নারীনীতি-শুভংকরের ফাঁকিতে নারী ও রাজনীতি by ফারুক ওয়াসিফ

যুদ্ধের শেষে ময়দানে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের অন্তত পরাজয়ী বলা যায় না। নারীনীতি নিয়ে সরকার প্লাস প্রগতিশীলদের সঙ্গে রক্ষণশীল হুজুরদের যুদ্ধের পরিণতি কী, তা এখনই বলা কঠিন; ময়দানে উভয়েই এখনো মোতায়েন। সরকার ও আমিনী উভয়ই দেখাতে চাইছে কে বেশি ইসলাম-দরদি।

দরদ প্রমাণের জন্য উভয়ের হাতেই উঠেছিল ধর্মের ঢাল। কিন্তু নারীদের হাতে কী রইল? তাদের হাতে রইল একটি কাগজ, যে কাগজটি ১৯৯৭ সালের কাগজটির চেয়েও কমজোরি। যা হোক, ‘মৌলবাদী’ জুজুর ভয়ে নারী উন্নয়নকারী এনজিওরা সরকারের সমালোচনা শিকেয় তুলে রেখে ‘মৌলবাদবিরোধী’ সংগ্রামে নেমে পড়ল। সরকারের দুই দিকেই লাভ, তারা নারীনেত্রীদের সমর্থনও পেল, পুরুষতান্ত্রিক গোষ্ঠীকেও অসন্তুষ্ট করল না। কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন না করার সাবেক প্রতিশ্রুতিও রাখা হলো। মাঝখান থেকে পুরুষের সম্পত্তি রক্ষার এই যুদ্ধে ‘ইসলাম’ যেমন চাঙা হলো, তেমনি ‘মৌলবাদ’ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী করা অনেকের কাছে দরকারি হয়ে পড়ল। দলটির ভোট ও ভাবমূর্তি দুই-ই বাড়ল। বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভ্যাসমাফিক আশঙ্কাও প্রকাশিত হলো। এদিকে হরতালের গন্ডগোলে এক মাদ্রাসাছাত্র ফট করে পুলিশের গুলিতে ‘শহীদ’ হয়ে গেল। কিন্তু বোনকে বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ দেবে না বলে যে ভাইয়ের জীবন গেল, সেই ভাই-ই তো সম্পত্তিহীন! যে নিজেই সম্পত্তিহীন, সে তাহলে কার সম্পত্তি রক্ষায় জানবাজি রাখল? বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের বেশির ভাগই দরিদ্র সম্পত্তিহীন শ্রেণীর সন্তান। সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার আসুক বা না আসুক, তাতে এই ছাত্রদের কিছু আসে-যায় না। কিন্তু পরিহাস হচ্ছে, সম্পদশালী তথাকথিত ইসলামি নেতাদের পুরুষাধিকার রক্ষার বন্দুকটা তাদের ঘাড়েই রাখা হলো। সবই ধর্মের নামে হলেও যা হচ্ছে তাকে সোজা বাংলায় ‘রাজনীতি’ বলে।
এই রাজনীতি পুরুষের, এই নারী ‘উন্নয়ন’ও পুরুষের চোখ দিয়ে দেখা উন্নয়ন। বিদেশি তহবিল পেতে, আন্তর্জাতিক ফোরামে মুখ রাখতে ভালো ভালো ‘নীতি’ থাকা দরকার হয়। কাজের বেলায় ঢনঢনা হলেও লোক দেখানো নীতিগুলো তাই সরকার আমলাদের দিয়ে করিয়ে থাকে। আর পরামর্শক হিসেবে থাকে বিভিন্ন এনজিও ও বিশেষজ্ঞ। যাদের জন্য নীতি তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ আসে সবার শেষে এবং প্রায়ই সেই মতামত রাখা হয় না। তাই উন্নয়নের নামে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে, তৈরি পোশাকশিল্পসহ বহু আধুনিক ক্ষেত্রে নারীর বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে কোনো কথা এই নীতিতে রইল না। আবার যেটুকু আছে, তার পক্ষেও সরকার বা সরকারি দলের দিক থেকে জনমত সংগঠনের চেষ্টাও ছিল না। অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার মাঠপর্যায়ে যতটা সক্রিয়, যতটা মুখর, মুফতি আমিনী চক্রের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে ততটা নয় কেন?
সরকার মনে হয় মাঠ গরম করা বিরোধী দলের অভাবে ‘ইসলামপন্থীদেরই’ বিরোধী দল হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। মিডিয়াও কয়েকটি মাদ্রাসার ছাত্রদের সমর্থনপুষ্ট একজন ধনী সামন্ত মুফতির কর্মকাণ্ডকে বিরাট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে তাদেরই পাল্লা ভারী করছে। এতে সরকারের লাভ এটাই যে প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লাতন্ত্রের ভয় দেখিয়ে একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ শান্তিপ্রিয় দেশবাসীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা হলো, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্তরেও একটা বার্তা চলে গেল যে বাংলাদেশে ‘তালেবানি’ ধরনের লোকজন শক্তিশালী হচ্ছে, এ অবস্থায় সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন দরকার। এ রকম কৌশল একদা বিএনপিও নিয়েছিল, কিন্তু আখেরে সেটা তাদের জন্য বুমেরাং হয়। সরকারের এটা মনে রাখা প্রয়োজন।
সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার অনেকটা গ্রামীণ সমস্যা। শহুরে সচ্ছল পরিবারে সম্পত্তি বণ্টন সব সময় সনাতন কায়দায় হয় না, এখানে নানা ধরনের বণ্টনের রীতি চালু আছে। সাধারণভাবে ফতোয়ার হাতও তাদের স্পর্শ করতে পারে না। নারীবিদ্বেষী সনাতন কালাকানুন ও দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হয় মূলত গ্রামীণ নারী এবং তাদের পরিবার। ফতোয়ার কোপানলে এ পর্যন্ত যত নারী নিহত হয়েছে, তার মধ্যে একজনও শিক্ষিত-সচ্ছল নারী নেই। প্রশ্নটা তাই কেবল নারীনীতির নয়, গ্রামীণ নারীদের এবং গ্রাম থেকে আসা মাদ্রাসার ছাত্রদের জীবনকে কতিপয় সামন্ত ধর্মনেতার খপ্পরে ছেড়ে রাখা হবে কি হবে না, এটা তারই মামলা। দ্বিতীয়ত, নারীনীতি না বলে এটা কেন জেন্ডারনীতি নয়? নারীবিদ্বেষী অথবা নারীদের সমান ভাবতে নারাজ পুরুষদের উন্নয়নে পুরুষনীতি নয়? সমস্যা তো নারী নয়, তাহলে কেন তাদের সমস্যায়িত করা? তৃতীয়ত, যারা মুসলমান নয়, কিংবা যারা নয় নর বা নারী, সেসব ব্যক্তির বেলায় কী বিধান? চতুর্থত, ইসলাম নারীদের সমানাধিকারের পক্ষে নয়—এমন মতবাদ কিসের ভিত্তিতে প্রচারিত হচ্ছে?
নারী নিয়ে নীতি ও রাজনীতির হাতে তাই দরিদ্র নারী ও মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রতারিতই হলো। যে দরিদ্র মাদ্রাসাছাত্রের সম্পত্তিই নেই, তার উত্তরাধিকারের বালাইও নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে একটা জিনিসই তারা পায়—দারিদ্র্য আর বঞ্চনা। একই সঙ্গে পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা গ্রামীণ সামন্ত মোল্লাদের গণবিরোধী রাজনীতির উত্তরাধিকারও তাদের ঘাড়েই চাপছে। এই রাজনীতির বড় অংশ সেনাশাসনের সঙ্গে ছিল, একাত্তরে মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সব স্বৈরশাসনের সামাজিক খুঁটির ভূমিকা পালন করেছিল। সম্পদ ও যোগাযোগে এরা আগের চেয়ে শক্তিশালী হলেও মাদ্রাসা জনগোষ্ঠীর বাইরে এদের প্রভাব সীমিত। আবার মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী মানেই রক্ষণশীল, এমন ধারণাও ঠিক নয়। মাদ্রাসাগুলোকে জমিদারি এবং ছাত্রদের প্রজাবাহিনীর মতো ব্যবহার করে তারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার হিস্যা চাইছে। বাঙালি পুরুষের সনাতন নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতিকে উসকে দিয়ে এরা ফেরত আনতে চাইছে সামন্তবাদী পুরুষতান্ত্রিকতাকে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র ও নাগরিকেরা কী করতে পারবে বা পারবে না, কোনটা ইসলামসম্মত আর ইসলামসম্মত নয়, কে মুমিন আর কে মুরতাদ, তা ঠিক করার যে ক্ষমতা তারা চায়, তা আসলে মধ্যযুগীয় চার্চতন্ত্র বা পুরোহিততন্ত্রের ক্ষমতা। খেয়াল করা দরকার, সুন্নি ইসলামে পুরোহিততন্ত্র বা পোপতন্ত্রের মতো কোনো কিছু অনুমোদিত নয়। বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন ইসলামে নেই, আল্লাহর দরবারে সবারই সমান অধিকার। তাহলেও হেফাজতে ইসলাম, শরিয়া বাস্তবায়ন কমিটি প্রভৃতি নাম নিয়ে এই গোষ্ঠী নিজেদের জনগণের ধর্মবিশ্বাসের মালিক ও পরিচালক হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে। এই মোল্লাতন্ত্রের বর্তমান কান্ডারি হয়েছেন মুফতি আমিনী।
কেউ জাতীয়তাবাদের নামে রাজনীতি করে, কেউ করে ধর্মের নামে। নাম যা-ই নিক, রাজনীতিকে রাজনীতি হিসেবেই দেখতে হবে এবং তাকে মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে রাজনীতির ময়দানেই। আমিনী সাহেবদের ক্ষমতা প্রয়োগের বলি হলো নারী। একইভাবে নারীদের ব্যবহার করে রাজনীতি করতেও দ্বিধা করল না সরকার। এই দুইয়ের ফ্যাঁকড়ায় রাজনীতি আরও ঘোলাটে হয়ে গেল।
এখন ইসলামি আলেমদের ঠিক করতে হবে, ইসলামকে যাঁরা নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন, যাঁরা মোল্লাতন্ত্র কায়েম করতে চাইছেন, তাঁদের তাঁরা অনুমোদন দেবেন কি দেবেন না। বহুকাল ধরে মোল্লাতন্ত্র গ্রামীণ ধনীদের সঙ্গে মিলে দরিদ্র কৃষক পরিবারের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে। শিক্ষার প্রসার এবং তৈরি পোশাকশিল্পসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক কাজের সুবাদে সেই ছড়ির দাপট কমে আসছে। গ্রামের মানুষও এসব ‘ভাত দেওয়ার মুরদ নাই কিল মারার গোঁসাই’কে মানতে নারাজ। মানুষের এই স্বাধীনচেতা মনোভাবের বিরুদ্ধে ফতোয়াই তাদের শেষ মারণাস্ত্র। ইতিমধ্যে আদালত এই অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। এ অবস্থায় অবক্ষয়িত মোল্লাতন্ত্র শেষ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে শহরাঞ্চলে কিছু মাদ্রাসায়ও এরা ঘাঁটি গেড়েছে। কখনো বিএনপি বা কখনো আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চড়ে বলবানও হয়েছে। সামরিক-বেসামরিক পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে নিজ গণ্ডির বাইরে পা রাখার সামর্থ্য এদের হতো কি না সন্দেহ।
এভাবে সরকার ও ইসলামপন্থী উভয়ে মিলে রাজনীতিতে ধর্মের ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক সমাজকে ধর্মীয় সমাজে রূপান্তরের কুফল কি তাঁরা পাকিস্তানকে দেখে শিখছেন না? ভারতে বিজেপির মতো ধর্মবাদী দলকেও আরও উগ্রবাদী আরএসএস-কে খুশি রাখতে হচ্ছে। এর পরিণতিতে ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমশই সাম্প্রদায়িকতার রসে সিক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশকে এই দুই পথ পরিহার করতেই হবে এবং তা করতে হবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। আর নারীর মর্যাদাপূর্ণ জীবন কেবল কাগুজে নীতির বিষয় নয়, তা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.