অভিভাবকদের প্রতি-কলাভেরি নিয়ে ব্যাপারটি কী, ভাইসব? by গেরলিও নিমালন
আসলে এই লেখাটার বিষয় ওই ‘কলাভেরি ডি’ গানটা নয়। এক নাদান কিশোরের সত্যিকার অনুভূতিই এর বিষয়। এমনকি আমার মা-বাবাও জানেন না, এ রকম একটি লেখা আমি লিখেছি। জানলে তাঁরা ভাববেন, আমি পড়ালেখা ছেড়ে বাইরের কাজ করছি। তাঁদের জবানে এটা পাপ।
আমি পড়ছি দশম শ্রেণীতে। আমার কাছে এটা জীবনেরই আরেকটা ধাপ। কিন্তু আমার আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী এবং এমনকি অচেনা লোকও মুখ ভেংচিয়ে, ‘পাজির পাঝাড়া!’ বলে একটু দম নেবেন, তারপর বলবেন, ‘মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ছ! যাও, এক্ষুনি গিয়ে বই নিয়ে বসো!’ এ জন্যই আমি ছাড়া দশম শ্রেণীর আর সবাইকে (অথবা, আরও কয়েকজন অন্তত) ভুগতেই হয়।
আমাদের নিয়ে অতিচিন্তিত বাবা-মা, অতি উৎসাহী প্রতিবেশী, দায়িত্বশীল আত্মীয়স্বজন, হকার, ফেরিওয়ালা এবং ‘রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী-শিক্ষকগণের’ দায়িত্বশীলতায় (পড়ুন, নির্যাতনপ্রবণতা) আমরা হয়রান হয়ে যাই, দম হারিয়ে ফেলি। পাঠে মন দিতে, মুখস্থ করতে, শিখতে এবং দম-মুখ-খিঁচে প্রতিযোগিতায় নামতে বলা হয় আমাদের। এটাই শুধু বিরক্তির কারণ নয়। সবচেয়ে বড় জ্বালাতন হলো, সারাক্ষণ শুনতে হয় এটা পড়ো, ওটা পড়ো, সেটা পড়ো; এখানে পড়ো, সেখানে পড়ো, এখন পড়ো, তখনো পড়ো; আর ফ্যাকাশে সবুজ, হলুদ ও নীল ছকের ভেতরের সব কিছু মুখস্থ করো। এমনকি এসব থেকে নতুন এক ক্রিয়াপদও জন্মেছে—মুখস্থ করা। মানুষ তা-ই বলে, অমুক রচনাটি আমি একেবারে মুখস্থ করে নিয়েছি। এখন তো ইতিহাসের শিক্ষকেরাও লজ্জাজনকভাবে বলেন, ‘স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়কার সব ঘটনা একেবারে মুখস্থ করে রাখো।’
হরহামেশাই আমাকে সময় নষ্ট না করার নসিহত করা হয় এবং বলা হয়, যত্ন করে, বিরসবদনে এবং জানপ্রাণ দিয়ে কেবল ‘মুখস্থ করে যাও’। আমার মায়ের একটি কথাই বলি, ‘যত বিদ্বান হবে, ততই তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। এর বাইরে তোমার নাচ-গান-অভিনয়, বলা ও লেখার গুণ কোনো কাজেই আসবে না। তুমি তো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছ।’ বিদ্বান হওয়া বলতে তিনি বোঝেন পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়া, প্রথম হওয়া, সেরা ফল অর্জন করা। কী আর করা! আমি বরং বাধিত হয়ে, অল্প কথায় ফলপত্র প্রকাশের দিনের বাড়ির পরিবেশ কতটা ভীতিকর থাকে, তা বর্ণনা করি।
‘কত পেয়েছো?’
‘৭০০-এর মধ্যে ৬৪৩’।
‘আর অর্চনা পেয়েছে কত?’ (অর্চনা আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ভালো ফল করা ছাত্রী। ওর নামটা মোটামুটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে গেছে এবং অন্তহীনভাবে তার সঙ্গেই আমাদের সবার তুলনা করে বকাবকি চলতে থাকে।)
‘ও পেয়েছে ৭০০-তে ৬৬২’, আমার গোমড়ামুখো জবাব।
বাবা-মায়েদের প্রতি মিনতি করি: দয়া করে আপনার ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষার ফলের সঙ্গে অন্যের সন্তানদের তুলনা করবেন না। মানছি তো, প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর ব্যাপার, কিন্তু সেটা তো হওয়া উচিত আমার আর অর্চনার মধ্যে। কার সন্তান বেশি নম্বর পেয়েছে সেটা নিয়ে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে অর্চনার বাবা-মায়ের প্রতিযোগিতা হবে কেন? খুবই খারাপ লাগে যখন দেখি ৯৯ পাওয়ার পরও মাত্র এক নম্বরের জন্য খোঁটা দেওয়া হয়। বিশ্বাস করুন, ইংরেজি অতিশুদ্ধতাবাদী, তামিল ভাষা ভীতিকর, গণিত তালগোল পাকানো, পদার্থবিদ্যা মারাত্মক, রসায়ন বিভ্রান্তিকর, জীববিদ্যা মাথা গুলিয়ে দেয়, ইতিহাস তো মোটামুটি দোজখ আর ভূগোল হতবুদ্ধিকর। তার পরও জানপ্রাণ দিয়ে আমরা সব ‘মুখস্থ’ করে যাই।
দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, গালিগালাজভরা মেইল যদি না-ও পাঠান, হাজার হাজার (কম করে হলেও) বাবা-মা আর অভিভাবক আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। কী আর করব, পায়ে পড়ি, আমাদের একটু রেহাই দিন। একটু দম নেওয়ার জন্য সামান্য কিছুটা সময় বিরতি দিন। এর বেশি কিছু তো আমরা চাইছি না। আর নিপাত যাক কলাভেরি (ছ্যাঁকা সংগীত)।
দ্য হিন্দু থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
গেরলিও নিমালন: ভারতের তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র।
আমাদের নিয়ে অতিচিন্তিত বাবা-মা, অতি উৎসাহী প্রতিবেশী, দায়িত্বশীল আত্মীয়স্বজন, হকার, ফেরিওয়ালা এবং ‘রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী-শিক্ষকগণের’ দায়িত্বশীলতায় (পড়ুন, নির্যাতনপ্রবণতা) আমরা হয়রান হয়ে যাই, দম হারিয়ে ফেলি। পাঠে মন দিতে, মুখস্থ করতে, শিখতে এবং দম-মুখ-খিঁচে প্রতিযোগিতায় নামতে বলা হয় আমাদের। এটাই শুধু বিরক্তির কারণ নয়। সবচেয়ে বড় জ্বালাতন হলো, সারাক্ষণ শুনতে হয় এটা পড়ো, ওটা পড়ো, সেটা পড়ো; এখানে পড়ো, সেখানে পড়ো, এখন পড়ো, তখনো পড়ো; আর ফ্যাকাশে সবুজ, হলুদ ও নীল ছকের ভেতরের সব কিছু মুখস্থ করো। এমনকি এসব থেকে নতুন এক ক্রিয়াপদও জন্মেছে—মুখস্থ করা। মানুষ তা-ই বলে, অমুক রচনাটি আমি একেবারে মুখস্থ করে নিয়েছি। এখন তো ইতিহাসের শিক্ষকেরাও লজ্জাজনকভাবে বলেন, ‘স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়কার সব ঘটনা একেবারে মুখস্থ করে রাখো।’
হরহামেশাই আমাকে সময় নষ্ট না করার নসিহত করা হয় এবং বলা হয়, যত্ন করে, বিরসবদনে এবং জানপ্রাণ দিয়ে কেবল ‘মুখস্থ করে যাও’। আমার মায়ের একটি কথাই বলি, ‘যত বিদ্বান হবে, ততই তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। এর বাইরে তোমার নাচ-গান-অভিনয়, বলা ও লেখার গুণ কোনো কাজেই আসবে না। তুমি তো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছ।’ বিদ্বান হওয়া বলতে তিনি বোঝেন পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়া, প্রথম হওয়া, সেরা ফল অর্জন করা। কী আর করা! আমি বরং বাধিত হয়ে, অল্প কথায় ফলপত্র প্রকাশের দিনের বাড়ির পরিবেশ কতটা ভীতিকর থাকে, তা বর্ণনা করি।
‘কত পেয়েছো?’
‘৭০০-এর মধ্যে ৬৪৩’।
‘আর অর্চনা পেয়েছে কত?’ (অর্চনা আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ভালো ফল করা ছাত্রী। ওর নামটা মোটামুটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে গেছে এবং অন্তহীনভাবে তার সঙ্গেই আমাদের সবার তুলনা করে বকাবকি চলতে থাকে।)
‘ও পেয়েছে ৭০০-তে ৬৬২’, আমার গোমড়ামুখো জবাব।
বাবা-মায়েদের প্রতি মিনতি করি: দয়া করে আপনার ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষার ফলের সঙ্গে অন্যের সন্তানদের তুলনা করবেন না। মানছি তো, প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর ব্যাপার, কিন্তু সেটা তো হওয়া উচিত আমার আর অর্চনার মধ্যে। কার সন্তান বেশি নম্বর পেয়েছে সেটা নিয়ে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে অর্চনার বাবা-মায়ের প্রতিযোগিতা হবে কেন? খুবই খারাপ লাগে যখন দেখি ৯৯ পাওয়ার পরও মাত্র এক নম্বরের জন্য খোঁটা দেওয়া হয়। বিশ্বাস করুন, ইংরেজি অতিশুদ্ধতাবাদী, তামিল ভাষা ভীতিকর, গণিত তালগোল পাকানো, পদার্থবিদ্যা মারাত্মক, রসায়ন বিভ্রান্তিকর, জীববিদ্যা মাথা গুলিয়ে দেয়, ইতিহাস তো মোটামুটি দোজখ আর ভূগোল হতবুদ্ধিকর। তার পরও জানপ্রাণ দিয়ে আমরা সব ‘মুখস্থ’ করে যাই।
দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, গালিগালাজভরা মেইল যদি না-ও পাঠান, হাজার হাজার (কম করে হলেও) বাবা-মা আর অভিভাবক আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। কী আর করব, পায়ে পড়ি, আমাদের একটু রেহাই দিন। একটু দম নেওয়ার জন্য সামান্য কিছুটা সময় বিরতি দিন। এর বেশি কিছু তো আমরা চাইছি না। আর নিপাত যাক কলাভেরি (ছ্যাঁকা সংগীত)।
দ্য হিন্দু থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
গেরলিও নিমালন: ভারতের তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র।
No comments