নারী উন্নয়ন নীতি-বিরোধিতাকারীদের আসল উদ্দেশ্য কী by বদিউল আলম মজুমদার
সরকার ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে সারা দেশে একটি চরম অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। নারীনীতিকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী দাবি করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগণকে এর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলছে। এমনকি তারা নারীনীতির বিরুদ্ধে হরতালও পালন করেছে।
কিন্তু অনেকেই জানেন না কী তাদের বক্তব্য? কী তাদের যুক্তি? কী কারণে তারা নারীনীতির বিরোধিতা করছে?
বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) নেতারা হরতালের আগে প্রদত্ত এক বক্তব্যে বলেন: ‘এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার কৌশল হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে।...সিডও সনদে নারীদের উত্থাপন করা হয়েছে ইউরোপীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবনধারা ও ইসলামি সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি।...আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি অবলম্বনে বাধ্য করার নীরব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।...নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপীয় নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে, অতএব নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ করা হয়নি।...ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোরআনের বিরুদ্ধাচরণ প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লঙ্ঘন হওয়ার কারণে কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারীনীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে...যা এখন ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে।...সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান অংশ প্রদানের সুযোগ রাখা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী। তা ছাড়া নারীনীতির...ধারাসমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যেকোনো ব্যক্তির দ্বারা উত্তরাধিকারে নারী পুরুষের সমান পাবে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে...সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে পুঁজি করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও সমতার ব্যাখ্যা করবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?’ (সংগ্রাম, ৩ এপ্রিল ২০১১)
উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে বেফাকের নারীনীতির বিরোধিতার চারটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়: ১. নারীনীতি মুসলিম সংস্কৃতির পরিবর্তে পশ্চিমা সংস্কৃতি অবলম্বনে নারীদের বাধ্য করার কৌশলমাত্র। ২. নারীনীতি আমাদের বিরাজমান পারিবারিক সম্প্রীতি ধ্বংস করে দেবে। ৩. নারীনীতির কয়েকটি ধারাকে পুঁজি করে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হতে পারে। ৪. নারীনীতিতে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে।
নারীনীতির বিরোধিতার পেছনের প্রথম তিনটি কারণ নিতান্তই তাদের আশঙ্কা। আমাদের নারীদের পশ্চিমাদের মতো ‘উচ্ছৃঙ্খল’ হওয়ার বিষয়ে আসা যাক। বিরোধিতাকারীদের ভয়, বর্তমান নারীনীতিতে আমাদের নারীদের উচ্ছৃঙ্খল হতে প্রণোদিত করার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু না থাকলেও এটি বাস্তবায়িত হলে তা ঘটে যেতে পারে। এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ভয়, যার সঙ্গে নারীনীতির কোনো যোগসূত্রতা নেই। আর আমাদের নারীদের পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হলে তাঁদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাতালপুরে আটকে রাখতে হবে—তাঁদের বাইরে যাওয়া, লেখাপড়াসহ সবকিছু বন্ধ করে দিতে হবে। নারীনীতির বিরোধিতাকারীরা কি তাঁদের পরিবারের ক্ষেত্রে তা করছেন কিংবা করতে প্রস্তুত?
নারীর প্রতি সহিংসতা, বঞ্চনা, যৌতুক ইত্যাদির যে করুণ কাহিনি আমরা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারি, তা কি আমাদের সামাজিক সম্প্রীতির প্রতিফলন? রাস্তাঘাটে মেয়েদের হয়রানি কি আমাদের ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুর পারিবারিক বন্ধনের প্রতিফলন নয়? আর সম্পর্ক যেখানে কর্তা-অধস্তনের, সেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সাধারণত বিরাজ করে না, সেখানে সত্যিকারের সম্প্রীতিও সচরাচর সৃষ্টি হয় না।
নারীনীতির ঘোর বিরোধীরাও বলবেন না যে এতে নারী-পুরুষের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নারীনীতির তো বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতেই পারে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য তাফসির বিদ্যমান। ইসলামের চারটি মাজহাব—হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি—বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভিন্ন ব্যাখ্যারই প্রতিফলন। এ ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নিসহ আরও অনেক বিভাজন রয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মের অনেক স্রোত রয়েছে, যার কোনোটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, আবার অন্যগুলো অনেক উদারপন্থী ও প্রগতিশীল। নারীনীতি বিরোধিতাকারীরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ঘরানার অন্তর্ভুক্ত।
বেফাকের আরেকটি বিরোধিতার কারণ হলো যে নারীনীতিতে পর্দার কথা বলা নেই। বস্তুত, পোশাক বহুলাংশে নির্ভর করে জলবায়ু ও সংস্কৃতির ওপর। তবে সব পোশাকই শালীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া নারীনীতিতে তো কাউকে পর্দা করতে নিষেধ করা হয়নি।
নারীনীতির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে নারীর অধিকারের প্রতি অনুদার। বস্তুত তাঁরা ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, যদিও ইসলাম নারীর সম-অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। মহানবী (সা.) বিদায়ী হজের বাণীতে সবাইকে স্মরণ করে দিয়ে গেছেন: ‘সাবধান! তাদের ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার রয়েছে, তাদেরও তোমাদের ওপর ততটুকুই অধিকার রয়েছে।’
অতীতের মতো নারীনীতির বর্তমান বিরোধিতাকারীরাও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন, যদিও আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তা করতে নিষেধ করেছেন। বাড়াবাড়ির কারণে তাঁদের ধারণা, এটি ‘অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজে’র (ওআইসি) ঘোষণারও পরিপন্থী। ১৯৯০ সালে ওআইসি ঘোষিত কায়রো ডিক্লারেশন অন হিউম্যান রাইটস ইন ইসলাম। ওআইসি ফিকাহ একাডেমির (Cairo Declaration on Human Rights in Islam. OIC Fiqh Academy) বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতির ভিত্তিতে রচিত এ ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: (ক) আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্ম বিশ্বাস, রাজনৈতিক আনুগত্য, সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান।...খ. প্রতিটি মানুষ আল্লাহর অধীন। সেসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তাঁর সব সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু ধর্মপরায়ণতা ও সৎ কর্মের ভিত্তি ছাড়া একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।
এ ছাড়া ওআইসি ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৬(ক)-তে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশ পরিচয় বজায় রাখার অধিকার। তাই নারীনীতির বিরোধিতাকারীদের অবস্থান মূল ধারার ইসলামিক চিন্তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। কারণ, ইসলাম নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের স্বীকৃতি দেয়।
এ ছাড়া নারীনীতি রাষ্ট্রে প্রচলিত আইনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানের ১০, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর সম-অধিকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ এ ছাড়া সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ তাই এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সংবিধানে সমাজে নারী-পুরুষের সমতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে আদালতের রায়ও রয়েছে।
প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনার পরিণতিও অত্যন্ত অমঙ্গলকর। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিসেফের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে দক্ষিণ এশিয়ার পুষ্টিহীনতার নজিরবিহীন উচ্চহারের শেকড় এসব দেশের সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের বৈষম্যে গভীরভাবে প্রোথিত আর বহু রোগ-ব্যাধির উৎস পুষ্টিহীনতা। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তি লোপ পায় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তাই নারীর প্রতি বৈষম্যের মাশুল পুরো জাতিকেই দিতে হয়।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে নারীনীতির বিরোধীদের অবস্থান আমাদের সংবিধান, বিদ্যমান আইন, আদালতের নির্দেশ, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া নারীনীতি নিয়ে তাঁদের সংশয় কল্পনাপ্রসূত এবং তাঁরা বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত। তাঁরা যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগাচ্ছেন। উপরন্তু ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের মতামত একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যে দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের মৌলিক সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে না। এ ছাড়া ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের চর্চা এবং মানুষের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কারণে বিশ্বে পুরো মুসলিম সমাজ আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ অবস্থায় ধর্ম সম্পর্কে কট্টর মনোভাবের পরিবর্তে উদারতা ও নিজেদের মধ্যে বিভাজনের পরিবর্তে একতাই হবে আমাদের জন্য উৎকৃষ্টতম পন্থা। তাই নারীনীতি নিয়ে বিতর্ক আত্মঘাতী। আশা করি, নারীনীতির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং তাঁদের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। একই সঙ্গে সরকারও নারীনীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি নারীর অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এর মধ্যে যেসব অস্পষ্টতা রয়েছে তা দূর করবে। এ ছাড়া নারীনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) নেতারা হরতালের আগে প্রদত্ত এক বক্তব্যে বলেন: ‘এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার কৌশল হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে।...সিডও সনদে নারীদের উত্থাপন করা হয়েছে ইউরোপীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবনধারা ও ইসলামি সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি।...আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি অবলম্বনে বাধ্য করার নীরব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।...নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপীয় নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে, অতএব নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ করা হয়নি।...ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোরআনের বিরুদ্ধাচরণ প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লঙ্ঘন হওয়ার কারণে কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারীনীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে...যা এখন ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে।...সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান অংশ প্রদানের সুযোগ রাখা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী। তা ছাড়া নারীনীতির...ধারাসমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যেকোনো ব্যক্তির দ্বারা উত্তরাধিকারে নারী পুরুষের সমান পাবে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে...সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে পুঁজি করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও সমতার ব্যাখ্যা করবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?’ (সংগ্রাম, ৩ এপ্রিল ২০১১)
উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে বেফাকের নারীনীতির বিরোধিতার চারটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়: ১. নারীনীতি মুসলিম সংস্কৃতির পরিবর্তে পশ্চিমা সংস্কৃতি অবলম্বনে নারীদের বাধ্য করার কৌশলমাত্র। ২. নারীনীতি আমাদের বিরাজমান পারিবারিক সম্প্রীতি ধ্বংস করে দেবে। ৩. নারীনীতির কয়েকটি ধারাকে পুঁজি করে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হতে পারে। ৪. নারীনীতিতে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে।
নারীনীতির বিরোধিতার পেছনের প্রথম তিনটি কারণ নিতান্তই তাদের আশঙ্কা। আমাদের নারীদের পশ্চিমাদের মতো ‘উচ্ছৃঙ্খল’ হওয়ার বিষয়ে আসা যাক। বিরোধিতাকারীদের ভয়, বর্তমান নারীনীতিতে আমাদের নারীদের উচ্ছৃঙ্খল হতে প্রণোদিত করার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু না থাকলেও এটি বাস্তবায়িত হলে তা ঘটে যেতে পারে। এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ভয়, যার সঙ্গে নারীনীতির কোনো যোগসূত্রতা নেই। আর আমাদের নারীদের পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হলে তাঁদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাতালপুরে আটকে রাখতে হবে—তাঁদের বাইরে যাওয়া, লেখাপড়াসহ সবকিছু বন্ধ করে দিতে হবে। নারীনীতির বিরোধিতাকারীরা কি তাঁদের পরিবারের ক্ষেত্রে তা করছেন কিংবা করতে প্রস্তুত?
নারীর প্রতি সহিংসতা, বঞ্চনা, যৌতুক ইত্যাদির যে করুণ কাহিনি আমরা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারি, তা কি আমাদের সামাজিক সম্প্রীতির প্রতিফলন? রাস্তাঘাটে মেয়েদের হয়রানি কি আমাদের ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুর পারিবারিক বন্ধনের প্রতিফলন নয়? আর সম্পর্ক যেখানে কর্তা-অধস্তনের, সেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সাধারণত বিরাজ করে না, সেখানে সত্যিকারের সম্প্রীতিও সচরাচর সৃষ্টি হয় না।
নারীনীতির ঘোর বিরোধীরাও বলবেন না যে এতে নারী-পুরুষের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নারীনীতির তো বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতেই পারে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য তাফসির বিদ্যমান। ইসলামের চারটি মাজহাব—হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি—বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভিন্ন ব্যাখ্যারই প্রতিফলন। এ ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নিসহ আরও অনেক বিভাজন রয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মের অনেক স্রোত রয়েছে, যার কোনোটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, আবার অন্যগুলো অনেক উদারপন্থী ও প্রগতিশীল। নারীনীতি বিরোধিতাকারীরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ঘরানার অন্তর্ভুক্ত।
বেফাকের আরেকটি বিরোধিতার কারণ হলো যে নারীনীতিতে পর্দার কথা বলা নেই। বস্তুত, পোশাক বহুলাংশে নির্ভর করে জলবায়ু ও সংস্কৃতির ওপর। তবে সব পোশাকই শালীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া নারীনীতিতে তো কাউকে পর্দা করতে নিষেধ করা হয়নি।
নারীনীতির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে নারীর অধিকারের প্রতি অনুদার। বস্তুত তাঁরা ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, যদিও ইসলাম নারীর সম-অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। মহানবী (সা.) বিদায়ী হজের বাণীতে সবাইকে স্মরণ করে দিয়ে গেছেন: ‘সাবধান! তাদের ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার রয়েছে, তাদেরও তোমাদের ওপর ততটুকুই অধিকার রয়েছে।’
অতীতের মতো নারীনীতির বর্তমান বিরোধিতাকারীরাও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন, যদিও আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তা করতে নিষেধ করেছেন। বাড়াবাড়ির কারণে তাঁদের ধারণা, এটি ‘অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজে’র (ওআইসি) ঘোষণারও পরিপন্থী। ১৯৯০ সালে ওআইসি ঘোষিত কায়রো ডিক্লারেশন অন হিউম্যান রাইটস ইন ইসলাম। ওআইসি ফিকাহ একাডেমির (Cairo Declaration on Human Rights in Islam. OIC Fiqh Academy) বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতির ভিত্তিতে রচিত এ ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: (ক) আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্ম বিশ্বাস, রাজনৈতিক আনুগত্য, সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান।...খ. প্রতিটি মানুষ আল্লাহর অধীন। সেসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তাঁর সব সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু ধর্মপরায়ণতা ও সৎ কর্মের ভিত্তি ছাড়া একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।
এ ছাড়া ওআইসি ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৬(ক)-তে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশ পরিচয় বজায় রাখার অধিকার। তাই নারীনীতির বিরোধিতাকারীদের অবস্থান মূল ধারার ইসলামিক চিন্তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। কারণ, ইসলাম নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের স্বীকৃতি দেয়।
এ ছাড়া নারীনীতি রাষ্ট্রে প্রচলিত আইনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানের ১০, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর সম-অধিকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ এ ছাড়া সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ তাই এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সংবিধানে সমাজে নারী-পুরুষের সমতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে আদালতের রায়ও রয়েছে।
প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনার পরিণতিও অত্যন্ত অমঙ্গলকর। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিসেফের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে দক্ষিণ এশিয়ার পুষ্টিহীনতার নজিরবিহীন উচ্চহারের শেকড় এসব দেশের সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের বৈষম্যে গভীরভাবে প্রোথিত আর বহু রোগ-ব্যাধির উৎস পুষ্টিহীনতা। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তি লোপ পায় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তাই নারীর প্রতি বৈষম্যের মাশুল পুরো জাতিকেই দিতে হয়।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে নারীনীতির বিরোধীদের অবস্থান আমাদের সংবিধান, বিদ্যমান আইন, আদালতের নির্দেশ, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া নারীনীতি নিয়ে তাঁদের সংশয় কল্পনাপ্রসূত এবং তাঁরা বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত। তাঁরা যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগাচ্ছেন। উপরন্তু ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের মতামত একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যে দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের মৌলিক সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে না। এ ছাড়া ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের চর্চা এবং মানুষের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কারণে বিশ্বে পুরো মুসলিম সমাজ আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ অবস্থায় ধর্ম সম্পর্কে কট্টর মনোভাবের পরিবর্তে উদারতা ও নিজেদের মধ্যে বিভাজনের পরিবর্তে একতাই হবে আমাদের জন্য উৎকৃষ্টতম পন্থা। তাই নারীনীতি নিয়ে বিতর্ক আত্মঘাতী। আশা করি, নারীনীতির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং তাঁদের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। একই সঙ্গে সরকারও নারীনীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি নারীর অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এর মধ্যে যেসব অস্পষ্টতা রয়েছে তা দূর করবে। এ ছাড়া নারীনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments