সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-ওসামা বেঈমানির শিকার? by রবার্ট ফিস্ক
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবিতে মধ্যপ্রাচ্য প্রকম্পিত হচ্ছে। লাখ লাখ আরবের এই বিদ্রোহের দ্বারা ইতিহাসের পথে কেউকেটা হয়ে পড়া, রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ, মধ্য বয়সী ওসামার মৃত্যু হলো পাকিস্তানে গত সোমবার। এরপর দুনিয়াব্যাপী উন্মাদনা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট মাত্র কদিন আগে দেখালেন তাঁর জন্মনিবন্ধন সনদ। সেই স্মৃতি মলিন হওয়ার আগেই মাঝরাতে তাঁকে হাজির হতে হলো ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুসনদ প্রদানের জন্য, তাও ঘটনা ঘটতে থাকার সময়ই। যে শহরে মারা গেলেন ওসামা, সেটির নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর এক মেজরের নামে। বলা হলো, ওসামার মাথায় একটিমাত্র গুলি করা হয়েছে। তবে ওসামার দেহ গোপনে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া আর তেমনই গোপনীয়তার সঙ্গে সমুদ্রে সমাহিত করা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। লাশের হিল্লে করার অদ্ভুত রহস্যময় এই পথ ওসামা ও তাঁর সংস্থার মতোই আতঙ্ক-জাগানিয়া।
মার্কিনরা এখন আনন্দে মাতোয়ারা। আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বললেন, এটা ‘সামনের দিকে বিশাল পদক্ষেপ’; ভারত বলেছে ‘বিজয়ের মাইলফলক’; ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বড়াই করে বলেছেন, ‘এক স্পষ্ট বিজয়’। কিন্তু নাইন-ইলেভেনে তিন হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু, মধ্যপ্রাচ্যে আরও অসংখ্য জীবনহানি, ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রায় পাঁচ লাখ মুসলমানের জীবনাবসান আর ওসামার খোঁজে ১০ বছরের অনুসন্ধান—এত সব কিছুর পর দোয়া করুন আর যেন এমন ‘স্পষ্ট বিজয়’ না আসে। প্রতিশোধমূলক হামলা? পশ্চিমা বিশ্বে আল-কায়েদার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন কোনো ক্ষুদ্র উপদল হয়তো হামলা চালাবে। কেউ না কেউ ‘শহীদ ওসামা বিন লাদেন ব্রিগেড’ তৈরির স্বপ্ন ইতিমধ্যে দেখতে শুরু করেছে।
কিন্তু আরব বিশ্বে গত চার মাসের গণবিদ্রোহের ফলে ইতিমধ্যেই আল-কায়েদা রাজনৈতিকভাবে মৃত। ওসামা বিশ্ববাসীকে (এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও) বলেছিলেন, তিনি আরব দুনিয়ার পশ্চিমপন্থী শাসকদের ধ্বংস করতে চান—তাঁর এ তালিকায় মোবারক ও বেন আলীদের মতো স্বৈরতন্ত্রীরা পড়েন। তিনি নতুন ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু গত কয়েক মাসে যে লাখ লাখ আরব মুসলমানের উত্থান দেখা গেল, তারা শাহাদাত বরণে প্রস্তুত ছিল—তবে ইসলামের জন্য নয়, বরং মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য। ওসামা স্বৈরশাসকদের হটাতে পারেননি। জনগণ হটিয়েছে। তা ছাড়া, তারা কোনো খিলাফতও চায়নি।
লাদেনের সঙ্গে আমি তিনবার দেখা করেছি। তাঁকে শুধু এই একটা প্রশ্ন করাই বাকি—চলমান বিপ্লব (যে বিপ্লব ইসলাম নয়, জাতির ঝান্ডার নিচেই ঘটছে আর তাতে মুসলমান, খ্রিষ্টান একসঙ্গে শামিল) চাক্ষুষ করে এসবের ব্যাপারে তিনি কী মনে করেন?
ওসামার নিজের দৃষ্টিতে তাঁর অর্জন হলো আল-কায়েদা সৃষ্টি। আল-কায়েদার সদস্যদের কোনো পরিচয়পত্র বহন করতে হয় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার মনে হলো আল-কায়েদায় যোগ দেবেন—সেটাই যথেষ্ট। ওসামা এর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু তিনি কখনো নিজে সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন না। তাঁর গুহায় ছিল না কোনো কম্পিউটার কিংবা ফোনকলের মাধ্যমে বোমা ফাটানোর ব্যবস্থা। পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে আরব স্বৈরশাসকেরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসন চালিয়েছে। তারা মার্কিন নীতির নিন্দা করা থেকে অনেকটাই বিরত থেকেছে। অন্যদিকে ওসামা এসব কথা বলেছেন। আরবরা কখনো সুউচ্চ দালানে উড়ন্ত বিমান ঢুকিয়ে দিতে চায়নি, তবে তারা যা বলতে চেয়েছে, সেসব কথা যে লোকটা বলেছে তাকে সাধুবাদ দিয়েছে ঠিকই। এখন অনেক বেশি করে তারা এসব কথা বলতে পারছে। তাদের আর ওসামাকে প্রয়োজন নেই। তিনি এখন কেউকেটা।
তবে ওসামার মৃত্যু আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে পাকিস্তানকে। কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি পশ্চিমাদের বলছিলেন, আফগানিস্তানের কোনো গুহায় বাস করছেন ওসামা। এখন তো পরিষ্কার হয়ে গেল যে ওসামা পাকিস্তানের ভেতর বড় এক অট্টালিকায় ছিলেন। ওসামার সঙ্গে কেউ কি বিশ্বাসঘাতকতা করল? তা তো নিশ্চয়ই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নাকি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)? খুব সম্ভবত দুটোই। ওসামা কোথায় তা পাকিস্তান জানত।
অ্যাবোটাবাদে শুধু পাকিস্তানের মিলিটারি কলেজ নয়, এখানে রয়েছে পাকিস্তানের নর্দার্ন আর্মি কর্পস, সেকেন্ড ডিভিশনের সদর দপ্তর। এক বছরেরও কম আগে আরেক ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান’-এর সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। মুম্বাই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী বলে সন্দেহভাজন গোষ্ঠীর নেতা তিনি। তাঁকে পেলাম লাহোরে—তাঁর পাহারায় নিয়োজিত মেশিনগান হাতে সাদা পোশাকের পুলিশ।
আরেকটি প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি—ওসামাকে কি জীবিত অবস্থায় ধরা যেত না? সিআইএ কিংবা নেভি সিলস অথবা মার্কিন বিশেষ বাহিনী অথবা যে সংস্থাই তাঁকে হত্যা করুক না কেন, তাদের কি কোনো ‘বাঘ’ ধরতে জাল নিক্ষেপের মতো ব্যবস্থা ছিল না? ওসামাকে হত্যা ওবামার ভাষায় ‘ন্যায়বিচার’। অবশ্য আগেকার দিনে ‘ন্যায়বিচার’ বলতে বোঝাত যথাযথ প্রক্রিয়া, আদালত, শুনানি, আত্মপক্ষ সমর্থন, বিচার। সাদ্দামের সন্তানদের মতোই ওসামাকে গুলি করে মারা হলো। তাঁকে জীবিত ধরা হোক তা যে কখনো তিনি চাননি—এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
আদালতে গেলে তা শুধু ওসামা নয়, আরও অনেকের মাথাব্যথার কারণ হতো। তিনি হয়তো আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির সময়ে সিআইএর সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স টার্কির সঙ্গে ইসলামাবাদে তাঁর উষ্ণ মোলাকাতের ব্যাপারে কথা বলতে পারতেন। ইরাকে যেমন আমেরিকা থেকে গ্যাসীয় দ্রব্য আমদানি (যা ব্যবহার করে কয়েক হাজার কুর্দিকে হত্যা করা হয়), ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব, ১৯৮০ সালে ইরান আক্রমণের সময় মার্কিন সামরিক সহায়তা পাওয়ার মতো নানা বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর করা হলো, এবারও ঘটল একই রকম ঘটনা।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলা চালিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ওসামা ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান’ হননি। তার আগে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে মার্কিন দূতাবাসে এবং ধারানে মার্কিন ব্যারাকে আল-কায়েদার হামলার জন্য তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়েস্ট পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি সব সময় ক্রুজ মিসাইল হামলার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমিও ছিলাম একই হুমকির মুখে। মৃত্যুর জন্য তিনি আগেও প্রতীক্ষা করেছেন, ২০০১ সালে তোরাবোরার গুহায় তাঁর দেহরক্ষীরা তাঁকে সরাসরি যুদ্ধ করা থেকে নিরস্ত করে পর্বতমালা পেরিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য করে।
অন্য মুসলমানদের সঙ্গে ওসামার সম্পর্ক ছিল রহস্যময়। আফগানিস্তানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পর তালেবানের ভয়ে আমাকে তাঁর প্রশিক্ষণ তাঁবু থেকে রাতের আঁধারে জালালাবাদ যেতে দেননি। পরদিন সুরক্ষার জন্য আমার সঙ্গে আল-কায়েদার লেফটেন্যান্টদের পাঠান। তাঁর অনুসারীরা শিয়া মুসলমানদের বিধর্মীদের মতোই ঘৃণা করত আর স্বৈরশাসকদের মনে করত অবিশ্বাসী। যদিও তিনি ইরাকে দখলদার মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে সাবেক বাথপন্থীদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন। একটি অডিও বার্তায় এ কথা বলেও ছিলেন। তিনি কখনো হামাসের প্রশংসা করেননি।
২০০১ সালের পর ওসামার সঙ্গে আমি অল্পস্বল্প পরোক্ষ যোগাযোগ রেখে এসেছি। একবার তাঁর এক বিশ্বস্ত সহযোগীর সঙ্গে পাকিস্তানের এক গুপ্ত স্থানে দেখা করি। আমি তাঁকে ১২টি প্রশ্নের একটি তালিকা দিই। প্রথম প্রশ্নটি ছিল: তাঁর কর্মকাণ্ডের ফলে দুটি মুসলমান রাষ্ট্রে মার্কিন দখলদারি কায়েম হলো। তাহলে তিনি কি বিজয়ের দাবিদার? কয়েক সপ্তাহ কোনো সাড়া পাইনি। তারপর একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইয়ে লেকচার দিতে যাচ্ছি, তখন জানানো হলো ওসামার কাছ থেকে আল-জাজিরা একটি অডিও টেপ পেয়েছে। আমার নাম না নিয়ে একের পর এক আমার করা ১২টা প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি। হ্যাঁ, তিনি চেয়েছিলেন মার্কিনরা মুসলমান বিশ্বে আসুক, যাতে তিনি তাদের ধ্বংস করতে পারেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল যখন অপহূত হলেন, তখন আমি দি ইন্ডিপেনডেন্ট-এ এক দীর্ঘ নিবন্ধে তাঁর জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে ওসামার প্রতি আকুতি জানাই। ২০০১ সালে আফগান সীমান্তে আমি প্রহূত হলে পার্ল ও তাঁর স্ত্রী আমার দেখভাল করেছিলেন। এমনকি তাঁর বেশ কিছু সূত্র আমাকে জানিয়েছিলেন। বহু পরে আমাকে জানানো হলো, ওসামা আমার লেখা পড়েছেন; পড়ে তাঁর মন খারাপ হয়েছে। তত দিনে পার্লকে মেরে ফেলা হয়। আমাকে একথাই বলা হয়।
ওসামার নিজের ঘোর ছিল তাঁর পরিবারের অপছন্দনীয়। এক স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে গেছেন, আরেকজন সোমবারের হামলায় মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওসামার এক ছেলে ওমরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। সে তখন পিতার সঙ্গেই ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কি সুখী? ইংরেজি ভাষায় জবাব দিল, ‘হ্যাঁ’। গত বছর তার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম লিভিং বিন লাদেন। তাঁর পছন্দের কুকুরগুলোর ওপর রাসায়নিক রণকৌশলবিষয়ক এক পরীক্ষা চালাতে গিয়ে পিতা কীভাবে সেগুলোকে মেরে ফেলেছেন, সে কথা মনে করে তাঁকে ‘খারাপ মানুষ’ বলে অভিহিত করেছেন ওমর। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাও আছে বইটিতে। ওমর লিখেছেন, আসলে তাঁর জবাব হওয়া উচিত ছিল, ‘না’, সে আসলে সুখী ছিল না।
সোমবার দুপুর নাগাদ আরবদের কাছ থেকে তিনটি ফোনকল পেলাম। তিনজনই নিশ্চিত যে মার্কিনরা যাকে হত্যা করেছে, সে আসল ওসামা নয়। একইভাবে অনেক ইরাকি মনে করে, আসল সাদ্দামকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়নি আর ২০০৩ সালে তাঁর পুত্রদের মেরে ফেলা হয়নি। এ ব্যাপারে যথাসময়ে আল-কায়েদা আমাদের অবহিত করবে। ওসামা না মারা গিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই আসল ওসামার কাছ থেকে শিগগিরই ভিডিও টেপ পাওয়া যাবে। আর তাহলে প্রেসিডেন্ট ওবামা আগামী নির্বাচনে হেরে যাবেন।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
মার্কিনরা এখন আনন্দে মাতোয়ারা। আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বললেন, এটা ‘সামনের দিকে বিশাল পদক্ষেপ’; ভারত বলেছে ‘বিজয়ের মাইলফলক’; ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বড়াই করে বলেছেন, ‘এক স্পষ্ট বিজয়’। কিন্তু নাইন-ইলেভেনে তিন হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু, মধ্যপ্রাচ্যে আরও অসংখ্য জীবনহানি, ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রায় পাঁচ লাখ মুসলমানের জীবনাবসান আর ওসামার খোঁজে ১০ বছরের অনুসন্ধান—এত সব কিছুর পর দোয়া করুন আর যেন এমন ‘স্পষ্ট বিজয়’ না আসে। প্রতিশোধমূলক হামলা? পশ্চিমা বিশ্বে আল-কায়েদার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন কোনো ক্ষুদ্র উপদল হয়তো হামলা চালাবে। কেউ না কেউ ‘শহীদ ওসামা বিন লাদেন ব্রিগেড’ তৈরির স্বপ্ন ইতিমধ্যে দেখতে শুরু করেছে।
কিন্তু আরব বিশ্বে গত চার মাসের গণবিদ্রোহের ফলে ইতিমধ্যেই আল-কায়েদা রাজনৈতিকভাবে মৃত। ওসামা বিশ্ববাসীকে (এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও) বলেছিলেন, তিনি আরব দুনিয়ার পশ্চিমপন্থী শাসকদের ধ্বংস করতে চান—তাঁর এ তালিকায় মোবারক ও বেন আলীদের মতো স্বৈরতন্ত্রীরা পড়েন। তিনি নতুন ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু গত কয়েক মাসে যে লাখ লাখ আরব মুসলমানের উত্থান দেখা গেল, তারা শাহাদাত বরণে প্রস্তুত ছিল—তবে ইসলামের জন্য নয়, বরং মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য। ওসামা স্বৈরশাসকদের হটাতে পারেননি। জনগণ হটিয়েছে। তা ছাড়া, তারা কোনো খিলাফতও চায়নি।
লাদেনের সঙ্গে আমি তিনবার দেখা করেছি। তাঁকে শুধু এই একটা প্রশ্ন করাই বাকি—চলমান বিপ্লব (যে বিপ্লব ইসলাম নয়, জাতির ঝান্ডার নিচেই ঘটছে আর তাতে মুসলমান, খ্রিষ্টান একসঙ্গে শামিল) চাক্ষুষ করে এসবের ব্যাপারে তিনি কী মনে করেন?
ওসামার নিজের দৃষ্টিতে তাঁর অর্জন হলো আল-কায়েদা সৃষ্টি। আল-কায়েদার সদস্যদের কোনো পরিচয়পত্র বহন করতে হয় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার মনে হলো আল-কায়েদায় যোগ দেবেন—সেটাই যথেষ্ট। ওসামা এর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু তিনি কখনো নিজে সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন না। তাঁর গুহায় ছিল না কোনো কম্পিউটার কিংবা ফোনকলের মাধ্যমে বোমা ফাটানোর ব্যবস্থা। পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে আরব স্বৈরশাসকেরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসন চালিয়েছে। তারা মার্কিন নীতির নিন্দা করা থেকে অনেকটাই বিরত থেকেছে। অন্যদিকে ওসামা এসব কথা বলেছেন। আরবরা কখনো সুউচ্চ দালানে উড়ন্ত বিমান ঢুকিয়ে দিতে চায়নি, তবে তারা যা বলতে চেয়েছে, সেসব কথা যে লোকটা বলেছে তাকে সাধুবাদ দিয়েছে ঠিকই। এখন অনেক বেশি করে তারা এসব কথা বলতে পারছে। তাদের আর ওসামাকে প্রয়োজন নেই। তিনি এখন কেউকেটা।
তবে ওসামার মৃত্যু আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে পাকিস্তানকে। কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি পশ্চিমাদের বলছিলেন, আফগানিস্তানের কোনো গুহায় বাস করছেন ওসামা। এখন তো পরিষ্কার হয়ে গেল যে ওসামা পাকিস্তানের ভেতর বড় এক অট্টালিকায় ছিলেন। ওসামার সঙ্গে কেউ কি বিশ্বাসঘাতকতা করল? তা তো নিশ্চয়ই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নাকি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)? খুব সম্ভবত দুটোই। ওসামা কোথায় তা পাকিস্তান জানত।
অ্যাবোটাবাদে শুধু পাকিস্তানের মিলিটারি কলেজ নয়, এখানে রয়েছে পাকিস্তানের নর্দার্ন আর্মি কর্পস, সেকেন্ড ডিভিশনের সদর দপ্তর। এক বছরেরও কম আগে আরেক ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান’-এর সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। মুম্বাই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী বলে সন্দেহভাজন গোষ্ঠীর নেতা তিনি। তাঁকে পেলাম লাহোরে—তাঁর পাহারায় নিয়োজিত মেশিনগান হাতে সাদা পোশাকের পুলিশ।
আরেকটি প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি—ওসামাকে কি জীবিত অবস্থায় ধরা যেত না? সিআইএ কিংবা নেভি সিলস অথবা মার্কিন বিশেষ বাহিনী অথবা যে সংস্থাই তাঁকে হত্যা করুক না কেন, তাদের কি কোনো ‘বাঘ’ ধরতে জাল নিক্ষেপের মতো ব্যবস্থা ছিল না? ওসামাকে হত্যা ওবামার ভাষায় ‘ন্যায়বিচার’। অবশ্য আগেকার দিনে ‘ন্যায়বিচার’ বলতে বোঝাত যথাযথ প্রক্রিয়া, আদালত, শুনানি, আত্মপক্ষ সমর্থন, বিচার। সাদ্দামের সন্তানদের মতোই ওসামাকে গুলি করে মারা হলো। তাঁকে জীবিত ধরা হোক তা যে কখনো তিনি চাননি—এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
আদালতে গেলে তা শুধু ওসামা নয়, আরও অনেকের মাথাব্যথার কারণ হতো। তিনি হয়তো আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির সময়ে সিআইএর সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স টার্কির সঙ্গে ইসলামাবাদে তাঁর উষ্ণ মোলাকাতের ব্যাপারে কথা বলতে পারতেন। ইরাকে যেমন আমেরিকা থেকে গ্যাসীয় দ্রব্য আমদানি (যা ব্যবহার করে কয়েক হাজার কুর্দিকে হত্যা করা হয়), ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব, ১৯৮০ সালে ইরান আক্রমণের সময় মার্কিন সামরিক সহায়তা পাওয়ার মতো নানা বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর করা হলো, এবারও ঘটল একই রকম ঘটনা।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলা চালিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ওসামা ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান’ হননি। তার আগে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে মার্কিন দূতাবাসে এবং ধারানে মার্কিন ব্যারাকে আল-কায়েদার হামলার জন্য তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়েস্ট পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি সব সময় ক্রুজ মিসাইল হামলার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমিও ছিলাম একই হুমকির মুখে। মৃত্যুর জন্য তিনি আগেও প্রতীক্ষা করেছেন, ২০০১ সালে তোরাবোরার গুহায় তাঁর দেহরক্ষীরা তাঁকে সরাসরি যুদ্ধ করা থেকে নিরস্ত করে পর্বতমালা পেরিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য করে।
অন্য মুসলমানদের সঙ্গে ওসামার সম্পর্ক ছিল রহস্যময়। আফগানিস্তানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পর তালেবানের ভয়ে আমাকে তাঁর প্রশিক্ষণ তাঁবু থেকে রাতের আঁধারে জালালাবাদ যেতে দেননি। পরদিন সুরক্ষার জন্য আমার সঙ্গে আল-কায়েদার লেফটেন্যান্টদের পাঠান। তাঁর অনুসারীরা শিয়া মুসলমানদের বিধর্মীদের মতোই ঘৃণা করত আর স্বৈরশাসকদের মনে করত অবিশ্বাসী। যদিও তিনি ইরাকে দখলদার মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে সাবেক বাথপন্থীদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন। একটি অডিও বার্তায় এ কথা বলেও ছিলেন। তিনি কখনো হামাসের প্রশংসা করেননি।
২০০১ সালের পর ওসামার সঙ্গে আমি অল্পস্বল্প পরোক্ষ যোগাযোগ রেখে এসেছি। একবার তাঁর এক বিশ্বস্ত সহযোগীর সঙ্গে পাকিস্তানের এক গুপ্ত স্থানে দেখা করি। আমি তাঁকে ১২টি প্রশ্নের একটি তালিকা দিই। প্রথম প্রশ্নটি ছিল: তাঁর কর্মকাণ্ডের ফলে দুটি মুসলমান রাষ্ট্রে মার্কিন দখলদারি কায়েম হলো। তাহলে তিনি কি বিজয়ের দাবিদার? কয়েক সপ্তাহ কোনো সাড়া পাইনি। তারপর একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইয়ে লেকচার দিতে যাচ্ছি, তখন জানানো হলো ওসামার কাছ থেকে আল-জাজিরা একটি অডিও টেপ পেয়েছে। আমার নাম না নিয়ে একের পর এক আমার করা ১২টা প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি। হ্যাঁ, তিনি চেয়েছিলেন মার্কিনরা মুসলমান বিশ্বে আসুক, যাতে তিনি তাদের ধ্বংস করতে পারেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল যখন অপহূত হলেন, তখন আমি দি ইন্ডিপেনডেন্ট-এ এক দীর্ঘ নিবন্ধে তাঁর জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে ওসামার প্রতি আকুতি জানাই। ২০০১ সালে আফগান সীমান্তে আমি প্রহূত হলে পার্ল ও তাঁর স্ত্রী আমার দেখভাল করেছিলেন। এমনকি তাঁর বেশ কিছু সূত্র আমাকে জানিয়েছিলেন। বহু পরে আমাকে জানানো হলো, ওসামা আমার লেখা পড়েছেন; পড়ে তাঁর মন খারাপ হয়েছে। তত দিনে পার্লকে মেরে ফেলা হয়। আমাকে একথাই বলা হয়।
ওসামার নিজের ঘোর ছিল তাঁর পরিবারের অপছন্দনীয়। এক স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে গেছেন, আরেকজন সোমবারের হামলায় মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওসামার এক ছেলে ওমরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। সে তখন পিতার সঙ্গেই ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কি সুখী? ইংরেজি ভাষায় জবাব দিল, ‘হ্যাঁ’। গত বছর তার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম লিভিং বিন লাদেন। তাঁর পছন্দের কুকুরগুলোর ওপর রাসায়নিক রণকৌশলবিষয়ক এক পরীক্ষা চালাতে গিয়ে পিতা কীভাবে সেগুলোকে মেরে ফেলেছেন, সে কথা মনে করে তাঁকে ‘খারাপ মানুষ’ বলে অভিহিত করেছেন ওমর। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাও আছে বইটিতে। ওমর লিখেছেন, আসলে তাঁর জবাব হওয়া উচিত ছিল, ‘না’, সে আসলে সুখী ছিল না।
সোমবার দুপুর নাগাদ আরবদের কাছ থেকে তিনটি ফোনকল পেলাম। তিনজনই নিশ্চিত যে মার্কিনরা যাকে হত্যা করেছে, সে আসল ওসামা নয়। একইভাবে অনেক ইরাকি মনে করে, আসল সাদ্দামকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়নি আর ২০০৩ সালে তাঁর পুত্রদের মেরে ফেলা হয়নি। এ ব্যাপারে যথাসময়ে আল-কায়েদা আমাদের অবহিত করবে। ওসামা না মারা গিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই আসল ওসামার কাছ থেকে শিগগিরই ভিডিও টেপ পাওয়া যাবে। আর তাহলে প্রেসিডেন্ট ওবামা আগামী নির্বাচনে হেরে যাবেন।
ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
No comments