পানি দিবস-সুপেয় পানি নাগরিকের মৌলিক অধিকার by ম. ইনামুল হক
সুপেয় পানি মানুষের মৌলিক অধিকার, বেঁচে থাকার জন্য জন্মগত অধিকার। আমাদের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহের ওপর আমাদের জনবসতি, কৃষি, অর্থনীতি এবং যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই নদীতে পানির প্রবাহ থাকাটা আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার
বাংলাদেশ পানিতে ভাসা দেশ। সাগর থেকে জাগা দেশ। অবিরাম বৃষ্টিপাতের দেশ। উজান থেকে বয়ে আসা পলিমাটির দেশ। উত্তরের সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণের সাগরপারের বনভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীর উর্বরতম দেশ। এখানে সারা বছর ফসল হয়, মাছ হয়। জমিতে ধান, গাছে ফল। সুজলা-সুফলা এই বাংলা তাই পৃথিবীর ঘন বসতিতম দেশ। এর সমতল পলিমাটির বুক চিরে বয়ে চলছে অজস্র নদনদী। এটাই ছিল বাংলার রূপ। কিন্তু বাংলার সেই রূপ আর নেই। বাংলা এখন দূষণে পরিপূর্ণ। গ্রাম ও বনভূমিতে লাগানো হয়েছে নিষ্ফম্ফলা বিজাতীয় গাছ। শহরাঞ্চলের নদীগুলো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যে পূর্ণ। গ্রামাঞ্চলের নদীগুলো মরা, যেখানে আগে বৈশাখ মাসেও হাঁটুজল থাকত। বিল ও জলাভূমিগুলো অতি নিষ্কাশনে শুষ্ক। এখন শুকনো মৌসুমে সারাদেশে উৎপন্ন হয় ফসল; খালে ও বিলে, এমনকি নদীতেও, যেখানে হাঁটুজল আর নেই।
তবুও প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে পানিই সবচেয়ে আদি ও অফুরান। কারণ প্রতি বছর প্রাকৃতিক চক্রে পানি সাগর থেকে বাষ্পীভূত হয়ে বৃষ্টির আকারে ভূমিতে পতিত হয় এবং নদীতে প্রবাহিত হয়ে আবার সাগরে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর জৈব ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষ অন্যান্য পশুপাখির আহার আত্মসাৎ করে নিজেরা বাড়ছে। মানুষ এরপরও যা করছে তা হলো, নিজেদের ভোগলিপ্সার জন্য কৃত্রিমভাবে খাদ্য ও ভোগসামগ্রী উৎপাদন করতে গিয়ে সুপেয় পানির বার্ষিক জোগানে হস্তক্ষেপ করছে। মানুষ ড্যাম নির্মাণ করে নদীর পানি আটকাচ্ছে, ব্যারাজ নির্মাণ করে সেচ প্রকল্পে ও শহরে নিয়ে যাচ্ছে, নদীর পানি তুলে নিয়ে শিল্পে ব্যবহার করে তরল বর্জ্য ফিরিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে দিকে দিকে নদীগুলো শুকিয়ে ও দূষিত হয়ে সুপেয় পানির অভাব সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও মানুষের সভ্য জীবনযাপন ও তথাকথিত উন্নয়নের জন্য পানির প্রয়োজন।
আমরা পানীয় জল সংগ্রহ করি কুয়া বা টিউবওয়েল থেকে অথবা শহরের পৌরসভা বা পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষের পাইপ থেকে। একমাত্র ঢাকা শহরেই নদীর পানি সংগ্রহ করে শোধনের পর সরবরাহ করার ব্যবস্থা আছে, যদিও এর পরিমাণ মোট সরবরাহের মাত্র ১৫ শতাংশ। ঢাকার বাকি পানীয় জলের সরবরাহ করা হয় ডিপটিউবওয়েল থেকে কোনো প্রকার শোধন ব্যতিরেকেই। পাহাড়ের মানুষরা অনেকেই সরাসরি ঝরনা থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূউপরিস্থ পানি লোনা বিধায় পানের জন্য বৃষ্টির পানি পুকুরে ধরে রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে নলকূপ অতি গভীরে পুঁতে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। জনস্বাস্থ্য ও সভ্যতার ওপর খেয়াল রেখে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত পানীয় জলের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কারখানায় শোধিত জলের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) থেকে বিচার্য বৈশিষ্ট্যের মাত্রা জানানো হয়।
সুপেয় পানি মানুষের মৌলিক অধিকার, বেঁচে থাকার জন্য জন্মগত অধিকার। আমাদের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহের ওপর আমাদের জনবসতি, কৃষি, অর্থনীতি এবং যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই নদীতে পানির প্রবাহ থাকাটা আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রথমত, উজানে অবস্থিত ভারত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ প্রকল্পে এবং নৌপথ সচল রাখার কাজে ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, খরার সময় অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর প্রবাহের ওপর মাটির বাঁধ দিয়ে পানি তুলে নিয়ে সেচকাজে লাগানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, নদীর হাঁটুজল প্রবাহের উৎস বিল ও জলাশয়গুলোকে অতি নিষ্কাশন করে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। চতুর্থত, সারাদেশে অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের জন্য পানি অতি-উত্তোলন করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পঞ্চমত, নদীগুলোর পাড়ের খাসজমি দখল করে ভরাট করে বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ষষ্ঠত, নদী, খাল ও জলাভূমিতে শিল্পবর্জ্য ও শহুরে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে এবং চরমভাবে দূষিত করা হয়েছে।
ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের বড় নদীগুলো বর্ষা শেষে দ্রুত শুকিয়ে যায়। সেচকাজে পানি তুলে নেওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে শীতকালে পানি থাকে না। বিল ও জলাশয়গুলো শুকিয়ে ফেলায় মৎস্যসম্পদের উৎস ধ্বংস হয়েছে, ভাটির খাল এবং নদী শুকিয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পুকুর শুকিয়ে গেছে, টিউবওয়েলে খাবার পানি ওঠে না, নদীর প্রবাহে জোগান দিতে এর পাড় থেকে কোনো ঝরনা প্রবাহ থাকে না। নদী দখলের কারণে নদী শীর্ণ হয়েছে, প্রবাহ বন্ধ হয়ে বুজে গেছে। দূষণের কারণে নদীর ভেতর ও বাইরের পরিবেশ নরকে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় সরকার যে 'বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১২' প্রস্তাব করেছে, তার মাধ্যমে কি পানির উৎস নদী বা বিল থেকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার বা নিষ্কাশন বন্ধ করা যাবে? নদী দখল ও ভরাট বন্ধ হবে? পানির অবিরাম দূষণ বন্ধ হবে? এবং এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কি দেশের নদীগুলোর প্রবাহ ফিরে আসবে? ঢাকা নগরীসহ দেশের সব শহর ও বন্দর সনি্নহিত নদীগুলো দূষণমুক্ত হয়ে কি প্রাণ ফিরে পাবে? 'বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২'-এর আগের খসড়ায় এসব বিষয়ে তেমন ব্যবস্থাই ছিল না।
'বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২'-এর আগের খসড়া ওয়েবসাইটে ছিল, যার প্রতি পরিবেশবাদীরা আপত্তি দিয়ে বলেন, আইনটি পানির ওপর জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। সরকার সেসব আপত্তির প্রতি কান দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত সংশোধিত আইনটিতে পানিসম্পদের ওপর মালিকানা, পানি ব্যবহারের অধিকার, সরকারি গেজেটে প্রাধিকারপ্রাপ্ত অথবা লাইসেন্সপ্রাপ্তদের প্রবেশাধিকার, পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার ও সংরক্ষণ, পানির মূল্য নির্ধারণ, জলাধার ভরাট নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি পরিচ্ছেদ ও ধারা আছে, কিন্তু নাগরিকের পানির ওপর জন্মগত অধিকারের কথা বলা নেই। বর্তমানে গ্রামের সাধারণ জনগণ নিজ উদ্যোগে অথবা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহায়তায় ইঁদারা, অগভীর কূপ, গভীর নলকূপ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করে থাকে। প্রবহমান নদী বা জলাধারের পানির ওপর জনগণের অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রস্তাবিত পানি আইনের ১৪ ধারায় সব ধরনের পানিসম্পদের মালিক রাষ্ট্র, ১৫ ধারায় সব ধরনের কাজে বণ্টনকারী কর্তৃপক্ষ সরকার, যার মধ্যে গৃহস্থালির কাজও আছে, ১৬ ধারায় সুপেয় পানি মৌলিক অধিকার বলা হলেও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত করে এই অধিকার সীমিত বলা হয়েছে।
আগের প্রস্তাবিত 'বাংলাদেশ পানি আইন ২০১১'-এর ২২, ২৩ ও ৩৫ ধারায় নদী বা জলাধারের কূলে প্রবেশাধিকার লাইসেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা ছিল। বর্তমান খসড়ায় তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ২৮ ধারায় পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সংগঠন গঠন করার কথা বলা হয়েছে এবং ২৯ ধারায় এর গঠন, নিবন্ধনের প্রকৃতি, কার্যাবলি সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারণ করবে বলা হয়েছে। ৩০ ধারায় পানি ব্যবহারের মূল্য নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব উপধারা আছে তাতে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারি দায়িত্ব ও পানির বিনামূল্যে ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। বিশেষ করে সরকারিভাবে গ্রামাঞ্চলের জনগণকে যে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, তা কি এই আইনের মাধ্যমে উঠে যাবে_ তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইনের প্রয়োজন, যা এই আইনের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে লেখা দরকার এবং জনগণ তথা গ্রাম ও শহরবাসীর পানির ওপর যে মৌলিক ও জন্মগত অধিকার আছে সেই বিষয়টি এই আইনে উল্লেখ থাকা দরকার। আমি মনে করি, রাষ্ট্রকে গ্রাম ও শহরে বিনামূল্যে অন্তত খাবার ও রান্নার পানি সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে। উন্মুক্ত জলাধার এবং প্রবাহিত নদী ও খালের ওপর দেশের জনগণের অধিকার কোনোক্রমেই হরণ করা যাবে না। বরং রাষ্ট্রকে উন্মুক্ত কি বদ্ধ সব জলাধার ও প্রবাহিত নদীগুলোর দূষণকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রস্তাবিত পানি আইনের কয়েকটি ধারায় দূষণ প্রতিরোধের কথা উল্লেখ আছে বটে (ধারা ২১), কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আইন (সংশোধিত) ২০১০ পানির দূষণ প্রতিরোধে অকার্যকর, তাই প্রস্তাবিত পানি আইনে পানির দূষণ প্রতিরোধের জন্য একটি পৃথক পরিচ্ছেদ সংযোজন করতে হবে। কেবল তা-ই নয়, পানিসম্পদের বিভিন্ন উৎস যথা_ বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি নদী ও ঝরনার পানি, পুকুর ও বদ্ধ জলাশয়ের পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, আন্তর্জাতিক নদীর পানি, সমতলের নদীর পানি, হাওর ও বিলের পানি, মোহনার পানি, সুন্দরবনের পানি এবং সাগরের পানির ব্যবহার, প্রবাহ সংরক্ষণ ও গুণগত মান বজায় রেখে দূষণ প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও ভিন্ন ভিন্ন ধারা থাকা দরকার।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা
minamul@gmail.com
তবুও প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে পানিই সবচেয়ে আদি ও অফুরান। কারণ প্রতি বছর প্রাকৃতিক চক্রে পানি সাগর থেকে বাষ্পীভূত হয়ে বৃষ্টির আকারে ভূমিতে পতিত হয় এবং নদীতে প্রবাহিত হয়ে আবার সাগরে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর জৈব ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষ অন্যান্য পশুপাখির আহার আত্মসাৎ করে নিজেরা বাড়ছে। মানুষ এরপরও যা করছে তা হলো, নিজেদের ভোগলিপ্সার জন্য কৃত্রিমভাবে খাদ্য ও ভোগসামগ্রী উৎপাদন করতে গিয়ে সুপেয় পানির বার্ষিক জোগানে হস্তক্ষেপ করছে। মানুষ ড্যাম নির্মাণ করে নদীর পানি আটকাচ্ছে, ব্যারাজ নির্মাণ করে সেচ প্রকল্পে ও শহরে নিয়ে যাচ্ছে, নদীর পানি তুলে নিয়ে শিল্পে ব্যবহার করে তরল বর্জ্য ফিরিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে দিকে দিকে নদীগুলো শুকিয়ে ও দূষিত হয়ে সুপেয় পানির অভাব সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও মানুষের সভ্য জীবনযাপন ও তথাকথিত উন্নয়নের জন্য পানির প্রয়োজন।
আমরা পানীয় জল সংগ্রহ করি কুয়া বা টিউবওয়েল থেকে অথবা শহরের পৌরসভা বা পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষের পাইপ থেকে। একমাত্র ঢাকা শহরেই নদীর পানি সংগ্রহ করে শোধনের পর সরবরাহ করার ব্যবস্থা আছে, যদিও এর পরিমাণ মোট সরবরাহের মাত্র ১৫ শতাংশ। ঢাকার বাকি পানীয় জলের সরবরাহ করা হয় ডিপটিউবওয়েল থেকে কোনো প্রকার শোধন ব্যতিরেকেই। পাহাড়ের মানুষরা অনেকেই সরাসরি ঝরনা থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূউপরিস্থ পানি লোনা বিধায় পানের জন্য বৃষ্টির পানি পুকুরে ধরে রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে নলকূপ অতি গভীরে পুঁতে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। জনস্বাস্থ্য ও সভ্যতার ওপর খেয়াল রেখে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত পানীয় জলের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কারখানায় শোধিত জলের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) থেকে বিচার্য বৈশিষ্ট্যের মাত্রা জানানো হয়।
সুপেয় পানি মানুষের মৌলিক অধিকার, বেঁচে থাকার জন্য জন্মগত অধিকার। আমাদের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহের ওপর আমাদের জনবসতি, কৃষি, অর্থনীতি এবং যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই নদীতে পানির প্রবাহ থাকাটা আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রথমত, উজানে অবস্থিত ভারত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ প্রকল্পে এবং নৌপথ সচল রাখার কাজে ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, খরার সময় অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর প্রবাহের ওপর মাটির বাঁধ দিয়ে পানি তুলে নিয়ে সেচকাজে লাগানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, নদীর হাঁটুজল প্রবাহের উৎস বিল ও জলাশয়গুলোকে অতি নিষ্কাশন করে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। চতুর্থত, সারাদেশে অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের জন্য পানি অতি-উত্তোলন করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পঞ্চমত, নদীগুলোর পাড়ের খাসজমি দখল করে ভরাট করে বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ষষ্ঠত, নদী, খাল ও জলাভূমিতে শিল্পবর্জ্য ও শহুরে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে এবং চরমভাবে দূষিত করা হয়েছে।
ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের বড় নদীগুলো বর্ষা শেষে দ্রুত শুকিয়ে যায়। সেচকাজে পানি তুলে নেওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে শীতকালে পানি থাকে না। বিল ও জলাশয়গুলো শুকিয়ে ফেলায় মৎস্যসম্পদের উৎস ধ্বংস হয়েছে, ভাটির খাল এবং নদী শুকিয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পুকুর শুকিয়ে গেছে, টিউবওয়েলে খাবার পানি ওঠে না, নদীর প্রবাহে জোগান দিতে এর পাড় থেকে কোনো ঝরনা প্রবাহ থাকে না। নদী দখলের কারণে নদী শীর্ণ হয়েছে, প্রবাহ বন্ধ হয়ে বুজে গেছে। দূষণের কারণে নদীর ভেতর ও বাইরের পরিবেশ নরকে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় সরকার যে 'বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১২' প্রস্তাব করেছে, তার মাধ্যমে কি পানির উৎস নদী বা বিল থেকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার বা নিষ্কাশন বন্ধ করা যাবে? নদী দখল ও ভরাট বন্ধ হবে? পানির অবিরাম দূষণ বন্ধ হবে? এবং এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কি দেশের নদীগুলোর প্রবাহ ফিরে আসবে? ঢাকা নগরীসহ দেশের সব শহর ও বন্দর সনি্নহিত নদীগুলো দূষণমুক্ত হয়ে কি প্রাণ ফিরে পাবে? 'বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২'-এর আগের খসড়ায় এসব বিষয়ে তেমন ব্যবস্থাই ছিল না।
'বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২'-এর আগের খসড়া ওয়েবসাইটে ছিল, যার প্রতি পরিবেশবাদীরা আপত্তি দিয়ে বলেন, আইনটি পানির ওপর জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। সরকার সেসব আপত্তির প্রতি কান দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত সংশোধিত আইনটিতে পানিসম্পদের ওপর মালিকানা, পানি ব্যবহারের অধিকার, সরকারি গেজেটে প্রাধিকারপ্রাপ্ত অথবা লাইসেন্সপ্রাপ্তদের প্রবেশাধিকার, পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার ও সংরক্ষণ, পানির মূল্য নির্ধারণ, জলাধার ভরাট নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি পরিচ্ছেদ ও ধারা আছে, কিন্তু নাগরিকের পানির ওপর জন্মগত অধিকারের কথা বলা নেই। বর্তমানে গ্রামের সাধারণ জনগণ নিজ উদ্যোগে অথবা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহায়তায় ইঁদারা, অগভীর কূপ, গভীর নলকূপ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করে থাকে। প্রবহমান নদী বা জলাধারের পানির ওপর জনগণের অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রস্তাবিত পানি আইনের ১৪ ধারায় সব ধরনের পানিসম্পদের মালিক রাষ্ট্র, ১৫ ধারায় সব ধরনের কাজে বণ্টনকারী কর্তৃপক্ষ সরকার, যার মধ্যে গৃহস্থালির কাজও আছে, ১৬ ধারায় সুপেয় পানি মৌলিক অধিকার বলা হলেও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত করে এই অধিকার সীমিত বলা হয়েছে।
আগের প্রস্তাবিত 'বাংলাদেশ পানি আইন ২০১১'-এর ২২, ২৩ ও ৩৫ ধারায় নদী বা জলাধারের কূলে প্রবেশাধিকার লাইসেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা ছিল। বর্তমান খসড়ায় তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ২৮ ধারায় পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সংগঠন গঠন করার কথা বলা হয়েছে এবং ২৯ ধারায় এর গঠন, নিবন্ধনের প্রকৃতি, কার্যাবলি সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারণ করবে বলা হয়েছে। ৩০ ধারায় পানি ব্যবহারের মূল্য নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব উপধারা আছে তাতে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারি দায়িত্ব ও পানির বিনামূল্যে ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। বিশেষ করে সরকারিভাবে গ্রামাঞ্চলের জনগণকে যে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, তা কি এই আইনের মাধ্যমে উঠে যাবে_ তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইনের প্রয়োজন, যা এই আইনের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে লেখা দরকার এবং জনগণ তথা গ্রাম ও শহরবাসীর পানির ওপর যে মৌলিক ও জন্মগত অধিকার আছে সেই বিষয়টি এই আইনে উল্লেখ থাকা দরকার। আমি মনে করি, রাষ্ট্রকে গ্রাম ও শহরে বিনামূল্যে অন্তত খাবার ও রান্নার পানি সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে। উন্মুক্ত জলাধার এবং প্রবাহিত নদী ও খালের ওপর দেশের জনগণের অধিকার কোনোক্রমেই হরণ করা যাবে না। বরং রাষ্ট্রকে উন্মুক্ত কি বদ্ধ সব জলাধার ও প্রবাহিত নদীগুলোর দূষণকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রস্তাবিত পানি আইনের কয়েকটি ধারায় দূষণ প্রতিরোধের কথা উল্লেখ আছে বটে (ধারা ২১), কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আইন (সংশোধিত) ২০১০ পানির দূষণ প্রতিরোধে অকার্যকর, তাই প্রস্তাবিত পানি আইনে পানির দূষণ প্রতিরোধের জন্য একটি পৃথক পরিচ্ছেদ সংযোজন করতে হবে। কেবল তা-ই নয়, পানিসম্পদের বিভিন্ন উৎস যথা_ বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি নদী ও ঝরনার পানি, পুকুর ও বদ্ধ জলাশয়ের পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, আন্তর্জাতিক নদীর পানি, সমতলের নদীর পানি, হাওর ও বিলের পানি, মোহনার পানি, সুন্দরবনের পানি এবং সাগরের পানির ব্যবহার, প্রবাহ সংরক্ষণ ও গুণগত মান বজায় রেখে দূষণ প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও ভিন্ন ভিন্ন ধারা থাকা দরকার।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা
minamul@gmail.com
No comments