দাহকালের কথা-হেমলক by মাহমুদুজ্জামান বাবু
বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। পরিচালকের নাম মনে নেই। কিন্তু স্থূল ও অশ্লীল নামের কারণে চলচ্চিত্রটির নাম মনে পড়ছে এত দিন পরও। কোপা শামসু নামের ওই ছবিটার বিশালাকৃতির পোস্টার নগর-মফস্বলের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো হয়েছিল সে সময়। সিনেমা হলগুলোর বাইরে বড় বড় ব্যানারও ছিল।
উৎকট চেহারার এক পুরুষ, মাথায় লাল ফেটি বাঁধা, রঙিন স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে পৌরাণিক আমলের একটি রামদার মতো অস্ত্র উঁচিয়ে ধাবমান। চতুর্দিকে লোকজন ছিটকে পালাচ্ছে। রামদাধারী পুরুষটির রাগী চেহারার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে রংচঙা সাজ ও যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া শরীরী অবয়বের এক নারীর মুখ। সম্ভবত সে রামদাধারী কোপা শামসুর সঙ্গিনী। অন্য আর দশজন মধ্যবিত্ত নাগরিক যেসব কারণে সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়েছে বহুকাল, একই দশা আমারও। তাই আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না, কোপা শামসু নামের ওই চলচ্চিত্রটির কোনো প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোপাকুপিতে পড়েছে কি না!
আশির দশকের শুরুতে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ধর্মের নামে হাত-পায়ের রগ কাটা শুরু করেছিল। তাদের প্রতিপক্ষ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, প্রধানত বামপন্থী ভাবাদর্শের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর নৃশংসতা সে সময়ের ছাত্র-আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সবার স্মৃতি থেকে এখনো বিস্মরণযোগ্য নয়। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কারান্তরালে থাকার কারণে কিরিচ, রামদা ও ক্ষুর নিয়ে সজ্জিত ছাত্রশিবিরের ‘রগকাটা বাহিনী’র প্রকাশ্য হলাহল শোনা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু মুহসীন হলের আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগের মারামারির ধরন ও ফলাফল ‘শিবির শিবির’ গন্ধ ছড়িয়েছে।
হাত ও পায়ের রগ কাটার উপযোগিতা কী? না, এটা কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ১ কিংবা ২ নম্বর প্রশ্ন নয়। এটা আমার নিজের জিজ্ঞাসা, জানতে চাওয়া। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুজন ছাত্র ওই দিনের সংঘর্ষে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে গেছে, তারা ছয় সপ্তাহের আগে ভালো করে হাঁটতে পারবে না—এই অভিমত দিয়েছেন আমার এক চিকিৎসক বন্ধু। সেলাই, ব্যান্ডেজ আর শুয়ে থাকা শেষে সারা জীবন বয়েও বেড়াতে হবে এই আঘাতের জের। এর মধ্যে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়তে পারা আর না পারার অনিশ্চয়তা। বাবা-মা বা অভিভাবক টাকা খরচ করে সন্তান বা পোষ্যকে কোন বাংলাদেশে রেখেছেন? একই মতাদর্শ অনুসারী, একই বঙ্গবন্ধু, একই শেখ হাসিনা, তবু টেন্ডারবাজি আর ক্ষমতা বিস্তারের রামদা ঝলসে উঠল পরস্পরের ভেতরেই?
লাভ, লোভ আর মুনাফা গলাগলি করে হেঁটে যায়, যেন পরম সখা তারা। যাবেই তো! প্রথমে ব্যক্তি, তারপর গোষ্ঠী, তারপর শ্রেণী। স্বার্থ এভাবে খুঁজে বেড়ায় শ্বাপদের চোখে সমস্বার্থের মুখ। মিলে গেলেই উল্লাস। বিরোধ হলেই ক্রূরতার চূড়ান্ত। এই যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে কত কথা চালাচালি, বলাবলি হচ্ছে, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাতে কী লাভ? যাঁরা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, কিংবা যাঁরা এ বিষয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা রেখেই এই ভাবনায় দুলছি যে, লাভ তো তাঁদের, যাঁরা ক্ষমতায় আছেন এবং যাঁরা ভবিষ্যতে আসবেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের পর এই ৪০ বছরে বাংলাদেশের সংবিধানে কে নৃশংস কোপ দেয়নি? একেকটি কোপে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে সংবিধান থেকে কেটে ফেলে দিয়েছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায়। নানা অজুহাতে সংবিধানকে করে তুলেছে নিজেদের শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার মাত্র। জনজীবনের দুর্ভোগ, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তাহীনতা, ধনিক-বণিক গোষ্ঠীর নির্বিচার লুটপাট—এই সবকিছু নিয়ে অত্যাবশ্যক আলোচনা বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের আলোচনার সাফল্য ও ব্যর্থতায় বাংলাদেশের আসলে কী আসবে-যাবে? কিছু আসে-যায়?
অন্তঃসারশূন্যতার একটি গল্প মনে পড়ছে। অগ্রজপ্রতিম এক বন্ধু একদিন সকালে পুরানা পল্টনের সংসার ছেড়ে বেরিয়েছেন। গন্তব্য কাঁটাবন। একটি প্রেসে পোস্টারের ডিজাইন জমা দিলে টাকা পাবেন, সংসারের চাকা চলবে। তো প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাত ধরে কাঁটাবনের দিকে যাচ্ছেন, উল্টো পাশের বিএমএ ভবন থেকে স্বনামখ্যাত একজন কবি তাঁকে ডেকে থামালেন। হেমলক নামের একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। ঘরের ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল, আলোচনা সভা শেষে কেক-চানাচুর-কলার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আলোচনা আর শেষ হয় না। সকালের নাশতা না করে আসা বন্ধুটি উদ্গ্রীব আলোচনা শেষের জন্য। একেক বক্তা উঠছেন আর গম্ভীর গম্ভীর কথায় আবিষ্কার করতে চাইছেন, এই হেমলক কীভাবে তৈরি হয়েছে। আমার বন্ধুটি অধৈর্য হয়ে বলে বসলেন, ‘আমলকী দিয়ে তৈরি হয়েছে।’ হো হো হাসিতে গম্ভীর আলোচনা ভেঙে গেল।
আমার চারপাশেও গম্ভীর আলোচনা।
কিন্তু নীলকণ্ঠ আমি হাসতে পারছি না।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
আশির দশকের শুরুতে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ধর্মের নামে হাত-পায়ের রগ কাটা শুরু করেছিল। তাদের প্রতিপক্ষ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, প্রধানত বামপন্থী ভাবাদর্শের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর নৃশংসতা সে সময়ের ছাত্র-আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সবার স্মৃতি থেকে এখনো বিস্মরণযোগ্য নয়। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কারান্তরালে থাকার কারণে কিরিচ, রামদা ও ক্ষুর নিয়ে সজ্জিত ছাত্রশিবিরের ‘রগকাটা বাহিনী’র প্রকাশ্য হলাহল শোনা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু মুহসীন হলের আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগের মারামারির ধরন ও ফলাফল ‘শিবির শিবির’ গন্ধ ছড়িয়েছে।
হাত ও পায়ের রগ কাটার উপযোগিতা কী? না, এটা কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ১ কিংবা ২ নম্বর প্রশ্ন নয়। এটা আমার নিজের জিজ্ঞাসা, জানতে চাওয়া। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুজন ছাত্র ওই দিনের সংঘর্ষে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে গেছে, তারা ছয় সপ্তাহের আগে ভালো করে হাঁটতে পারবে না—এই অভিমত দিয়েছেন আমার এক চিকিৎসক বন্ধু। সেলাই, ব্যান্ডেজ আর শুয়ে থাকা শেষে সারা জীবন বয়েও বেড়াতে হবে এই আঘাতের জের। এর মধ্যে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়তে পারা আর না পারার অনিশ্চয়তা। বাবা-মা বা অভিভাবক টাকা খরচ করে সন্তান বা পোষ্যকে কোন বাংলাদেশে রেখেছেন? একই মতাদর্শ অনুসারী, একই বঙ্গবন্ধু, একই শেখ হাসিনা, তবু টেন্ডারবাজি আর ক্ষমতা বিস্তারের রামদা ঝলসে উঠল পরস্পরের ভেতরেই?
লাভ, লোভ আর মুনাফা গলাগলি করে হেঁটে যায়, যেন পরম সখা তারা। যাবেই তো! প্রথমে ব্যক্তি, তারপর গোষ্ঠী, তারপর শ্রেণী। স্বার্থ এভাবে খুঁজে বেড়ায় শ্বাপদের চোখে সমস্বার্থের মুখ। মিলে গেলেই উল্লাস। বিরোধ হলেই ক্রূরতার চূড়ান্ত। এই যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে কত কথা চালাচালি, বলাবলি হচ্ছে, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাতে কী লাভ? যাঁরা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, কিংবা যাঁরা এ বিষয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা রেখেই এই ভাবনায় দুলছি যে, লাভ তো তাঁদের, যাঁরা ক্ষমতায় আছেন এবং যাঁরা ভবিষ্যতে আসবেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের পর এই ৪০ বছরে বাংলাদেশের সংবিধানে কে নৃশংস কোপ দেয়নি? একেকটি কোপে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে সংবিধান থেকে কেটে ফেলে দিয়েছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায়। নানা অজুহাতে সংবিধানকে করে তুলেছে নিজেদের শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার মাত্র। জনজীবনের দুর্ভোগ, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তাহীনতা, ধনিক-বণিক গোষ্ঠীর নির্বিচার লুটপাট—এই সবকিছু নিয়ে অত্যাবশ্যক আলোচনা বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের আলোচনার সাফল্য ও ব্যর্থতায় বাংলাদেশের আসলে কী আসবে-যাবে? কিছু আসে-যায়?
অন্তঃসারশূন্যতার একটি গল্প মনে পড়ছে। অগ্রজপ্রতিম এক বন্ধু একদিন সকালে পুরানা পল্টনের সংসার ছেড়ে বেরিয়েছেন। গন্তব্য কাঁটাবন। একটি প্রেসে পোস্টারের ডিজাইন জমা দিলে টাকা পাবেন, সংসারের চাকা চলবে। তো প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাত ধরে কাঁটাবনের দিকে যাচ্ছেন, উল্টো পাশের বিএমএ ভবন থেকে স্বনামখ্যাত একজন কবি তাঁকে ডেকে থামালেন। হেমলক নামের একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। ঘরের ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল, আলোচনা সভা শেষে কেক-চানাচুর-কলার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আলোচনা আর শেষ হয় না। সকালের নাশতা না করে আসা বন্ধুটি উদ্গ্রীব আলোচনা শেষের জন্য। একেক বক্তা উঠছেন আর গম্ভীর গম্ভীর কথায় আবিষ্কার করতে চাইছেন, এই হেমলক কীভাবে তৈরি হয়েছে। আমার বন্ধুটি অধৈর্য হয়ে বলে বসলেন, ‘আমলকী দিয়ে তৈরি হয়েছে।’ হো হো হাসিতে গম্ভীর আলোচনা ভেঙে গেল।
আমার চারপাশেও গম্ভীর আলোচনা।
কিন্তু নীলকণ্ঠ আমি হাসতে পারছি না।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
No comments