শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমার বাবা by নিমা রহমান
আমার বাবা লুৎফর রহমান। বাবার সঙ্গে সন্তানের যে সম্পর্ক থাকে, আমার সঙ্গে তার চেয়ে একটু বেশিই ছিল—পেয়েছি বেশি আদর, বেশি প্রশ্রয়। মানুষের জীবনে কিছু অধ্যায় থাকে, তা আড়ালেই থেকে যায়; বিস্মৃতির চাদরে ঢাকা পড়ে। মানুষটা চলে গেলে বড় বেশি মনে পড়ে সে কথাগুলো।
মানুষের বড় গুণ, যে আমাদের ছেড়ে চলে যায়, আমরা তাঁর মহত্ত্বের কথাটাই ভাবি, কীর্তির কথাটাই ভাবি। প্রচারবিমুখ আমার বাবার কথা তাই আজ জানাতে বসেছি আপনাদের।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের স্নাতক আমার বাবা লুৎফর রহমান বড় কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছিলেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মা হাসিনা রহমানকে। তারপর জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। ফরিদপুরে বাড়ি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কথা বলেছেন সেই ফরিদপুরের আঞ্চলিক উচ্চারণেই।
সংসার-জীবনের শুরু নারায়ণগঞ্জে। পাট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া। বাংলার সোনালি আঁশকে বিশ্বের দরবারে যে কজন পরিচিত করেছেন, আমার বাবা তাঁদের একজন। শুরুর দিকে গাড়ি ছিল না, ব্যবসার কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে। একবার ওই ব্যবসার কাজে ট্রেনে যাওয়ার সময় হঠাৎ কাচের জানালা পড়ে যায় তাঁর আঙুলের ওপর। আঙুলটা থেঁতলে যায়। অন্য আঙুল থেকে আলাদা দেখাত সেটিকে। বাবা কতবার গর্ব করে দেখিয়েছেন, কষ্ট আর সংগ্রামের নিদর্শন সেই আঙুলটাকে।
বাঙালির স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলনে বাবা ছিলেন সব সময় সক্রিয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠনে লুৎফর রহমানের একটা ভূমিকা ছিল। প্রথম কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সভা হতো আমাদের বাসায়। আমার চাচা মজিবর রহমান (ডাক্তার) ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। আত্মগোপনে যেতে হলো তাঁকে। সেই সূত্র ধরে বাবা গ্রেপ্তার হলেন, জেলে গেলেন। মামা মুস্তাফা মনোয়ার তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। মুস্তাফা মনোয়ারও গ্রেপ্তার হলেন। বাবা জেল থেকে ছাড়া পেলেন আগে। কিন্তু মায়ের কড়া হুকুম, তাঁর ভাইকে (মন্টু মামা) ছাড়া বাড়ি আসা যাবে না। অতিরিক্ত আরও ১০ দিন জেল খেটে নিজ শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। তখন শেখ মুজিব তরুণ নেতা—আমাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের হীরা মঞ্জিলে প্রায়ই আসতেন বঙ্গবন্ধু। বাবা ভালোবাসতেন বাজার করতে, মা ভালোবাসতেন রান্না করতে আর মানুষকে খাওয়াতে। বঙ্গবন্ধু ‘লুৎফরের বউ’-এর রান্নার তারিফ করেছেন বহুবার।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে বহুবার গেছেন, সঙ্গে থাকতেন গ্রিন অ্যান্ড হোয়াইটের নুরুদ্দিন চাচা। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিয়ের কথাবার্তা তাঁদের সামনে পেড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, আলোচনাও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু, তাঁর দল এবং স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন নিয়মিত। পুরোনো এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা কেউই আশা করি বিস্মৃত হননি তাঁদের ‘লুৎফর ভাই’-এর কথা।
এভাবেই এল ১৯৭১। তখন রাজারবাগের পুলিশ লাইনের সামনেই আমাদের বাসা ‘ছায়ানীড়’। ২৬ মার্চের রাতের নির্মমতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমার বাবা-মা, আমাদের পরিবার। ওই রাতেই আহত অনেক পুলিশ সদস্য আমাদের বাড়ির ওপর দিয়েই গেছেন। ওই উৎকণ্ঠার মধ্যেও দেখেছি, আমার বাবা-মা তাঁদের সাহায্যের জন্য তৎপর।
পাকিস্তান আর্মি ১৯৭১-এ বাবাকে কয়েকবার ধরে নিয়ে গেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। বাবা তখন রপ্তানি-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বড় বাঙালি ব্যবসায়ী, তাই সন্দেহ করলেও শেষ পর্যন্ত কিছু করতে সাহস করেনি তারা, ছেড়ে দিয়েছে বাবাকে। কিন্তু গোপনে গোপনে বাবা-মা দুজনে ঠিকই সাহায্য করতেন মুক্তিবাহিনীকে, নিয়মিত টাকা-পয়সা, কাপড়চোপড় পাঠাতেন বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে। শিল্পী আবুল বারক্ আলভী ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের শ্যালকদের পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজ গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সবাই দেখা করেছে, কিন্তু বাবা যাননি। বঙ্গবন্ধুর ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। হঠাৎ একদিন কাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই এল, লুৎফর তো একদিনও এল না।’ বাবা গেলেন দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে, তাঁদের ভুল বোঝাবুঝি ভাঙাতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে হবে। ঠিক হলো, গোপনে একটা দল যাবে চীনে, সেই দলে থাকতে হবে বাবাকে। কিন্তু চীনে যাওয়া তো তখন সহজ নয়। চীন তখনো স্বীকৃতি দেয়নি, সরাসরি যাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দিক ঘুরে তারপর চীন। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বীজ তখনই বোনা হয়েছিল। তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়তে যে আমার বাবার ভূমিকা ছিল, সে কথাও আজ বুঝি অনেকেই বিস্মৃত।
বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বরের অরক্ষিত বাড়িতে থাকতে নিষেধ করতেন বাবা। ‘শেখ, এই বাড়ি ছাড়িয়া নিরাপদ জায়গায় যাও।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আজরাইল যখন আসবে, তখন বাক্সের মধ্যে তালা-চাবি মাইরাও তো আমারে রাখতে পারবা না।’ সম্পর্কটা এমনই ছিল তাঁদের।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে, অর্থনীতির বুনিয়াদ তৈরি করতে বহু দেশ ব্যক্তিগতভাবে সফর করেছেন আমার বাবা। শিল্প ব্যাংকের পরিচালক হয়ে বহু লোককে ব্যবসা-বাণিজ্য গঠনে সাহায্য করেছেন তিনি।
লুৎফর রহমান—আমার বাবা—আড়ালের মানুষ ছিলেন, আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন, গোপনে সাহায্য করতে পছন্দ করতেন। আড়ালের মানুষটা গত ২৮ এপ্রিল আড়ালেই চলে গেলেন। হয়তো ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করবে না, তবু আড়াল থেকে দেশ ও জাতিকে সাহায্য করা লুৎফর রহমান নামের এই মানুষটার অবদানের জন্য আমি গর্ব করি। গর্ব করি আমার বাবার জন্য।
নিমা রহমান
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের স্নাতক আমার বাবা লুৎফর রহমান বড় কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছিলেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মা হাসিনা রহমানকে। তারপর জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। ফরিদপুরে বাড়ি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কথা বলেছেন সেই ফরিদপুরের আঞ্চলিক উচ্চারণেই।
সংসার-জীবনের শুরু নারায়ণগঞ্জে। পাট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া। বাংলার সোনালি আঁশকে বিশ্বের দরবারে যে কজন পরিচিত করেছেন, আমার বাবা তাঁদের একজন। শুরুর দিকে গাড়ি ছিল না, ব্যবসার কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে। একবার ওই ব্যবসার কাজে ট্রেনে যাওয়ার সময় হঠাৎ কাচের জানালা পড়ে যায় তাঁর আঙুলের ওপর। আঙুলটা থেঁতলে যায়। অন্য আঙুল থেকে আলাদা দেখাত সেটিকে। বাবা কতবার গর্ব করে দেখিয়েছেন, কষ্ট আর সংগ্রামের নিদর্শন সেই আঙুলটাকে।
বাঙালির স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলনে বাবা ছিলেন সব সময় সক্রিয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠনে লুৎফর রহমানের একটা ভূমিকা ছিল। প্রথম কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সভা হতো আমাদের বাসায়। আমার চাচা মজিবর রহমান (ডাক্তার) ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। আত্মগোপনে যেতে হলো তাঁকে। সেই সূত্র ধরে বাবা গ্রেপ্তার হলেন, জেলে গেলেন। মামা মুস্তাফা মনোয়ার তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। মুস্তাফা মনোয়ারও গ্রেপ্তার হলেন। বাবা জেল থেকে ছাড়া পেলেন আগে। কিন্তু মায়ের কড়া হুকুম, তাঁর ভাইকে (মন্টু মামা) ছাড়া বাড়ি আসা যাবে না। অতিরিক্ত আরও ১০ দিন জেল খেটে নিজ শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। তখন শেখ মুজিব তরুণ নেতা—আমাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের হীরা মঞ্জিলে প্রায়ই আসতেন বঙ্গবন্ধু। বাবা ভালোবাসতেন বাজার করতে, মা ভালোবাসতেন রান্না করতে আর মানুষকে খাওয়াতে। বঙ্গবন্ধু ‘লুৎফরের বউ’-এর রান্নার তারিফ করেছেন বহুবার।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে বহুবার গেছেন, সঙ্গে থাকতেন গ্রিন অ্যান্ড হোয়াইটের নুরুদ্দিন চাচা। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিয়ের কথাবার্তা তাঁদের সামনে পেড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, আলোচনাও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু, তাঁর দল এবং স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন নিয়মিত। পুরোনো এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা কেউই আশা করি বিস্মৃত হননি তাঁদের ‘লুৎফর ভাই’-এর কথা।
এভাবেই এল ১৯৭১। তখন রাজারবাগের পুলিশ লাইনের সামনেই আমাদের বাসা ‘ছায়ানীড়’। ২৬ মার্চের রাতের নির্মমতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমার বাবা-মা, আমাদের পরিবার। ওই রাতেই আহত অনেক পুলিশ সদস্য আমাদের বাড়ির ওপর দিয়েই গেছেন। ওই উৎকণ্ঠার মধ্যেও দেখেছি, আমার বাবা-মা তাঁদের সাহায্যের জন্য তৎপর।
পাকিস্তান আর্মি ১৯৭১-এ বাবাকে কয়েকবার ধরে নিয়ে গেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। বাবা তখন রপ্তানি-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বড় বাঙালি ব্যবসায়ী, তাই সন্দেহ করলেও শেষ পর্যন্ত কিছু করতে সাহস করেনি তারা, ছেড়ে দিয়েছে বাবাকে। কিন্তু গোপনে গোপনে বাবা-মা দুজনে ঠিকই সাহায্য করতেন মুক্তিবাহিনীকে, নিয়মিত টাকা-পয়সা, কাপড়চোপড় পাঠাতেন বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে। শিল্পী আবুল বারক্ আলভী ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের শ্যালকদের পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজ গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সবাই দেখা করেছে, কিন্তু বাবা যাননি। বঙ্গবন্ধুর ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। হঠাৎ একদিন কাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই এল, লুৎফর তো একদিনও এল না।’ বাবা গেলেন দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে, তাঁদের ভুল বোঝাবুঝি ভাঙাতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে হবে। ঠিক হলো, গোপনে একটা দল যাবে চীনে, সেই দলে থাকতে হবে বাবাকে। কিন্তু চীনে যাওয়া তো তখন সহজ নয়। চীন তখনো স্বীকৃতি দেয়নি, সরাসরি যাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দিক ঘুরে তারপর চীন। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বীজ তখনই বোনা হয়েছিল। তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়তে যে আমার বাবার ভূমিকা ছিল, সে কথাও আজ বুঝি অনেকেই বিস্মৃত।
বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বরের অরক্ষিত বাড়িতে থাকতে নিষেধ করতেন বাবা। ‘শেখ, এই বাড়ি ছাড়িয়া নিরাপদ জায়গায় যাও।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আজরাইল যখন আসবে, তখন বাক্সের মধ্যে তালা-চাবি মাইরাও তো আমারে রাখতে পারবা না।’ সম্পর্কটা এমনই ছিল তাঁদের।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে, অর্থনীতির বুনিয়াদ তৈরি করতে বহু দেশ ব্যক্তিগতভাবে সফর করেছেন আমার বাবা। শিল্প ব্যাংকের পরিচালক হয়ে বহু লোককে ব্যবসা-বাণিজ্য গঠনে সাহায্য করেছেন তিনি।
লুৎফর রহমান—আমার বাবা—আড়ালের মানুষ ছিলেন, আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন, গোপনে সাহায্য করতে পছন্দ করতেন। আড়ালের মানুষটা গত ২৮ এপ্রিল আড়ালেই চলে গেলেন। হয়তো ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করবে না, তবু আড়াল থেকে দেশ ও জাতিকে সাহায্য করা লুৎফর রহমান নামের এই মানুষটার অবদানের জন্য আমি গর্ব করি। গর্ব করি আমার বাবার জন্য।
নিমা রহমান
No comments