গন্তব্য ঢাকা-এই গ্রীষ্মে শীতের পিঠার স্মৃতি by শর্মিলা সিনড্রেলা
গ্রীষ্মকালে শীতের কথা। ‘শীতের সময় আইলে বাড়ির কথা বেশি মনে হয়। গ্রামে থাকলে ওই সময় খেজুরের গুড়, আর কত্ত রকমের পিঠা যে খাওয়া হয়, তার হিসাব নাই। ঢাকায় এখন ওগুলা খাওয়া হয় না। মায়ের হাতের রান্নার কথা সব সময় মনে পড়ে। যে যতই ভালো রান্না করুক, মায়ের মতো কেউ-ই রানতে জানে না।’ কথাগুলো বলছিলেন মো. বাবুল।
বহু দূরে মাদারীপুরের চরনাচনা গ্রামে নিজের মমতাময়ী মাকে রেখে এসেছেন তিনি।
গ্রামে তখন বাবুলের অভাবেই দিন চলেছে। কোনো রকমে দিন যায়। গ্রাম থেকে সমবয়সী বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ঢাকায় এসেছিল এবং তিনি শুনেছিলেন যে তারা বেশ ভালো আয় করে। তাই একদিন বন্ধু ফারুকের হাত ধরে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। তা-ও তো আজ ১২ বছর হয়ে গেল। ‘গ্রামে ইনকাম থাউক আর না থাউক, ওটা জন্মস্থান, ভালো তো লাগবই। কিন্তু জীবনে টাকারও তো দরকার আছে। তাই এই ঢাকায় থাকা।’ বললেন বাবুল।
প্রথম যখন এই ঢাকায় এসেছিলেন, তখন বন্ধুর সঙ্গেই বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে রঙের কাজ করতেন। একসময় সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে নিলেন হাসপাতালে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ। কিন্তু না, এসব করে যেন ভালো লাগছিল না। তাই নিজেই একটা ছোট ব্যবসা করার চিন্তা করলেন। তারপর কিনে ফেললেন আখের রস বের করার মেশিন। এখন এই মেশিনই জোগাড় করে দেয় তাঁর সারা দিনের আহার। ঢাকার মৌচাক মার্কেটের সামনে দিয়ে মালিবাগ রেলগেটের দিকে কয়েক পা এগোলেই হাতের বাঁ দিকে দেখা মেলে মো. বাবুলের। পিপাসার্ত পথচারীকে বরফ মেশানো আখের রস খাইয়ে তৃপ্ত করতেই তিনি বেশি তৃপ্তি পান। তাই তো এই মেশিন। কিছু আখ, বরফ আর গুটি কয়েক গ্লাস নিয়ে সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তিনি। বাবুল বলেন, ‘দুপুরের দিকে বিক্রি হয় বেশি। আবার রাতে একটু কম হয়। আর শীত আসলে বিক্রি তো একেবারেই কম হয়। তাই তখন এই ব্যবসা না করে পপকর্ন তৈরি করি। পপকর্ন তৈরির মেশিনও আমার আছে।’
গ্রামের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর তাঁর অনেক প্রিয় ছিল। জমিতে সবাই মিলে ইরি ধান লাগানো, কখনো বা একসঙ্গে মাছ ধরা—সবই উপভোগ করতেন তিনি। মৌসুম শেষে যখন সেই মাঠে নিজের হাতে লাগানো ফসল ফলত, তখন অনেক খুশি হতেন বাবুল। বাবুলের ভাষায় ‘আজ অনেক দিন হলো ঢাকায় এসেছি। তখন এসব করে অনেক আনন্দ পেতাম। কিন্তু এখন তো এসব প্রায় ভুইলাই গেছি। এখন মনে হয় আর এসব করতে পারব না। অতটা ভালোও লাগে না এখন।’
মাদারীপুর দিয়ে বয়ে চলা নদীতে ট্রলার চালাতেন বাবুল। এতে তাঁর আয়ও হতো কিছু। ট্রলার নিয়ে কখনো যেতেন খুলনায়। তারপর সেখান থেকে বয়ে আনতেন লবণ। আবার কখনো ছুটতেন বরিশালে। সেখান থেকে আনতেন কাঠ। আর মাদারীপুর থেকে পাট নিয়ে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়। নদীর ওপর ভেসে ভেসে বিভিন্ন জায়গায় যেতে বেশ ভালোই লাগত বাবুলের। কিন্তু আয়টা তো যথেষ্ট হতো না। একবার সেই ট্রলারেই বাধল বিপত্তি। বাবুল তাঁর বর্ণনা দেন এভাবে—‘ট্রলারে আমরা চাইরজন আছিলাম। মালবোঝাই ট্রলার। তখন ডাকাতেরা আমাদের ট্রলারে ডাকাতি করতে চাইছিল। ওরা ইশারা করছিল যেন আমরা ট্রলার থামাই। আরেকটা লঞ্চ দিয়া ওরা আমাদের ওপর হামলা করতে চাইছিল। কিন্তু আমরা ট্রলার থামাইনি, নদীর পাড়ে ট্রলার নিয়া গিয়া চিৎকার করতে থাকি। তখন লোকজন আইলে চোরেরা পালায়।’
বাবা সুলতান জমাদ্দার মারা গেছেন আজ অনেক দিন হলো। গ্রামেই আছেন মা রোকেয়া বেগম। বাবুলের আরেক ভাই কামালও থাকেন ঢাকায়। এক ভাই বিদেশে। আর বড় ভাই লিয়াকত স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামেই থাকেন, দেখাশোনা করেন মায়ের। ঢাকায় স্ত্রী নূরনাহার বেগম আর সন্তান মেহেদী হাসানকে নিয়ে ছোট সংসার বাবুলের।
ঢাকার মেয়ে নূরনাহারের গ্রামে থাকার ইচ্ছে নেই। আর বাবুলের মনে হয়, ‘ওহানে গ্যালে তো প্যাট বাঁচব না। আয়-ইনকাম নাই।’ তাই গ্রামে যাওয়া হবে না হয়তো বাবুলের। ঢাকাতেই একটু জমি কিনে ছোট একটা ঘর বাঁধতে চান তিনি। টাকার অভাবে নিজের লেখাপড়া হয়নি, তাই ছেলেটাকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তবু জন্মস্থানের প্রতি টান তিনি ভুলতে পারেন না কিছুতেই। বলেন, ‘ঢাকায় গরমে অনেক কষ্ট হয়। গ্রামে অত গরমও লাগে না। আবার গরম লাগলে মাঠে গেলেই বাতাস লাগে।’ এক বছর পর যখন বাড়ি যান মো. বাবুল, তখন মায়ের আনন্দের শেষ থাকে না। সারা বছরের খাবার যেন তখনই তৈরি করেন। পিঠা, পায়েস থেকে শুরু করে শাকসবজি। সবই যেন নিজের হাতে ছেলের মুখে তুলে দিতে চান রোকেয়া বেগম। বাবুলও অপেক্ষায় থাকেন এসব ভালোবাসার। হয়তো ওদিকে মা সারা বছরই পথের দিকে চেয়ে বসে থাকেন স্নেহের ছেলের আশায়।
শর্মিলা সিনড্রেলা
গ্রামে তখন বাবুলের অভাবেই দিন চলেছে। কোনো রকমে দিন যায়। গ্রাম থেকে সমবয়সী বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ঢাকায় এসেছিল এবং তিনি শুনেছিলেন যে তারা বেশ ভালো আয় করে। তাই একদিন বন্ধু ফারুকের হাত ধরে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। তা-ও তো আজ ১২ বছর হয়ে গেল। ‘গ্রামে ইনকাম থাউক আর না থাউক, ওটা জন্মস্থান, ভালো তো লাগবই। কিন্তু জীবনে টাকারও তো দরকার আছে। তাই এই ঢাকায় থাকা।’ বললেন বাবুল।
প্রথম যখন এই ঢাকায় এসেছিলেন, তখন বন্ধুর সঙ্গেই বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে রঙের কাজ করতেন। একসময় সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে নিলেন হাসপাতালে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ। কিন্তু না, এসব করে যেন ভালো লাগছিল না। তাই নিজেই একটা ছোট ব্যবসা করার চিন্তা করলেন। তারপর কিনে ফেললেন আখের রস বের করার মেশিন। এখন এই মেশিনই জোগাড় করে দেয় তাঁর সারা দিনের আহার। ঢাকার মৌচাক মার্কেটের সামনে দিয়ে মালিবাগ রেলগেটের দিকে কয়েক পা এগোলেই হাতের বাঁ দিকে দেখা মেলে মো. বাবুলের। পিপাসার্ত পথচারীকে বরফ মেশানো আখের রস খাইয়ে তৃপ্ত করতেই তিনি বেশি তৃপ্তি পান। তাই তো এই মেশিন। কিছু আখ, বরফ আর গুটি কয়েক গ্লাস নিয়ে সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তিনি। বাবুল বলেন, ‘দুপুরের দিকে বিক্রি হয় বেশি। আবার রাতে একটু কম হয়। আর শীত আসলে বিক্রি তো একেবারেই কম হয়। তাই তখন এই ব্যবসা না করে পপকর্ন তৈরি করি। পপকর্ন তৈরির মেশিনও আমার আছে।’
গ্রামের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর তাঁর অনেক প্রিয় ছিল। জমিতে সবাই মিলে ইরি ধান লাগানো, কখনো বা একসঙ্গে মাছ ধরা—সবই উপভোগ করতেন তিনি। মৌসুম শেষে যখন সেই মাঠে নিজের হাতে লাগানো ফসল ফলত, তখন অনেক খুশি হতেন বাবুল। বাবুলের ভাষায় ‘আজ অনেক দিন হলো ঢাকায় এসেছি। তখন এসব করে অনেক আনন্দ পেতাম। কিন্তু এখন তো এসব প্রায় ভুইলাই গেছি। এখন মনে হয় আর এসব করতে পারব না। অতটা ভালোও লাগে না এখন।’
মাদারীপুর দিয়ে বয়ে চলা নদীতে ট্রলার চালাতেন বাবুল। এতে তাঁর আয়ও হতো কিছু। ট্রলার নিয়ে কখনো যেতেন খুলনায়। তারপর সেখান থেকে বয়ে আনতেন লবণ। আবার কখনো ছুটতেন বরিশালে। সেখান থেকে আনতেন কাঠ। আর মাদারীপুর থেকে পাট নিয়ে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়। নদীর ওপর ভেসে ভেসে বিভিন্ন জায়গায় যেতে বেশ ভালোই লাগত বাবুলের। কিন্তু আয়টা তো যথেষ্ট হতো না। একবার সেই ট্রলারেই বাধল বিপত্তি। বাবুল তাঁর বর্ণনা দেন এভাবে—‘ট্রলারে আমরা চাইরজন আছিলাম। মালবোঝাই ট্রলার। তখন ডাকাতেরা আমাদের ট্রলারে ডাকাতি করতে চাইছিল। ওরা ইশারা করছিল যেন আমরা ট্রলার থামাই। আরেকটা লঞ্চ দিয়া ওরা আমাদের ওপর হামলা করতে চাইছিল। কিন্তু আমরা ট্রলার থামাইনি, নদীর পাড়ে ট্রলার নিয়া গিয়া চিৎকার করতে থাকি। তখন লোকজন আইলে চোরেরা পালায়।’
বাবা সুলতান জমাদ্দার মারা গেছেন আজ অনেক দিন হলো। গ্রামেই আছেন মা রোকেয়া বেগম। বাবুলের আরেক ভাই কামালও থাকেন ঢাকায়। এক ভাই বিদেশে। আর বড় ভাই লিয়াকত স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামেই থাকেন, দেখাশোনা করেন মায়ের। ঢাকায় স্ত্রী নূরনাহার বেগম আর সন্তান মেহেদী হাসানকে নিয়ে ছোট সংসার বাবুলের।
ঢাকার মেয়ে নূরনাহারের গ্রামে থাকার ইচ্ছে নেই। আর বাবুলের মনে হয়, ‘ওহানে গ্যালে তো প্যাট বাঁচব না। আয়-ইনকাম নাই।’ তাই গ্রামে যাওয়া হবে না হয়তো বাবুলের। ঢাকাতেই একটু জমি কিনে ছোট একটা ঘর বাঁধতে চান তিনি। টাকার অভাবে নিজের লেখাপড়া হয়নি, তাই ছেলেটাকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তবু জন্মস্থানের প্রতি টান তিনি ভুলতে পারেন না কিছুতেই। বলেন, ‘ঢাকায় গরমে অনেক কষ্ট হয়। গ্রামে অত গরমও লাগে না। আবার গরম লাগলে মাঠে গেলেই বাতাস লাগে।’ এক বছর পর যখন বাড়ি যান মো. বাবুল, তখন মায়ের আনন্দের শেষ থাকে না। সারা বছরের খাবার যেন তখনই তৈরি করেন। পিঠা, পায়েস থেকে শুরু করে শাকসবজি। সবই যেন নিজের হাতে ছেলের মুখে তুলে দিতে চান রোকেয়া বেগম। বাবুলও অপেক্ষায় থাকেন এসব ভালোবাসার। হয়তো ওদিকে মা সারা বছরই পথের দিকে চেয়ে বসে থাকেন স্নেহের ছেলের আশায়।
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments