ধর্ম-পবিত্র শবে মিরাজের তাৎপর্য by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মিরাজ’ আরবি শব্দ; এর আভিধানিক অর্থ সিঁড়ি, সোপান প্রভৃতি। অন্য অর্থে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ বা মহামিলন। মিরাজের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ মক্কা নগরের কাবা শরিফে বা মসজিদুল হারামের হাতিম থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা পর্যন্ত বোরাকে আরোহণ-অবতরণ করা পর্যন্ত ইহলোক ভ্রমণকে ‘ইস্রা’ বলা হয় এবং এখান থেকে নূরের চলন্ত সিঁড়িযোগে

মহাকাশ তথা ঊর্ধ্বলোকে সফরকে ‘মিরাজ’ বলে। সামগ্রিকভাবে এ নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ ‘শবে মিরাজ’ নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব যুগান্তকারী ঘটনার কথা উল্লেখ আছে, তন্মধ্যে শবে মিরাজের স্থান শীর্ষে। পবিত্র কোরআনে একাধিক সূরায় ও হাদিস শরিফে সবিস্তারে লাইলাতুল মিরাজের বর্ণনা রয়েছে।
নবী করিম (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সে মাক্কি জীবনের প্রায় শেষলগ্নে অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বছরে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে লাইলাতুল মিরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। মহানবী (সা.) মিরাজের ওই রজনীতে কাবাগৃহের চত্বরে নিদ্রিত ছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর নির্দেশে গভীর রাতে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) তাঁর সান্নিধ্যে আগমন করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বোরাকে আরোহণ করার সঙ্গেই তা দ্রুতগতিতে ছুটে চলল। প্রথমে মদিনা মুনাওয়ারা, তারপর সিনাই পর্বত, তারপর হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান ‘বায়তে লাহম’ হয়ে চোখের পলকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছালেন। নবীকুল শিরোমণি সেখানে আম্বিয়ায়ে কিরামের সঙ্গে দুই রাকাত নামাজের জামাতে ইমামতি করলেন। তিনি হলেন ‘ইমামুল মুরসালিন’ অর্থাৎ সকল নবী-রাসুলের ইমাম। নামাজের পর জিব্রাইল (আ.) উপস্থিত সবার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেন। নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ এখানেই সমাপ্ত হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইস্রা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
তারপর নবী করিম (সা.) বোরাকে আরোহণ করলে তা দ্রুতগতিতে মিরাজ বা ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা শুরু করে। বিশ্বস্রষ্টার নভোমণ্ডলের অপরূপ দৃশ্য দেখে তিনি বিমোহিত হন। প্রতিটি আসমানে বিশিষ্ট নবীদের সঙ্গে তাঁর সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হয়। প্রথম আকাশে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আকাশে হজরত ঈসা (আ.) ও হজরত ইয়াহ্ইয়া (আ.), তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আকাশে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ হলে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সপ্তম আসমানে অবস্থিত ফেরেশতাদের আসমানি কাবাগৃহ বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশতাকে তাওয়াফরত অবস্থায় এবং অনেককে সালাত আদায় করতে দেখেন। এরপর তিনি জিব্রাইল (আ.)-এর সঙ্গে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া আলমে বারজাখের অসংখ্য দৃশ্যাবলি স্বচক্ষে অবলোকন করে পুনরায় সিদরাতুল মুনতাহায় ফিরে আসেন।
এভাবে সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এসে সফরসঙ্গী জিব্রাইল (আ.) ও ঐশীবাহন বোরাকের গতি স্থির হয়ে গেল। জিব্রাইল (আ.) এখানে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই সীমানাকে অতিক্রম করে আমার আর সামনে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা নেই। এখানে শুধু আপনি আর আপনার রব।’ এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-কে তাঁর স্বরূপে দেখতে পান।
অতঃপর জিব্রাইল (আ.) নবীজির সঙ্গে গমন করলেন না। এখানে তাঁর বাহনও পরিবর্তন হয়। তারপর নবী করিম (সা.) স্বয়ং ‘রফরফ’ নামক বিশেষ স্বর্গীয় বাহনে আরোহণ করে রাব্বুল আলামিনের অসীম কুদরতে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মোয়াল্লার সন্নিকটে পৌঁছালেন এবং আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন। মহানবী (সা.) স্থান-কালের ঊর্ধ্বে লা মাকাম-লা জামান স্তরে পৌঁছান। নূর আর নূরের সৌরভে তিনি অভিভূত হয়ে যান। সেখানে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দিদার এবং কথোপকথন হয়। তিনিই একমাত্র মহামানব, যিনি এ সফরের মাধ্যমে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে যান। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তাআলার নৈকট্য, সান্নিধ্য ও দিদার লাভ করার পর জ্ঞান-গরিমায় মহীয়ান হয়ে তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন এবং করুণা ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পুরস্কার হিসেবে আল্লাহর বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাত ও উষার সন্ধিক্ষণে আবার মক্কায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। বস্তুত, মহানবী (সা.)-এর মিরাজ একটি বিস্ময় সৃষ্টিকারী মুজিজা এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের জ্বলন্ত প্রমাণ।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজের অনুপম শিক্ষা বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। যখন নবী করিম (সা.) জাগতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হন, তখন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী উম্মুল মুমিনীন হজরত খাদিজা (রা.) ও বিপদে আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিবের আকস্মিক ইন্তেকাল হয়। অপর দিকে কাফেরদের অত্যাচার তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তখন মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা স্বীয় হাবিবকে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে এনে সান্ত্বনা দিয়ে সমাজ সংস্কারের একটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। সৃষ্টিকুলের মধ্যে এমনকি ফেরেশতাদের গতি যেখানে স্তব্ধ, সেই ঊর্ধ্বলোকের উচ্চতম স্থানে মহান স্রষ্টার চরম, নিবিড় সান্নিধ্যে মহাবিশ্বে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনের পরম সৌভাগ্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রদান করে মানবমর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব মিরাজের মাধ্যমে বিধান করা হয়। এ রজনীতে বায়তুল মুকাদ্দাসে মহানবী (সা.)-এর ইমামতিতে হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসুলের সালাত আদায় করার মাধ্যমে নবীজির সর্বশ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর আদর্শ শিক্ষার অনুসরণীয় বিশ্বজনীন রূপটি প্রমাণিত হয়।
নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায়। তাই মুমিন মুসলমান হিসেবে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে সর্বাগ্রে মিরাজের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বাস্তবায়নে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোকন নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

[পবিত্র কোরআনের ভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইস্রা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।]
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.