দূরদেশ-নিরক্ষরতা দূরীকরণের দায়িত্ব পাচ্ছে ছাত্রলীগ! by আলী রীয়াজ

গত দুই দশকে শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এই সাফল্যের বিভিন্ন দিক রয়েছে। কিন্তু দেশে ও বিদেশে যেসব অগ্রগতিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হলো শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি এবং তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিশ্চিত করা।


এই সাফল্যের মাত্রা বোঝা যায় ১৯৯১ ও ২০০৮ সালের দুটি পরিসংখ্যান তুলনা করলেই। ১৯৯১ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তির হার ছিল ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ; ২০০৮ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৯১ দশমিক ৯ শতাংশে। অর্থাৎ, দুই দশকেরও কম সময়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার ৩০ শতাংশ বাড়াতে পেরেছে। এ ধরনের সাফল্য অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিরল। দ্বিতীয় যে অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশ অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের কাছে মডেল বলে বিবেচিত হয়, তা হলো মেয়েশিশুদের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বিরাট বৈষম্য ছিল, তা কার্যত দূর করা গেছে।
এসব সাফল্যের পাশাপাশি কতক দুর্বলতা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রকে অনুজ্জ্বল করে ফেলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারা। স্কুলে যাওয়ার বয়সী প্রায় ৩০ লাখ শিশু এখনো স্কুলের বাইরে থেকে যাচ্ছে। দেশের অনেক জায়গায় স্কুল নেই। যাদের বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন, যেমন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরা, তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাতেগোনা মাত্র। স্কুলে যারা পড়ালেখা করছে, তারাও মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। অর্থাৎ শিক্ষার মান যথাযথ নয়। তদুপরি ঝরে পড়া শিশুর হার অত্যন্ত বেশি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করা হয়, ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও অতিরিক্ত আশাবাদী চিত্র বলে মনে হলেও এই অঙ্গীকার থেকে মনে হচ্ছিল যে আওয়ামী লীগ এই সমস্যার ব্যাপকতা উপলব্ধি করেছে। অনেকে আশা করেছিলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে দল ও সরকার মনোযোগ দেবে। জাতিসংঘ-ঘোষিত সাক্ষরতা দশকের (২০০৩-২০১২) মাঝামাঝি সময়ে এই অঙ্গীকার করা হয়েছিল বলেও আশা তৈরি হয়েছিল বেশি। নির্বাচিত হওয়ার পরপরই এ বিষয়ে দল ও সরকার মনোযোগ না দিলেও সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে, ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য একটি ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে। দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীনে ৬১ জেলায় ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম। বেসিক লিটারেসি অ্যান্ড কন্টিনিউয়িং এডুকেশেন নামের এই প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে পাঠানো হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। অতীতের অন্য যেকোনো উদ্যোগের চেয়ে এবারের উদ্যোগটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং সে কারণেই এটি সবার মনোযোগ দাবি করে। আর সেই বৈশিষ্ট্য হলো, এবার এই অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ওপর। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ‘দেশ নিরক্ষরতামুক্ত করার দায়িত্ব পাচ্ছে ছাত্রলীগ।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের হাতে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সাক্ষরতা কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হবে।’ যদিও বলা হচ্ছে, ‘এর সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন।’ তবে তাঁদের ভূমিকা যে গৌণ হবে, তা এখনই স্পষ্ট।
নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সামাজিক আন্দোলন তৈরির প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা নিয়ে কারও মনেই সন্দেহ থাকার কারণ নেই। নিরক্ষতা জাতীয় অভিশাপ। পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের মধ্যে ৯৮টি দেশেই সাক্ষরতার হার ৯০ শতাংশের বেশি। একবিংশ শতাব্দীতে দেশের অর্ধেক মানুষকে নিরক্ষর রেখে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি যে কেবল ফাঁকা বুলি, তা সবাই বোঝেন। নিরক্ষরতা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন জাতীয় জাগরণ, কেবল সরকারি আমলাতান্ত্রিক উদ্যোগে কাজ হবে না। সে জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের পথ তৈরি করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রকর্মীরাই সে জন্য কেন উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলো, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে সামাজিক আন্দোলন বা জাতীয় গণ-অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিরক্ষতা দূরীকরণের উদাহরণ যে নেই, তা নয়। কিউবার উদাহরণ এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য। ১৯৬১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিউবা নিরক্ষতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল ১০ লাখ মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। চারটি ব্রিগেড তৈরি করে গোটা দেশে উৎসব ও আন্দোলনের জোয়ার তৈরি করে এ আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য অর্জিত হয়। বলা হয়ে থাকে, এক বছরে সাত লাখ সাত হাজার ২১২ জন বয়স্ক ব্যক্তিকে নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে বের করে আনা গিয়েছিল। সে জন্য ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী এক লাখ শিশু-কিশোর-তরুণ তাদের শিক্ষায়তন ছেড়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব ব্রিগেডের একটি ছিল স্কুলশিক্ষকদের ব্রিগেড। ১৫ হাজার শিক্ষকের দায়িত্ব ছিল এই অভিযানের সাংগঠনিক দিকের তদারক করা। ১৩ হাজার শ্রমিক তাঁদের নিরক্ষর সহকর্মীদের সাক্ষর করে তুলেছিলেন। এটাও মনে রাখা দরকার, কিউবায় এই সাফল্য এসেছিল বিপ্লবের অব্যবহিত পরে এবং একটি একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায়।
নিকারাগুয়ার উদারহরণও স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৮০ সালে তৎকালীন সান্দানিস্তা সরকার ‘ন্যাশনাল লিটারেসি ক্রুসেড’ নামে পাঁচ মাস ধরে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। মাত্র পাঁচ মাসে নিরক্ষতার হার ৫০ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশে নামানো সম্ভব হয়েছিল। এই উদ্যোগ সান্দানিস্তাদের বিপ্লবী বিজয়ের পরপরই করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরও এর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল কয়েক মাস ধরে। এ অভিযানের উপদেষ্টা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে যুক্ত করা হয়েছিল বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরিকে। এর জন্য জাতীয় পর্যায়ে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে দেশের ২৫টি সংগঠনকে যুক্ত করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই প্রকল্প নেওয়া হলেও জাতীয় সাক্ষরতা কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমলারা নন, সামাজিকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব। এই কার্যক্রমের জন্য যে পাঠ্যক্রম ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা কেবল অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকেই তৈরি হয়নি, কয়েক দফা পরীক্ষাও চালানো হয়েছিল। গোটা দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নাগরিক কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। নিকারাগুয়ায় এর পরও ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৯৫ ও ২০০০ সালে সাক্ষরতা অভিযান চালানো হয়। ২০০৭ সালে সান্দানিস্তারা ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবারও তারা একই ধরনের কার্যক্রম চালায়।
তৃতীয় যে দেশটির কথা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক, তা হলো চীন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ৫০ বছরে চীনের সাক্ষরতার হার ছিল ১০ শতাংশের মতো। কিন্তু পরবর্তী ৫০ বছরে তা পর্যায়ক্রমে ৯৫ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবছর কমপক্ষে ৪০ লাখ নাগরিককে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে চীনের সাফল্য এসেছে ধাপে ধাপে—১৯৫৯ সালে নিরক্ষরতার হার দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে, ১৯৭৯ সালে ৩০, ১৯৮২ সালে ২৫ এবং ১৯৮৮ সালে ২০ শতাংশে; ২০০০ সালের শুমারি অনুযায়ী ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। চীনের সাফল্য এসেছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সঙ্গে জনসাধারণের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি নিরক্ষতার ব্যাপারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটানোর ফলে এই নাটকীয় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণের এই তিনটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনার অর্থ এই নয় যে কেবল এগুলোই মডেল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় বয়স্কদের মধ্যে ১৯৪৫ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ২২ শতাংশ, ১৯৭০ সালে তা ৮৮ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৮০-র দশকের শেষ নাগাদ তা গিয়ে দাঁড়ায় ৯৩ শতাংশে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই এই সাফল্য অর্জন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে আরও অসংখ্য।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এসব উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে তার ছাত্রসংগঠনের হাতে এই দায়িত্ব অর্পণকে কেন যথাযথ মনে করল, তার কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। গত প্রায় আড়াই বছরে ছাত্রলীগের কর্মীদের ভূমিকা দেশবাসীর যতটা জানা আছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের ও সরকারের তার চেয়ে বেশিই জানার কথা। তার পরও তারা কি আন্তরিকভাবেই মনে করে, তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের যোগ্যতা সংগঠনটির আছে? রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত জনস্বার্থমূলক প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা কতটা যথাযথ, সেই প্রশ্ন তোলা বোধ করি অসংগত হবে না। তদুপরি দলীয় কর্মীদের দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের এই উদাহরণ ভবিষ্যতে অন্য দল যদি অনুসরণ করে, তা কি আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হবে?
এসব প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য এই নয় যে আমি বলতে চাচ্ছি, ছাত্রলীগ নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান থেকে বিরত থাকুক। এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল। ১৮ মার্চ মাগুরায় সেই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রলীগ চাইলে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তা অব্যাহত রাখতেই পারে। তাতে তাদের দুর্নাম ঘুচবে। কিন্তু এখন সরকারি অর্থে তারা এই প্রকল্প চালালে ‘মহতী উদ্দেশ্য’র চেয়ে ‘অর্থের প্রলোভন’ কারণ বলে অনেকে সন্দেহ করবেন। সেই সন্দেহ থেকে আমাদের মুক্ত করার দায়িত্ব ছাত্রলীগেরই। অন্যদিকে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, নিরক্ষতার বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রকৃত অর্থেই একটি জাতীয় সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা।
ইলিনয়, ২৮ এপ্রিল, ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.