গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কি ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ? by মোকাররম হোসেন
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত বিষয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। কয়েকটি দলের জোরালো দাবি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। দাবি জানানো হচ্ছে সরকার বিশেষত নির্বাচন কমিশন সমীপে। প্রথমদিকে কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেও শেষ পর্যন্ত কমিশন সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে এটা তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়।
বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানও তা সমর্থন করে না। দেশের বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন সমস্যায় প্রায়ই ইউরোপ, আমেরিকার উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদাহরণ টেনে আনা হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিষয়ে সেসব গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থান কী? ধর্মীয় দল বলতে কি সেসব দেশে কিছু নেই?
জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য আর নিত্যনতুন আবিষ্কারের দেশ জার্মানি। গেল শতাব্দীর আলোচিত মতবাদ সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্কস, হেগেলস জার্মানির সন্তান। ফ্রয়োডীয় যৌনতত্ত্বের প্রবক্তা সিগময়েড ফ্রয়েড একজন সুইজ জার্মান। এ দেশেরই সন্তান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম কে না জানে! সেই জার্মানিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির নাম ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি। সহযোগী আরেকটি দল ক্রিশ্চিয়ান সোসালিস্ট ইউনিয়ন। বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল এই দলেরই নেত্রী। বহুদিন থেকে তারা জার্মানির বৃহত্তম দল হিসেবে পরিচিত। শাসন করেছে অনেক অঙ্গরাজ্য। কেউ কোনোদিন দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে বলে শোনা যায়নি।
ওয়েস্ট মিনিস্টার ধারার গণতন্ত্রের প্রবক্তা যুক্তরাজ্য। গণতন্ত্রের জন্য দুটি দেশের নাম বললে যার নাম অবশ্যই আসে তার একটি যুক্তরাজ্য। সেখানে দিব্যি স্কটিশ ক্রিশ্চিয়ান পার্টি নামের দলটি বৈধভাবেই রয়েছে। তারা ২০০৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে স্কটল্যান্ড থেকে নির্বাচন করে ১.৮ শতাংশ ভোটও অর্জন করে। ব্রিটেনের রানী এংলিকান চার্চের প্রধান। এছাড়া ব্রিটিশ লর্ড সভার ২৫টি আসন যাজকদের জন্য সংরক্ষিত।
ইউরোপের অন্যতম একটি গণতান্ত্রিক দেশ নেদারল্যান্ডস। চার দলের কোয়ালিশন সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় আসীন। বৃহত্ দলটি ডাচ ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি। কোয়ালিশন সরকারের শরিক দলও ধর্মভিত্তিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ), সিডিইউ-এর মূল আদর্শ খ্রিস্টান গণতন্ত্র। দলের মূলমন্ত্রে বলা হয়েছে, বাইবেলই একজন সদস্যের অনুপ্রেরণার উত্স। সম্প্রতি কোয়ালিশন সরকার নেদারল্যান্ডস থেকে ২৬ হাজার অভিবাসী (মূলত মুসলমান) বহিষ্কার করে নিজ ধর্মীয় আনুকূল্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে।
নিরপেক্ষতা, সমৃদ্ধি আর সৌন্দর্যের দেশ সুইজারল্যান্ড। সে দেশে গণতন্ত্র অত্যন্ত শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
এসব কারণেই হয়তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাংলাদেশকে আমি এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বানাব।
বর্তমানে প্রায় দেড় ডজন দল পার্লামেন্টে সক্রিয়। এর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান পিপলস পার্টি, ক্রিশ্চিয়ান সোসাল পার্টি, ইভানজেলিক পিপলস পার্টি নামের তিনটি দলের মূল ভিত্তিই ক্রিশ্চিয়ান গণতন্ত্র। ক্রিশ্চিয়ান পিপলস পার্টি প্রায় একশ’ বছরের পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি বর্তমান সরকারের কোয়ালিশন পার্টনার। এটি ২০০৩ সালে ১৫ ভাগ, ২০০৫ সালে ২০.৭ ভাগ এবং ২০০৭ সালে ১৪.৬ ভাগ ভোট অর্জন করতে সক্ষম হয়।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ ইতালি। ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ এবং জি-৮ সদস্য দেশ। অনেক বছর থেকে কোনো দলই এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারেনি সে দেশে। বর্তমানে প্রথম সাতটি প্রধান দলের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়ন অন্যতম। পার্লামেন্টে এদের সমর্থক প্রায় ৩০ জনেরও বেশি সদস্য রয়েছে। আর জনসমর্থনও ৪ ভাগের উপরে।
ইউরোপের অন্যতম ধনী ও গণতান্ত্রিক দেশ অস্ট্রিয়া। চরম ডানপন্থী আন্দোলনের নেতা ভিয়েনার মেয়র কার্ল লুগারের নেতৃত্বে ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় ক্রিশ্চিয়ান সোসাল পার্টি (সিএসপি)। ১৯৪৫ সালে অস্ট্রিয়ার স্বাধীনতা লাভের পর সিএসপি নাম পরিবর্তন করে অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টি নাম ধারণ করে। তারা ২০০০ সালে আরেকটি ডানপন্থী দল অস্ট্রিয়ান ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। মাত্র ২ বছর পর ২০০২ সালে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে দলটি এককভাবে আবার সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। ধর্ম থেকে উত্সারিত এ দলটি অস্ট্রিয়ার ইতিহাসে গত সোয়াশ’ বছর প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
এছাড়াও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, আলবেনিয়া, হাইতি, হাঙ্গেরি, লেবানন, নরওয়ে, সিরিয়া, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সার্বিয়া, রোমানিয়া, পানামা,পাপুয়া নিউগিনি, বলিভিয়া প্রভৃতি দেশে বিদ্যমান।
বিশ্বের অভিবাসীদের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত দেশ কানাডা। বহু দেশ থেকে প্রতি বছর নানা ধর্ম ও ভাষার হাজারও অভিবাসী আসছে এখানে। কানাডার কুইবেক রাজ্যে ২০০০ সালে রোমান ক্যাথলিকদের সহযোগিতায় গঠিত হলো ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি। পার্টির মূল নীতিতে বলা হয়েছে, অর্থোডক্স খ্রিস্টীয় মতবাদ ও কুইবেক জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ই হবে দলের প্রধান লক্ষ্য। দলটি সমকামীদের মধ্যে বিয়ে ও গর্ভপাতের ঘোর বিরোধী। এই তো কিছুদিন আগেই সমকামী সমর্থক আইনের প্রতিবাদে কানাডার ক্রিশ্চিয়ান, ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু ও শিখদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ইউনাইটেড রিলেজন্স ফ্রন্ট চার্চ, সিনেগগ, মসজিদ, মন্দির ও গুরুদুয়ারা থেকে আন্দোলন পরিচালিত করল।
খ্রিস্টান মূল্যবোধের পুনর্জাগরণের স্লোগান দিয়ে খোদ আমেরিকাতেই কাজ করছে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন। পার্টির ওয়েবসাইটে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে এভাবে—আমরা শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার দুটি দলের বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হব। এক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটদের সাফল্য আমাদের সামনে রাখতে হবে। জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশেই তারা ক্ষমতাসীন।
যারা বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের কোরাস গাইছেন তারা প্রধানত নিজেদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন। মজার ব্যাপার হলো, সেই কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা সমাজতন্ত্রের দেশ কিউবাতেও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি কাজ করে যাচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক দল ছাড়া অন্যান্য দলের প্রকাশ্য তত্পরতা নিষিদ্ধ থাকায় ক্রিশ্চিয়ান দলটি যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি থেকে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ অস্ট্রেলিয়া। রাজনীতিতে বিরাজমান ডজনখানেক ভিন্নধর্মী আদর্শের দল। নিউ সাউথ ওয়েলসের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি তাদের অন্যতম। বর্তমানে পার্লামেন্টে এই দলের দু’জন সদস্য আছেন। ক্রিশ্চিয়ানদের মাঝে এ দলটি নৈতিকতা বোধ সৃষ্টিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। গর্ভপাত, সমকামিতা, পর্নোগ্রাফি, সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ের তারা কট্টর বিরোধী। ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে এক বক্তব্যে অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম অভিবাসী আগমন বন্ধের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন দলনেতা ফ্রেড নীল।
আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত। জনসংখ্যার দিক থেকে যাকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। কাগজে-কলমে অবশ্য সেকুলার রাষ্ট্রও বলা হয়। হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বাপ্নিক দলটি (বিজেপি) ৫শ’ বছরের পুরনো মসজিদ ভেঙে রাতারাতি আলোচিত হলো। ১৯৮০ সালে গঠিত বিজেপি ১৯৮৪ সালে মাত্র দুটি আসন নিয়ে যাত্রা শুরু করে পনের বছরের (১৯৯৬) ব্যবধানে ক্ষমতাসীন হয়। কে না জানে দুই দু’বার সরকার পরিচালনার পর এখন তারা দেশটির বিরোধী দলে। এটা তো গেল হিন্দু ধর্মভিত্তিক দল। এছাড়াও মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামের ধর্মীয় দলগুলোও তো রয়েছে বহাল তবিয়তে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর কয়েকটি ধর্মীয় দলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সরকার এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়েও যোগ্য নেতৃত্বের ফলে মাত্র দুই দশকের মধ্যে যে দেশটি উন্নয়ন ও সহনশীলতায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে তা হলো মালয়েশিয়া। বলিষ্ঠ ও ক্যারিশমাটিক নেতা মাহাথির মোহাম্মদের দেশ মালয়েশিয়ায় নানা ধর্ম ও জাতির বসবাস। দীর্ঘকাল থেকে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল পার্টি বেশ দাপটের সঙ্গেই শাসন করে চলেছে। একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিরোধী দলটি (পাস) ধর্মভিত্তিক। অতীতে সেখানে তিনটি রাজ্য শাসনেরও অভিজ্ঞতা আছে দলটির। সহজ-সরল জীবন-যাপনের জন্য পাস-এর নেতা নিক আবদুল আজিজের নাম অনেকেরই জানা।
পাশ্চাত্যের সংবাদ মাধ্যমের গোয়েবলসীয় প্রচারণা দেখে মনে হয় খ্রিস্টবাদী পশ্চিমা দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বলে কিছু নেই। শুধু এরা সমস্যা তৈরি করছে মুসলিম দেশগুলোতে। কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপে ধর্মভিত্তিক দল এমনকি ক্রিশ্চিয়ান দল, মুসলিম দল, হিন্দু দল নামে কোনো দল আছে কিনা, রাজনীতিতে নির্বাচনের আগে ধর্মের ব্যবহার কেমন হয়, ভোটের আগে প্রার্থীরা নিজেদের জনগণের মাঝে কে কত বড় প্র্যাকটিসিং ক্রীশ্চিয়ান প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত হন অথবা চার্চ থেকে মিছিল বের হয় কিনা তা জানার জন্য আরও একটু পড়াশোনা করার অনুরোধ করছি। যারা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলছে, বিগত নির্বাচনগুলোতে তাদের জনসমর্থন শূন্য দশমিক শূন্য থেকে দশমিক দুই শতাংশের মধ্যে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত নির্বাচনে জাসদ ০.২১ ভাগ, ওয়ার্কার্স পার্টি শতকরা ০.০৭ ভাগ, সিপিবি ০.১ ভাগ, সাম্যবাদী দল ০.০ ভাগ, গণতন্ত্রী পার্টি ০.০১ ভাগ, ন্যাপ ০.০ ভাগ ভোট পেয়েছিল।
আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কাদের দিকে তাকাব। বহুদলীয় গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা, বহু মতের চর্চা করে যারা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের, নাকি যারা সামরিকতন্ত্র, শেখতন্ত্র, জুলুমতন্ত্রসহ সব ধরনের একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে দিন দিন অবনতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জার্মানি
No comments