বদলে দাও বদলে যাও মিছিল-কার্টুন ব্যাধি কার্টুনেই প্রতিকার by কাজী মনজুর করিম ও গুলশান আরা

বদলে দাও বদলে যাও মিছিলে দেশের তিনটি জরুরি সমস্যা নিয়ে অব্যাহত আলোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যমে শিশুদের জন্য বাংলায় বিনোদন চাই, যৌন হয়রানিমুক্ত বাংলাদেশ চাই এবং সড়ক দুর্ঘটনা কি চলতেই থাকবে? আজ প্রথমোক্ত বিষয়ে কাজী মনজুর করিম ও গুলশান আরা দম্পতির জীবন অভিজ্ঞতার লেখা ছাপা হলো।
যেসব বাবা-মা সন্তানকে একা (আত্মীয় বা আয়ার কাছে) বাসায় রেখে চাকরি করছেন, কমবেশি সবাই হয়তো আমাদের মতো একই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি একটু বেশি গুরুতর।
আমাদের একমাত্র সন্তান কাজী পৃথিবী ইসলাম (মেঘ)। ওর বয়স এখন পাঁচ বছর। মেঘ যখন দুই বছরে পড়ল, তখনো সে কোনো কথা বলতে পারত না, কারও কোনো কথা বুঝতও না। ওর মধ্যে এমন আরও কিছু লক্ষণ ছিল, যার কারণে আমাদের অনেক আত্মীয় ধরে নিয়েছিলেন ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী। আসল প্রতিবন্ধকতা যে টিভি কার্টুন, সেটা বুঝলাম যখন ওর বয়স আড়াই বছর। একজনের পরামর্শে ছুটলাম মহাখালীর ‘সোসাইটি ফর অ্যাসিসট্যান্স টু হিয়ারিং ইমপিয়ার্ড চিলড্রেন’-এ।
সেখানে হেয়ারিং অ্যাসেসমেন্টে মেঘ ভালোভাবে উৎরে গেল। ওকে দেখে ওসব ঘটনা শুনে ওখানকার একজন বিশেষজ্ঞ বললেন, একটু বুদ্ধি হওয়ার পর (প্রায় এক বছর বয়স) থেকেই ও বাসায় কার্টুন বেশি দেখে এবং টিভি বিজ্ঞাপন বেশি পছন্দ করে (প্রসঙ্গত, মেঘকে খাওয়ানোর জন্য আমরা ওকে টিভি দেখাতাম যাতে ও অন্যমনস্ক হয়ে সব খেয়ে নেয়)। ফলে আশপাশের মানুষের কথা ওকে আকৃষ্ট করে না। বিষয়টা মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়। এরপর কিছুদিন বাসায় টিভি বন্ধ রইল। কয়েক সপ্তাহ পর আবার শুরু করতে হলো। কারণ টিভি ছাড়া মেঘ খেতে চায় না।
মেঘের কিছু আচরণ দেখে কোনো কোনো নিকটাত্মীয় বললেন, ও সম্ভবত অটিস্টিক, ওকে ভালো চিকিৎসক দেখানো দরকার। শুনে ভীষণ কষ্ট পেলাম আমরা। কারণ আমাদের কাছে ওর ‘আই কন্টাক’ নিয়ে কোনো সমস্যা কখনো মনে হয়নি। আর বাচ্চারা এক খেলা সারা দিন খেলবে এটা কি খুব অস্বাভাবিক? প্রথম আলো পড়ে জেনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অটিস্টিক শিশুদের জন্য খোলা হয়েছে ‘সেন্টার ফর অটিজম’। সেখানে গিয়ে দেখলাম, অটিস্টিক কাকে বলে? খুব কষ্ট হলো ওই শিশুদের দেখে। মেঘের মধ্যে সেসব কোনো লক্ষণই নেই। একজন প্রফেসর ওকে দেখলেন। কিছু অ্যাসেসমেন্ট করাতে বললেন। পরে আরেক দিন নিয়ে গেলাম অ্যাসেসমেন্টের জন্য। একজন চাইল্ড সাইকোলজিস্ট তিন পৃষ্ঠার এক প্রশ্নপত্র নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন করলেন। মেঘকে কিছুটা পরীক্ষা করলেন। শেষে বললেন, ওর কোনো চিকিৎসার দরকার নেই। প্রয়োজন শুধু মা-বাবার সঙ্গ এবং সক্রিয় প্রচেষ্টা। আমরাও নতুন আশা নিয়ে এবং আরও বেশি সময় দিয়ে চেষ্টা করতে শুরু করলাম। স্পিস থেরাপিস্টের কাছে নিতে গিয়ে ভাবলাম, নিজেরা আগে একটু চেষ্টা করে দেখি।
এখন থেকে প্রায় নয় মাস আগে (জুন ২০১১) মেঘ আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে শুরু করল যখন ওকে বাসায় বুয়ার কাছে রাখার বদলে ডে কেয়ার সেন্টারে রাখা শুরু করলাম। ওখানে অন্য বাচ্চাদের কথা বলতে দেখে এবং একজন অভিজ্ঞ ভদ্রমহিলার তত্ত্বাবধানে মেঘ কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠল। কিন্তু এর অধিকাংশ কথাই ডোরেমনকেন্দ্রিক এবং হিন্দিতে! ‘রোকো’, ‘নেহি’, ‘বাড়িয়া’, ‘কিউ’ এসব শব্দ তখন ওর ঠোঁটাগ্রে। মেঘ এক বছর ধরে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা এই কার্টুন শোটি নিয়মিত দেখেছে। এই তার পরিণতি! যারা এ কার্টুন শোটি মন দিয়ে দেখেন না, তাদের একটু ধারণা দিই: এর মূল চরিত্র ‘ডোরেমন’ ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে আগত একটি রোবট বিড়াল, যে নোবিতা নামের এক জাপানি বালককে নানা রকম গ্যাজেট (বৈজ্ঞানিক যন্ত্র, যার নিজস্ব কিছু ইনটেলিজেন্স আছে) দিয়ে সাহায্য করে, কিন্তু নোবিতা সব সময় সেগুলোর অপব্যবহার করে। নোবিতা একটি অলস, ফাঁকিবাজ এবং মিথ্যাবাদী বালক, যে সব সময় স্কুলের হোমওয়ার্ক ফাঁকি দেয়ে, মাকে মিথ্যা বলে এবং সুজুকা নামে তার সহপাঠিনীর প্রেমে দিওয়ানা। নোবিতার ক্লাসের আরও দুই বালক জিয়ান ও সোনিও। জিয়ান বিনা কারণে নোবিতার সঙ্গে মারপিট করে আর সোনিও ধনী পরিবারের নাক উঁচু ধরনের একটি
ছেলে, নোবিতাকে মারতে সে জিয়ানকে নানা রকম উসকানি দেয়। অন্য দুটি চরিত্র নিকিসুকি ও সুজুকা অবশ্য লেখাপড়ায় মনোযোগী এবং মিষ্টি স্বভাবের। ডোরেমন সবাইকে হিতোপদেশ দেয়, প্রাকৃতিক নিয়মে মেঘ এবং অন্য সব শিশুরাই আকৃষ্ট হয় এই কার্টুনের খারাপ দিকগুলোর প্রতি এবং এই চিত্র শুধু আমাদের পরিবারে নয়, দেশের অসংখ্য শিশু এখন ডোরেমন জ্বরে আক্রান্ত।
বিপদ আঁচ করতে পেরে বাসায় এই চ্যানেলটি দেখা বন্ধ করা হলো। কিন্তু মেঘকে তো বিকল্প কিছু দিতে হবে! যখন আমরা বুঝলাম যে কার্টুন ছবি দেখে মেঘ অনেক কিছু শিখছে এবং কথা বলা শুরু করেছে, তখন ঠিক করলাম ওকে এবার বাংলা কিছু দেখাই। আর তখনই কিনলাম সিসিমপুর-এর এক সেট ডিভিডি। এই বাংলা পাপেট শোটি গবেষণাপ্রসূত এবং খুব সুপরিকল্পিতভাবে শিশুদের জন্য নির্মিত। আমার জানামতে প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে বিটিভিতে প্রতি শুক্রবার সকালে (৯.৩০ মি.) প্রচারিত হয়। মেঘকে সিসিমপুর-এর ডিভিডি দেখানোর কয়েক দিনেই পেলাম নাটকীয় ফলাফল। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ একদিন শুনি মেঘ আমাদের ডেকে বলছে ‘এই, কী করছ?’। আমরা জবাব দিলাম, ‘কাজ করছি, বাবা।’ মেঘের পাল্টা প্রশ্ন্ন, ‘কেন-ও?’ । আমরা বিস্ময়ে অভিভূত! এক সপ্তাহ সিসিমপুর দেখে ও পাপেট চরিত্র টুকটুকির মতো করে কথা বলছে। যা আমরা পারিনি, তা টুকটুকি পেরেছে।
বাংলা কথা বলা এবং শোনার প্রতি ওর আগ্রহ তৈরি হয়েছে সিসিমপুর দেখে। টুকটুকি, হালুম, ইকড়ি, শিকু, লালমিয়া, গুণী ময়রা, নানু এসব চরিত্রগুলো ওকে প্রভাবান্বিত করে। সিসিমপুর দেখে ওর জ্ঞানও বাড়ছে। বর্ণ আর সংখ্যার সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি ও শিখেছে গাছ আলো আর পানি খায়, মাছ খেতে খুব মজা আর সূর্য আমাদের আলো দেয়, মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, কেউ কিছু দিলে তাকে ধন্যবাদ বলতে হয় ইত্যাদি।
আমরা শিক্ষিত বাবা-মা হয়েও ভুল করেছি কথা শেখার বয়সটাতে মেঘকে বিদেশি ভাষার টিভি অনুষ্ঠান দেখতে দিয়ে। বিজাতীয় সংস্কৃতির এই ডিজিটাল আগ্রাসন কী নীরবে আমাদের শিশুদের মনোজাগতিক ক্ষতি সাধন করছে, তা কয়জন ভেবে দেখেছেন? ঘরে ঘরে হিন্দি চ্যানেলের যে জোয়ার চলছে, তা আমাদের পরিবারের সংস্কৃতিতে যে প্রভাব ফেলছে, তার কুফল পরবর্তী সময়ে দেখা দেবে আরও বড় মাত্রায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। আর যখন তা ধরা পড়বে, সে ভুল শোধরানোর পথ হয়তো আর তখন খোলা রইবে না।
লেখক: প্রকৌশলী কাজী মনজুর করিম ও চিকিৎসক গুলশান আরা।

ব্লগ থেকে...
নির্বাচিত প্রস্তাব
সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের দুজন কীর্তিমান সন্তানকে আমরা হারিয়েছি। এই দেশটিকে আরও কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে এমন রত্নতুল্য মেধাবী গড়ে তুলতে আমাদের তা জানা নেই। এঁরা পুরো জাতিকে বিশ্ববাসীর কাছে সম্মানিত করেছেন এবং আরও শিখরে নিয়ে যেতে পারতেন। আমি বর্তমান সরকারের কাছে সশ্রদ্ধ চিত্তে নিবেদন করছি প্রয়াত তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরের মতো সোনার ছেলে দুটির নামে মানিকগঞ্জের সড়কটির নামকরণ করা হোক। সরকার এই উদারতাটুকু দেখিয়ে কীর্তিমানদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করুক। আমাদের বিশ্বাস বর্তমান মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর এই সাংস্কৃতিক মানসিকতা আছে, তাঁর উদ্যোগেই এটা সম্ভব।
খন্দকার আশিকুল ইসলাম mdashik.ban@gmail.com

নির্বাচিত মন্তব্য
আজকাল টেলিভিশনে শিশুরা বাংলাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষার অনুষ্ঠান বা কার্টুন দেখতে পছন্দ করছে। কিন্তু কেন? ওই শিশুদের কি কোনো অভিভাবক নেই? অভিভাবকেরা কি পারে না নিজ গৃহে শিশুদের বাংলা ভাষার প্রতি মনোযোগী করে তুলতে? এ ছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের সচেতন ভূমিকাই পারে শিশুদের বিনোদনকে বাংলায় রূপান্তরিত করতে। অভিভাবকেরা এখনো রাস্তায় নামছেন না কেন?
শেখ সাদী
shadi.luxmi@gmail.com

অভিনন্দন
প্রথম আলোর বদলে যাওয়ার বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার। দুষ্টু নেতৃত্বের এই দেশে এমন একটি উদ্যোগ নিয়ে টিকে থাকা মহা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। এর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়। কিন্তু ইতিহাস কোনো কিছুই ভোলে না। প্রথম আলো যা করছে যুগের পর যুগ ইতিহাস সেটাকে সম্মানের সঙ্গে সংরক্ষণ করবে। তাদের এই নতুন বিপ্লবের কথা দেশের মানুষ সব সময় স্মরণে রাখবে। প্রথম আলো র সর্বশেষ সফলতা নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একজন সন্ত্রাসের গডফাদারের মুখোশ উন্মোচন করে জনগণকে তার শোষণের হাত থেকে রক্ষা করা। এটা মূলত আইভির বিজয় ছিল না, ছিল সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিজয়। বদলে যাওয়ার বদলে দেওয়ার শপথ নিয়ে প্রথম আলো সর্বদা মানুষের পাশে থাকুক।
মুহাম্মাদ ইকবাল হোছাইন
iqbalcomilla2007@yahoo.com

নিজের মত দিন....
ব্লগে
www.bodlejaobodledao.com
চলতি বিষয়—
 গণমাধ্যমে শিশুদের জন্য বাংলায়বিনোদন চাই
 ইভ টিজিংমুক্ত বাংলাদেশ চাই
 সড়ক দুর্ঘটনা কি চলতেই থাকবে?

জনমত জরিপের ফলাফল
বদলে যাও বদলে দাও মিছিলের ওয়েবসাইটে তিনটি প্রশ্নে জনমত চলছে। আপনিও অংশ নিন জরিপে।

আপনি কি মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ইভ টিজিং বন্ধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে?
 হ্যাঁ ৬৬%  না ৩০%
 মন্তব্য নেই ৪%
অংশগ্রহণকারী ১০৯১
২১ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত

স্যাটেলাইট চ্যানেলে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত কার্টুন বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ক্ষতিকর বলে কি আপনি মনে করেন?
 হ্যাঁ ৮৪%  না ১৩%
 মন্তব্য নেই ৩%
অংশগ্রহণকারী ১৩৪১
২১ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত

মহাসড়কে সোয়া লাখ ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি চলছে। আপনি কি মনে করেন, এগুলো তুলে নিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে?
 হ্যাঁ ৭৮%  না ২০%
 মন্তব্য নেই ২%
অংশগ্রহণকারী ১৩০৭
২১ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত
www.bodlejaobodledao.com

No comments

Powered by Blogger.