যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েতের পর ওসামা, তারপর কে? by অ্যাডাম কার্টিস
ওসামা বিন লাদেনের ভীতিকর দিক হলো, তিনি দুনিয়াব্যাপী কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ হত্যায় সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু অদ্ভুত, তিনি পাশ্চাত্যের কাছে অত্যন্ত মূল্যবানও ছিলেন। তিনি দুনিয়ার হিসাব-নিকাশ সরল করে দিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে কমিউনিজমের বিপর্যয়ের সময় পাশ্চাত্যের নাগরিকদের মনের ভেতরে খোদাই হয়ে থাকা দূরবর্তী এক অশুভ ও
কালশক্তির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ের বিশাল গল্পটি আকস্মিকভাবে সমাপ্ত হলো। হঠাৎই দুনিয়াকে বোঝা অনেক কঠিন হয়ে গেল, যতক্ষণ না ওসামার আবির্ভাব ঘটল। ১৯৯৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটকে ঘিরে সংশয় আর মনিকা লিউইনস্কির ঘটনা নিয়ে উন্মাদনা ছাপিয়ে পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে আবির্ভূত হলেন ওসামা।
সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সুযোগটা লুফে নিলেন। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। অনেকে অভিযোগ করল, ওসামার অজুহাত খাড়া করে ক্লিনটন নিজেকেই বাঁচাতে চাইছেন। সেদিন ওয়াশিংটনে টেলিভিশন সাংবাদিকেরা যেসব প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর ওপর নজর বোলালে আরও কিছু ব্যাপার দেখতে পাবেন। সেই পুরোনো গল্পের ঘোর কালো চেহারা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ ভেসে উঠতে থাকার মতো করে।
ওসামা ও তাঁর মতাদর্শিক গুরু আইমান আল জাওয়াহিরি দুই ধরনের শত্রুর কথা বললেন—‘নিকটবর্তী শত্রু’ আর ‘দূরবর্তী শত্রু’। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘দূরবর্তী শত্রুতে’ পরিণত হয়েছেন। নয়া রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা শেষবার স্নায়ুযুদ্ধের কালে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের শাসনামলে সত্যিকারের ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিলেন। তাঁরা ওসামা ও জাওয়াহিরি সম্পর্কে জানা অল্প কিছু তথ্য লুফে নিয়ে তাঁদের অতিপরিচিত ছকে ফেলে দিলেন। তাঁদের সম্পর্কে বললেন: এঁরা তাঁদের অশুভ শত্রু, দুনিয়াব্যাপী যাঁদের ছদ্মবেশী সদস্য আছে, যাঁরা প্রয়োজনের সময় নির্দেশ মোতাবেক সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারেন (স্লিপার সেল); আর সারা দুনিয়াতেই এঁদের জাল ছড়ানো। এই শত্রুর একমাত্র লক্ষ্য পাশ্চাত্য সভ্যতার ধ্বংসসাধন। আল-কায়েদা হয়ে উঠল নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর এভাবেই ওসামা বিন লাদেন পরিণত হলেন দৈত্যাকার, ভয়ানক ক্ষমতাধর এক চরিত্রে, যিনি গুহায় বসে থেকেও দুনিয়াব্যাপী আল-কায়েদার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পারেন। এভাবেই গুরুতর অথচ সামাল দেওয়া সম্ভব এমন এক সন্ত্রাসী হুমকি ভীষণ অতিরঞ্জিত করা হলো।
বহু সাংবাদিক, যাঁরা আগের দিনের সরল দুনিয়ার জন্য ব্যাকুল, তাঁরা এটা লুফে নিলেন; এই সরলীকৃত আধিপত্যশীল আখ্যানের প্রতিফলন ঘটাতে একেবারে শুরু থেকেই ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী হুমকিবিষয়ক প্রতিবেদনে বিকৃতি ঘটানো হতে থাকে। আর ওসামাও সেটা লুফে নেন। যে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁরাই জানাচ্ছেন, প্রচারণার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সুদক্ষ। নয়া রক্ষণশীল, ‘সন্ত্রাস সাংবাদিক’ ও ওসামা বিন লাদেন নিজে—এই তিন পক্ষই বেশ কার্যকরভাবে একসঙ্গে কাজ করেছে আসন্ন বিপর্যয়ের নাটকীয় রকমের সরল গল্প বানানোর ক্ষেত্রে। তা কোনোভাবেই ষড়যন্ত্র নয়। এরা সবাই নিজস্ব কায়দায় একটি সরল ফ্যান্টাসি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, যে ফ্যান্টাসি তাদের নিজস্ব চাহিদা মেটায়।
এই সরল গল্পের শক্তি ইতিহাসকে সামনের দিকে চালিত করেছে। নয়া রক্ষণশীল আর তাদের উদারপন্থী হস্তক্ষেপ-সমর্থক মিত্ররা এর ফলে নতুন করে বিশ্বব্যবস্থা গড়া ও গণতন্ত্র বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে বিপ্লবী ইসলাম পন্থা আরব জনগণকে জাগাতে এবং তাদের স্বপ্ন লালন করতে নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল। সেই শক্তিও নিজের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের সুযোগ পেল। এরই মধ্যে বহু সংবাদপত্র নিজেদের বিক্রি বাড়িয়ে নিল।
কিন্তু আমরা আর আমাদের নেতারা যেহেতু সাদা শুভ শক্তি ও কালো অশুভ শক্তির বিরোধের ফ্যান্টাসি জগতে বাস করছি, তাই আমরা বাস্তব দুনিয়ার নতুন জটিলতা বুঝি আরও কম। অর্থাৎ, আরব দুনিয়ায় আসলে কী ঘটছে, তা আমরা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছি।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নানা ‘ব্র্যান্ডের’ আল-কায়েদার খোঁজে যখন ছুটে চলেছে সাংবাদিক ও প্রাণঘাতী ড্রোন আর মার্কিনরা একের পর এক ঠিকা দিয়ে রাখছে সেই সব স্বৈরশাসককে, যাঁরা ‘সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেছেন, তখন পুরো মঞ্চে আবির্ভূত হলো এক নতুন প্রজন্ম, যারা স্বৈরশাসকদের হাত থেকে নিস্তার চায়। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের এই বিপ্লব পাশ্চাত্যের জন্য ধাক্কা হিসেবে এসেছে। পশ্চিমারা আসলে জানেই না, এসব বিপ্লবী পরিচয় কী কিংবা কোন মতাদর্শ তাদের চালিত করছে। আল-কায়েদার সঙ্গে যে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। তবে তারা হোসনি মোবারকের মতো স্বৈরশাসক অর্থাৎ ‘নিকটবর্তী শত্রু’ বিতাড়নের লক্ষ্যটি পূরণ করেছে, যা কাকতালীয়ভাবে ছিল ওসামারও প্রধান লক্ষ্য।
রাজনীতিকদের (এবং সাংবাদিকদেরও) অন্যতম প্রধান কাজ হলো আমাদের জন্য দুনিয়াটাকে সরল করে তোলা। কিন্তু তাঁরা যত চেষ্টাই করুন না কেন, বাস্তবতার ক্ষুদ্র কোনো অংশ ঘটনার কোনো ভগ্নাংশকে যখন আর আগের কাঠামোতে ধরা সম্ভব হয় না, তখনই ঘটে বিপত্তি।
ভালো মানুষ বনাম খারাপ মানুষ—এই সরলীকৃত গল্পে ওসামার মৃত্যু হয়তো সেই বিপত্তি বিন্দু। ভালো মানুষ বনাম খারাপ মানুষের এই গল্পের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (‘ভালো যুদ্ধ’) পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে। এরপর স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে তা পাশ্চাত্য কল্পনায় অনেক গভীরে গেঁথে যায়। গত ১০ বছরে সেই গল্পের পুনর্জাগরণ ঘটেছে এবং তা জাগরূক থেকেছে এক অদ্ভুত মিত্রতার মধ্য দিয়ে—যে মিত্রতায় শরিক আছেন মার্কিন ও ইউরোপীয় রাজনীতিক, সাংবাদিক, ‘সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ’ ও বিপ্লবী ইসলামপন্থীরা, যাঁরা সবাই এক স্বপ্নহীনতার যুগে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া।
ইতিমধ্যে বারাক ওবামা এ গল্প অস্বীকার করতে শুরু করেছেন। অবশ্য লিবিয়ায় ‘উদারপন্থী হস্তক্ষেপ সমর্থনের’ প্রত্যাবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে ইউরোপীয়রা এখনো তা আঁকড়ে ধরে আছে। তবে তারা নিরুদ্যম; একদমই নিরুদ্বেগ হতে পারছে না।
আফগানিস্তানে এই গল্পটি আসলেই ধ্বংসের পথে। পশ্চিমারা বুঝতে শুরু করেছে, এই সরলীকরণের ফলে প্রকৃত শত্রু সম্পর্কে পুরোপুরি অলীক, বাস্তবতাবিবর্জিত ফ্যান্টাসি তৈরি হচ্ছে। ফ্যান্টাসিতেই অটল থাকা হচ্ছে, কারণ তা সেখানে পশ্চিমা উপস্থিতি জায়েজ করার জন্য জরুরি। ভালো বনাম মন্দের এই সরল গল্পের মূল সমস্যা হলো এই গল্প কোনো যথাযথ সমালোচনামূলক কাঠামো অনুমোদন করে না, যে কাঠামো দিয়ে ঠিকভাবে যাচাই করা যায় যেমন শত্রুকে, মিত্রকেও তেমনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আফগানিস্তান আক্রমণের সোজাসাপ্টা ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংসসাধন এবং এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে ভালো মানুষেরা দেশটি শাসন করতে পারবেন। কিন্তু পরবর্তী এক দশকে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর জাল বিস্তৃত হয়ে এমন এক রাষ্ট্র তৈরি করেছে, যে রাষ্ট্র দুর্নীতির কারণে পঙ্গু—কে হতে পারে ‘ভালো’ মানুষ, তা জানাও এখন অসম্ভব করে তুলেছে।
এদিকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বলেছেন, ওসামার হত্যা প্রমাণ করে যে প্রকৃত সন্ত্রাসবাদী হুমকি আসলে পাকিস্তানে—তাঁর দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলো ফ্যান্টাসি। কিন্তু কারজাই যা বলেছেন তার অনেকটাই হয়তো তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দিতে এস্তেমাল করা ফ্যান্টাসি। তাহলে আফগানিস্তান হয়ে উঠল এক আরশিনগর; ব্যতিক্রম শুধু একটাই—সবাই এখন একমত, ওসামা আফগানিস্তানে ছিলেন না।
ওসামার মৃত্যু হয়তো বর্তমান আখ্যানের জাদুকরি ক্ষমতা ভেঙে ফেলবে। মনে হচ্ছে, আমরা যেন দুনিয়ার বিষয়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গির এমন এক সীমায় উপনীত হয়েছি, যেখানে আর কোনো অর্থ তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, পরের গল্প কোথা থেকে আসবে? পরের খারাপ লোক/শক্তিটি কে হবে? আসল সত্য হলো, এসব গল্পের নির্মাতা তারাই, যাদের হাতে আছে ক্ষমতা। হয়তো পরের বড় গল্পটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে না। অথবা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কমে যাচ্ছে—এই ধারণাটিই হয়তো আমাদের যুগের নতুন সরলীকৃত ফ্যান্টাসি।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অ্যাডাম কার্টিস: ব্রিটিশ সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সুযোগটা লুফে নিলেন। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। অনেকে অভিযোগ করল, ওসামার অজুহাত খাড়া করে ক্লিনটন নিজেকেই বাঁচাতে চাইছেন। সেদিন ওয়াশিংটনে টেলিভিশন সাংবাদিকেরা যেসব প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর ওপর নজর বোলালে আরও কিছু ব্যাপার দেখতে পাবেন। সেই পুরোনো গল্পের ঘোর কালো চেহারা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ ভেসে উঠতে থাকার মতো করে।
ওসামা ও তাঁর মতাদর্শিক গুরু আইমান আল জাওয়াহিরি দুই ধরনের শত্রুর কথা বললেন—‘নিকটবর্তী শত্রু’ আর ‘দূরবর্তী শত্রু’। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘দূরবর্তী শত্রুতে’ পরিণত হয়েছেন। নয়া রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা শেষবার স্নায়ুযুদ্ধের কালে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের শাসনামলে সত্যিকারের ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিলেন। তাঁরা ওসামা ও জাওয়াহিরি সম্পর্কে জানা অল্প কিছু তথ্য লুফে নিয়ে তাঁদের অতিপরিচিত ছকে ফেলে দিলেন। তাঁদের সম্পর্কে বললেন: এঁরা তাঁদের অশুভ শত্রু, দুনিয়াব্যাপী যাঁদের ছদ্মবেশী সদস্য আছে, যাঁরা প্রয়োজনের সময় নির্দেশ মোতাবেক সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারেন (স্লিপার সেল); আর সারা দুনিয়াতেই এঁদের জাল ছড়ানো। এই শত্রুর একমাত্র লক্ষ্য পাশ্চাত্য সভ্যতার ধ্বংসসাধন। আল-কায়েদা হয়ে উঠল নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর এভাবেই ওসামা বিন লাদেন পরিণত হলেন দৈত্যাকার, ভয়ানক ক্ষমতাধর এক চরিত্রে, যিনি গুহায় বসে থেকেও দুনিয়াব্যাপী আল-কায়েদার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পারেন। এভাবেই গুরুতর অথচ সামাল দেওয়া সম্ভব এমন এক সন্ত্রাসী হুমকি ভীষণ অতিরঞ্জিত করা হলো।
বহু সাংবাদিক, যাঁরা আগের দিনের সরল দুনিয়ার জন্য ব্যাকুল, তাঁরা এটা লুফে নিলেন; এই সরলীকৃত আধিপত্যশীল আখ্যানের প্রতিফলন ঘটাতে একেবারে শুরু থেকেই ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী হুমকিবিষয়ক প্রতিবেদনে বিকৃতি ঘটানো হতে থাকে। আর ওসামাও সেটা লুফে নেন। যে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁরাই জানাচ্ছেন, প্রচারণার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সুদক্ষ। নয়া রক্ষণশীল, ‘সন্ত্রাস সাংবাদিক’ ও ওসামা বিন লাদেন নিজে—এই তিন পক্ষই বেশ কার্যকরভাবে একসঙ্গে কাজ করেছে আসন্ন বিপর্যয়ের নাটকীয় রকমের সরল গল্প বানানোর ক্ষেত্রে। তা কোনোভাবেই ষড়যন্ত্র নয়। এরা সবাই নিজস্ব কায়দায় একটি সরল ফ্যান্টাসি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, যে ফ্যান্টাসি তাদের নিজস্ব চাহিদা মেটায়।
এই সরল গল্পের শক্তি ইতিহাসকে সামনের দিকে চালিত করেছে। নয়া রক্ষণশীল আর তাদের উদারপন্থী হস্তক্ষেপ-সমর্থক মিত্ররা এর ফলে নতুন করে বিশ্বব্যবস্থা গড়া ও গণতন্ত্র বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে বিপ্লবী ইসলাম পন্থা আরব জনগণকে জাগাতে এবং তাদের স্বপ্ন লালন করতে নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল। সেই শক্তিও নিজের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের সুযোগ পেল। এরই মধ্যে বহু সংবাদপত্র নিজেদের বিক্রি বাড়িয়ে নিল।
কিন্তু আমরা আর আমাদের নেতারা যেহেতু সাদা শুভ শক্তি ও কালো অশুভ শক্তির বিরোধের ফ্যান্টাসি জগতে বাস করছি, তাই আমরা বাস্তব দুনিয়ার নতুন জটিলতা বুঝি আরও কম। অর্থাৎ, আরব দুনিয়ায় আসলে কী ঘটছে, তা আমরা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছি।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নানা ‘ব্র্যান্ডের’ আল-কায়েদার খোঁজে যখন ছুটে চলেছে সাংবাদিক ও প্রাণঘাতী ড্রোন আর মার্কিনরা একের পর এক ঠিকা দিয়ে রাখছে সেই সব স্বৈরশাসককে, যাঁরা ‘সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেছেন, তখন পুরো মঞ্চে আবির্ভূত হলো এক নতুন প্রজন্ম, যারা স্বৈরশাসকদের হাত থেকে নিস্তার চায়। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের এই বিপ্লব পাশ্চাত্যের জন্য ধাক্কা হিসেবে এসেছে। পশ্চিমারা আসলে জানেই না, এসব বিপ্লবী পরিচয় কী কিংবা কোন মতাদর্শ তাদের চালিত করছে। আল-কায়েদার সঙ্গে যে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। তবে তারা হোসনি মোবারকের মতো স্বৈরশাসক অর্থাৎ ‘নিকটবর্তী শত্রু’ বিতাড়নের লক্ষ্যটি পূরণ করেছে, যা কাকতালীয়ভাবে ছিল ওসামারও প্রধান লক্ষ্য।
রাজনীতিকদের (এবং সাংবাদিকদেরও) অন্যতম প্রধান কাজ হলো আমাদের জন্য দুনিয়াটাকে সরল করে তোলা। কিন্তু তাঁরা যত চেষ্টাই করুন না কেন, বাস্তবতার ক্ষুদ্র কোনো অংশ ঘটনার কোনো ভগ্নাংশকে যখন আর আগের কাঠামোতে ধরা সম্ভব হয় না, তখনই ঘটে বিপত্তি।
ভালো মানুষ বনাম খারাপ মানুষ—এই সরলীকৃত গল্পে ওসামার মৃত্যু হয়তো সেই বিপত্তি বিন্দু। ভালো মানুষ বনাম খারাপ মানুষের এই গল্পের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (‘ভালো যুদ্ধ’) পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে। এরপর স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে তা পাশ্চাত্য কল্পনায় অনেক গভীরে গেঁথে যায়। গত ১০ বছরে সেই গল্পের পুনর্জাগরণ ঘটেছে এবং তা জাগরূক থেকেছে এক অদ্ভুত মিত্রতার মধ্য দিয়ে—যে মিত্রতায় শরিক আছেন মার্কিন ও ইউরোপীয় রাজনীতিক, সাংবাদিক, ‘সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ’ ও বিপ্লবী ইসলামপন্থীরা, যাঁরা সবাই এক স্বপ্নহীনতার যুগে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া।
ইতিমধ্যে বারাক ওবামা এ গল্প অস্বীকার করতে শুরু করেছেন। অবশ্য লিবিয়ায় ‘উদারপন্থী হস্তক্ষেপ সমর্থনের’ প্রত্যাবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে ইউরোপীয়রা এখনো তা আঁকড়ে ধরে আছে। তবে তারা নিরুদ্যম; একদমই নিরুদ্বেগ হতে পারছে না।
আফগানিস্তানে এই গল্পটি আসলেই ধ্বংসের পথে। পশ্চিমারা বুঝতে শুরু করেছে, এই সরলীকরণের ফলে প্রকৃত শত্রু সম্পর্কে পুরোপুরি অলীক, বাস্তবতাবিবর্জিত ফ্যান্টাসি তৈরি হচ্ছে। ফ্যান্টাসিতেই অটল থাকা হচ্ছে, কারণ তা সেখানে পশ্চিমা উপস্থিতি জায়েজ করার জন্য জরুরি। ভালো বনাম মন্দের এই সরল গল্পের মূল সমস্যা হলো এই গল্প কোনো যথাযথ সমালোচনামূলক কাঠামো অনুমোদন করে না, যে কাঠামো দিয়ে ঠিকভাবে যাচাই করা যায় যেমন শত্রুকে, মিত্রকেও তেমনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আফগানিস্তান আক্রমণের সোজাসাপ্টা ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংসসাধন এবং এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে ভালো মানুষেরা দেশটি শাসন করতে পারবেন। কিন্তু পরবর্তী এক দশকে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর জাল বিস্তৃত হয়ে এমন এক রাষ্ট্র তৈরি করেছে, যে রাষ্ট্র দুর্নীতির কারণে পঙ্গু—কে হতে পারে ‘ভালো’ মানুষ, তা জানাও এখন অসম্ভব করে তুলেছে।
এদিকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বলেছেন, ওসামার হত্যা প্রমাণ করে যে প্রকৃত সন্ত্রাসবাদী হুমকি আসলে পাকিস্তানে—তাঁর দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলো ফ্যান্টাসি। কিন্তু কারজাই যা বলেছেন তার অনেকটাই হয়তো তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দিতে এস্তেমাল করা ফ্যান্টাসি। তাহলে আফগানিস্তান হয়ে উঠল এক আরশিনগর; ব্যতিক্রম শুধু একটাই—সবাই এখন একমত, ওসামা আফগানিস্তানে ছিলেন না।
ওসামার মৃত্যু হয়তো বর্তমান আখ্যানের জাদুকরি ক্ষমতা ভেঙে ফেলবে। মনে হচ্ছে, আমরা যেন দুনিয়ার বিষয়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গির এমন এক সীমায় উপনীত হয়েছি, যেখানে আর কোনো অর্থ তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, পরের গল্প কোথা থেকে আসবে? পরের খারাপ লোক/শক্তিটি কে হবে? আসল সত্য হলো, এসব গল্পের নির্মাতা তারাই, যাদের হাতে আছে ক্ষমতা। হয়তো পরের বড় গল্পটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে না। অথবা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কমে যাচ্ছে—এই ধারণাটিই হয়তো আমাদের যুগের নতুন সরলীকৃত ফ্যান্টাসি।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অ্যাডাম কার্টিস: ব্রিটিশ সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
No comments