সময়ের প্রতিবিম্ব-বিএনপি-আওয়ামী লীগে কিছু মিল, অনেক গরমিল by এবিএম মূসা
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে হতো। ম্যাট্রিকুলেশনে বর্তমানের এসএসসি পরীক্ষায় ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে সম্রাট আকবর দ্য গ্রেটের ও অশোক দ্য গ্রেটের শাসনকালের তুলনামূলক আলোচনা করতে বলা হতো। কারণ, দুজনের শাসন পরিচালনায় প্রজাহিতকর রাষ্ট্রপরিচালনা নীতির মিল ছিল।
আকবরের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের তুলনা হতো না, অশোকের তুলনা করা হতো না ভারতবর্ষে হানা দেওয়া লুণ্ঠনকারী কোনো তাতার সেনাপতির। তেমনি মুক্তিসংগ্রাম থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতাযুদ্ধে জনগণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দলটির সঙ্গে সঙ্গিন উঁচিয়ে ক্ষমতা দখলকারী কোনো দলেরও তুলনা হয় না। জন্মদাতা পিতার সমপর্যায়ে এনে আজান দিয়ে শিশুর আগমনবার্তা শোনানো মৌলভি সাহেবের নামোল্লেখও হাস্যকর। এতসব সত্ত্বেও ভিন্ন ধরনের নীতি ও আদর্শের অনুসারী দুই দলের একটি অসম তুলনা করেছেন সোহরাব হাসান (প্রথম আলো, ১৬ এপ্রিল)। এ কে এম শাহাবুদ্দিন একটি নিবন্ধে তাঁর প্রতিক্রিয়া (প্রথম আলো, ৩ মে) জানিয়েছেন। তাঁদের দুজনের এবং আরও অনেকের দুটি দল নিয়ে কতিপয় নিরর্থক ধারণা ও অসম তুলনার বিশ্লেষণে আমার আজকের প্রতিবেদন।
সোহরাব হাসান ও এ কে এম শাহাবুদ্দিন নিজ নিজ অবস্থান থেকে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্ম ও কর্ম নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। ইতিহাসের একজন সাক্ষী অনেক কিছু দেখা-জানার আলোকে শাহাবুদ্দিনের বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করে তাঁর কিছু ভ্রান্ত ধারণার নিরসন করতে চাই। প্রথমত, আওয়ামী লীগের জন্ম অবশ্যই গণতান্ত্রিক ধারায় ঘটেছে। তৎকালীন স্বৈরতান্ত্রিক মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে, তাদের অপশাসনের অবসান ঘটাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। আচম্বিতে অথবা কোনো কলকাঠি নেড়ে এ-দল ও-দল ভাঙিয়ে নীতি-আদর্শহীন রাজনীতি চর্চাকারীদের সমন্বয়ে দলটির জন্ম হয়নি, যেমনটি হয়েছিল বিএনপির। যাঁরা এককালে মুসলিম লীগে ছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মোহভঙ্গের পর আওয়ামী মানে জনগণের, মধ্যপন্থী প্রগতিশীল আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন। অন্যদিকে বিএনপি, তার আদিরূপ ‘জাগদল’ অগণতান্ত্রিক পন্থায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি।
শাহাবুদ্দিনের কথা সত্য, ক্যান্টনমেন্টে বিএনপি ও তার পূর্বসূরি ‘জাগদলে’র জন্ম হয়নি। কারণ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তখন অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এসে গেছেন, জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের কাঁধে সওয়ার হয়েছেন। জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী ও তাঁদের সহায়তাকারী আমলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালাহউদ্দিন আহমদ আদর্শচ্যুত, সুবিধাবাদী, রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে ‘জাগদল’ গঠন করেছিলেন। একসময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক পোশাকটি ছাড়লেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেননি, সাফারি-স্যুট পরে সিভিলিয়ানের ভেক ধরেছেন। তাঁর সিভিলিয়ান কাম মিলিটারি মনোনীত পরামর্শক ও মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন কার্যরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আর তাঁদের উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিক। উভয় শ্রেণীর অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
বিএনপি গঠন করে জেনারেল জিয়াউর রহমান শাহাবুদ্দিন-কথিত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ নয়, বহির্বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি ‘মাল্টি-পার্টি’ তথা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্ররোচিত করে, রাজনীতি করার সীমিত সুযোগ দিয়ে ‘বহুদলীয় সংসদ’ গঠন করেছিলেন। এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি গণতন্ত্রের প্রতি মায়ার কারণে নয়, বহির্বিশ্বে তাঁর সরকারকে গ্রহণযোগ্য করতে। এর আগে একটি প্রহসনের গণভোটে তিনি ১১০ ভাগ ভোট আদায় করেছিলেন। মিলের কথা যদি বলি, এখনকার জনগণ নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে অবশ্য শহীদ জিয়ার সেই সাজানো কারসাজির নির্বাচনে বাছাই করা সংসদের একটুখানি তুলনা করা যায়। আজকের সংসদ কি বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চার সংসদ? একক আধিপত্যের কারণে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসরণে সদস্যদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে দু-দুবার কি প্রকারান্তরে একদলীয় শাসন কায়েম হয়নি? গরমিল হচ্ছে, প্রথমটিতে জিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী, বিশেষ করে, জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু ও বশংবদ আমলা সালাহউদ্দিন বাছাইয়ের কাজটি করেছেন। অন্যদিকে পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী ও এরশাদ পতন-পরবর্তী সব সংসদ—সামান্য ব্যতিক্রম ধর্তব্যে না নিয়ে বলা যায়, সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিমূলক জনগণ দ্বারা নির্বাচিত।
শাহাবুদ্দিনকে বুঝতে হবে, বিএনপি সরকারের অপশাসনে কতখানি বিরূপ হয়ে জনগণ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করাতে গিয়ে একেবারে গোল্ডেন জিপিএ-ফাইভ দিয়েছে। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি ভোটযুদ্ধের ‘মিল’ খুঁজে পাওয়া যাবে।
এখন সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক, শাহাবুদ্দিন বর্ণিত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় রূপান্তরের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ থেকে আমার অতি শ্রদ্ধেয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি যাঁর স্নেহভাজন ছিলাম, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে মতদ্বৈধতা প্রকাশ করে কাগমারি সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন, ত্যাজ্য করেননি। আদর্শ, নীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িকতা-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দুই দলের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মিল ছিল। জিয়াউর রহমান এসবের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তান আমলের ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মান্ধতাকে পুঁজি, সাম্প্রদায়িকতার বীজ লালন করে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়া তৈরি করেছিলেন। শাহাবুদ্দিনকে জানাই, জিয়ার লাইসেন্স নিয়ে নয়, তাঁর রচিত আইন অনুসরণে আবদুল মালেক উকিল প্রমুখ আওয়ামী লীগ দল সংবিধিবদ্ধ করেন। একইভাবে আইয়ুব খান কর্তৃক বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বর্তমান আওয়ামী লীগকে। এ সবই কারও অনুগ্রহ গ্রহণ নয়, বিদ্যমান আইন অনুসরণ মাত্র।
সেনাবাহিনী নিয়ে সোহরাবের মন্তব্যে আপত্তি জানিয়েছেন শাহাবুদ্দিন। তাঁকে প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়াউর রহমানসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধার হত্যাকারী কারা? ‘কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল’ সেনাসদস্যের অপকর্ম বলে কি সমগ্র সেনাবাহিনীকে দায়মুক্ত করা যাবে? উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু শাহাবুদ্দিন যাঁর ব্রিফ নিয়েছেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রকৃত হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বর্তমানের বিএনপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। একটি খাঁটি কথা বলেছেন শাহাবুদ্দিন, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠই সেনাবাহিনীর। কথাটিতে শুধু একটুখানি ভুল আছে, ইপিআর ও পুলিশও মনে হয় তালিকায় আছে। একই সঙ্গে আমারও একটি প্রশ্ন রয়েছে, অনেক সময় এ নিয়ে ভেবেছিও। বীরযোদ্ধা সাতজনের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রশ্ন করছি, সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্য চাকরিজীবী, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী মুক্তিযোদ্ধার কেউ কি সেই সাতজনের সমান্তরালের বীরত্ব প্রদর্শন করেননি, সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হননি? রহস্যটি হচ্ছে, সব উপাধিই সে সময়ে দেওয়া হয়েছিল কর্নেল, পরে জেনারেল ও অবসরগ্রহণকারী সেনাপ্রধান ওসমানীর সুপারিশে।
মিল-গরমিলের তুলনায় আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেই আলোচনায় অনেক তথ্য ও সত্য বিবেচনায় আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই জিয়াউর রহমানের অবদান রয়েছে। সেই অবদানটি যুদ্ধক্ষেত্রে, দুই দশকের মুক্তি আন্দোলনে নয়। মুক্তি আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে দুই দশকের চরম পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি যে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর কোনো অবদান ছিল না। বায়ান্ন, বাষট্টি ও ঊনসত্তর পেরিয়ে আমরা একাত্তরে পৌঁছেছি। সেই ক্রমবিকাশেই বাঙালি অনেক ত্যাগের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে এগিয়েছে। ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে শিঙা ফুঁকে কেউ স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা করেননি। সেসব ধাপ তৈরিতে জেনারেল জিয়া অথবা বিএনপির কোনো অবদান নেই।
বাস্তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিল-গরমিলের আলোচনায় সাম্প্রতিককালের সরকার পরিচালনার আলোকে বিবেচনা করলে দলীয় আঙ্গিকে নয়, সরকার পরিচালনায় কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বৈকি। এ জন্য দল ও সরকারকে আলাদা করতে হবে। মিল রয়েছে বিএনপি সরকারের অপারেশন ক্লিন হার্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ক্রসফায়ারের। জিয়ার সামরিক শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো কর্নেল তাহেরকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে পা কেড়ে নেওয়া ল্যাংড়া লিমনকে ‘বিচারক’ জেলে পাঠিয়েছেন। বিএনপির শাসনামলে সাংবাদিক খুন হন, আওয়ামী লীগের সাংসদ ও তাঁর ক্যাডাররা সাংবাদিক পেটান, চোখ উপড়ে নেন। ক্ষমতাসীন হলে উভয় দলের ক্যাডার হয় দখলবাজ-চাঁদাবাজ। কারও চেয়ে কেউ কম যান না। দল যখন ক্ষমতায় থাকেনি, তখন উভয়েরই সমানভাবে চরিত্র স্খলন ঘটেছে। ক্ষমতা হারালে উভয় দলের সুবিধাভোগীরা গর্তে ঢুকে যায়।
সর্বশেষ একটি কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে। সেনা ঔরসজাত দলটি কালের বিবর্তনে জনগণের একটি বিরাট অংশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এটি অবশ্যই আদিতে জিয়ার পরে খালেদা জিয়ার এ কৃতিত্বটি স্বীকার করতেই হবে। উভয়েই জনগণের মধ্যে ক্যারিশমা তথা সম্মোহন সৃষ্টি করেছেন। অনেকের ধারণা, তিনি শেষ সময়ে বিএনপিকে সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং এ জন্যই নাকি তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জিয়া হত্যার বিচার হলে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যেত।
আমার সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে, এখন অতীত নিয়ে বর্তমানের দুই দলের অবস্থান নির্ণয় করা অথবা তুলনামূলক আলোচনা অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সরকার যা-ই করুক, আওয়ামী লীগ দলটি তার ত্যাগী, সাত দশকের গভীরে প্রোথিত শিকড়ের কারণে তৃণমূল কর্মীরা দলের দুর্দিনেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অটল থাকেন। তাঁরা সবাই ‘তালেবান’ মানে বঙ্গবন্ধুর নামে, তাঁর কন্যার প্রতি ভালোবাসা ও প্রশ্নোর্ধ্ব আনুগত্যের কারণে সুসময়ে-দুঃসময়ে সমানতালে নাচতে থাকেন। সুযোগসন্ধানী নব্য আওয়ামী লীগাররা হলো ‘ফলেবান’ মানে দল ক্ষমতায় এলে ফল ভোগ করে। অন্যদিকে বিএনপির অবস্থা হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে বীরত্বের সঙ্গে বাগেরহাট-ভোলায় তাণ্ডব করে। কেমন তাণ্ডব তা বোঝাতে শাহাবুদ্দিনকে সেই আর্তনাদটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ভোলা, নাকি বাগেরহাটে এক মায়ের সেই আর্তনাদ: ‘বাবারা! আমার মেয়ে ছোট, তোমরা একজন-একজন করে আইসো।’ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতা হারালে সংঘবদ্ধ হয়, বিএনপি হয় বিপর্যস্ত-ছত্রভঙ্গ। এটি হলো দুই দলের ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন অবস্থায় গরমিল চেহারা। তার পরও আমি চাই, গত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়া রূপান্তরিত দলটি গণতন্ত্রের স্বার্থে একদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতিকূলে উঠে দাঁড়াক।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
সোহরাব হাসান ও এ কে এম শাহাবুদ্দিন নিজ নিজ অবস্থান থেকে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্ম ও কর্ম নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। ইতিহাসের একজন সাক্ষী অনেক কিছু দেখা-জানার আলোকে শাহাবুদ্দিনের বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করে তাঁর কিছু ভ্রান্ত ধারণার নিরসন করতে চাই। প্রথমত, আওয়ামী লীগের জন্ম অবশ্যই গণতান্ত্রিক ধারায় ঘটেছে। তৎকালীন স্বৈরতান্ত্রিক মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে, তাদের অপশাসনের অবসান ঘটাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। আচম্বিতে অথবা কোনো কলকাঠি নেড়ে এ-দল ও-দল ভাঙিয়ে নীতি-আদর্শহীন রাজনীতি চর্চাকারীদের সমন্বয়ে দলটির জন্ম হয়নি, যেমনটি হয়েছিল বিএনপির। যাঁরা এককালে মুসলিম লীগে ছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মোহভঙ্গের পর আওয়ামী মানে জনগণের, মধ্যপন্থী প্রগতিশীল আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন। অন্যদিকে বিএনপি, তার আদিরূপ ‘জাগদল’ অগণতান্ত্রিক পন্থায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি।
শাহাবুদ্দিনের কথা সত্য, ক্যান্টনমেন্টে বিএনপি ও তার পূর্বসূরি ‘জাগদলে’র জন্ম হয়নি। কারণ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তখন অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এসে গেছেন, জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের কাঁধে সওয়ার হয়েছেন। জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী ও তাঁদের সহায়তাকারী আমলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালাহউদ্দিন আহমদ আদর্শচ্যুত, সুবিধাবাদী, রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে ‘জাগদল’ গঠন করেছিলেন। একসময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক পোশাকটি ছাড়লেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেননি, সাফারি-স্যুট পরে সিভিলিয়ানের ভেক ধরেছেন। তাঁর সিভিলিয়ান কাম মিলিটারি মনোনীত পরামর্শক ও মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন কার্যরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আর তাঁদের উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিক। উভয় শ্রেণীর অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
বিএনপি গঠন করে জেনারেল জিয়াউর রহমান শাহাবুদ্দিন-কথিত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ নয়, বহির্বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি ‘মাল্টি-পার্টি’ তথা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্ররোচিত করে, রাজনীতি করার সীমিত সুযোগ দিয়ে ‘বহুদলীয় সংসদ’ গঠন করেছিলেন। এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি গণতন্ত্রের প্রতি মায়ার কারণে নয়, বহির্বিশ্বে তাঁর সরকারকে গ্রহণযোগ্য করতে। এর আগে একটি প্রহসনের গণভোটে তিনি ১১০ ভাগ ভোট আদায় করেছিলেন। মিলের কথা যদি বলি, এখনকার জনগণ নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে অবশ্য শহীদ জিয়ার সেই সাজানো কারসাজির নির্বাচনে বাছাই করা সংসদের একটুখানি তুলনা করা যায়। আজকের সংসদ কি বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চার সংসদ? একক আধিপত্যের কারণে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসরণে সদস্যদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে দু-দুবার কি প্রকারান্তরে একদলীয় শাসন কায়েম হয়নি? গরমিল হচ্ছে, প্রথমটিতে জিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী, বিশেষ করে, জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু ও বশংবদ আমলা সালাহউদ্দিন বাছাইয়ের কাজটি করেছেন। অন্যদিকে পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী ও এরশাদ পতন-পরবর্তী সব সংসদ—সামান্য ব্যতিক্রম ধর্তব্যে না নিয়ে বলা যায়, সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিমূলক জনগণ দ্বারা নির্বাচিত।
শাহাবুদ্দিনকে বুঝতে হবে, বিএনপি সরকারের অপশাসনে কতখানি বিরূপ হয়ে জনগণ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করাতে গিয়ে একেবারে গোল্ডেন জিপিএ-ফাইভ দিয়েছে। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি ভোটযুদ্ধের ‘মিল’ খুঁজে পাওয়া যাবে।
এখন সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক, শাহাবুদ্দিন বর্ণিত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় রূপান্তরের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ থেকে আমার অতি শ্রদ্ধেয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি যাঁর স্নেহভাজন ছিলাম, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে মতদ্বৈধতা প্রকাশ করে কাগমারি সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন, ত্যাজ্য করেননি। আদর্শ, নীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িকতা-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দুই দলের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মিল ছিল। জিয়াউর রহমান এসবের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তান আমলের ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মান্ধতাকে পুঁজি, সাম্প্রদায়িকতার বীজ লালন করে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়া তৈরি করেছিলেন। শাহাবুদ্দিনকে জানাই, জিয়ার লাইসেন্স নিয়ে নয়, তাঁর রচিত আইন অনুসরণে আবদুল মালেক উকিল প্রমুখ আওয়ামী লীগ দল সংবিধিবদ্ধ করেন। একইভাবে আইয়ুব খান কর্তৃক বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বর্তমান আওয়ামী লীগকে। এ সবই কারও অনুগ্রহ গ্রহণ নয়, বিদ্যমান আইন অনুসরণ মাত্র।
সেনাবাহিনী নিয়ে সোহরাবের মন্তব্যে আপত্তি জানিয়েছেন শাহাবুদ্দিন। তাঁকে প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়াউর রহমানসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধার হত্যাকারী কারা? ‘কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল’ সেনাসদস্যের অপকর্ম বলে কি সমগ্র সেনাবাহিনীকে দায়মুক্ত করা যাবে? উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু শাহাবুদ্দিন যাঁর ব্রিফ নিয়েছেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রকৃত হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বর্তমানের বিএনপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। একটি খাঁটি কথা বলেছেন শাহাবুদ্দিন, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠই সেনাবাহিনীর। কথাটিতে শুধু একটুখানি ভুল আছে, ইপিআর ও পুলিশও মনে হয় তালিকায় আছে। একই সঙ্গে আমারও একটি প্রশ্ন রয়েছে, অনেক সময় এ নিয়ে ভেবেছিও। বীরযোদ্ধা সাতজনের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রশ্ন করছি, সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্য চাকরিজীবী, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী মুক্তিযোদ্ধার কেউ কি সেই সাতজনের সমান্তরালের বীরত্ব প্রদর্শন করেননি, সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হননি? রহস্যটি হচ্ছে, সব উপাধিই সে সময়ে দেওয়া হয়েছিল কর্নেল, পরে জেনারেল ও অবসরগ্রহণকারী সেনাপ্রধান ওসমানীর সুপারিশে।
মিল-গরমিলের তুলনায় আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেই আলোচনায় অনেক তথ্য ও সত্য বিবেচনায় আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই জিয়াউর রহমানের অবদান রয়েছে। সেই অবদানটি যুদ্ধক্ষেত্রে, দুই দশকের মুক্তি আন্দোলনে নয়। মুক্তি আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে দুই দশকের চরম পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি যে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর কোনো অবদান ছিল না। বায়ান্ন, বাষট্টি ও ঊনসত্তর পেরিয়ে আমরা একাত্তরে পৌঁছেছি। সেই ক্রমবিকাশেই বাঙালি অনেক ত্যাগের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে এগিয়েছে। ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে শিঙা ফুঁকে কেউ স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা করেননি। সেসব ধাপ তৈরিতে জেনারেল জিয়া অথবা বিএনপির কোনো অবদান নেই।
বাস্তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিল-গরমিলের আলোচনায় সাম্প্রতিককালের সরকার পরিচালনার আলোকে বিবেচনা করলে দলীয় আঙ্গিকে নয়, সরকার পরিচালনায় কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বৈকি। এ জন্য দল ও সরকারকে আলাদা করতে হবে। মিল রয়েছে বিএনপি সরকারের অপারেশন ক্লিন হার্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ক্রসফায়ারের। জিয়ার সামরিক শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো কর্নেল তাহেরকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে পা কেড়ে নেওয়া ল্যাংড়া লিমনকে ‘বিচারক’ জেলে পাঠিয়েছেন। বিএনপির শাসনামলে সাংবাদিক খুন হন, আওয়ামী লীগের সাংসদ ও তাঁর ক্যাডাররা সাংবাদিক পেটান, চোখ উপড়ে নেন। ক্ষমতাসীন হলে উভয় দলের ক্যাডার হয় দখলবাজ-চাঁদাবাজ। কারও চেয়ে কেউ কম যান না। দল যখন ক্ষমতায় থাকেনি, তখন উভয়েরই সমানভাবে চরিত্র স্খলন ঘটেছে। ক্ষমতা হারালে উভয় দলের সুবিধাভোগীরা গর্তে ঢুকে যায়।
সর্বশেষ একটি কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে। সেনা ঔরসজাত দলটি কালের বিবর্তনে জনগণের একটি বিরাট অংশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এটি অবশ্যই আদিতে জিয়ার পরে খালেদা জিয়ার এ কৃতিত্বটি স্বীকার করতেই হবে। উভয়েই জনগণের মধ্যে ক্যারিশমা তথা সম্মোহন সৃষ্টি করেছেন। অনেকের ধারণা, তিনি শেষ সময়ে বিএনপিকে সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং এ জন্যই নাকি তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জিয়া হত্যার বিচার হলে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যেত।
আমার সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে, এখন অতীত নিয়ে বর্তমানের দুই দলের অবস্থান নির্ণয় করা অথবা তুলনামূলক আলোচনা অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সরকার যা-ই করুক, আওয়ামী লীগ দলটি তার ত্যাগী, সাত দশকের গভীরে প্রোথিত শিকড়ের কারণে তৃণমূল কর্মীরা দলের দুর্দিনেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অটল থাকেন। তাঁরা সবাই ‘তালেবান’ মানে বঙ্গবন্ধুর নামে, তাঁর কন্যার প্রতি ভালোবাসা ও প্রশ্নোর্ধ্ব আনুগত্যের কারণে সুসময়ে-দুঃসময়ে সমানতালে নাচতে থাকেন। সুযোগসন্ধানী নব্য আওয়ামী লীগাররা হলো ‘ফলেবান’ মানে দল ক্ষমতায় এলে ফল ভোগ করে। অন্যদিকে বিএনপির অবস্থা হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে বীরত্বের সঙ্গে বাগেরহাট-ভোলায় তাণ্ডব করে। কেমন তাণ্ডব তা বোঝাতে শাহাবুদ্দিনকে সেই আর্তনাদটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ভোলা, নাকি বাগেরহাটে এক মায়ের সেই আর্তনাদ: ‘বাবারা! আমার মেয়ে ছোট, তোমরা একজন-একজন করে আইসো।’ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতা হারালে সংঘবদ্ধ হয়, বিএনপি হয় বিপর্যস্ত-ছত্রভঙ্গ। এটি হলো দুই দলের ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন অবস্থায় গরমিল চেহারা। তার পরও আমি চাই, গত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়া রূপান্তরিত দলটি গণতন্ত্রের স্বার্থে একদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতিকূলে উঠে দাঁড়াক।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments