চলমান এই জীবন by আতাউর রহমান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম দিক থেকে আমরা দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা শুরু করি। তখন টিকিটের দাম অনেক কম ছিল, ২ টাকা ও ৫ টাকা। বিভিন্ন নাট্যদলের নাট্যচর্চার পীঠস্থান ছিল আজকের নাটক সরণির (নিউ বেইলি রোড) মহিলা সমিতি মঞ্চ।
জীর্ণ এই মিলনায়তনে তখন আমরা ১০টির মতো নাট্যদল নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করতাম। তখন বন্ধের দিন রোববার সকালবেলায়ও নাটক হতো। আমি বক্তৃতা দিতে গিয়ে অনেক সময় বলি, গত ৩৫-৩৬ বছর মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে অভিনয় করে আমাদের গলার বারোটা বেজে গেছে। গাইড হাউস কর্তৃপক্ষ বর্তমানে নাটকের জন্য হল বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। এই দুটো হলে শব্দ পরিবহন ক্ষমতা অত্যন্ত নিম্নমানের। মহিলা সমিতি মিলনায়তনের সংস্কার সাধনের পরও বিশেষ উন্নতি হয়নি। নাট্যকর্মীদের উদ্যোগে হলটি বর্তমানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তবে তা সন্তোষজনক নয়। পিডিবি’কে হাতে-পায়ে ধরার পরও নাটক চলাকালীন লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুত্ প্রবাহ ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই বিপর্যয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ও পরীক্ষণ হলে হয় না। সেখানে বিদ্যুত্ প্রবাহ বৈদ্যুতিক লাইন বিভাজনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। একটি বন্ধ হলে আরেকটি চালু হয়ে যায়। শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ দুটি নাট্যকর্মীদের আন্দোলন ও দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চত্রয় (স্টুডিও থিয়েটারসহ), রিহার্সাল রুম, কফি হাউস ইত্যাদি আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে পুরস্কারস্বরূপ। শিল্পকলা একাডেমি এখন বিকাল থেকে লোক-সমাগমে গমগম করে। নাটকের দলের সংখ্যা এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে এবং বছরজুড়ে নাট্য, নৃত্য ও আবৃত্তি উত্সব লেগে থাকে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আমাদের দেশের মানুষ অমানবিক পরিস্থিতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত, যা উন্নত দেশে ভাবাই যায় না। মহিলা সমিতি মঞ্চে আমরা এক সময় প্রাগৈতিহাসিক আমলের সল্ট-ডিমার দিয়ে কাজ করতাম। তবুও মানসিক ও কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভর করে তখন অনেক ভালো ভালো নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে এবং বিদেশেও এসব নাটকের মঞ্চায়ন প্রশংসা অর্জন করেছে। আসলে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আধুনিক অবকাঠামো শেষ কথা নয়, মানুষের সদিচ্ছা ও নবপ্রয়াস অসাধ্য সাধন করতে পারে। তা না হলে সত্যজিত্ রায় পুরনো আমলের ক্যামেরা দিয়ে বিশ্বজয়ী অপু-ট্রিলজি চলচ্চিত্র বানাতে পারতেন না। ইংরেজিতে বলে ্তুগধহ ইবযরহফ্থ ই বড় কথা। আমাদের দেশের মানুষদের স্বভাবে একটি করিত্কর্ম উপাদান আছে। পাশ্চাত্যের যে কোনো দেশে নাটক করতে ১ বছরের নোটিশ দিতে হয়, তা না হলে হল বুকিং পাওয়া যায় না। রাস্তাঘাটে বা গাছের নিচে মঞ্চ বানিয়ে নাটক, নৃত্য বা সঙ্গীত পরিবেশন করা যায় না। আমরা একদিনের নোটিশে মগবাজারের মোড়ে কী জিরো পয়েন্টের কাছে বা যে কোনো জায়গায় চৌকি ফেলে মঞ্চ বানিয়ে যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারি। খরচও বেশি হয় না। বিদেশিরা আমাদের এই তত্পরতা দেখে বিস্মিত হয়। টেলিভিশনের জন্য নির্মিত নাটকগুলোতে বেশিরভাগ সময় আমরা অমানবিক পরিস্থিতিতে কাজ করি। আউটডোর বা ইনডোর হোক, আমাদের সুযোগ-সুবিধা খুবই অপ্রতুল। তবুও আমাদের চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত নাটক সম্প্রচারিত হচ্ছে। অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও দেখানো হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে টিভি নাটকের শুটিংয়ে অমানুষিক পরিশ্রম হয়। মুহূর্তের মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী গরমে ঘেমে নেয়ে ওঠে। অভিনেতা-অভিনেত্রী পাউডার পাফ্ দিয়ে ঘাম মুছবে না নাটকের শর্ট দেবে। তারপর শব্দ-দূষণের শেষ নেই। তারপর আছে লোডশেডিং, জেনারেটর চালালে তার বিকট শব্দও রেকডিংয়ে ধরা পড়ে। আউটডোরে অনেক সময় দুর্গম স্থানে শুটিং হয়, যেখানে পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করতে অসুবিধায় পড়তে হয়। ইনডোর শুটিংয়ে কিছুটা সুবিধা আছে। তবুও গ্রীষ্মকালে ক্যামেরার সামনে শর্ট দিয়ে দৌড়ে এয়ারকন্ডিশন্ড মেকআপ রুমে ঢুকে ঠাণ্ডা হতে হয়। বেশিরভাগ সময় এক ক্যামেরাতে কাজ করতে হয় এবং এই কাজটি খুবই দুরূহ। অনেকে বলেন, আমাদের টিভি অভিনয় নাকি খুবই জড়, বিদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর অভিনয় অনেক স্বচ্ছন্দ। আমি উত্তরে বলি, আমাদের তিন হাত পরিমাণ অ্যাকটিং জোন বেঁধে দেয়া হয়, চোখের দৃষ্টি থেকে চিবুকের ওঠানামা সামান্য পরিসরে বেঁধে দেয়া হয়, কখনও কখনও চশ্মা নিয়ে অভিনয় করার সময় চশ্মা থেকে আলোর প্রতিসরণ হয়। ঢাকার উত্তরাতে বিভিন্ন বাড়িতে নিয়মিত শুটিং হয়, কিন্তু ওইসব বাড়ি যথার্থ স্টুডিও নয়। উন্নত দেশগুলোতে এমন সব স্টুডিও আছে যেখানে বাড়িঘর থেকে শুরু করে বন-জঙ্গল সবই বানানো যায়। সেখানে অভিনেতা একাধিক ক্যামেরার সামনে হাত-পা ছড়িয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে অভিনয় করতে পারে,
ক্যামেরা অভিনেতাকে অনুসরণ করে। আর আমরা ক্যামেরার মর্জিমাফিক চলি, আমরা ক্যামেরাকে অনুসরণ করি। আমরা কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছি এবং জীবনযাপন করছি। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা কেউ ঝকঝকে-তকতকে হার্ভার্ড, কেমব্রিজ বা এমআইটি’তে পড়াশোনা করিনি, বেশিরভাগই ছাল-চামড়া ওঠানো বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। তবুও আমরা জীবনকে নিয়ে তুষ্ট, আমরা মেধা ও শ্রমের দিক থেকে খুব খারাপও নই—এটাই আমাদের আত্মতৃপ্তি।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments