যুদ্ধে বিপন্ন মানবিকতার গল্প
আমরা অনেকেই একাত্তর দেখিনি। একাত্তর নিয়ে সেই মাপের খুব বেশি ছবিও বানানো হয়নি আমাদের দেশে। তার পরও একাত্তরে কীভাবে বিপন্ন হয়েছিল মানবিকতা, সেই ছবি কল্পনায় এঁকে নিতেই পারেন। আর আপনার কল্পনার ক্যানভাসে রং-তুলি-ইজেলের রসদ জোগাতে পারে এই তিনটি ছবি। সবখানে, সব কালেই আসলে যুদ্ধের ছবিটা অভিন্ন।
সব যুদ্ধের ইতিহাসই যে রক্তলাল অক্ষরে লেখা, যে ইতিহাস আত্মত্যাগের ইতিহাস। ছবি তিনটি নিয়ে লিখেছেন রাজীব হাসান
লাইফ ইজ বিউটিফুল
ছবিটি আমাদের অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করিয়ে দেয়। ছবিটি দেখতে গিয়ে আমরা হাসতে হাসতে কাঁদি, কাঁদতে কাঁদতে হাসি। আবার এমনও হয়, একই দৃশ্য দেখে আমাদের চোখ দিয়ে কান্নার মেঘ ঝরে, আর ঠোঁটে উদ্ভাসিত হয় হাসি। পরিচালক রবার্তো বেনিনিকে তখন আর শুধু আমাদের একজন চিত্রপরিচালক, চিত্রনাট্য রচয়িতা কিংবা মূল চরিত্রে অভিনয় করা দক্ষ অভিনেতাই মনে হয় না; মনে হয় একজন জাদুকর!
ছবির প্রথমার্ধটা কেবলই গুইদোর (বেনিনি) অদ্ভুত হাস্যকর সব কাণ্ডকারখানায় ভরা। তাঁর এই হাস্যরসই একমাত্র শক্তি। দেখতেও অতিসাধারণ। তাই সাধারণ একজন ওয়েটার হয়েও তিনি জিতে নেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে ডোরাকে। ইহুদি গুইদো আর অ-ইহুদি ডোরার ভালোবাসার ফুল হয়ে জন্ম নেয় তাঁদের ছেলে। আর সেই ছেলের জন্মদিনেই ছবির গল্প ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে। যে যুদ্ধে হিটলার আর তাঁর নাৎসি বাহিনী ইহুদিদের নিয়ে ‘খেলছে’।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে থেকে শুরু হয় গুইদোর বেঁচে থাকার লড়াই। ঠিক তাঁর নিজের নয়, তিনি আসলে বাঁচিয়ে রাখতে চান ছেলেকে। ছেলের মন ভোলাতে গুইদো বলেন, চারপাশে যা ঘটছে, সবই আসলে একটা খেলা। যে খেলায় এক হাজার পয়েন্ট পেলেই তাঁরা জিতে যাবেন সত্যিকারের একটা ট্যাংক। খাবার চুরি করে, হাসিয়ে, মন ভুলিয়ে এভাবেই ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখেন গুইদো। কিন্তু নিজে একসময় মারা পড়েন। সেটাও যুদ্ধ শেষের পর্যায়ে। এরপর মিত্র বাহিনীর ট্যাংক চলে আসে সেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। হঠাৎ একটা বড়সড় ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে গুইদোর ছেলে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে। কারণ, বাবার কথা সত্যি হয়েছে। খেলাটায় জিতে তারা জিতে নিয়েছে একটা ট্যাংকও!
সিন্ডলারস লিস্ট
স্টিভেন স্পিলবার্গের অসামান্য এক ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সত্য কাহিনি অবলম্বনে বানানো হয়েছে ছবিটি। মূল চরিত্রটি সিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ীর, প্রথমে আমরা যাঁকে আবিষ্কার করি ধুরন্ধর হিসেবে। যুদ্ধ থেকে ফায়দা লুটে টু-পাইস কামিয়ে নেওয়াই তাঁর ধান্ধা। নিজের স্বার্থের জন্য নাৎসি বাহিনীকে ঘুষ দিতেও তাঁর রুচিতে বাধে না। আসলে, তিনি নিজের স্বার্থের জন্যই তাঁর কারখানায় নিয়োগ দেন যুদ্ধবন্দী ইহুদিদের। এরা মজুরি হিসেবে টাকা চায় না, চায় বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। কাজে নিযুক্ত ইহুদিদের খরচার খাতায় ফেলবে না নাৎসিরা—এমনই কথা আদায় করে নেন সিন্ডলার।
ধূর্ত চরিত্রের সিন্ডলারের অস্তিত্বের শিকড়ে টান পড়ে, যখন তিনি এই ইহুদিদের একের পর এক অমানবিক গল্পের মুখোমুখি হন। আর এই রূপান্তরে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন কারখানায় তাঁর প্রধান সহকারী স্টার্ন। এর পর পরই সিন্ডলারের মানবিক দিকটার দেখা পেতে শুরু করি আমরা। একসময় দেখা যায়, কীভাবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ইহুদিদের বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সিন্ডলার। যিনি কি না একজন জার্মান। নিজেও নাৎসি পার্টির সদস্য!
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এক হাজারের বেশি ইহুদিকে বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হন সিন্ডলার। যদিও আরও কয়েক হাজার ইহুদিকে বাঁচাতে না-পারার আত্মদহনেই বেশি পুড়তে দেখা যায় তাঁকে। প্রায় পুরোটাই সাদাকালো ফ্রেমে বানানো ছবি শেষ মুহূর্তে রঙিন হয়ে ওঠে। ছবি শেষ হয় সিন্ডলারের কারণে বেঁচে থাকা ইহুদিরা, যাঁদের প্রায় সবাই বুড়োবুড়ি হয়ে গেছেন বহু বছর পেরিয়ে, সিন্ডলারের কবরে নিবেদন করছেন শ্রদ্ধা।
দ্য পিয়ানিস্ট
১৯৩৯ সাল। কারও সাতে-পাঁচে নেই। কেবল নিজের সংগীতে মগ্ন এক পিয়ানোবাদক কীভাবে যুদ্ধের খাঁচায় বন্দী হয়ে পড়েন, সেই গল্পই দেখিয়েছেন রোমান পোলনস্কি। পোল্যান্ডে নাৎসি বাহিনী ঢুকে পড়ার প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ভ্লাদিস্ল স্পিলমানের হয়, যখন তাঁর বেতারকেন্দ্র কাঁপিয়ে তোলে একের পর এক বোমার আঘাত। ওয়ারশ শহরে শুরু হয়ে যায় নাৎসি তাণ্ডব। কাজের অযোগ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রথম সুযোগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। তরুণদের বন্দী করা হয় যুদ্ধ-দাস হিসেবে। শুরু হয় স্পিলমানের পালিয়ে বেঁচে থাকার নিঃসঙ্গ এক সংগ্রাম।
এমনি করে কেটে যায় পাঁচ বছর। সৌম্য, নিপাট পরিপাটি ভদ্রলোক স্পিলমানের তত দিনে একমুখ দাড়ি-গোঁফ। শুকিয়ে কড়িকাঠ। খাবার হিসেবে যেখানে শুধু বন্দুকের গুলিই সহজপ্রাপ্য, এমন অবস্থায় তাঁর বেঁচে থাকাই এক বিস্ময়। এক কৌটো খাবার খুঁজে পেয়ে সেটি খেতে গিয়েই জার্মান ক্যাপ্টেন উইলম হসেনফেল্ডের কাছে ধরা পড়েন। কিন্তু তাঁর পিয়ানোবাদক পরিচয় আর পিয়ানোর বাজনা শুনে মুগ্ধ হন ক্যাপ্টেন। বাঁচিয়ে রাখেন। ভাগ্যের কী পরিহাস, সোভিয়েত সেনারা পোল্যান্ড জয় করার পর সেই জার্মান অধিনায়ক বন্দী হন, মুক্তি পান পিয়ানোবাদক। হসেনফেল্ড হয়তো বা আশায় দিন গুনতে থাকেন, প্রতিদান হিসেবে তাঁকে মুক্ত করবে স্পিলমান। কিন্তু সেই সাধ্য তো পিয়ানোবাদকের নেই। তিনি শুধু পারেন হসেনফেল্ডের প্রিয় কোনো সুর পিয়ানোর ঝঙ্কারে বাজিয়ে তুলতে।
লাইফ ইজ বিউটিফুল
ছবিটি আমাদের অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করিয়ে দেয়। ছবিটি দেখতে গিয়ে আমরা হাসতে হাসতে কাঁদি, কাঁদতে কাঁদতে হাসি। আবার এমনও হয়, একই দৃশ্য দেখে আমাদের চোখ দিয়ে কান্নার মেঘ ঝরে, আর ঠোঁটে উদ্ভাসিত হয় হাসি। পরিচালক রবার্তো বেনিনিকে তখন আর শুধু আমাদের একজন চিত্রপরিচালক, চিত্রনাট্য রচয়িতা কিংবা মূল চরিত্রে অভিনয় করা দক্ষ অভিনেতাই মনে হয় না; মনে হয় একজন জাদুকর!
ছবির প্রথমার্ধটা কেবলই গুইদোর (বেনিনি) অদ্ভুত হাস্যকর সব কাণ্ডকারখানায় ভরা। তাঁর এই হাস্যরসই একমাত্র শক্তি। দেখতেও অতিসাধারণ। তাই সাধারণ একজন ওয়েটার হয়েও তিনি জিতে নেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে ডোরাকে। ইহুদি গুইদো আর অ-ইহুদি ডোরার ভালোবাসার ফুল হয়ে জন্ম নেয় তাঁদের ছেলে। আর সেই ছেলের জন্মদিনেই ছবির গল্প ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে। যে যুদ্ধে হিটলার আর তাঁর নাৎসি বাহিনী ইহুদিদের নিয়ে ‘খেলছে’।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে থেকে শুরু হয় গুইদোর বেঁচে থাকার লড়াই। ঠিক তাঁর নিজের নয়, তিনি আসলে বাঁচিয়ে রাখতে চান ছেলেকে। ছেলের মন ভোলাতে গুইদো বলেন, চারপাশে যা ঘটছে, সবই আসলে একটা খেলা। যে খেলায় এক হাজার পয়েন্ট পেলেই তাঁরা জিতে যাবেন সত্যিকারের একটা ট্যাংক। খাবার চুরি করে, হাসিয়ে, মন ভুলিয়ে এভাবেই ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখেন গুইদো। কিন্তু নিজে একসময় মারা পড়েন। সেটাও যুদ্ধ শেষের পর্যায়ে। এরপর মিত্র বাহিনীর ট্যাংক চলে আসে সেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। হঠাৎ একটা বড়সড় ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে গুইদোর ছেলে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে। কারণ, বাবার কথা সত্যি হয়েছে। খেলাটায় জিতে তারা জিতে নিয়েছে একটা ট্যাংকও!
সিন্ডলারস লিস্ট
স্টিভেন স্পিলবার্গের অসামান্য এক ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সত্য কাহিনি অবলম্বনে বানানো হয়েছে ছবিটি। মূল চরিত্রটি সিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ীর, প্রথমে আমরা যাঁকে আবিষ্কার করি ধুরন্ধর হিসেবে। যুদ্ধ থেকে ফায়দা লুটে টু-পাইস কামিয়ে নেওয়াই তাঁর ধান্ধা। নিজের স্বার্থের জন্য নাৎসি বাহিনীকে ঘুষ দিতেও তাঁর রুচিতে বাধে না। আসলে, তিনি নিজের স্বার্থের জন্যই তাঁর কারখানায় নিয়োগ দেন যুদ্ধবন্দী ইহুদিদের। এরা মজুরি হিসেবে টাকা চায় না, চায় বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। কাজে নিযুক্ত ইহুদিদের খরচার খাতায় ফেলবে না নাৎসিরা—এমনই কথা আদায় করে নেন সিন্ডলার।
ধূর্ত চরিত্রের সিন্ডলারের অস্তিত্বের শিকড়ে টান পড়ে, যখন তিনি এই ইহুদিদের একের পর এক অমানবিক গল্পের মুখোমুখি হন। আর এই রূপান্তরে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন কারখানায় তাঁর প্রধান সহকারী স্টার্ন। এর পর পরই সিন্ডলারের মানবিক দিকটার দেখা পেতে শুরু করি আমরা। একসময় দেখা যায়, কীভাবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ইহুদিদের বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সিন্ডলার। যিনি কি না একজন জার্মান। নিজেও নাৎসি পার্টির সদস্য!
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এক হাজারের বেশি ইহুদিকে বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হন সিন্ডলার। যদিও আরও কয়েক হাজার ইহুদিকে বাঁচাতে না-পারার আত্মদহনেই বেশি পুড়তে দেখা যায় তাঁকে। প্রায় পুরোটাই সাদাকালো ফ্রেমে বানানো ছবি শেষ মুহূর্তে রঙিন হয়ে ওঠে। ছবি শেষ হয় সিন্ডলারের কারণে বেঁচে থাকা ইহুদিরা, যাঁদের প্রায় সবাই বুড়োবুড়ি হয়ে গেছেন বহু বছর পেরিয়ে, সিন্ডলারের কবরে নিবেদন করছেন শ্রদ্ধা।
দ্য পিয়ানিস্ট
১৯৩৯ সাল। কারও সাতে-পাঁচে নেই। কেবল নিজের সংগীতে মগ্ন এক পিয়ানোবাদক কীভাবে যুদ্ধের খাঁচায় বন্দী হয়ে পড়েন, সেই গল্পই দেখিয়েছেন রোমান পোলনস্কি। পোল্যান্ডে নাৎসি বাহিনী ঢুকে পড়ার প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ভ্লাদিস্ল স্পিলমানের হয়, যখন তাঁর বেতারকেন্দ্র কাঁপিয়ে তোলে একের পর এক বোমার আঘাত। ওয়ারশ শহরে শুরু হয়ে যায় নাৎসি তাণ্ডব। কাজের অযোগ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রথম সুযোগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। তরুণদের বন্দী করা হয় যুদ্ধ-দাস হিসেবে। শুরু হয় স্পিলমানের পালিয়ে বেঁচে থাকার নিঃসঙ্গ এক সংগ্রাম।
এমনি করে কেটে যায় পাঁচ বছর। সৌম্য, নিপাট পরিপাটি ভদ্রলোক স্পিলমানের তত দিনে একমুখ দাড়ি-গোঁফ। শুকিয়ে কড়িকাঠ। খাবার হিসেবে যেখানে শুধু বন্দুকের গুলিই সহজপ্রাপ্য, এমন অবস্থায় তাঁর বেঁচে থাকাই এক বিস্ময়। এক কৌটো খাবার খুঁজে পেয়ে সেটি খেতে গিয়েই জার্মান ক্যাপ্টেন উইলম হসেনফেল্ডের কাছে ধরা পড়েন। কিন্তু তাঁর পিয়ানোবাদক পরিচয় আর পিয়ানোর বাজনা শুনে মুগ্ধ হন ক্যাপ্টেন। বাঁচিয়ে রাখেন। ভাগ্যের কী পরিহাস, সোভিয়েত সেনারা পোল্যান্ড জয় করার পর সেই জার্মান অধিনায়ক বন্দী হন, মুক্তি পান পিয়ানোবাদক। হসেনফেল্ড হয়তো বা আশায় দিন গুনতে থাকেন, প্রতিদান হিসেবে তাঁকে মুক্ত করবে স্পিলমান। কিন্তু সেই সাধ্য তো পিয়ানোবাদকের নেই। তিনি শুধু পারেন হসেনফেল্ডের প্রিয় কোনো সুর পিয়ানোর ঝঙ্কারে বাজিয়ে তুলতে।
No comments