বাঘা তেঁতুল-শয়তান, ভেড়া ও পার্লামেন্ট by সৈয়দ আবুল মকসুদ
এই দুনিয়ায় বালা-মুসিবত যেমন আছে, তেমনি আছে সেসব থেকে আসান পাওয়ার উপায়। বিধাতার পরেই দুনিয়াতে কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান সবচেয়ে ক্ষমতাবান। শয়তানের প্রভাবে বহু ভালো মানুষ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যায়। তবে শয়তানের আছরমুক্ত হওয়ার উপায় সব দেশের মানুষের জানা নেই।
তা জানা আছে কিরগিজস্তানের নেতাদের। তাঁরা শয়তান তাড়ানোর বিদ্যা এবার হাতে-কলমে এস্তেমাল করেছেন।
বার্তা সংস্থা এএফপি পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল কিরগিজস্তানের পার্লামেন্টে সাতটি ভেড়া বলি দেওয়া হয়েছে। দেশটির প্রথা অনুযায়ী পার্লামেন্ট কক্ষকে ‘শয়তানের প্রভাব’ থেকে মুক্ত রাখতে এই বলি দেওয়া হয়। গত বছরের জাতিগত সহিংসতা ও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আইনপ্রণেতারাই এ সিদ্ধান্ত নেন। পার্লামেন্টের তথ্য বিভাগ জানিয়েছে, রাজধানী বিশকেকে অবস্থিত ঝোগোরকু কেনেশ পার্লামেন্ট ভবনের দেয়ালঘেঁষে ভেড়াগুলো বলি দেওয়া হয়। দেশটির জনসংযোগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আইন পরিষদের প্রতিনিধিরা দুরাত্মা বিতাড়িত করার আশায় বলির সিদ্ধান্ত নেন। [প্রথম আলো, ২২.০৪.১১]
এ যে কত বড় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, তা বলে শেষ করা যাবে না। এ শুধু কিরগিজস্তানের মানুষের স্বার্থে নয়, এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর বহু জাতিকেই আলোর সন্ধান দেবে, বিশেষ করে সেসব দেশকে, যাদের কোনো রকম একটি পার্লামেন্ট রয়েছে; কিন্তু তাতে রয়েছে দুরাত্মা শয়তানের প্রবল প্রভাব। অদূর ভবিষ্যতে অনেক দেশেই পার্লামেন্টকে শয়তানের প্রভাবমুক্ত রাখতে সাতটি ভেড়া বলি দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন পর্যন্ত হবে। গোলটেবিলও হবে। এক বেলা ‘আমৃত্যু অনশন’ কর্মসূচি যে পালিত হবে না, তা হলফ করে বলতে পারি না। কোনো কোনো দেশে সাতটি ভেড়ায় কাজ হবে না। যেসব পার্লামেন্টে শয়তানের আছর বেশি, সেখানে চৌদ্দটি ভেড়া বলি দিতে হবে। কোনো দেশে চার গুণ—চার সাতে আঠাশটি।
কোনো কোনো দেশে শুধু পার্লামেন্ট ভবন নয়, শাসকদের বাসভবনে পর্যন্ত শয়তান ঢুকে পড়ে। ওই কিরগিজস্তানেরই প্রেসিডেন্ট কুরমানবেগ বাকিয়েভ পড়েছিলেন প্রেতাত্মার পাল্লায়। সেই শয়তানের আছর তাড়াতে গতবার রাস্তায় নেমে পড়েছিল দেশের মানুষ। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বাকিয়েভ দেশত্যাগে বাধ্য হন। বাকিয়েভ বাকি জীবন বেগম নিয়ে বিদেশে কাটাবেন। এ মুহূর্তে পৃথিবীর বেশ কয়েকজন স্বৈরশাসক, ‘যাঁরা ছিলেন একদিন লৌহমানব’, দেশ থেকে পলাতক।
সব দেশে অবশ্য শয়তান, জিন ও ভূতপ্রেত নেই। আর থাকলেও এবং তারা বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে পড়লেও পড়তে পারে, কিন্তু পার্লামেন্ট ভবনের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না। আর কোনো কোনো দেশে তোশক-বালিশ-মশারি নিয়ে শয়তান পার্লামেন্টের কক্ষে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করে। অনেক দেশে শয়তান ও জিনের ভয়ে বিরোধী দলের সদস্যরা পার্লামেন্টের কক্ষে ঢুকতেই চান না। পৃথিবীর বহু পার্লামেন্ট আছে, যেখানে সরকারি দলের সদস্যসংখ্যা চার ভাগের তিন ভাগ। কিন্তু দুরাত্মার ভয়ে তাঁরা অধিবেশনে যোগ দেন না। সুতরাং কোরাম হয় না।
ভেড়া কোরবানি ছাড়াই বহু দেশের পার্লামেন্ট শয়তানের প্রভাবমুক্ত। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, ফরাসি পার্লামেন্ট, জার্মান পার্লামেন্ট বা জাপানি পার্লামেন্টে ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি। ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনের পাশে হাজার খানেক পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছে বলেও শোনা যায় না। পাঁঠা বলি ছাড়াই ৬১ বছরেও সেখানে প্রেতাত্মা প্রবেশ করতে পারেনি। শয়তান বড় ছিদ্র দিয়ে ঢুকেছিল পাকিস্তানের পার্লামেন্টে, পঞ্চাশের দশকে। পেশিঅলা প্রেতাত্মা প্রবেশ করেছিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে, ১৯৫৮-তে। সেদিন যদি জগন্নাথ হলের পাশে সাতটি ভেড়া কোরবানি দেওয়া যেত, তাহলে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারি বেহেশতবাসী হতেন না। পাকিস্তানেও সামরিক শাসন আসত না।
তবে শুধু পার্লামেন্ট ভবনকে দোষ দেওয়া যাবে না। ওই ভবনের যাঁরা অধিবাসী, তাঁদের আত্মা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ভেড়া কেন, উট কোরবানিতেও কাজ হবে না। কোনো এমপি যদি তাঁর বাবার বয়সী স্পিকারকে বলেন, ‘মাইক দে’, তা প্রেতাত্মার দোষ নয়—সাংসদাত্মার অশিষ্টাচার ও অপরাধ। এমন দিন দূরে নয়, যেদিন কোনো কোনো দেশে পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকার পথেই একটি পার্লামেন্ট-বেদি বানিয়ে রাখতে হবে। সেই বেদিতে কিছুদিন পর পর প্রচুর ভেড়া, দুম্বা ও উট কোরবানি দিতে হবে। কষ্ট হয় নিরীহ প্রাণীগুলোর জন্য।
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যিনি অধিপতি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, শুধু কিরগিজস্তান নয়, পৃথিবীর সব দেশের পার্লামেন্টকেই শয়তানের প্রভাবমুক্ত করুন। কারণ, ওখানে শয়তান ঢুকে পড়লে দেশের জনগণের দুর্গতির অন্ত থাকে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বার্তা সংস্থা এএফপি পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল কিরগিজস্তানের পার্লামেন্টে সাতটি ভেড়া বলি দেওয়া হয়েছে। দেশটির প্রথা অনুযায়ী পার্লামেন্ট কক্ষকে ‘শয়তানের প্রভাব’ থেকে মুক্ত রাখতে এই বলি দেওয়া হয়। গত বছরের জাতিগত সহিংসতা ও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আইনপ্রণেতারাই এ সিদ্ধান্ত নেন। পার্লামেন্টের তথ্য বিভাগ জানিয়েছে, রাজধানী বিশকেকে অবস্থিত ঝোগোরকু কেনেশ পার্লামেন্ট ভবনের দেয়ালঘেঁষে ভেড়াগুলো বলি দেওয়া হয়। দেশটির জনসংযোগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আইন পরিষদের প্রতিনিধিরা দুরাত্মা বিতাড়িত করার আশায় বলির সিদ্ধান্ত নেন। [প্রথম আলো, ২২.০৪.১১]
এ যে কত বড় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, তা বলে শেষ করা যাবে না। এ শুধু কিরগিজস্তানের মানুষের স্বার্থে নয়, এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর বহু জাতিকেই আলোর সন্ধান দেবে, বিশেষ করে সেসব দেশকে, যাদের কোনো রকম একটি পার্লামেন্ট রয়েছে; কিন্তু তাতে রয়েছে দুরাত্মা শয়তানের প্রবল প্রভাব। অদূর ভবিষ্যতে অনেক দেশেই পার্লামেন্টকে শয়তানের প্রভাবমুক্ত রাখতে সাতটি ভেড়া বলি দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন পর্যন্ত হবে। গোলটেবিলও হবে। এক বেলা ‘আমৃত্যু অনশন’ কর্মসূচি যে পালিত হবে না, তা হলফ করে বলতে পারি না। কোনো কোনো দেশে সাতটি ভেড়ায় কাজ হবে না। যেসব পার্লামেন্টে শয়তানের আছর বেশি, সেখানে চৌদ্দটি ভেড়া বলি দিতে হবে। কোনো দেশে চার গুণ—চার সাতে আঠাশটি।
কোনো কোনো দেশে শুধু পার্লামেন্ট ভবন নয়, শাসকদের বাসভবনে পর্যন্ত শয়তান ঢুকে পড়ে। ওই কিরগিজস্তানেরই প্রেসিডেন্ট কুরমানবেগ বাকিয়েভ পড়েছিলেন প্রেতাত্মার পাল্লায়। সেই শয়তানের আছর তাড়াতে গতবার রাস্তায় নেমে পড়েছিল দেশের মানুষ। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বাকিয়েভ দেশত্যাগে বাধ্য হন। বাকিয়েভ বাকি জীবন বেগম নিয়ে বিদেশে কাটাবেন। এ মুহূর্তে পৃথিবীর বেশ কয়েকজন স্বৈরশাসক, ‘যাঁরা ছিলেন একদিন লৌহমানব’, দেশ থেকে পলাতক।
সব দেশে অবশ্য শয়তান, জিন ও ভূতপ্রেত নেই। আর থাকলেও এবং তারা বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে পড়লেও পড়তে পারে, কিন্তু পার্লামেন্ট ভবনের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না। আর কোনো কোনো দেশে তোশক-বালিশ-মশারি নিয়ে শয়তান পার্লামেন্টের কক্ষে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করে। অনেক দেশে শয়তান ও জিনের ভয়ে বিরোধী দলের সদস্যরা পার্লামেন্টের কক্ষে ঢুকতেই চান না। পৃথিবীর বহু পার্লামেন্ট আছে, যেখানে সরকারি দলের সদস্যসংখ্যা চার ভাগের তিন ভাগ। কিন্তু দুরাত্মার ভয়ে তাঁরা অধিবেশনে যোগ দেন না। সুতরাং কোরাম হয় না।
ভেড়া কোরবানি ছাড়াই বহু দেশের পার্লামেন্ট শয়তানের প্রভাবমুক্ত। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, ফরাসি পার্লামেন্ট, জার্মান পার্লামেন্ট বা জাপানি পার্লামেন্টে ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি। ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনের পাশে হাজার খানেক পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছে বলেও শোনা যায় না। পাঁঠা বলি ছাড়াই ৬১ বছরেও সেখানে প্রেতাত্মা প্রবেশ করতে পারেনি। শয়তান বড় ছিদ্র দিয়ে ঢুকেছিল পাকিস্তানের পার্লামেন্টে, পঞ্চাশের দশকে। পেশিঅলা প্রেতাত্মা প্রবেশ করেছিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে, ১৯৫৮-তে। সেদিন যদি জগন্নাথ হলের পাশে সাতটি ভেড়া কোরবানি দেওয়া যেত, তাহলে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারি বেহেশতবাসী হতেন না। পাকিস্তানেও সামরিক শাসন আসত না।
তবে শুধু পার্লামেন্ট ভবনকে দোষ দেওয়া যাবে না। ওই ভবনের যাঁরা অধিবাসী, তাঁদের আত্মা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ভেড়া কেন, উট কোরবানিতেও কাজ হবে না। কোনো এমপি যদি তাঁর বাবার বয়সী স্পিকারকে বলেন, ‘মাইক দে’, তা প্রেতাত্মার দোষ নয়—সাংসদাত্মার অশিষ্টাচার ও অপরাধ। এমন দিন দূরে নয়, যেদিন কোনো কোনো দেশে পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকার পথেই একটি পার্লামেন্ট-বেদি বানিয়ে রাখতে হবে। সেই বেদিতে কিছুদিন পর পর প্রচুর ভেড়া, দুম্বা ও উট কোরবানি দিতে হবে। কষ্ট হয় নিরীহ প্রাণীগুলোর জন্য।
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যিনি অধিপতি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, শুধু কিরগিজস্তান নয়, পৃথিবীর সব দেশের পার্লামেন্টকেই শয়তানের প্রভাবমুক্ত করুন। কারণ, ওখানে শয়তান ঢুকে পড়লে দেশের জনগণের দুর্গতির অন্ত থাকে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments