জন্মদিন-অপরাজিত ৭৫ by বিপ্লব বাল
যে যতই হম্বিতম্বি করি, আমরা জন্মাই, বড় হই একেক মায়ের আঁচলতলে। তাই নিয়ে উপন্যাসে রবীন্দ্র-চরিত্র বলে, ‘বাঙালি ছেলেদের কখনো বয়স হয় না, তারা চিরকাল খোকাই থেকে যায়—প্রথমে মায়ের, তারপর বউয়ের হাতে খোকাই হয়ে থাকে। বড় হওয়া আর হয় না তাদের।’ ঘরে ঘরে মায়ের হাতেই নাকি থাকে সংসারের তাবৎ চাবিকাঠি।
বাবারা টাকা-পয়সা আয়-রোজগার করার বদৌলতে যতই কেন আপাত আস্ফাালন করে ফিরুক। বাঙালি সমাজে মেয়েরা জন্ম থেকেই জানে-শেখে, কী করে পুরুষের মুখের যত হামবড়া ‘হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা’ ওপরে ওপরে মেনেই তাকে হাতে রাখতে হয়, তাঁবে রাখতে হয়। একালের রোজগেরে শিক্ষিত আধুনিক নারী এই চিরকেলে কলাকৌশল ছেড়ে অবতীর্ণ হয় সম্মুখ সমরে—নারী অধিকার বলে কথা! সেই বিষম রণে সংসারের এমন হাল আজ।
আমি একজন মাকে জানি, চিরকাল আর একাল এই দুই নৌকায় পা দিয়ে সংসার চালিয়েছেন যিনি। তাঁর বাবা, বিরাজমোহন ছিলেন যে আশ্চর্য এক রেনেসাঁ-মানুষ, গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ে বসেও কলকাতায় গিয়ে সর্বাগ্রসর ব্রাহ্ম শিক্ষিত সমাজ থেকে শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী নিয়ে গিয়ে গ্রামে খুলে বসেন নারী বিদ্যালয়, সেখানে আবাসিক হোস্টেলও ছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়ে জোগাড় করে ফিরতেন। স্কুলে নাটক ও অভিনয় করত মেয়েরা। আমাদের এই মা-টি ঝাঁসির রানি নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন, সবাই ধন্য ধন্য করে। তারপর ভর্তি হন তিনি কলকাতার, স্কুলে। সেখানে নানা অগ্রসর পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে এক হোস্টেলে থাকতে থাকতে কত কত সব মুক্তি-ভাবনার স্বাদ পান। রাজনীতি করা মেয়েরাও ছিল তো। নাটক-সিনেমা দেখা তো চলতই। উপমহাদেশের সেরা শহরের কাছেই হয় হাতেখড়ি এভাবেই তাঁর।
পার্শ্ববর্তী আঠারো গ্রামের প্রথম উচ্চশিক্ষিত এক যুবক খোঁজ পান এই রূপবতী গুণবতীর। বিয়ে হয় তাঁদের। কলকাতায় চলাফেরায় অভ্যস্ত এই মেয়েকেই বউ হিসেবে যেতে হয় মাদারীপুরের অজগ্রামের এক নিরক্ষর গরিব পরিবারে। বাড়ির একেবার বড় বউ হিসেবে ১৪ বছরের বালিকা সেই বধূটিকে। সে বড় সহজ গান তো ছিল না। তারপর নবদম্পতি কলকাতায় আবাস গাড়ে, স্বামী সরকারি চাকুরে হন। নিরপদ্রুব সেই সুখও সয় না বেশি দিন। ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন দেশে। গ্রামের কাকা-জ্যাঠা মিলে তাঁদের শিক্ষিত সন্তানকে ফিরিয়ে আনেন দেশে। নির্বাচনে জয়ী হন যে মুসলিম লীগের মন্ত্রীর জামানত বাজেয়াপ্ত করে। মন্ত্রী প্রবর মিথ্যা মামলায় জড়ান স্বামীকে। থানায় নির্বাচনী সমন্বয়ক সেই বালিকাবধূটির স্বামীকে ‘ঝাঁসির রানী’-সুলভ বরাভয়-দান কখনো ভোলেননি পাশে উপবিষ্ট চিরসংগ্রামী ফণীভূষণ মজুমদার। কতজনকে না বলে বেড়িয়েছেন সেই নাটুকে সংলাপ, ‘তুমি দেশ ও দশের জন্য...’। তারপর হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠ সদস্য স্বামী—বছর দুয়েকে সব ভেস্তে যায় আইয়ুবী সামরিক ঘোষণায়।
ফরিদপুর শহরে ভাড়াবাসায় আস্তানা গাড়েন এই মা-টি স্বামী-পুত্রকন্যা নিয়ে। জীবিকায় বিমনা রাজনীতি-পাগল স্বামীর সংসারে পরিবারের সব ভার এসে পড়ে এই চিরকেলে বাঙালি মায়েরই হাতে। তাতে তিনি বুঝি ১০০-তে ১০০ পেয়েই উত্তীর্ণ। শহরের সবারই ভাষ্য: মায়ের কারণেই এই রাজনৈতিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়েছে।
তখনো অপ্রকাশিত তাঁর ভেতরের আরেক নারী। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বাইরে চলে গেলে ছেলের বন্ধু সিরাজুল আযম আর দেশের প্রায় সব কাজের নাটের গুরু ওয়াহিদুল হকের মন্তরে শিশু সংগঠন ‘ফুলকি’র প্রতিষ্ঠা ১৯৮৭। চট্টগ্রামের ফুলকির সায় ছিল তাতে। তারপর বছর ২৫ ধরে তিনি হয়ে ওঠেন ফুলকির মাসিমা/দিদা থেকে শহরেরই বহু বহুজনের সর্বজনীন এক মাসিমা, ছোটদের দিদা। শহরে হেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই, যেখানে তিনি বিশিষ্ট বক্তা নন। বাগ্মী স্বামী, গৌরচন্দ্র বালা প্রথম প্রথম নিশ্চয় মুচকি হেসেছেন, নবীনা এই ভাষিকার ক্রমবর্ধমান নামকামে।
আমরা জানি, নাগরিক নানা প্রবর্তনায় বাঙালি এই মাসিমাদের অম্লান বিভা রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে। বরিশালের মনোরামা মাসিমা এই সেদিনও ছিলেন মূর্তিমতী এক মাতৃকাশক্তি। সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে খালাম্মা সুফিয়া কামাল কি ‘আমার মায়ের মৃত্যু নেই’—জাহানারা ইমাম।
তাতেই বুঝি, সমাজের অন্তস্তলে আজিও এক মাতৃতান্ত্রিকতায় অনিঃশেষ চির ফল্গুপ্রবহন। অবশ্য পুরুষেরই প্রতিনিধি যত নারীনেত্রী সবাই এর মধ্যে পড়েন না। তাঁরা ক্ষমতাধরেরই নারীর রকমফের।
পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনে চিরকালের বাঙালি নারীর একালের এই নাগরিক রূপান্তরিতাকে প্রণাম: শতায়ু হও তুমি আয়ুষ্মতী।
ফরিদপুরের নাগরিক সমাজ আজ ২২ মার্চ আয়োজন করেছে—অঞ্জলি বালা পঞ্চসপ্ততিতম জন্মোৎসব।
বিপ্লব বাল
আমি একজন মাকে জানি, চিরকাল আর একাল এই দুই নৌকায় পা দিয়ে সংসার চালিয়েছেন যিনি। তাঁর বাবা, বিরাজমোহন ছিলেন যে আশ্চর্য এক রেনেসাঁ-মানুষ, গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ে বসেও কলকাতায় গিয়ে সর্বাগ্রসর ব্রাহ্ম শিক্ষিত সমাজ থেকে শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী নিয়ে গিয়ে গ্রামে খুলে বসেন নারী বিদ্যালয়, সেখানে আবাসিক হোস্টেলও ছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়ে জোগাড় করে ফিরতেন। স্কুলে নাটক ও অভিনয় করত মেয়েরা। আমাদের এই মা-টি ঝাঁসির রানি নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন, সবাই ধন্য ধন্য করে। তারপর ভর্তি হন তিনি কলকাতার, স্কুলে। সেখানে নানা অগ্রসর পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে এক হোস্টেলে থাকতে থাকতে কত কত সব মুক্তি-ভাবনার স্বাদ পান। রাজনীতি করা মেয়েরাও ছিল তো। নাটক-সিনেমা দেখা তো চলতই। উপমহাদেশের সেরা শহরের কাছেই হয় হাতেখড়ি এভাবেই তাঁর।
পার্শ্ববর্তী আঠারো গ্রামের প্রথম উচ্চশিক্ষিত এক যুবক খোঁজ পান এই রূপবতী গুণবতীর। বিয়ে হয় তাঁদের। কলকাতায় চলাফেরায় অভ্যস্ত এই মেয়েকেই বউ হিসেবে যেতে হয় মাদারীপুরের অজগ্রামের এক নিরক্ষর গরিব পরিবারে। বাড়ির একেবার বড় বউ হিসেবে ১৪ বছরের বালিকা সেই বধূটিকে। সে বড় সহজ গান তো ছিল না। তারপর নবদম্পতি কলকাতায় আবাস গাড়ে, স্বামী সরকারি চাকুরে হন। নিরপদ্রুব সেই সুখও সয় না বেশি দিন। ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন দেশে। গ্রামের কাকা-জ্যাঠা মিলে তাঁদের শিক্ষিত সন্তানকে ফিরিয়ে আনেন দেশে। নির্বাচনে জয়ী হন যে মুসলিম লীগের মন্ত্রীর জামানত বাজেয়াপ্ত করে। মন্ত্রী প্রবর মিথ্যা মামলায় জড়ান স্বামীকে। থানায় নির্বাচনী সমন্বয়ক সেই বালিকাবধূটির স্বামীকে ‘ঝাঁসির রানী’-সুলভ বরাভয়-দান কখনো ভোলেননি পাশে উপবিষ্ট চিরসংগ্রামী ফণীভূষণ মজুমদার। কতজনকে না বলে বেড়িয়েছেন সেই নাটুকে সংলাপ, ‘তুমি দেশ ও দশের জন্য...’। তারপর হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠ সদস্য স্বামী—বছর দুয়েকে সব ভেস্তে যায় আইয়ুবী সামরিক ঘোষণায়।
ফরিদপুর শহরে ভাড়াবাসায় আস্তানা গাড়েন এই মা-টি স্বামী-পুত্রকন্যা নিয়ে। জীবিকায় বিমনা রাজনীতি-পাগল স্বামীর সংসারে পরিবারের সব ভার এসে পড়ে এই চিরকেলে বাঙালি মায়েরই হাতে। তাতে তিনি বুঝি ১০০-তে ১০০ পেয়েই উত্তীর্ণ। শহরের সবারই ভাষ্য: মায়ের কারণেই এই রাজনৈতিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়েছে।
তখনো অপ্রকাশিত তাঁর ভেতরের আরেক নারী। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বাইরে চলে গেলে ছেলের বন্ধু সিরাজুল আযম আর দেশের প্রায় সব কাজের নাটের গুরু ওয়াহিদুল হকের মন্তরে শিশু সংগঠন ‘ফুলকি’র প্রতিষ্ঠা ১৯৮৭। চট্টগ্রামের ফুলকির সায় ছিল তাতে। তারপর বছর ২৫ ধরে তিনি হয়ে ওঠেন ফুলকির মাসিমা/দিদা থেকে শহরেরই বহু বহুজনের সর্বজনীন এক মাসিমা, ছোটদের দিদা। শহরে হেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই, যেখানে তিনি বিশিষ্ট বক্তা নন। বাগ্মী স্বামী, গৌরচন্দ্র বালা প্রথম প্রথম নিশ্চয় মুচকি হেসেছেন, নবীনা এই ভাষিকার ক্রমবর্ধমান নামকামে।
আমরা জানি, নাগরিক নানা প্রবর্তনায় বাঙালি এই মাসিমাদের অম্লান বিভা রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে। বরিশালের মনোরামা মাসিমা এই সেদিনও ছিলেন মূর্তিমতী এক মাতৃকাশক্তি। সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে খালাম্মা সুফিয়া কামাল কি ‘আমার মায়ের মৃত্যু নেই’—জাহানারা ইমাম।
তাতেই বুঝি, সমাজের অন্তস্তলে আজিও এক মাতৃতান্ত্রিকতায় অনিঃশেষ চির ফল্গুপ্রবহন। অবশ্য পুরুষেরই প্রতিনিধি যত নারীনেত্রী সবাই এর মধ্যে পড়েন না। তাঁরা ক্ষমতাধরেরই নারীর রকমফের।
পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনে চিরকালের বাঙালি নারীর একালের এই নাগরিক রূপান্তরিতাকে প্রণাম: শতায়ু হও তুমি আয়ুষ্মতী।
ফরিদপুরের নাগরিক সমাজ আজ ২২ মার্চ আয়োজন করেছে—অঞ্জলি বালা পঞ্চসপ্ততিতম জন্মোৎসব।
বিপ্লব বাল
No comments