অরণ্যে রোদন-যা দিতে পারো না, তা কেড়ে নিয়ো না by আনিসুল হক
গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দেখা করতে গেলেন দার্শনিক ডায়োজেনিসের সঙ্গে। দার্শনিক তখন একটা চৌবাচ্চায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। আলেকজান্ডার তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’ ডায়োজেনিস উত্তর দিলেন, ‘সূর্য আর আমার মধ্য থেকে সরে দাঁড়ান।
আপনি আমার রোদ আটকে রেখেছেন। আপনি যা আমাকে দিতে পারেন না, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারেন না।’
মানুষের প্রাণও কেউ দিতে পারে না। কাজেই সেটা কারও কাছ থেকে কেড়ে নেওয়াটাও উচিত নয়, একেবারেই অনন্যোপায় না হয়ে থাকলে।
তবু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজও মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। আমাদের দেশে তো আছেই, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও আছে। কিন্তু তার আগে বিচার সম্পন্ন করতে হয়। চুলচেরা বিচার। বিচারের মাধ্যমে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সহজ নয়। প্রচলিত আইনে হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে বহু বছর লেগে যায় বটে। তবু একজন অপরাধীর যখন ফাঁসি হয়, তখনো আমাদের মন খারাপ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যেথা, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’
লিমনের কথাটা লিমনের মায়ের হয়ে, বাবার হয়ে একটু ভাবার চেষ্টা করি। ১৬ বছরের লিমন হোসেন। তার থাকার কথা পরীক্ষার হলে। নিজের পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্য ঝালকাঠির এই কিশোর কাজ করত ইটের ভাটায়। লিমনের মুখে এই কাহিনি যিনি শুনেছেন, তিনিই কেঁদেছেন। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার কারিগরি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী লিমন হোসেন ২৩ মার্চ বিকেলে গরু আনতে মাঠে যায়। পথে তার সামনে পড়ে র্যাব-৮-এর একটা দল। তারা তার শার্টের কলার ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। লিমন নিজেকে ছাত্র পরিচয় দিলে তারা তাকে ‘তুই সন্ত্রাসী’ বলে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি বর্ষণ করে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
লিমন এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পেয়েছিল। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে লিমনের ওই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। গ্রামের লোকেরা যে যা পারে, তা-ই দিয়ে সাহায্য করেছে লিমনের চিকিৎসার জন্য। খবরের কাগজে আমরা পড়েছি, এলাকার লোকেরা তাকে শান্তশিষ্ট নির্বিরোধ ছেলে হিসেবেই জানে। র্যাবের মহাপরিচালক বলেছেন, লিমন সন্ত্রাসী নয়, তবে সে ক্রসফায়ারের শিকার, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে। র্যাবের এই অভিযানের নেতা বলেছেন, লিমন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর সহযোগী। সে র্যাবের ওপর গুলি করেছে। ক্রসফায়ারে সে আহত হয়েছে।
৪ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় লিমনের ওপর প্রকাশিত ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শীর্ষক খবর দেখে পঙ্গু হাসপাতালে ছুটে গেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। লিমনের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন। লিমনের জন্য কাঁদছে গ্রামবাসী।
লিমন হোসেনের ঘটনা কী ঘটেছে আসলে, একটু ভাবার চেষ্টা করি। এর মধ্যে চিন্তার একটা সূত্র পেয়ে যাই। এক পুলিশকর্তার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। তিনি কীভাবে আসামি ধরেন, সেই গল্প করছিলেন। তাঁকে আমি বলি, পুলিশ কিন্তু অনেক সময় খুবই দক্ষতার পরিচয় দেয়। বাংলাদেশে এত মানুষ, একটা পলাতক আসামি কোন গ্রামে লুকিয়ে আছে, কোন ঘরে আছে, ঠিক সেই ঘরে হানা দিয়ে সেই লোকটাকে আপনারা ধরেন কী করে? চেনেন কী করে?
পুলিশকর্তা গল্পচ্ছলে বলেন, ‘আমাদের সোর্স থাকে, ইনফরমার থাকে। সে হয়তো বলল, আমি আসামির সামনে গিয়ে কান চুলকাব। আপনি বুঝবেন, এইটাই আসামি।’
তখনই আমার মনে হয়েছিল, এ ধরনের সংকেতে অনেক সময় ভুল লোক ধরা পড়তে পারে। কানে একটা মশা পড়লে নিরীহ মানুষের সামনে দাঁড়িয়েও পুলিশের ‘সোর্স’ কান চুলকাতে পারে। ১৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘সন্ত্রাসীর লাল গেঞ্জি, র্যাব ও লিমনের লাল রক্ত’ শীর্ষক প্রতিবেদন পড়ে আমার সেই আশঙ্কাই দৃঢ়মূল হতে দেখলাম। র্যাবের কাছে খবর ছিল, সন্ত্রাসী লাল গেঞ্জি পরিহিত। ঘটনাচক্রে লিমনের পরনে সেদিন ছিল লাল গেঞ্জি। এখন এটা ঘটা খুবই সম্ভব যে, ভুলক্রমে আরেকজনকে ধরতে গিয়ে র্যাবের হাতে পড়ে লিমন এবং সে গুলির শিকারে পরিণত হয়। এখন উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি, লিমন আর তার বাবা-মায়ের মনের অবস্থা, অপরাধী না হয়েও লিমনকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে, তার পা কাটা পড়েছে এবং সেই ভয়াবহ ভুলটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা করা হয়েছে। এখানেই আমার আবেদন—সবার প্রতি, কর্তৃপক্ষের প্রতি, সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রতি—আসুন, লিমনের মায়ের হয়ে আমরা ঘটনাটাকে বোঝার চেষ্টা করি, লিমনের বাবার হয়ে ঘটনাটা উপলব্ধি করি। আপনার/আমার ছেলেমেয়েও ঘরের বাইরে যায়। যেকোনো কারণে যেকোনো পুলিশ বা র্যাবের সোর্স তার সামনে কান চুলকাতে পারে, তার পরনের গেঞ্জির রং যেকোনো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে মিলে যেতে পারে। তারপর আপনার/আমার ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করতে পারে এবং তারপর সেই গুলির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য তাকে কোনো সন্ত্রাসী দলের সদস্য বানিয়ে ফেলতে পারে। তার হাতে একটা পিস্তল গুঁজে দিতে পারে।
এখানে আসছে সেই জরুরি প্রশ্নটি। লিমন হোসেন সন্ত্রাসী নয়, সে কিশোর, তাকে ভুল করে র্যাব গুলি করেছে, এই জন্যই কি কেবল আমরা প্রতিবাদ করব, এই ঘটনার বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলব, আর যারা সত্যি সত্যি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, তাদের ক্ষেত্রে বিনা বিচারে শাস্তিদান, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদিকে সমর্থন করব, অন্তত উপেক্ষা করব? না, করা যাবে না। বিনা বিচারে মেরে ফেলাটাকে কখনো কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যাবে না। ব্রিটিশ আইনের মূল কথাটা আমরা স্মরণ করব, ১০০ জন অপরাধীও যদি ছাড়া পায়, পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও যেন সাজাপ্রাপ্ত না হয়।
এ ধরনের ভুল এর আগে একাধিকবার হয়েছে বলে আমরা কাগজে পড়েছি। প্রতিবার একই কাহিনি বর্ণনা করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। র্যাব সন্ত্রাসীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা র্যাবের ওপর গুলি চালায়। র্যাব আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে ওই ধৃত ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই গল্প দেশের মানুষ বিশ্বাস করে কি না, আমি জানি না। আমার আশপাশে যাঁদের জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা বিশ্বাস করেন না।
শুধু ভুলক্রমে নিরীহ, নিরপরাধ লোক মারা পড়লে আমরা প্রতিবাদ করি, সোচ্চার হই। কিন্তু ভুল হতে পারে বলেই একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। তাৎক্ষণিকভাবে ক্রসফায়ার একটা সমাধান দেয় বটে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতিও হয়, কিন্তু এটা চলতে দেওয়া যায় না। আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া যায় না কাউকে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নয়। তাদের হাতে অস্ত্র থাকে বলেই তাদের আইন মেনে চলতে হবে কঠোরভাবে। আর এ ধরনের ভুল যে কেবল অনিচ্ছাকৃতভাবে হতে পারে, তা-ই নয়, এই দুর্নীতিকবলিত দেশে, এই রাজনৈতিক হানাহানির দেশে প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে, জমিজমার গোলযোগ থেকে, পারিবারিক প্রতিহিংসা থেকে, এমনই হাজারটা উপলক্ষে দুর্নীতিতাড়িত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেকোনো সদস্যের, একটা বাহিনীর সুনাম যা নষ্ট করে দিতে পারে একেবারেই। খবরের কাগজে এ ধরনের সুনামহানিকর খবর র্যাবের কোনো কোনো বিপথগামী সদস্য সম্পর্কে প্রকাশিতও হয়েছে।
এমন না যে, র্যাবের সাফল্য, দক্ষতা, যোগ্যতা, আন্তরিকতাকে আমরা খাটো করে দেখছি। বইমেলায়, রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে র্যাবের উপস্থিতি অন্তত আমার মনে সব সময় নিরাপত্তার বোধ তৈরি করেছে। রাতের বেলা পথ চলতে গিয়ে যখন চোখে পড়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ দলের প্রহরা, তখন সত্যি মনে একটা ভরসা জাগে। জঙ্গি দমনে র্যাবের ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও এখন আমরা জানি, বাংলা ভাই ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনে বিগত সরকারের উচ্চমহলের প্রশ্রয় ছিল, তবু জঙ্গি দমনে র্যাবের দক্ষতা স্মরণীয় হয়েই আছে। এখনো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযানের সফলতার খবর আমাদের মনে স্বস্তি এনে দিচ্ছে। তবু মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাই গংকে কিন্তু ক্রসফায়ারে নেওয়া হয়নি, প্রচলিত আদালতে বিচারের মাধ্যমেই তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এটাই হতে পারে অনুসরণীয়। সন্ত্রাসী, সে যত কুখ্যাত, যত ভয়ংকর হোক না কেন, তাকে বন্দী করুন, বিচারের সম্মুখীন করুন; বিচার বিভাগকে কার্যকর করুন, দক্ষ করুন, জনবল বাড়ান, দ্রুত বিচার আদালতের সংখ্যা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করুন; বিচার হোক, অভিযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাক, তারপর বিচারের রায়ে অপরাধী শাস্তি পাক। এটা কিন্তু একজনের ব্যাপার নয়, একটা বাহিনীর ব্যাপার নয়, এটা নীতির ব্যাপার, দিক-নির্দেশনাটা আসতে হবে রাজনৈতিকভাবে; আমাদের মন্ত্রীরা যখন বলেন, ক্রসফায়ার এক দিনে বন্ধ হবে না, সময় লাগবে, তখন বোঝা যায়, সরকার থেকে সরকারান্তরে একই নীতি আসলে অনুসরণ করে আসা হচ্ছে।
লিমন হোসেনের বর্তমান অবস্থা দুঃখজনক, তার কাটা পড়া পা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। গ্রিক দার্শনিকের কথা তাই বারবার বলি, ‘যা তুমি দিতে পারো না, তা কেড়ে নিয়ো না।’ এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সংশ্লিষ্টদের করতে হবে অবশ্যই। তার চেয়েও বড় কথা, ভুলটাকে ঢাকতে গিয়ে একের পর এক ভুল যেন কর্তৃপক্ষ না করে বসে। লিমন হোসেনকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা ভুলের মিছিলকেই কেবল দীর্ঘ করবে। আমরা মানবাধিকার কমিশন সমীপে আবেদন জানাই, এই কেসটাকে একটা লিটমাস টেস্ট হিসেবে গ্রহণ করুন। আর সরকারকে বলি, ক্রসফায়ারের ‘সংস্কৃতি’র অবসান ঘটানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত সাহসিকতার সঙ্গে গ্রহণ করুন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পাঁচটি অগ্রাধিকার তালিকার ৫ নম্বরটি হলো ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’, যার ২ নম্বর অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যই হলো: ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে’। প্রতিশ্রুতি পালন করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
মানুষের প্রাণও কেউ দিতে পারে না। কাজেই সেটা কারও কাছ থেকে কেড়ে নেওয়াটাও উচিত নয়, একেবারেই অনন্যোপায় না হয়ে থাকলে।
তবু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজও মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। আমাদের দেশে তো আছেই, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও আছে। কিন্তু তার আগে বিচার সম্পন্ন করতে হয়। চুলচেরা বিচার। বিচারের মাধ্যমে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সহজ নয়। প্রচলিত আইনে হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে বহু বছর লেগে যায় বটে। তবু একজন অপরাধীর যখন ফাঁসি হয়, তখনো আমাদের মন খারাপ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যেথা, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’
লিমনের কথাটা লিমনের মায়ের হয়ে, বাবার হয়ে একটু ভাবার চেষ্টা করি। ১৬ বছরের লিমন হোসেন। তার থাকার কথা পরীক্ষার হলে। নিজের পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্য ঝালকাঠির এই কিশোর কাজ করত ইটের ভাটায়। লিমনের মুখে এই কাহিনি যিনি শুনেছেন, তিনিই কেঁদেছেন। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার কারিগরি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী লিমন হোসেন ২৩ মার্চ বিকেলে গরু আনতে মাঠে যায়। পথে তার সামনে পড়ে র্যাব-৮-এর একটা দল। তারা তার শার্টের কলার ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। লিমন নিজেকে ছাত্র পরিচয় দিলে তারা তাকে ‘তুই সন্ত্রাসী’ বলে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি বর্ষণ করে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
লিমন এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পেয়েছিল। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে লিমনের ওই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। গ্রামের লোকেরা যে যা পারে, তা-ই দিয়ে সাহায্য করেছে লিমনের চিকিৎসার জন্য। খবরের কাগজে আমরা পড়েছি, এলাকার লোকেরা তাকে শান্তশিষ্ট নির্বিরোধ ছেলে হিসেবেই জানে। র্যাবের মহাপরিচালক বলেছেন, লিমন সন্ত্রাসী নয়, তবে সে ক্রসফায়ারের শিকার, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে। র্যাবের এই অভিযানের নেতা বলেছেন, লিমন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর সহযোগী। সে র্যাবের ওপর গুলি করেছে। ক্রসফায়ারে সে আহত হয়েছে।
৪ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় লিমনের ওপর প্রকাশিত ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শীর্ষক খবর দেখে পঙ্গু হাসপাতালে ছুটে গেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। লিমনের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন। লিমনের জন্য কাঁদছে গ্রামবাসী।
লিমন হোসেনের ঘটনা কী ঘটেছে আসলে, একটু ভাবার চেষ্টা করি। এর মধ্যে চিন্তার একটা সূত্র পেয়ে যাই। এক পুলিশকর্তার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। তিনি কীভাবে আসামি ধরেন, সেই গল্প করছিলেন। তাঁকে আমি বলি, পুলিশ কিন্তু অনেক সময় খুবই দক্ষতার পরিচয় দেয়। বাংলাদেশে এত মানুষ, একটা পলাতক আসামি কোন গ্রামে লুকিয়ে আছে, কোন ঘরে আছে, ঠিক সেই ঘরে হানা দিয়ে সেই লোকটাকে আপনারা ধরেন কী করে? চেনেন কী করে?
পুলিশকর্তা গল্পচ্ছলে বলেন, ‘আমাদের সোর্স থাকে, ইনফরমার থাকে। সে হয়তো বলল, আমি আসামির সামনে গিয়ে কান চুলকাব। আপনি বুঝবেন, এইটাই আসামি।’
তখনই আমার মনে হয়েছিল, এ ধরনের সংকেতে অনেক সময় ভুল লোক ধরা পড়তে পারে। কানে একটা মশা পড়লে নিরীহ মানুষের সামনে দাঁড়িয়েও পুলিশের ‘সোর্স’ কান চুলকাতে পারে। ১৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘সন্ত্রাসীর লাল গেঞ্জি, র্যাব ও লিমনের লাল রক্ত’ শীর্ষক প্রতিবেদন পড়ে আমার সেই আশঙ্কাই দৃঢ়মূল হতে দেখলাম। র্যাবের কাছে খবর ছিল, সন্ত্রাসী লাল গেঞ্জি পরিহিত। ঘটনাচক্রে লিমনের পরনে সেদিন ছিল লাল গেঞ্জি। এখন এটা ঘটা খুবই সম্ভব যে, ভুলক্রমে আরেকজনকে ধরতে গিয়ে র্যাবের হাতে পড়ে লিমন এবং সে গুলির শিকারে পরিণত হয়। এখন উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি, লিমন আর তার বাবা-মায়ের মনের অবস্থা, অপরাধী না হয়েও লিমনকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে, তার পা কাটা পড়েছে এবং সেই ভয়াবহ ভুলটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা করা হয়েছে। এখানেই আমার আবেদন—সবার প্রতি, কর্তৃপক্ষের প্রতি, সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রতি—আসুন, লিমনের মায়ের হয়ে আমরা ঘটনাটাকে বোঝার চেষ্টা করি, লিমনের বাবার হয়ে ঘটনাটা উপলব্ধি করি। আপনার/আমার ছেলেমেয়েও ঘরের বাইরে যায়। যেকোনো কারণে যেকোনো পুলিশ বা র্যাবের সোর্স তার সামনে কান চুলকাতে পারে, তার পরনের গেঞ্জির রং যেকোনো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে মিলে যেতে পারে। তারপর আপনার/আমার ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করতে পারে এবং তারপর সেই গুলির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য তাকে কোনো সন্ত্রাসী দলের সদস্য বানিয়ে ফেলতে পারে। তার হাতে একটা পিস্তল গুঁজে দিতে পারে।
এখানে আসছে সেই জরুরি প্রশ্নটি। লিমন হোসেন সন্ত্রাসী নয়, সে কিশোর, তাকে ভুল করে র্যাব গুলি করেছে, এই জন্যই কি কেবল আমরা প্রতিবাদ করব, এই ঘটনার বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলব, আর যারা সত্যি সত্যি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, তাদের ক্ষেত্রে বিনা বিচারে শাস্তিদান, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদিকে সমর্থন করব, অন্তত উপেক্ষা করব? না, করা যাবে না। বিনা বিচারে মেরে ফেলাটাকে কখনো কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যাবে না। ব্রিটিশ আইনের মূল কথাটা আমরা স্মরণ করব, ১০০ জন অপরাধীও যদি ছাড়া পায়, পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও যেন সাজাপ্রাপ্ত না হয়।
এ ধরনের ভুল এর আগে একাধিকবার হয়েছে বলে আমরা কাগজে পড়েছি। প্রতিবার একই কাহিনি বর্ণনা করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। র্যাব সন্ত্রাসীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা র্যাবের ওপর গুলি চালায়। র্যাব আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে ওই ধৃত ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই গল্প দেশের মানুষ বিশ্বাস করে কি না, আমি জানি না। আমার আশপাশে যাঁদের জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা বিশ্বাস করেন না।
শুধু ভুলক্রমে নিরীহ, নিরপরাধ লোক মারা পড়লে আমরা প্রতিবাদ করি, সোচ্চার হই। কিন্তু ভুল হতে পারে বলেই একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। তাৎক্ষণিকভাবে ক্রসফায়ার একটা সমাধান দেয় বটে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতিও হয়, কিন্তু এটা চলতে দেওয়া যায় না। আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া যায় না কাউকে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নয়। তাদের হাতে অস্ত্র থাকে বলেই তাদের আইন মেনে চলতে হবে কঠোরভাবে। আর এ ধরনের ভুল যে কেবল অনিচ্ছাকৃতভাবে হতে পারে, তা-ই নয়, এই দুর্নীতিকবলিত দেশে, এই রাজনৈতিক হানাহানির দেশে প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে, জমিজমার গোলযোগ থেকে, পারিবারিক প্রতিহিংসা থেকে, এমনই হাজারটা উপলক্ষে দুর্নীতিতাড়িত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেকোনো সদস্যের, একটা বাহিনীর সুনাম যা নষ্ট করে দিতে পারে একেবারেই। খবরের কাগজে এ ধরনের সুনামহানিকর খবর র্যাবের কোনো কোনো বিপথগামী সদস্য সম্পর্কে প্রকাশিতও হয়েছে।
এমন না যে, র্যাবের সাফল্য, দক্ষতা, যোগ্যতা, আন্তরিকতাকে আমরা খাটো করে দেখছি। বইমেলায়, রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে র্যাবের উপস্থিতি অন্তত আমার মনে সব সময় নিরাপত্তার বোধ তৈরি করেছে। রাতের বেলা পথ চলতে গিয়ে যখন চোখে পড়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ দলের প্রহরা, তখন সত্যি মনে একটা ভরসা জাগে। জঙ্গি দমনে র্যাবের ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও এখন আমরা জানি, বাংলা ভাই ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনে বিগত সরকারের উচ্চমহলের প্রশ্রয় ছিল, তবু জঙ্গি দমনে র্যাবের দক্ষতা স্মরণীয় হয়েই আছে। এখনো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযানের সফলতার খবর আমাদের মনে স্বস্তি এনে দিচ্ছে। তবু মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাই গংকে কিন্তু ক্রসফায়ারে নেওয়া হয়নি, প্রচলিত আদালতে বিচারের মাধ্যমেই তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এটাই হতে পারে অনুসরণীয়। সন্ত্রাসী, সে যত কুখ্যাত, যত ভয়ংকর হোক না কেন, তাকে বন্দী করুন, বিচারের সম্মুখীন করুন; বিচার বিভাগকে কার্যকর করুন, দক্ষ করুন, জনবল বাড়ান, দ্রুত বিচার আদালতের সংখ্যা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করুন; বিচার হোক, অভিযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাক, তারপর বিচারের রায়ে অপরাধী শাস্তি পাক। এটা কিন্তু একজনের ব্যাপার নয়, একটা বাহিনীর ব্যাপার নয়, এটা নীতির ব্যাপার, দিক-নির্দেশনাটা আসতে হবে রাজনৈতিকভাবে; আমাদের মন্ত্রীরা যখন বলেন, ক্রসফায়ার এক দিনে বন্ধ হবে না, সময় লাগবে, তখন বোঝা যায়, সরকার থেকে সরকারান্তরে একই নীতি আসলে অনুসরণ করে আসা হচ্ছে।
লিমন হোসেনের বর্তমান অবস্থা দুঃখজনক, তার কাটা পড়া পা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। গ্রিক দার্শনিকের কথা তাই বারবার বলি, ‘যা তুমি দিতে পারো না, তা কেড়ে নিয়ো না।’ এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সংশ্লিষ্টদের করতে হবে অবশ্যই। তার চেয়েও বড় কথা, ভুলটাকে ঢাকতে গিয়ে একের পর এক ভুল যেন কর্তৃপক্ষ না করে বসে। লিমন হোসেনকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা ভুলের মিছিলকেই কেবল দীর্ঘ করবে। আমরা মানবাধিকার কমিশন সমীপে আবেদন জানাই, এই কেসটাকে একটা লিটমাস টেস্ট হিসেবে গ্রহণ করুন। আর সরকারকে বলি, ক্রসফায়ারের ‘সংস্কৃতি’র অবসান ঘটানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত সাহসিকতার সঙ্গে গ্রহণ করুন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পাঁচটি অগ্রাধিকার তালিকার ৫ নম্বরটি হলো ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’, যার ২ নম্বর অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যই হলো: ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে’। প্রতিশ্রুতি পালন করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments