ঢাকা মেডিকেলে নিয়োগ-বাণিজ্যঃ ক্ষমতার কামান দাগছেন মন্ত্রীরাও
বর্তমান সরকার শুরু থেকেই দলীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ক্ষমতার অপব্যহার সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা বলে আসছে। এদিকে শুরু থেকেই প্রশাসনিক ও দলীয় ক্ষমতাবানরা উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছেন। ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দিনবদলের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত হচ্ছে প্রহসনে।
প্রশাসনের সর্বস্তরে প্রভাবশালীদের নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি একটি মজবুত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠার পথও নিষ্কণ্টক হচ্ছে না। সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তিদের চাপে প্রশাসনে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার পাশাপাশি প্রকাশ্যে চলছে নিয়োগ ও বদলির ব্যাপারে তদবির-বাণিজ্য। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তদবিরের চাপ সইতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তদবির-সুপারিশের ব্যাপারে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরাও কোনো সীমা-চৌহদ্দি মানছেন না। এমনকি সাধারণ একটি চাকরির ক্ষেত্রেও তারা লিখিত এবং টেলিফোনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাছে সুপারিশ করছেন। অর্থাত্ নিজেরাই হয়ে উঠছেন নিজেদের পদমর্যাদার প্রতিপক্ষ। এ অবস্থায় সুশাসন দূরের কথা, ন্যূনতম প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বানের পর হাসপাতালের পরিচালকের কাছে ক্ষমতাবানদের সুপারিশের পাহাড় জমেছে। সুপারিশকারীদের মধ্যে একাধিক মন্ত্রীও রয়েছেন। ১৭১টি পদের বিপরীতে ১২ হাজার চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে সুপারিশের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে মন্ত্রীরাই লিখিত ও টেলিফোন-তদবির করেছেন শ’ পাঁচেক প্রার্থীর জন্য। মন্ত্রী ও সাবেক-বর্তমান সংসদ সদস্য ছাড়াও তদবিরকারীদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ (স্বাচিপ) ও কর্মচারী সমিতির নেতারা। এ অবস্থায় যদি কেবল মন্ত্রীদের সুপারিশকেও আমলে নিতে হয় তাহলে ৫০০ সুপারিশের বিপরীতে আরও ৩২৯টি পদ সৃষ্টি করতে হবে। জনৈক প্রভাবশালী মন্ত্রী শুধু লিখিত সুপারিশই নয়, ফোন করে চাকরি দেয়ার তদবির করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ অস্বাভাবিক সুপারিশের বহর দেখে শেষ পর্যন্ত নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামাল দিতে আপাতত নিয়োগ স্থগিত করেছেন। তবে সিলগালা করা বস্তাবন্দি তদবিরের কাগজপত্র কোথায় আছে তা জানা যায়নি। এ নিয়ে দৈনিক আমার দেশ-এ মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের সুপারিশের নমুনাচিত্রসহ ‘মন্ত্রীদের ৫০০ সুপারিশ : এক মন্ত্রীর আড়াইশ’ শীর্ষক একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ২০ জানুয়ারি। প্রতিবেদনে তিনজন মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট চাকরি প্রার্থীর নামও প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, হাসপাতালের এ নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত ১৬ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিনই তদন্ত চলছে। এর মধ্যেও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সুপারিশ আসা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেলের উপপরিচালকের মাধ্যমে এরই মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নিয়োগ সম্পন্ন হয় এবং বাকিগুলো রাখা হয় অন্য তদবিরকারীদের মর্জি পূরণের জন্য। যদিও উপপরিচালক এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, যারা চাকরি পাওয়ার আশায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে আসছিলেন আপাতত তাদের চাকরির কোনোই আশা নেই। এত সব অনিয়মের মধ্যে চাকরিরতদের সাধারণ শর্তও রক্ষা করা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী বয়স এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা পর্যন্ত উপেক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া মেডিকেলের চাকরি-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট রয়েছে বলেও আলোচ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে গত ১৪ জানুয়ারি হাসপাতালের নিয়োগ কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উকিল নোটিশ দিয়েছেন জনৈক আইনজীবী। কমিটি বিলুপ্ত করা না হলে তারা আইনের আশ্রয় নেবেন। এই যদি হয় সুপারিশ তথা তদবির-বাণিজ্যের চেহারা, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তথা দিনবদলের স্বপ্নপূরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের শঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে মন্ত্রী-এমপিরা যদি এভাবে ক্ষমতার কামান দাগেন তাহলে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরবে কে?
আমাদের প্রত্যাশা, সরকার যে কোনো মূল্যে ঢাকা মেডিকেলের নিয়োগসহ যে কোনো নিয়োগ, বদলি ও ছাঁটাইয়ের ব্যাপারে তদবিরকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনবে। এ ব্যাপারে যে কোনো ধরনের শৈথিল্য সুশাসনের পথে কাঁটা হয়ে থাকবে—যা কারও কাম্য হতে পারে না।
No comments