গোধূলির ছায়াপথে-মৃত্যুর অবিনাশী শক্তি by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
চিন্তারও অবকাশ প্রয়োজন, তখন দেখা যাবে অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তারা এসে মনকে গ্রাস করছে। রোগশয্যায়, রোগমুক্তির প্রহরে যে চিন্তার আশ্রয়, অনেক সময় ভালো কবিতা ও গল্পের উৎস। সুস্থ সময়ে অদ্ভুত চিন্তা বাসা বাঁধার সুযোগ পায় না। জাপানি লেখক কাওয়াবাতা নোবেল পুরস্কার পেয়েই শুধু নয়, সারা দুনিয়ায় সাইকিডেলিক উপন্যাসে নতুন মাত্রা সংযোগ করেছেন।
তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, কী ছাইপাঁশ লিখছেন? উত্তর দিলেন, ‘যারা পড়ুয়া, তারা তো গিলছে মশাই। আপনার আপত্তির কারণ কী? আমার সঙ্গে এখন পাঠকেরা উড়ছে। ওদের উড়তে দিন।’
নজরুলের লেখাগুলো পড়তে গিয়ে কিছু মুসলমান হোঁচট খায়, আর হিন্দুরা হোঁচট খায় তাঁর মুসলমানি লেখা নিয়ে। নজরুল বললেন, ‘ছোটবেলায় মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়েছি, কোরআন-হাদিস পড়েছি, “কাব্যে আমপারা”র অনুবাদ করেছি। যারা শ্যামাসংগীত শুনেছে, আর কাব্যে পেয়েছে হিন্দু মাইথোলজি, তারা ভাবল আমি মূর্তিপূজারি। আমার ধর্ম ও কাব্য আলাদা, যেমন-হাফিজ, রুমি। দুটোকে ওঁরা গুলিয়ে ফেলেননি। সে সময় ওঁদের সাইকিডেলিক মনে হয়েছে। যারা ওপরে উড়তে চায়, সেই কবিরা সবাইকে নিয়ে উড়তে চান। কাউকে এখানে ফেলে যাব না।’
তাঁদের কালের আগে আসেন কিছু কবি-সাহিত্যিক। ৭০০ বছর পর খোঁজ হয় রুমির। যুক্তরাষ্ট্রে যে কবির বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি, তিনি মওলানা জালালউদ্দিন রুমি। রুমি এক করতে চেয়েছিলেন নানা প্রার্থনাকারীকে একই প্রার্থনালয়ে। খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুসলমান, অগ্নি-উপাসক—এদের এক করে কবির কী লাভ? কবি জানতেন, একটি সময়ে এসে এরা এক হতে চাইবে। প্রকৃষ্ট প্রমাণ রুমির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা। কেনিয়ায় গিয়ে দেখি নানা ধর্মের লোক সমবেত তাঁর মাজারের সামনে, কেউ পড়ছে কোরআন, কেউ বাইবেল, কেউ বা জিন্দাবেস্তা। কেউ বা নীরবে করছে অশ্রু বিসর্জন, সকল প্রার্থনার অভীষ্ট যা। রাতে ২০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করছে দরবেশি নৃত্য। ইউরোপ থেকে প্রায় হেঁটে এসেছে হাজার হাজার দর্শক। ইসলাম ধর্মের তারা কিছুই জানে না। দেখল, প্রায় আধঘণ্টা ধরে প্রথমে হলো কোরআন তিলাওয়াত সুমধুর স্বরে, তারপর নাতে রসুল। এরপর উদ্বাহু ঘূর্ণিনৃত্য, প্রায় এক ঘণ্টা। যারা পাওয়ার নয়, কিছুই পেল না। যারা পেল, তারা এমনটি আর জীবনেও পায়নি। এখানেই মানুষে মানুষে তফাত। মানুষ আজ এক হতে চায় আলাদা ধর্মে থেকেও, আলাদা সংস্কৃতিতে থেকেও। কবিদের জন্ম এদের জন্যই।
কবি হাফিজ শিয়া অনুসারী। তাই সুন্নিরা তাঁর কবিতা মুখস্থ করে না, যেমন করে ইরানিরা। আবার যখন হাফিজের কবিতায় আকাশের তারকার মধ্যে খুঁজে পায় আল্লাহর হাকিকত, সুন্নিরা হয়ে পড়ে অভিভূত। তখন তারা দলে দলে ছুটে যায় শিরাজের ‘হাফিজিয়া’তে, যে ফুলের বাগানের অন্তরালে শুয়ে হাফিজ। হাফিজের বাবা ছিলেন কোরআনে হাফেজ। হাফিজকে পাঠানো হয়নি কোনো মসজিদ বা মাদ্রাসায় কোরআন মুখস্থ করার জন্য। বাবা প্রতি প্রত্যুষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে তিলাওয়াত করতেন, তারই রসমাধুর্য সিঞ্চিত হয়ে চিরতরে অঙ্কিত হয়ে যায় তাঁর হূদয়ে। আল্লাহর তরফ থেকেই এই দান। অথচ তাঁর কবিতায় আছে আকাশের শুকতারা, যারা হাফিজের কবিতা নিয়ে মাতে। তা-ই তো হওয়ার কথা। এটা নির্ভর করছে যিনি শুকতারার দিকে তাকাবেন, তাঁর ওপর। সারা জীবন আকাশের দিকে তাকিয়েছে, অথচ চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা কিছুই চেনে না, এমন মানুষের সংখ্যাই সর্বাধিক। দেখেনি তারা প্রভাতে সূর্যের জেগে ওঠা। তাই তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কেমন করে হাফিজ আকাশের শুকতারায় দেখেছেন তাঁর কাব্যের প্রতিবিম্ব। এমন কিছু, যা মানুষের অন্তরের চাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মারিফত অর্থাৎ গোপন তত্ত্ব তাকে নিয়ে অনেক গভীরে। কবিরা যা দেখেন, তা অন্যরা দেখেন সমকালের দৃষ্টিতে।
ব্যস্ত সময়ের আবর্তে ত্রস্ত, এতটুকু সময় নেই কাউকে দেওয়ার। সকাল থেকে সূর্যের আলো দিয়ে চলেছে, শুধু আমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। আমি আলোকিত হতে পারিনি, হিংসা ছাড়তে পারিনি। সবাইকে সন্দেহ করি, নিজেকে ছাড়া। অথচ সন্দেহের তীর তো প্রথমে আমাকেই স্পর্শ করার কথা। সংবাদ ছুটে চলেছে সংবাদপত্রকে পেছনে ফেলে, তারা ছাপা হয়ে আসার আগেই ছুটে চলেছে ইন্টারনেটে, ফেসবুকে, টুইটারে, স্কাইপে।
মাইকেল নিউটন, নতুন গ্রন্থ, লাইফ বিটুইন লাইভস যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ছেয়ে ফেলেছে, লিখছেন: ‘নতুন কিছু পেতে হলে নিজ বিশ্বাসবলয়ের দিগন্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে খোলা মন নিয়ে। আজকের সত্য পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতি প্রজন্মে আগামী দিনের উচ্চতর সত্যের কাছে, জ্ঞানের পরিধির হচ্ছে নিত্য বিকাশ, যা মানবের সংজ্ঞা দিচ্ছে বদলে। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু নয়, মৃত্যুকে জয় করার অবিনাশী শক্তি অর্জন এই শতাব্দীর শান্তি, ভালোবাসা, স্বাস্থ্য, প্রগতির মূল লক্ষ্য।’
বুধবার কাগজে দেখেছি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেনারেলদের সঙ্গে নিয়ে দেখছেন টেলিভিশনের পর্দায় কীভাবে ঘায়েল হয়েছেন পয়লা নম্বরের শত্রু। এর আগে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে অসংখ্য মৃত্যু, হাজার মাইলের ব্যবধানে ডিজিটাল ট্রিগারে একে একে ঢলে পড়ছে: পাঁচ লাখ নিরপরাধ ইরাকি। মাইকেল নিউটনের শেষ কথাটি: ‘মৃত্যুকে জয় করো একটি নিঃশ্বাস দিয়ে। জোরে একটা নিঃশ্বাস নাও, সব সময় নিয়ো। হতে পারে, এটি তোমার শেষ নিঃশ্বাস। আর জেনো, বিশ্বাস নিঃশ্বাসকে দেয় অবিনাশী শক্তি।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
নজরুলের লেখাগুলো পড়তে গিয়ে কিছু মুসলমান হোঁচট খায়, আর হিন্দুরা হোঁচট খায় তাঁর মুসলমানি লেখা নিয়ে। নজরুল বললেন, ‘ছোটবেলায় মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়েছি, কোরআন-হাদিস পড়েছি, “কাব্যে আমপারা”র অনুবাদ করেছি। যারা শ্যামাসংগীত শুনেছে, আর কাব্যে পেয়েছে হিন্দু মাইথোলজি, তারা ভাবল আমি মূর্তিপূজারি। আমার ধর্ম ও কাব্য আলাদা, যেমন-হাফিজ, রুমি। দুটোকে ওঁরা গুলিয়ে ফেলেননি। সে সময় ওঁদের সাইকিডেলিক মনে হয়েছে। যারা ওপরে উড়তে চায়, সেই কবিরা সবাইকে নিয়ে উড়তে চান। কাউকে এখানে ফেলে যাব না।’
তাঁদের কালের আগে আসেন কিছু কবি-সাহিত্যিক। ৭০০ বছর পর খোঁজ হয় রুমির। যুক্তরাষ্ট্রে যে কবির বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি, তিনি মওলানা জালালউদ্দিন রুমি। রুমি এক করতে চেয়েছিলেন নানা প্রার্থনাকারীকে একই প্রার্থনালয়ে। খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুসলমান, অগ্নি-উপাসক—এদের এক করে কবির কী লাভ? কবি জানতেন, একটি সময়ে এসে এরা এক হতে চাইবে। প্রকৃষ্ট প্রমাণ রুমির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা। কেনিয়ায় গিয়ে দেখি নানা ধর্মের লোক সমবেত তাঁর মাজারের সামনে, কেউ পড়ছে কোরআন, কেউ বাইবেল, কেউ বা জিন্দাবেস্তা। কেউ বা নীরবে করছে অশ্রু বিসর্জন, সকল প্রার্থনার অভীষ্ট যা। রাতে ২০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করছে দরবেশি নৃত্য। ইউরোপ থেকে প্রায় হেঁটে এসেছে হাজার হাজার দর্শক। ইসলাম ধর্মের তারা কিছুই জানে না। দেখল, প্রায় আধঘণ্টা ধরে প্রথমে হলো কোরআন তিলাওয়াত সুমধুর স্বরে, তারপর নাতে রসুল। এরপর উদ্বাহু ঘূর্ণিনৃত্য, প্রায় এক ঘণ্টা। যারা পাওয়ার নয়, কিছুই পেল না। যারা পেল, তারা এমনটি আর জীবনেও পায়নি। এখানেই মানুষে মানুষে তফাত। মানুষ আজ এক হতে চায় আলাদা ধর্মে থেকেও, আলাদা সংস্কৃতিতে থেকেও। কবিদের জন্ম এদের জন্যই।
কবি হাফিজ শিয়া অনুসারী। তাই সুন্নিরা তাঁর কবিতা মুখস্থ করে না, যেমন করে ইরানিরা। আবার যখন হাফিজের কবিতায় আকাশের তারকার মধ্যে খুঁজে পায় আল্লাহর হাকিকত, সুন্নিরা হয়ে পড়ে অভিভূত। তখন তারা দলে দলে ছুটে যায় শিরাজের ‘হাফিজিয়া’তে, যে ফুলের বাগানের অন্তরালে শুয়ে হাফিজ। হাফিজের বাবা ছিলেন কোরআনে হাফেজ। হাফিজকে পাঠানো হয়নি কোনো মসজিদ বা মাদ্রাসায় কোরআন মুখস্থ করার জন্য। বাবা প্রতি প্রত্যুষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে তিলাওয়াত করতেন, তারই রসমাধুর্য সিঞ্চিত হয়ে চিরতরে অঙ্কিত হয়ে যায় তাঁর হূদয়ে। আল্লাহর তরফ থেকেই এই দান। অথচ তাঁর কবিতায় আছে আকাশের শুকতারা, যারা হাফিজের কবিতা নিয়ে মাতে। তা-ই তো হওয়ার কথা। এটা নির্ভর করছে যিনি শুকতারার দিকে তাকাবেন, তাঁর ওপর। সারা জীবন আকাশের দিকে তাকিয়েছে, অথচ চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা কিছুই চেনে না, এমন মানুষের সংখ্যাই সর্বাধিক। দেখেনি তারা প্রভাতে সূর্যের জেগে ওঠা। তাই তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কেমন করে হাফিজ আকাশের শুকতারায় দেখেছেন তাঁর কাব্যের প্রতিবিম্ব। এমন কিছু, যা মানুষের অন্তরের চাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মারিফত অর্থাৎ গোপন তত্ত্ব তাকে নিয়ে অনেক গভীরে। কবিরা যা দেখেন, তা অন্যরা দেখেন সমকালের দৃষ্টিতে।
ব্যস্ত সময়ের আবর্তে ত্রস্ত, এতটুকু সময় নেই কাউকে দেওয়ার। সকাল থেকে সূর্যের আলো দিয়ে চলেছে, শুধু আমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। আমি আলোকিত হতে পারিনি, হিংসা ছাড়তে পারিনি। সবাইকে সন্দেহ করি, নিজেকে ছাড়া। অথচ সন্দেহের তীর তো প্রথমে আমাকেই স্পর্শ করার কথা। সংবাদ ছুটে চলেছে সংবাদপত্রকে পেছনে ফেলে, তারা ছাপা হয়ে আসার আগেই ছুটে চলেছে ইন্টারনেটে, ফেসবুকে, টুইটারে, স্কাইপে।
মাইকেল নিউটন, নতুন গ্রন্থ, লাইফ বিটুইন লাইভস যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ছেয়ে ফেলেছে, লিখছেন: ‘নতুন কিছু পেতে হলে নিজ বিশ্বাসবলয়ের দিগন্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে খোলা মন নিয়ে। আজকের সত্য পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতি প্রজন্মে আগামী দিনের উচ্চতর সত্যের কাছে, জ্ঞানের পরিধির হচ্ছে নিত্য বিকাশ, যা মানবের সংজ্ঞা দিচ্ছে বদলে। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু নয়, মৃত্যুকে জয় করার অবিনাশী শক্তি অর্জন এই শতাব্দীর শান্তি, ভালোবাসা, স্বাস্থ্য, প্রগতির মূল লক্ষ্য।’
বুধবার কাগজে দেখেছি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেনারেলদের সঙ্গে নিয়ে দেখছেন টেলিভিশনের পর্দায় কীভাবে ঘায়েল হয়েছেন পয়লা নম্বরের শত্রু। এর আগে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে অসংখ্য মৃত্যু, হাজার মাইলের ব্যবধানে ডিজিটাল ট্রিগারে একে একে ঢলে পড়ছে: পাঁচ লাখ নিরপরাধ ইরাকি। মাইকেল নিউটনের শেষ কথাটি: ‘মৃত্যুকে জয় করো একটি নিঃশ্বাস দিয়ে। জোরে একটা নিঃশ্বাস নাও, সব সময় নিয়ো। হতে পারে, এটি তোমার শেষ নিঃশ্বাস। আর জেনো, বিশ্বাস নিঃশ্বাসকে দেয় অবিনাশী শক্তি।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments