দাহকালের কথা-অশনিসংকেত by মাহমুদুজ্জামান বাবু

সাতসকালে টেলিফোন কলের শব্দে ঘুম ভেঙেছিল আজ। অপরিচিত নম্বর। কিন্তু কথা শুরু হলে অপরিচিতির দূরত্ব কাটল। ওপাশের ব্যক্তিটি ডা. আলম। আত্মীয়তার সূত্রে আমি তার মামা। আলম বলল, ‘মামা, আপনি কি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন?’ কথা শুনে আমি তাজ্জব! মেজাজও চড়ে যাচ্ছিল। তবুও শান্ত গলায় জানতে চাইলাম, ‘কেন বলছ, এ কথা?’

আলমের স্বরেও ক্রোধ। ‘আমি জানি, আপনি বামপন্থার মানুষ। আওয়ামী লীগ-বিএনপি আপনার না। কিন্তু প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের যে গানটি (আমি বাংলার গান গাই) আপনি গেয়েছিলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বানানো একটি তথ্যচিত্রে যে সেই গানটি জুড়ে দিল, সবাই তো ভাবছে আপনি ভোল পাল্টেছেন। আমার বন্ধুরা আমাকে এখন টিটকারি দেয়। বলে, আপনি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য এই কাজ করেছেন।’
আলমের কথা শুনতে শুনতে ক্রোধের বদলে আমার ক্লান্ত লাগতে থাকে। আমি তাকে কীভাবে বোঝাব, বাংলাদেশ টেলিভিশন বা আওয়ামী লীগের ওই বোধটুকু নেই যে, তথ্যচিত্রে ওই গানটি ব্যবহার করার জন্য আমার বা গানটির মূল গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এটি শিষ্টাচারের অংশ এবং এটি কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশ নামের এই গায়ের জোরের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসবের কোনো বালাই আছে? নেই। এটা সংস্কৃতির সংকট। সংকট রুচিরও। স্বেচ্ছাচারিতাকে আমরা সভ্যতা বলি না। দুনিয়াজোড়া ওটার পরিচয় ‘অসভ্যতা’। বর্তমান সময় ও দুনিয়া ওই দিয়েই চলছে। আবার এসবের বিরুদ্ধে মানুষের জাগরণও ঘটছে। এখানেও ঘটবে (মহাবিশ্বে ধ্রুব বা শাশ্বত বলে কিছু নেই। সবকিছুই পরিবর্তনশীল। বন্ধুদের কেউ কেউ মন্দের ভালো হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোটের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের পক্ষে সাফাই গান। বিএনপি কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দল গড়ে তোলেনি। তাদের জন্ম সেনানিবাসে। তাদের নেতা জিয়াউর রহমান অনেক সামরিক কর্মকর্তা হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এ রকম অসংখ্য সত্য কথা আছে বিএনপি প্রসঙ্গে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান (কোকো) কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, অনাচার করেছেন প্রশাসনে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ‘ভাইয়া’ উপাধি পেয়েছেন এবং তারপর মইন উ আহমেদের সেনাশাসনের সময় দেশত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটকে প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটকে নিরঙ্কুশভাবে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিল। ক্ষমতাগ্রহণের তিন বছর অতিক্রম করেছে আওয়ামী জোটের এই সরকার। রাষ্ট্রে কি মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে? শেয়ার কেলেঙ্কারি, প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান মূল্য, জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা, সাংবাদিক দম্পতি খুন আর সরকারের ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের মাস্তানিতে বাংলাদেশ কি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের চেয়ে ভালো আছে? নেই। এ নিয়ে বিস্তারিত লেখারও কিছু নেই। দেশের আমজনতা প্রতিমুহূর্তে সেটা উপভোগ করছে।
১২ মার্চের বিএনপির জোটের মহাসমাবেশের এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে, রাজপথে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট একটি বড় সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করছে। তো, সেদিন বনানীর এক অফিসে মিটিং শেষ করে দুপুর দেড়টায় বেরিয়েছি। গন্তব্য পশ্চিম রাজাবাজার। বনানীর ৪ নম্বর সড়ক থেকে বেরিয়ে মহাখালী উড়ালসেতুমুখী প্রধান সড়কে এসে দেখি সব যানবাহন অনড় দাঁড়িয়ে আছে। চড়া দামে একটি সিএনজি ভাড়া করা হলো। ৪০ মিনিটে সেই সিএনজি মহাখালীর উড়ালসেতুর মাঝখানে এসে থমকে গেল। এবার পুরোপুরি নট নড়নচড়ন। কারণ কী? চালক জানালেন, বিজয় সরণি থেকে শাহবাগমুখী রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজ প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন! ঘড়ির কাঁটা এবার ৫০০ মিনিট অতিক্রম করল। সিএনজি শামুকের গতিতে চলে ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেট বরাবর উল্টো পাশটায় থমকে গেল। গ্যাস শেষ। অন্য গাড়িগুলোও নড়ছে না। অনেকেই বিরক্তমুখে হাঁটা শুরু করেছে। আমিও পা মেলালাম। মাথার ওপর তখন বেলা তিনটার গনগনে রোদ। আমি কেন এই রোদে পুড়ব? কেন?
বিএনপি-জামায়াত জোটের মহাসমাবেশের দিন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি পড়ন্ত বিকেলে। সরাসরি সমাবেশ দেখাচ্ছিল বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশন আর একুশে টিভি। হঠাৎ করেই চ্যানেল দুটির সমপ্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা গেল, সরকারের বিশেষ সংস্থার নির্দেশে কেব্ল অপারেটররা এটা করতে বাধ্য হয়েছে। এই যে রাস্তা বন্ধ করা, টিভি চ্যানেল বন্ধ করা, মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা, সুসজ্জিত মঞ্চে বসে আমাদের নেতা-নেত্রীদের একে অপরের নামে কুৎসা করায় কোন গণণতন্ত্রের জয়ডঙ্কা বাজে? এঁদের কে মন্দ আর কে ভালো? বিচারের মাপকাঠি কী? স্বাধীনতার মাস মার্চ। টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র আর অন্যান্য গণমাধ্যমে আবেগমথিত হয়ে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনার গল্প শুনছি, বলছি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের শাসকদের নৃশংস দমন-পীড়নের ইতিহাস পড়ছি বারবার। এখন তো এটা স্বাধীন দেশ। এখন কেন গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরা হলো? আমাদের সংবিধান তো এক সাগর রক্তে ভিজিয়ে রচিত হয়েছে। সেখানে কি বাক, ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছু বলা আছে? আমরা কি মগ্ন হয়ে পাঠ করব? আবার?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.