চারদিক-পরিবর্তনটা তাহলে কোথায় হলো? by শারমিন নাহার
৩০ এপ্রিল। ভোর। ভোরের আলো ফোটার আগেই জেগে উঠেছেন তাঁরা। নাওয়া-খাওয়া সেরে তৈরি হয়ে ছুটে এসেছেন গন্তব্যে। ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর ছোঁয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে ঢোকা চাই, নচেৎ বেতন থেকে কিছু টাকা কেটে রাখা হবে। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না মর্জিনার।
নগরের পশ্চিম রাজাবাজারের সরু পথ ধরেই দ্রুত হাঁটছিলেন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা। সকাল থেকেই কিছুটা মেঘলা আকাশ, মাঝে মাঝে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েছে, তপ্ত নগরে বৃষ্টির ফোঁটা আশীর্বাদ হলেও এই বৃষ্টিকে আশীর্বাদ ভাবতে পারছেন না মর্জিনা ও তাঁর সঙ্গীরা। আকাশ থেকে মেঘ সরে যায়। রোদ্দুর। এ সময় কথা বলার ফুরসত তাঁদের নেই। নিজেকে কোনোরকমে তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করি।
কাজ করেন কোথায়?
মর্জিনার উত্তর: ফার্মগেটের কাছে একটা গার্মেন্টসে।
কাজের সময় আর বেতন নিয়ে প্রশ্ন করতেই উত্তর মেলে, সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। মাঝে কেবল এক ঘণ্টা খাবারের বিরতি। অনেক শ্রমের কাজ হলেও মাস শেষে এ জন্য মজুরি পান মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। বাড়ির লোকজনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই ঢাকায় এসেছিলেন মর্জিনা। তবে এখন এই টাকায় নিজের চলাই কষ্টকর।
মর্জিনা অকপটে বলেন, ‘কন, এই বাজারে সাড়ে তিন হাজার টাকায় কী হয়? এত কাজ করি, তার পরও কাজের তুলনায় সে পরিমাণ পারিশ্রমিক পাই না। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভালো নয়—অনেক গরম, ধুলাবালি, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির অভাব আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়।’
মর্জিনার এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই আমাদের সবাইকে ভাবায়। ছুটির দিনে ওভারটাইম করে অনেকটা কষ্ট করে চলতে হয় মর্জিনাদের। আর সময় দিতে পারলেন না মর্জিনা। মলিন মুখে একচিলতে হাসি হেসে চলে গেলেন।
১ মে। দুপুর। নীলক্ষেত পেরিয়ে নিউমার্কেটের সামনে যেতেই জোর গলায় হাঁক দিতে শোনা যায়, ‘ফারামগেট’। এই কণ্ঠ কাশেমের। কাশেম ছেলেটা ছোট। তাতে কী! গলায় জোর তার কম নয়। জোরে জোরে চিৎকার করে যাত্রী সংগ্রহ করাই তার কাজ। স্কুলে গিয়েছিল কয়েক ক্লাস, তারপর আর হয়ে ওঠেনি। হেলপারি করাই তার কাজ। অনেক ঝুঁকি নিয়েই তাকে এ কাজ করতে হয়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তার পরও সে পরিমাণ মূল্যায়ন নেই। কাশেম বলে, ‘সারা দিন শেষে ওস্তাদ ৫০ ট্যাকা দেয়। মাঝে মাঝে আবার খাওনও দেয়, তয় সব সময় না।’
কোনো ছুটিছাটা?
‘ছুটি আবার কিয়ের। তয় হরতাল হলে কিছুক্ষণ ছুটি পাই। ছুটি পাইলে তো আর প্যাট চলব না। সকাল আটটা বাজে আহি, কাম করি রাত তামাতি।’
এই বয়সে যে শিশু হয়তো স্কুলে যেত, সে কাজ করছে এবং তা সময়ের হিসাবে কয়েক ঘণ্টা নয়, বরং করতে হয় দিনমান।
মোমেনা বেগম ও তাঁর স্বামী মোহাম্মদ ফারুক মিয়া একসঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। আজিমপুরের একটি বাড়িতে দেয়াল করার জন্য মাটি খুঁড়ছেন তাঁর স্বামী। মোমেনা ঝুড়িতে ভরে দিচ্ছেন মাটি। দুজনেরই চুলে পাক ধরেছে, বয়সের ভারে কিছুটা ঝুঁকেও পড়েছেন; তার পরও পেটের দায়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু পরিশ্রম স্বামীর মতো করলেও মোমেনা বেগম দিন শেষে স্বামীর চেয়ে ৫০ টাকা কম পান। কারণ, তিনি নারী। মোমেনা বেগম বলেন, ‘আমি তো গতর খাটায় কাম করি, তার পরেও কম টেকা দেয়। মালিকে কয়, আমি বেডি।’
দুজনকেই প্রশ্ন করি, পয়লা মে কী, জানেন?
দুজনের একই উত্তর, তাঁরা জানেন না এবং জানার আগ্রহ বোধ করেন না। কারণ, ‘জানলে তো প্যাট ভরব না। সকাল আটটা থেকে কোনো দিন ছয়টা, আবার সাতটা পর্যন্ত কাজ করি।’
একজন মানুষ যদি ১০-১১ ঘণ্টা কাজ করেও সে পরিমাণ মজুরি না পান, তবে কেন এই মে দিবস?
কে মোমেনা বেগমকে বলবে, ইতিহাসের পাতা উল্টে একটু পেছনে গেলেই মিলবে ১৮৮৬ সালের ঘটনা। শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকেরা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ে সোচ্চার হন। আর এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। প্রাণ দিতে হয় অসংখ্য শ্রমিককে। এ ঘটনার কথা ইউরোপের শ্রমিকেরা জানতে পারেন। তাঁরাও সংহতি জানিয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন। একসময় আট ঘণ্টা কর্মদিবস আর বাঁচার মতো মজুরি হয়ে ওঠে শ্রমিকের বৈশ্বিক দাবি। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮৯০ সাল থেকেই তা বিশ্বের নানা দেশে পালিত হয়ে আসছে।
ফিরে আসার সময় ধানমন্ডিতে দেখা হলো দুটি ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে। বড়টির নাম মৌসুমী, ছোটটির সোনিয়া। ওরা পথের ধারে কাগজ, প্লাস্টিক কুড়ায়। আজ ওদের মন খারাপ। যে পরিমাণ কাগজ আর প্লাস্টিকের ডিব্বা জোগাড় করেছে, তাতে বেশি টাকা আয় হবে না। আর বেশি টাকা আয় না হলে ঠিকমতো খাওয়া হবে না। ওদের বাবাও একজন শ্রমিক। ওদের শ্রমিক বলা যায় কি না, জানি না। কিন্তু মে দিবসের এই দিনে ওদের চোখে যে আকুতি, তা মন ছুঁয়ে যায়।
যাঁদের জন্য মে দিবস, সেই মোমেনা বেগম কিংবা কাশেম কিংবা সোনিয়া জানেনই না দিনটির তাৎপর্য। পরিবর্তনটা তাহলে কোথায় হলো?
শারমিন নাহার
কাজ করেন কোথায়?
মর্জিনার উত্তর: ফার্মগেটের কাছে একটা গার্মেন্টসে।
কাজের সময় আর বেতন নিয়ে প্রশ্ন করতেই উত্তর মেলে, সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। মাঝে কেবল এক ঘণ্টা খাবারের বিরতি। অনেক শ্রমের কাজ হলেও মাস শেষে এ জন্য মজুরি পান মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। বাড়ির লোকজনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই ঢাকায় এসেছিলেন মর্জিনা। তবে এখন এই টাকায় নিজের চলাই কষ্টকর।
মর্জিনা অকপটে বলেন, ‘কন, এই বাজারে সাড়ে তিন হাজার টাকায় কী হয়? এত কাজ করি, তার পরও কাজের তুলনায় সে পরিমাণ পারিশ্রমিক পাই না। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভালো নয়—অনেক গরম, ধুলাবালি, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির অভাব আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়।’
মর্জিনার এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই আমাদের সবাইকে ভাবায়। ছুটির দিনে ওভারটাইম করে অনেকটা কষ্ট করে চলতে হয় মর্জিনাদের। আর সময় দিতে পারলেন না মর্জিনা। মলিন মুখে একচিলতে হাসি হেসে চলে গেলেন।
১ মে। দুপুর। নীলক্ষেত পেরিয়ে নিউমার্কেটের সামনে যেতেই জোর গলায় হাঁক দিতে শোনা যায়, ‘ফারামগেট’। এই কণ্ঠ কাশেমের। কাশেম ছেলেটা ছোট। তাতে কী! গলায় জোর তার কম নয়। জোরে জোরে চিৎকার করে যাত্রী সংগ্রহ করাই তার কাজ। স্কুলে গিয়েছিল কয়েক ক্লাস, তারপর আর হয়ে ওঠেনি। হেলপারি করাই তার কাজ। অনেক ঝুঁকি নিয়েই তাকে এ কাজ করতে হয়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তার পরও সে পরিমাণ মূল্যায়ন নেই। কাশেম বলে, ‘সারা দিন শেষে ওস্তাদ ৫০ ট্যাকা দেয়। মাঝে মাঝে আবার খাওনও দেয়, তয় সব সময় না।’
কোনো ছুটিছাটা?
‘ছুটি আবার কিয়ের। তয় হরতাল হলে কিছুক্ষণ ছুটি পাই। ছুটি পাইলে তো আর প্যাট চলব না। সকাল আটটা বাজে আহি, কাম করি রাত তামাতি।’
এই বয়সে যে শিশু হয়তো স্কুলে যেত, সে কাজ করছে এবং তা সময়ের হিসাবে কয়েক ঘণ্টা নয়, বরং করতে হয় দিনমান।
মোমেনা বেগম ও তাঁর স্বামী মোহাম্মদ ফারুক মিয়া একসঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। আজিমপুরের একটি বাড়িতে দেয়াল করার জন্য মাটি খুঁড়ছেন তাঁর স্বামী। মোমেনা ঝুড়িতে ভরে দিচ্ছেন মাটি। দুজনেরই চুলে পাক ধরেছে, বয়সের ভারে কিছুটা ঝুঁকেও পড়েছেন; তার পরও পেটের দায়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু পরিশ্রম স্বামীর মতো করলেও মোমেনা বেগম দিন শেষে স্বামীর চেয়ে ৫০ টাকা কম পান। কারণ, তিনি নারী। মোমেনা বেগম বলেন, ‘আমি তো গতর খাটায় কাম করি, তার পরেও কম টেকা দেয়। মালিকে কয়, আমি বেডি।’
দুজনকেই প্রশ্ন করি, পয়লা মে কী, জানেন?
দুজনের একই উত্তর, তাঁরা জানেন না এবং জানার আগ্রহ বোধ করেন না। কারণ, ‘জানলে তো প্যাট ভরব না। সকাল আটটা থেকে কোনো দিন ছয়টা, আবার সাতটা পর্যন্ত কাজ করি।’
একজন মানুষ যদি ১০-১১ ঘণ্টা কাজ করেও সে পরিমাণ মজুরি না পান, তবে কেন এই মে দিবস?
কে মোমেনা বেগমকে বলবে, ইতিহাসের পাতা উল্টে একটু পেছনে গেলেই মিলবে ১৮৮৬ সালের ঘটনা। শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকেরা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ে সোচ্চার হন। আর এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। প্রাণ দিতে হয় অসংখ্য শ্রমিককে। এ ঘটনার কথা ইউরোপের শ্রমিকেরা জানতে পারেন। তাঁরাও সংহতি জানিয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন। একসময় আট ঘণ্টা কর্মদিবস আর বাঁচার মতো মজুরি হয়ে ওঠে শ্রমিকের বৈশ্বিক দাবি। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮৯০ সাল থেকেই তা বিশ্বের নানা দেশে পালিত হয়ে আসছে।
ফিরে আসার সময় ধানমন্ডিতে দেখা হলো দুটি ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে। বড়টির নাম মৌসুমী, ছোটটির সোনিয়া। ওরা পথের ধারে কাগজ, প্লাস্টিক কুড়ায়। আজ ওদের মন খারাপ। যে পরিমাণ কাগজ আর প্লাস্টিকের ডিব্বা জোগাড় করেছে, তাতে বেশি টাকা আয় হবে না। আর বেশি টাকা আয় না হলে ঠিকমতো খাওয়া হবে না। ওদের বাবাও একজন শ্রমিক। ওদের শ্রমিক বলা যায় কি না, জানি না। কিন্তু মে দিবসের এই দিনে ওদের চোখে যে আকুতি, তা মন ছুঁয়ে যায়।
যাঁদের জন্য মে দিবস, সেই মোমেনা বেগম কিংবা কাশেম কিংবা সোনিয়া জানেনই না দিনটির তাৎপর্য। পরিবর্তনটা তাহলে কোথায় হলো?
শারমিন নাহার
No comments