গতকাল সমকাল-ওবামার ওসামা-নিধন by ফারুক চৌধুরী

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুসংবাদ পেয়েই মনে পড়ল, ১০ বছর আগে ইসলামাবাদে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মিরের সঙ্গে ২০ অক্টোবর ২০০১ সালে আমার সাক্ষাৎকারের কথা। হামিদ মির, ‘জিয়ো’ টিভির বদৌলতে এখন একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক। কিন্তু ২০০১ সালে ইসলামাবাদের উর্দু দৈনিক আওসাফ-এর সম্পাদক হিসেবে তাঁর এত নামডাক

ছিল না। তাঁর সঙ্গে দেখা করার আমার আগ্রহ জন্মেছিল এই জেনে যে, তিনি মোল্লা ওমর আর ওসামা বিন লাদেনের পরিচিত ব্যক্তি এবং শুনেছিলাম, তিনি নাকি ওসামা বিন লাদেনের জীবনী লিখছেন। হামিদ মিরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোয় ২০০১ সালের ২২ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছিল। আমার সঙ্গে হামিদ মিরের সাক্ষাৎকারের ১৯ দিন পর তাঁর সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের তৃতীয় ও শেষ দেখা হয় ৮ নভেম্বর ২০০১ সালে, বুশ সাহেবের বোমা-আক্রান্ত কাবুলে। সেই সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ গতকাল, অর্থাৎ ৩ মে ২০১১ সালের প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে।
এই নিবন্ধে তাঁর সঙ্গে আমার ২০ অক্টোবর ২০০১ সালের সাক্ষাৎকারে ওসামা বিন লাদেন সম্বন্ধে তিনি যা বলেছিলেন, তার খানিকাংশ পাঠককে স্মরণ করাতে চাই। হামিদ মির ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন মোল্লা ওমরের নির্দেশে। তখন ঋজু দীর্ঘকায় ফরসা ওসামা বাস করতেন মানবসৃষ্ট একটি গুহায়। হামিদ মিরের মতে, হাস্যরসসম্পন্ন এই মানুষটির ধর্মীয় বিষয়াদিতে মোল্লা ওমরের পর্যায়ের পাণ্ডিত্য ছিল না। তাঁর জীবনযাত্রাও ছিল মোল্লা ওমরের চেয়ে ভিন্ন—গুহায় বাস সত্ত্বেও কিছুটা রাজকীয় বটে। মোল্লা ওমরের সঙ্গে খেতে বসে হামিদ মিরের কপালে জুটেছিল আলুর ঝোল। ওসামা বিন লাদেনের খাবার তালিকায় ছিল পোলাওয়ের ওপর বিছানো আস্ত দুম্বার রোস্ট, পেস্তা বাদাম, সালাদ আর বিলেতি বেগুন। জিভে জল আসার ‘মেন্যু’! কিন্তু খাওয়ার চেয়ে ওসামার অধিক আগ্রহ ছিল আরব ভূমি থেকে ইহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিতাড়িত করা। তিনি নাকি সেই ‘অনুপ্রেরণা’ তাঁর পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে ওসামা যখন সৌদি আরবে, তখন সে দেশের সরকারও তাঁর সাহায্য চেয়েছিল সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করতে। রাজি ছিলেন ওসামা, তবে এক শর্তে—সৌদি সরকার যেন সৌদি আরব থেকে আমেরিকানদের বিতাড়িত করে! হাস্যরস একেই বলে! হামিদ মির ওসামাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমেরিকানদের হত্যা করার যৌক্তিকতা কী? হামিদ মিরের ভাষায়, কোনো তাৎক্ষণিক উত্তর ওসামার ছিল না, তবে তাঁর পাশে উপবিষ্ট আইমান আল জাওয়াহিরি বললেন, আমেরিকানদের প্রদত্ত অর্থে ইসরায়েল সামরিক সাজসরঞ্জাম এবং অস্ত্র ক্রয় করে থাকে, আর সেই দেশ ফিলিস্তিনিদের হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত। অতএব, আমেরিকানদের হত্যা করার যৌক্তিকতা আছে বৈকি। বলা হচ্ছে, মিসরীয় নাগরিক এই আইমান আল জাওয়াহিরিই এখন আল-কায়েদার নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। অতএব, ওসামার মৃত্যুর সঙ্গে যে আল-কায়েদার সহিংসতার অবসান ঘটবে—এ প্রত্যাশাটি অবাস্তব বলেই মনে হয়। ইসলামাবাদে ২০ অক্টোবর ২০০১-এর সন্ধ্যায় হামিদ মির আমার কাছে এই বিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন যে ওমর আর ওসামাকে মেরে ফেললেও তালেবানকে শেষ করা যাবে না। আমি তাঁর সঙ্গে একমত এবং অদূর ভবিষ্যতে, বিক্ষিপ্তভাবে হলেও, আল-কায়েদার ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওসামাকে নিধন করে ওবামা খণ্ডযুদ্ধে নিঃসন্দেহে বিজয়ী হয়েছেন—তবে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি কি ঘটেছে?
ওসামার অ্যাবোটাবাদে আস্তানা গাড়ার কারণটি কিন্তু প্রণিধানযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর আমেজে আছি আমরা এখন। তাই ওসামার তিনতলা বাড়িটির অবস্থান সম্বন্ধে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার।’ পঁচিশ মিলিয়ন ডলার ছিল ওসামার মস্তকমূল্য। এত টাকা দামের মাথা নিয়ে অর্থলোভী উপজাতীয় অঞ্চলে তাঁর বসবাস নিরাপদ হতো না মোটেও। উপজাতীয়রা মেহমান-নওয়াজ বটে, তবে অর্থ যে তাদের এই সামাজিক কর্তব্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল নয়। ওসামা তাঁর জন্য সন্দেহাতীত একটি প্রকাশ্য স্থান বেছে নিয়েছিলেন, কাকুল মিলিটারি একাডেমির কাছে—কিছুটা খুনির থানার পাশের বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার মতো। তিনি বাড়ির বাইরে পা ফেলতেন না নিশ্চয়ই আর বাড়ির মেয়েদের জন্য বোরকার নিরাপত্তা তো ছিলই। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে আর সত্তরের দশকের প্রারম্ভে যখন ইসলামাবাদে ছিলাম, তখন অ্যাবোটাবাদে বহুবারই গিয়েছি। সাবেক উপদেষ্টা শফি সামি তখন অ্যাবোটাবাদের ক্ষমতাবান মহকুমা-অধীশ্বর, আমার কনিষ্ঠতম ভ্রাতা সাবেক উপদেষ্টা ইফতেখার চৌধুরীর চাকরিজীবনের প্রারম্ভ সেখানেই আর ওসামা বিন লাদেনের বর্তমানে বিশ্বখ্যাত বাড়িটির (হয়তো বা তখন তা কেবল জমিই ছিল) অদূরের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে পাস করা আমার মামাতো ভাই, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীর ‘পাসিং আউট’ প্যারেডে আমার মামির সঙ্গে আমি সস্ত্রীক ছিলাম নিমন্ত্রিত অতিথি। নান্দনিক, ছিমছাম সেই পরিবেশে একদিন এমন একজন মানুষ বাস করবে, যে হবে সহিংসতার মূর্তিমান বিভীষিকা, তা ছিল কল্পনাতীত।
যা-ই হোক, ওসামা-নিধনে তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হলেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি এখন জনপ্রিয়তার শিখরে। তবে বিপুল অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে তিনি এই জনপ্রিয়তা কত দিন ধরে রাখতে পারবেন, তা দেখার বিষয়। বলতেই হয়, ঘটনাটি থেকে তিনি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অধিকাংশ আমেরিকানের চোখে তিনি একজন লক্ষ্যস্থির সাহসী কমান্ডার-ইন-চিফ আর এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি সুপরিকল্পিতভাবে ৯/১১-এর বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রতিশোধটি নিলেন। এক সপ্তাহ আগে যে প্রেসিডেন্টকে দেশবাসীর কাছে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে হয়েছিল, তিনি আজ দেশপ্রেমে দীপ্তিমান। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে পেয়ে ধন্য!
এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের বিবর্তন আগ্রহোদ্দীপক রইবে। এ দুই দেশের সম্পর্ক, পাকিস্তানের বহুমুখী জনমতের কারণে এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এই ওসামা-নিধনযজ্ঞ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন টেনে আনে বৈকি, যেমনি আনে সে দেশে আপাতদৃষ্টিতে বহু বছর ধরে ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, আল-কায়েদা দমনে ড্রোন বিমান হামলা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো নাটকীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিন লাদেন অস্ত্রধারী বহিরাগতদের জন্য পাকিস্তানের দ্বার উন্মুক্ত করেই বিদায় নিলেন।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রনায়কেরা যে যুক্তরাষ্ট্রের নেকনজরে নেই, তাঁরা এখন বুঝে গেছেন যে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমানোর অবকাশ আর নেই। গাদ্দাফি তাঁর সন্তানকে ন্যাটো হামলায় বলি দিয়েছেন, কিন্তু তাতে ওবামার বিচারে তাঁর ‘পাপস্খলন’ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে গড়ে নিতে হবে অ্যাবোটাবাদের চেয়েও অনেক বেশি নিরাপদ এবং নিরাপত্তাদায়ক অবস্থান। তাঁকে বলির পাঁঠা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে বলেই মনে হয়। তবে এটাও সত্যি যে, আরব বিশ্বের গণজাগরণ সেসব দেশে আল-কায়েদার অবস্থান দুর্বলই করেছে। এই গণজাগরণ প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষ। গণতন্ত্রের সপক্ষে তা দুর্নীতিবিরোধী। আরব বিশ্ব এখন একটি গণতান্ত্রিক আবহের সূচনালগ্নে রয়েছে। তা আল-কায়েদাকে হয়তো বা আগামী দিনে অবান্তর ও দুর্বল করে দেবে। গণতান্ত্রিক আরব বিশ্ব স্বৈরাচারী শাসনাধীন আরব বিশ্ব থেকে অধিকতর সক্রিয়ই হবে। ইতিমধ্যে মিসরের উদ্যোগে অর্জিত হামাস আর আলফাতাহর মধ্যে সমঝোতা তার একটি উদাহরণ। অতএব কেবল সন্ত্রাসী আর স্বৈরাচারী নিধন নয়, আগামী বছরগুলোতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, উদারপন্থী, স্বাধীনচেতা আরব বিশ্বের অভ্যুত্থান, যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের চিন্তায় ও কর্মে একটি নতুন প্রভাব ফেলতে পারে। তা হবে আরব-ইসরায়েল সম্পর্কসমেত বিশ্ব রাজনীতির জন্য কল্যাণকর।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.