে পেরেছে? আজ মুহসীন হলের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা কি আমাদের গ্যারান্টি দিতে পারবে যে এরপর আর এ রকম ঘটনা ঘটবে না? টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি চিরতরে বন্ধ হবে? আমরা জানি, পারবে না।
আমি খুব দৃঢ়ভাবেই বলছি, পারবে না। কারণ, সংঘর্ষটি অসুখ নয়, অসুখের প্রকাশ। অসুখ হলো সংগঠনের, রাজনীতিতে। আমরা কি বলতে পারি, মুহসীন হল একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ? নাকি সব হলই এখন মুহসীন হল? আমরা কি বলতে পারি, শফিকও একজন ব্যক্তি মাত্র? নাকি এ রকম অনেক শফিক আছেন ছাত্রলীগে? কিংবা ছাত্রদলে? আমি বলছি, এ রকম থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এ রকম আগেও ছিল। ঊনসত্তরের সেই বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও। সেই সময় ১৯৬৯ সালের ৪ মার্চ, মঙ্গলবার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় সভাপতির ভাষণে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সংগ্রাম পরিষদের নামে বিভিন্ন লোক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। এসব ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
ঊনসত্তরে বলতে গেলে কোনো সরকার ছিল না। বলা যায়, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদই তখন সরকারে ছিল। তোফায়েল আহমেদের বক্তৃতাতেই চাঁদাবাজেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, তোফায়েল আহমেদ একা ছিলেন না। সমস্ত ছাত্রনেতা এবং গোটা ছাত্রসমাজ তাঁর সঙ্গে ছিল। এবং সেই ছাত্রসমাজের সামনে স্থির একটি লক্ষ্য ছিল বাঙালির স্বাধিকার, প্রায় ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি। তাই তাঁর এক বক্তৃতাতেই হয়তো কাজ হয়েছে। আজ হচ্ছে না। কেন? অনেক শক্ত শক্ত কথা বলছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবু কাজ হচ্ছে না। কেন? কারণ, ছাত্রদের সামনে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। তাঁদের মনে হচ্ছে না জাতীয় রাজনীতিতে কোনো অঙ্গীকার আছে। তাঁরা দেখছে, নেতা-নেত্রীরা যা বলছেন, বাস্তবে তার কোনো চর্চা নেই। দীর্ঘদিনের নিঃস্বার্থ ত্যাগী ছাত্রনেতারা বয়স ফায়ারে পরিচয়হীন হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের অন্য কোনো কমিটিতে জায়গা হচ্ছে না। তাঁরা নমিনেশন পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা এবং নতুন আমলা। বর্তমান ছাত্রনেতাদের প্রণোদনা কোন দিকে যাবে?
এ অবস্থা থেকে ছাত্রসংগঠনকে বের করে আনতে পারেন দুই নেত্রী, বিশেষত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আজ ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য, আদর্শ ও লক্ষ্য কী, দেশের দুই মূল নেত্রীকে সেটাই স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। নিজেদের স্পষ্ট করতে হবে, তাঁরা কোনো বাছবিচার করেন না, সব ছাত্রকে নিজের ছেলের মতো দেখেন। তাঁদের সবার জন্য একইভাবে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে চান। এই ছাত্ররা তাঁদের ছেলের মতোই, তাঁদের চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ হতে দেবেন না। তাঁরা ছাত্রদের ধ্বংস হয়ে যেতে দেবেন না।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.