চারদিক-তোমাকে ভালোবাসি, মা by শারমিন নাহার
‘মা’! ‘মা’ শব্দটি শুনলেই অমিয় সুধায় প্রাণ ভরে যায়। এ শব্দের মাঝে আছে প্রশান্তি ও নির্ভরতা। জগতের মধুরতম শব্দ ‘মা’ কেবল শব্দই নয়, বরং বলা যায় একটা বর্ণ। কিন্তু এর অর্থগত ব্যাপ্তি অনেক বেশি। অভিধান ঘাঁটলে এর সমার্থক শব্দ মিলবে ঢের। কখনো জননী, কখনো গর্ভধারিণী কখনো বা মাতা।
যেখান থেকে একটা ভ্রূণের সৃষ্টি আর ভ্রূণ থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠা। এই মায়ের জন্যই যদি হয় দিনটা। আজ বিশ্ব মা দিবস। মাকে হয়তো সব সন্তান সারা দিনমান ভালোবাসেন। তার পরও এই দিনে মাকে বিশেষভাবে স্মরণ করা। মা দিবস নিয়ে তাই সন্তানদের উত্তেজনাটা একটু বেশি থাকে।
‘মা দিবসে প্রতিবছরই আমরা দুই বোন মাকে সারপ্রাইজ দিই। রাত ১২টা বাজলেই কেক কাটি। এমন কিছু দিতে চেষ্টা করি, যা পেয়ে মা খুশি হন। কখনো বা মায়ের পছন্দের কিছু রান্না করি। সারা বছর তো মা আমাদের জন্য করেন। একটা দিন না-হয় আমরা দুই বোনই করলাম।’ কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইভা।
মুঠোফোনে সেদিন এক অভিবাসী বাঙালির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘প্রথম যখন স্বামীর সঙ্গে পরবাসে চলে আসি, তখন মা আমার কথা মনে করে গ্রীষ্মের ফল আম আর কাঁঠাল খেতে পারেননি। শেষমেশ কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফলগুলো। তাতেই যেন তাঁর শান্তি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাতের কথাই বলা যাক। পরীক্ষার চাপে কোরবানির ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি, তাই মা ওইবার কোরবানির মাংস না খেয়ে ছিলেন। পরীক্ষার শেষে বাড়ি যাওয়ার পর তাঁর মা তাঁকে খাইয়ে তবেই মুখে তুলেছেন।
সব কটি ঘটনাই নিখাদ সত্য। ঘটনাটা বেশ আগের, তার পরও বলি, আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন এক নারী। স্বামী পরিত্যক্তা এই নারীর খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল আমাদের বাড়িতে। তবে কোনো দিন খেতে দেখিনি তাঁকে। আগ্রহবশে প্রশ্ন করেছিলাম, সব খাবার পোঁটলায় বেঁধে নিয়ে যান কেন? শত কষ্টের মাঝে এক চিলতে হাসি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার খাওনের মানুষ তো বাড়িতে।’ অর্থাৎ বাড়িতে নাড়িছেঁড়া ধন, তাকে ছাড়া এ খাবার তাঁর মুখে রুচবে কী করে।
কার্জন হলের রাস্তার পাড় ধরে যে বসত গড়ে উঠেছে, সেখানে বসবাস করেন হোসনা বেগম। তরকারি ছাড়া লবণ, মরিচে মাখা সাদা ভাতের গ্রাস ছোট ছেলে সাইফুলের মুখেই পুরে দেন। হোসনার চোখ-মুখ বলে, তিনি অভুক্ত। প্রশ্ন করি, খিদা নাই? ঝটপট উত্তর, ‘পোলারে আগে খাওয়াই লই।’
সন্তানকে খাইয়ে যেন সবটুকু প্রশান্তি এই মায়ের।
যাঁরা মাকে হারিয়েছেন, তাঁদের ব্যথা তো কোনো অংশে কম নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তাঁর মাকে সম্প্রতি হারিয়েছেন। বাবাকে হারিয়েছেন আড়াই মাস বয়সে। তাই মা-ই ছিলেন কখনো বাবা, কখনো মা আবার কখনো বন্ধু। আমি ছুটিতে বাড়ি গিয়ে কার কাছে বসব, কে পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াবে, কে আমার না বলা কথা বুঝে নেবে—এই শিক্ষার্থীর শত প্রশ্ন আর চোখের কাছে চিকচিক করা জল বলে দেয়, মা আসলে কী। হয়তো অনেকেই মায়ের কদর বোঝেন না, আবার অনেকে হারিয়ে বোঝেন, কত মূল্যবান এই রত্ন।
মা দিবসের প্রচলনটা হয় প্রাচীন গ্রিস থেকে। বসন্তকালের একদিন দেবতার মা ‘রিয়া’, যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিণী, তাঁর উদ্দেশে উদ্যাপন করা হতো দিনটি।
সার্বিকভাবে মা দিবসের চিন্তা মাথায় আসে মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের। তবে দিবসটি প্রবর্তকের খেতাব পেয়ে যান আনা জার্বিস। ১৯০৮ সালের ১০ মে জার্বিসের পরিচালনায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনে সর্বপ্রথম দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি মানুষের মনে জায়গাও করে নেয়। ১৯১৪ সালে দিবসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে নয় বছর পর জার্বিস দিবসটির বিরোধিতা করে আদালতের দ্বারস্থ হন। তাঁর বক্তব্য ছিল, দিনটি কেবল পারিবারিকভাবেই পালন করা হোক। তবে এই বিরোধী মত ধোপে টেকেনি। কেননা দিনটি তত দিনে মানুষের জন্য বিশেষ দিন হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে।
এখন উন্নত দেশেই কেবল নয়, বরং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেশ সাড়ম্বরেই পালিত হচ্ছে মা দিবস।
অনেকেই বলেন, পুঁজিবাদী আর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকেই এই দিবস পালনের অভিপ্রায়। সেটা যদি থাকেও, তার পরও বলি, মায়ের জন্য একটি বিশেষ দিন থাকলে ক্ষতি কী। আমরা তো সারা দিনমান মাকে ভালোবাসি। তার পরও এই দিনে ছোট্ট উপহার আর একবার কাছে এসে দুদণ্ড বসে বলি, মা, তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি।
পৃথিবীর সব মায়ের জন্য মা দিবসের ঐকান্তিক ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা।
শারমিন নাহার
‘মা দিবসে প্রতিবছরই আমরা দুই বোন মাকে সারপ্রাইজ দিই। রাত ১২টা বাজলেই কেক কাটি। এমন কিছু দিতে চেষ্টা করি, যা পেয়ে মা খুশি হন। কখনো বা মায়ের পছন্দের কিছু রান্না করি। সারা বছর তো মা আমাদের জন্য করেন। একটা দিন না-হয় আমরা দুই বোনই করলাম।’ কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইভা।
মুঠোফোনে সেদিন এক অভিবাসী বাঙালির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘প্রথম যখন স্বামীর সঙ্গে পরবাসে চলে আসি, তখন মা আমার কথা মনে করে গ্রীষ্মের ফল আম আর কাঁঠাল খেতে পারেননি। শেষমেশ কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফলগুলো। তাতেই যেন তাঁর শান্তি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাতের কথাই বলা যাক। পরীক্ষার চাপে কোরবানির ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি, তাই মা ওইবার কোরবানির মাংস না খেয়ে ছিলেন। পরীক্ষার শেষে বাড়ি যাওয়ার পর তাঁর মা তাঁকে খাইয়ে তবেই মুখে তুলেছেন।
সব কটি ঘটনাই নিখাদ সত্য। ঘটনাটা বেশ আগের, তার পরও বলি, আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন এক নারী। স্বামী পরিত্যক্তা এই নারীর খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল আমাদের বাড়িতে। তবে কোনো দিন খেতে দেখিনি তাঁকে। আগ্রহবশে প্রশ্ন করেছিলাম, সব খাবার পোঁটলায় বেঁধে নিয়ে যান কেন? শত কষ্টের মাঝে এক চিলতে হাসি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার খাওনের মানুষ তো বাড়িতে।’ অর্থাৎ বাড়িতে নাড়িছেঁড়া ধন, তাকে ছাড়া এ খাবার তাঁর মুখে রুচবে কী করে।
কার্জন হলের রাস্তার পাড় ধরে যে বসত গড়ে উঠেছে, সেখানে বসবাস করেন হোসনা বেগম। তরকারি ছাড়া লবণ, মরিচে মাখা সাদা ভাতের গ্রাস ছোট ছেলে সাইফুলের মুখেই পুরে দেন। হোসনার চোখ-মুখ বলে, তিনি অভুক্ত। প্রশ্ন করি, খিদা নাই? ঝটপট উত্তর, ‘পোলারে আগে খাওয়াই লই।’
সন্তানকে খাইয়ে যেন সবটুকু প্রশান্তি এই মায়ের।
যাঁরা মাকে হারিয়েছেন, তাঁদের ব্যথা তো কোনো অংশে কম নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তাঁর মাকে সম্প্রতি হারিয়েছেন। বাবাকে হারিয়েছেন আড়াই মাস বয়সে। তাই মা-ই ছিলেন কখনো বাবা, কখনো মা আবার কখনো বন্ধু। আমি ছুটিতে বাড়ি গিয়ে কার কাছে বসব, কে পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াবে, কে আমার না বলা কথা বুঝে নেবে—এই শিক্ষার্থীর শত প্রশ্ন আর চোখের কাছে চিকচিক করা জল বলে দেয়, মা আসলে কী। হয়তো অনেকেই মায়ের কদর বোঝেন না, আবার অনেকে হারিয়ে বোঝেন, কত মূল্যবান এই রত্ন।
মা দিবসের প্রচলনটা হয় প্রাচীন গ্রিস থেকে। বসন্তকালের একদিন দেবতার মা ‘রিয়া’, যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিণী, তাঁর উদ্দেশে উদ্যাপন করা হতো দিনটি।
সার্বিকভাবে মা দিবসের চিন্তা মাথায় আসে মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের। তবে দিবসটি প্রবর্তকের খেতাব পেয়ে যান আনা জার্বিস। ১৯০৮ সালের ১০ মে জার্বিসের পরিচালনায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনে সর্বপ্রথম দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি মানুষের মনে জায়গাও করে নেয়। ১৯১৪ সালে দিবসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে নয় বছর পর জার্বিস দিবসটির বিরোধিতা করে আদালতের দ্বারস্থ হন। তাঁর বক্তব্য ছিল, দিনটি কেবল পারিবারিকভাবেই পালন করা হোক। তবে এই বিরোধী মত ধোপে টেকেনি। কেননা দিনটি তত দিনে মানুষের জন্য বিশেষ দিন হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে।
এখন উন্নত দেশেই কেবল নয়, বরং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেশ সাড়ম্বরেই পালিত হচ্ছে মা দিবস।
অনেকেই বলেন, পুঁজিবাদী আর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকেই এই দিবস পালনের অভিপ্রায়। সেটা যদি থাকেও, তার পরও বলি, মায়ের জন্য একটি বিশেষ দিন থাকলে ক্ষতি কী। আমরা তো সারা দিনমান মাকে ভালোবাসি। তার পরও এই দিনে ছোট্ট উপহার আর একবার কাছে এসে দুদণ্ড বসে বলি, মা, তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি।
পৃথিবীর সব মায়ের জন্য মা দিবসের ঐকান্তিক ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা।
শারমিন নাহার
No comments