কে করবে বিচার? by এসএম কবীর মামুন

'কাঁদতে আসিনি/ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'_ এ কবিতার লাইনগুলো বারবার মনে পড়ে যায় তখনই_ যখন রেবেকা সরেন বা মহেশ্বর সরেন অথবা আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী-সন্তানদের অশ্রুভেজা চোখ ভেসে ওঠে। এগারো বছর পূর্ণ হতে চলল তবুও বিচার পেল না আলফ্রেডের স্বজনরা। ১৮ আগস্ট এলে শোনা যায় তাদের আহাজারি।

তবে কি বিচার হবে না এই হত্যাকাণ্ডের! নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের ভূমিদস্যু গদাই লস্কর, হাতেম ও তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট সকালে ভীমপুরের আদিবাসী পল্লীতে হামলা চালিয়ে আদিবাসীদের প্রাণপ্রিয় নেতা আলফ্রেড সরেনকে মধ্যযুগীয় নৃশংস কায়দায় হত্যা করে। সেদিনের সেই হামলায় নারী ও শিশুসহ আহত হয় আরও ১৭ জন। ভীমপুরের আদিবাসীদের কাছে সেই দিনটি ভয়াল দিন হিসেবে চিহ্নিত। সেই দিনের কথা মনে হলে আজও তাদের শরীর শিউরে ওঠে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঘটনার বিচার চাইবে কার কাছে সেই মানুষটাকে তারা খুঁজে পায় না। কিন্তু এর শেষ কোথায়?
আদিবাসী প্রশ্নে সরকার আজ আদিবাসী অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মহাজোট সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাঙালি ব্যতীত ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক সত্তার অধিকারী জাতিগুলোকে 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকার করলেও আজ পঞ্চদশ সংশোধনীতে সব আদিবাসীকে বাঙালি হিসেবে আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দিল। যেখানে সংবিধানই তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না, সেখানে তাদের মৌলিক মানবাধিকারগুলো কীভাবে রক্ষা হবে তা অবশ্যই ভাবনার দাবি রাখে। প্রতিদিনই সমতল থেকে পাহাড়ে নিগৃহীত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হচ্ছে কোনো না কোনো আদিবাসী। ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে তারা। এ আগ্রাসনের বলি হচ্ছে কোনো না কোনো আদিবাসী। ধর্ষিত হচ্ছে আদিবাসী নারী। ধর্ষকের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিতে হচ্ছে আদিবাসীদের। আদিবাসীর স্বীকৃতির প্রশ্নে সরকারের বর্তমান অবস্থান আগ্রাসীদের আরও উস্কে দিয়েছে অথবা দিচ্ছে, এ রকম ভাবা বোধ করি অন্যায় কিছু হবে না।
কল্পনা চাকমা, ফরেন স্নাল কিংবা আলফ্রেড সরেনসহ সব আদিবাসী হত্যাকাণ্ডের কোনোটারই আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি অথবা বিচার চেয়েও পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর ১৮ আগস্ট এলে ভীমপুরের আদিবাসীরা আলফ্রেড হত্যার বিচার চেয়ে জড়ো হয় নওগাঁ শহরে। তাতে কোনো ফল হয় না। আদিবাসীদের জমিগুলো আজও গদাই লস্করদের দখলে। এবারও অনেক হাঙ্গামা করে তারা আদিবাসীদের জমির ধান কেটে নিয়ে গেছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দু'জনকে আটক করলেও আর কোনো কিছুই হয়নি। দখলদার হত্যাকারীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর অনবরত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ভীমপুরের আদিবাসীদের।
বাংলাদেশের পাহাড় এবং সমতলের সব আদিবাসীই ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের জীবন-জীবিকা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সবকিছুই ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভূমির সঙ্গেই মিশে রয়েছে তাদের জীবন। ভূমিগ্রাসীদের আগ্রাসনে দিনে দিনে সেই ভূমি হারিয়ে আদিবাসীরা হয়ে পড়ছে প্রান্তিকের প্রান্তিক। আর ভূমির মালিকানা না থাকার কারণে সমতলের আদিবাসীদের সংস্কৃতিও বিলীন হতে চলেছে দিনে দিনে। সমতলের, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, মাহলি, মাহাতো, রাজোয়াড়, পাহানসহ আরও অনেক আদিবাসীর ভূমি রক্ষায় সংঘবদ্ধ করেছিল আলফ্রেড সরেন। তাই ভূমিগ্রাসীদের প্রধান বাধা ছিল এই আলফ্রেড। তারা ভেবেছিল এই আলফ্রেডকে সরিয়ে দিতে পারলে তাদের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাই তো সেদিন সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে আলফ্রেড নিজের ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিলেও সেখান থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল ভূমিদস্যুরা। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আদায়ের লড়াই আজও চলছে। হয়তো চালাতে হবে আরও অনেক দিন। ভূমি অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে জীবন দেওয়া আলফ্রেড এই লড়াইয়ে আদর্শ হিসেবে বেঁচে থাকবে। শুধু আদিবাসী নয়, ভূমির অধিকার অর্জনে বাঙালি ভূমিহীন প্রান্তজন অথবা পৃথিবীর যে প্রান্তে যত লড়াই সংগ্রাম চলছে অথবা হবে আলফ্রেড সরেন তাদের কাছে অধিকার আদায়ের আন্দোলনের আদর্শ। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রেরণা হয়ে থাকবে। জয়তু আলফ্রেড সরেন। তুমি বেঁচে থাকবে অধিকার বঞ্চিত-ভূমিহারা সংগ্রামী সব মানুষের মাঝে। কোনো কোনো মৃত্যু আছে পাখির পালকের মতো হালকা, আবার কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী। তোমার এই হিমালয় কাঁপিয়ে দেওয়া মৃত্যু আমাদের প্রেরণা।
krmamun334@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.