চারদিক-কুমারখালীর কুলফি খাবেন? by আজাদুর রহমান
আউল-বাউলের হইহই-থইথই ফেলে ঠান্ডা খুঁজতে লাগলাম। ভক্তকুল এত বেশি যে ঠা ঠা রোদে ছাউনি তুলে নিচে ঢুকে পড়েছে কেউ কেউ। পলিথিনের ওপর শাড়ি, নয়তো পাতলা চাদর। ব্যস, রোদ ঠেকানো হয়ে গেল। তলা থেকে ঝাঁকি উঠছে, ‘হাওয়া দমে দেখ তারে আসল বেনা।’ দোতরা-একতারা জোয়ারি, চাকতি, দপ, ঢোল, তবলা,
তালে-বেতালে সব চলছে। তল্লাট ভরা মউজ। সকাল থেকে মাথা-গায়ে রোদ নিয়ে ঘুরে ঘুরে মজমা দেখছি। তিরতিরে রোদ। শরীর তেতে উঠেছে। বিশ্রাম নিয়ে চাঙা হতে না পারলে ম্যান্দা মেরে থাকতে হবে। আসল মচ্ছব শুরু হবে রাতে, খোলা জ্যোৎস্নায়। পাঁচ দিনের আনন্দযজ্ঞ। কিন্তু বাউলেরা তিথি মান্য করেন। দোলের দুই রাতের পর সাধুদের আর পাওয়া যায় না। মেলা কমিটি টেনেটুনে আরও তিন দিন নিয়ে যাবে বটে, তাতে লাভ হবে না। ভজন-সাধনের কিছুই থাকবে না তখন। আখড়া থেকে বেরিয়ে এলাম। ভেতরটা কেবলই ঠান্ডা চাইছে এখন। পানি খুঁজতে গিয়ে আওয়াজ এল, ‘ঠান্ডা খান, ঠান্ডা। গরমের আরাম, পরানের শান্তি। ঠান্ডা খান, ঠান্ডা...।’
গাছতলা থেকে লোকটা যেন ‘মনের কথা’ই বলছেন। কাছে গিয়ে দাম করলাম, কুলফি কত করে। কুলফিওয়ালা বলে গেলেন—২০, ১৫, ১০। ১৫ টাকা দামের কৌটা খুলতে বললাম। হাঁড়ির বরফ ঘেঁটে আলতো হাতে একটা কৌটা তুলে নিলেন তিনি। তারপর তেলমর্দন করার মতো করে দুই হাতে কৌটা বেলতে শুরু করলেন। ‘গরমের আরাম, পরানের শান্তি’ মানে কী? নরম করে জানতে চাইলাম। ব্যাখ্যা ছিল প্রস্তুত—‘শোনেন, য্যামন ধরেন, অসহ্য গরমে যদি ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগাতি পারেন, তবে বেশ আরাম হয়। আর যদি সাথে হিম ঠান্ডা পানি পান, তাহলি খালি আরাম আর থাকবে না। এটটা শান্তি পাবেন। আমার কুলফিটা দুধ-চিনি মসলাপাতি আর বরফ মিশেলে বানানি। এটা খেইলে দ্যাকপেন, প্যাটে যেমন আরাম হবে, মনেও তেমন শান্তি পাবেন।’ হাত-মুখ একসঙ্গে চলে। কথা চালু রেখেই কলাপাতায় কৌটা উপুড় করে অর্ধগলিত কুলফি ঢেলে দিলেন তিনি। এগিয়ে ধরলেন। সাধারণ দোকানি আইসক্রিমের মতো না। মুখে ফেলতেই চুমচুম করে মিলিয়ে যেতে লাগল। যেমন ঘ্রাণ, তেমন ঠান্ডা আর স্বাদের। মনমতো আরামদায়ক। দাম মিটিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলাম। কুমারখালীর জাহেদপুরের লুৎফর রহমান। কালীগঙ্গার পাড়ে নিয়ে গেলে ক্ষতি কী? বললাম, ‘চলেন, ওদিকে যাই। সাধুরা তো সব এখন স্নানে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে বেচাবিক্রি মন্দ হবে না।’ লুৎফর রা করলেন না। ‘ন্যান, চলেন’ বলেই তিনি দুই হাতে হাঁড়িটা মাথায় তুলে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন।
মরা কালীগঙ্গার ঘাটের ঘাসে বসামাত্র দুটো কুলফি বিক্রি হয়ে গেল। তবে একটানে বেশিক্ষণ চালানো গেল না। হঠাৎ ঘাটপাড় স্নানার্থী শূন্য হয়ে পড়ল। তার মানে পুণ্যস্নানের সঙ্গেও দিনক্ষণের যোগ আছে নাকি! তা হোক, অল্প সময়ে মন্দ হয়নি। লুৎফর উজ্জ্বল মুখে বিড়ি ধরালেন। সাধু-সেবাদাসীদের কোলাহল কমে ক্রমেই নিরিবিলি নামছে। কেবল একটা মারফতি গান হাওয়ায় দুলতে দুলতে এ পর্যন্ত এসে ছোট হয়ে যাচ্ছে, ‘মিলন হবে কত দিনে/ আমার মনের মানুষেরও সনে।’ নতুন করে কথা পাড়তে হলো না। আপনাআপনি বলতে লাগলেন লুৎফর, ‘আজিমনকে নিয়ে তিন পোলার সংসার। ছোড পোলাডা ল্যাংড়া, হাঁটতি পারে না। বাপের জমিজমাও ক্যাছো নাই। কুলফির ব্যবসাডা আছে বলি একনো চলতি-ফিরতি পাচ্চি...।’ আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করি, ‘কুলফির কথা বলেন।’ লুৎফর বোঝেন না। মর্জিমাফিক গ্রামের আত্মীয়স্বজন নিয়ে তুললেন। কুলফিছাড়া বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারি না; বরং কুলফির ছবিটা মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। একসময় লুৎফর অবশ্য কুলফিতে নেমে আসেন। রুটিন করা কাজ। স্ত্রী আজিমন সমান তালে না খাটলে কুলফি বানানো যেত না। মূল কাজটা আগ রাতের। দুধ জ্বাল করে ক্ষীরের মতো করে রাতভর জিরানো লাগে। এরপর বাদবাকি লুৎফরের কাজ। ফজরের আগেই ক্ষীরের হাঁড়ি বের করে চিনি-মসলা মনমতো মিশিয়ে দেন তিনি। হয়ে গেল মালাই। কৌটায় ভরেন। এবার হাঁড়ি মাথায় ছুটতে থাকেন কুষ্টিয়া শহরের দিকে। মানে সাদ্দামবাজারের মালাই ফ্যাক্টরি থেকে বরফ কিনে হাউসে ফেলেন। মাপমতো লবণ-পানি যোগ করেন। তারপর বানানো বরফপানিতে কৌটাগুলো ছেড়ে ঝাঁকুনি শুরু করে দেন। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কৌটাতে রাখা দুধ-পানি জমতে শুরু করলেই বেচার জন্য পথে নেমে পড়েন তিনি। বাসে ঝুলে চলে যান ঝিনাইদহের বারোবাজার অথবা মুজিবনগর পিকনিক স্পটে। বেশি বেচা হয় শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। লালনমেলা হলে ভিন্ন কথা। কম পুঁজিতে ভালো লাভ। তবে গায়ে খাটুনি হয় খুব। ব্যবসা হয় সিজন মতো। মাঘ-ফাগুন থেকে ভাদ্র। এরপর কোনো ব্যবসা নেই। কখনো লোকসান হয় না? প্রশ্ন শুনে লুৎফর হতাশ হলেন—‘ম্যাগ লাগলে আর জান থাকে না। মানুষ কুলফি টানে না। বরফ গলে পানি হলেই শ্যাষ। তখন লসের পর লস হয়। তা ছাড়া আপনাকে কী বুলব। আগের মতো নাই, ব্যবসাডা বিলে হয়ে গ্যাছে। কুমারখালীতে কম করি হলিও ২০০ মানুষ এ কারবার করছেন। দিনকে দিন কারবারডা ছোড হয়া যাচ্চে। দুধ-বরফের দাম বাড়তি। আগের মতন কামাই হয় না।’ একটানে কথাগুলো বলে মাথায় হাঁড়ি তুলে নিলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাঁড়ি টানতে ঘাড়ে টান লাগে না?’ বেদনা ছাপিয়ে মুচকি হাসলেন, ‘দ্যাকেন, লাব তো হয় ওই গতরের উপর। এ তো বাবুগিরি ব্যবসা না, মাথার ঘাম পায় ফেলি তবে প্যাটের ভাত পাই।’ লুৎফর চলে যাচ্ছেন। বেলায় বেলায় বেচতে না পারলে তো সব পানি হয়ে যাবে। আমি বসেই থাকলাম। নিঃশব্দ ঘাটে এখন কেউ নেই। একটাই গান শোনা যাচ্ছে, ‘ধন্য ধন্য বলি তারে।’
আজাদুর রহমান
গাছতলা থেকে লোকটা যেন ‘মনের কথা’ই বলছেন। কাছে গিয়ে দাম করলাম, কুলফি কত করে। কুলফিওয়ালা বলে গেলেন—২০, ১৫, ১০। ১৫ টাকা দামের কৌটা খুলতে বললাম। হাঁড়ির বরফ ঘেঁটে আলতো হাতে একটা কৌটা তুলে নিলেন তিনি। তারপর তেলমর্দন করার মতো করে দুই হাতে কৌটা বেলতে শুরু করলেন। ‘গরমের আরাম, পরানের শান্তি’ মানে কী? নরম করে জানতে চাইলাম। ব্যাখ্যা ছিল প্রস্তুত—‘শোনেন, য্যামন ধরেন, অসহ্য গরমে যদি ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগাতি পারেন, তবে বেশ আরাম হয়। আর যদি সাথে হিম ঠান্ডা পানি পান, তাহলি খালি আরাম আর থাকবে না। এটটা শান্তি পাবেন। আমার কুলফিটা দুধ-চিনি মসলাপাতি আর বরফ মিশেলে বানানি। এটা খেইলে দ্যাকপেন, প্যাটে যেমন আরাম হবে, মনেও তেমন শান্তি পাবেন।’ হাত-মুখ একসঙ্গে চলে। কথা চালু রেখেই কলাপাতায় কৌটা উপুড় করে অর্ধগলিত কুলফি ঢেলে দিলেন তিনি। এগিয়ে ধরলেন। সাধারণ দোকানি আইসক্রিমের মতো না। মুখে ফেলতেই চুমচুম করে মিলিয়ে যেতে লাগল। যেমন ঘ্রাণ, তেমন ঠান্ডা আর স্বাদের। মনমতো আরামদায়ক। দাম মিটিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলাম। কুমারখালীর জাহেদপুরের লুৎফর রহমান। কালীগঙ্গার পাড়ে নিয়ে গেলে ক্ষতি কী? বললাম, ‘চলেন, ওদিকে যাই। সাধুরা তো সব এখন স্নানে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে বেচাবিক্রি মন্দ হবে না।’ লুৎফর রা করলেন না। ‘ন্যান, চলেন’ বলেই তিনি দুই হাতে হাঁড়িটা মাথায় তুলে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন।
মরা কালীগঙ্গার ঘাটের ঘাসে বসামাত্র দুটো কুলফি বিক্রি হয়ে গেল। তবে একটানে বেশিক্ষণ চালানো গেল না। হঠাৎ ঘাটপাড় স্নানার্থী শূন্য হয়ে পড়ল। তার মানে পুণ্যস্নানের সঙ্গেও দিনক্ষণের যোগ আছে নাকি! তা হোক, অল্প সময়ে মন্দ হয়নি। লুৎফর উজ্জ্বল মুখে বিড়ি ধরালেন। সাধু-সেবাদাসীদের কোলাহল কমে ক্রমেই নিরিবিলি নামছে। কেবল একটা মারফতি গান হাওয়ায় দুলতে দুলতে এ পর্যন্ত এসে ছোট হয়ে যাচ্ছে, ‘মিলন হবে কত দিনে/ আমার মনের মানুষেরও সনে।’ নতুন করে কথা পাড়তে হলো না। আপনাআপনি বলতে লাগলেন লুৎফর, ‘আজিমনকে নিয়ে তিন পোলার সংসার। ছোড পোলাডা ল্যাংড়া, হাঁটতি পারে না। বাপের জমিজমাও ক্যাছো নাই। কুলফির ব্যবসাডা আছে বলি একনো চলতি-ফিরতি পাচ্চি...।’ আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করি, ‘কুলফির কথা বলেন।’ লুৎফর বোঝেন না। মর্জিমাফিক গ্রামের আত্মীয়স্বজন নিয়ে তুললেন। কুলফিছাড়া বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারি না; বরং কুলফির ছবিটা মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। একসময় লুৎফর অবশ্য কুলফিতে নেমে আসেন। রুটিন করা কাজ। স্ত্রী আজিমন সমান তালে না খাটলে কুলফি বানানো যেত না। মূল কাজটা আগ রাতের। দুধ জ্বাল করে ক্ষীরের মতো করে রাতভর জিরানো লাগে। এরপর বাদবাকি লুৎফরের কাজ। ফজরের আগেই ক্ষীরের হাঁড়ি বের করে চিনি-মসলা মনমতো মিশিয়ে দেন তিনি। হয়ে গেল মালাই। কৌটায় ভরেন। এবার হাঁড়ি মাথায় ছুটতে থাকেন কুষ্টিয়া শহরের দিকে। মানে সাদ্দামবাজারের মালাই ফ্যাক্টরি থেকে বরফ কিনে হাউসে ফেলেন। মাপমতো লবণ-পানি যোগ করেন। তারপর বানানো বরফপানিতে কৌটাগুলো ছেড়ে ঝাঁকুনি শুরু করে দেন। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কৌটাতে রাখা দুধ-পানি জমতে শুরু করলেই বেচার জন্য পথে নেমে পড়েন তিনি। বাসে ঝুলে চলে যান ঝিনাইদহের বারোবাজার অথবা মুজিবনগর পিকনিক স্পটে। বেশি বেচা হয় শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। লালনমেলা হলে ভিন্ন কথা। কম পুঁজিতে ভালো লাভ। তবে গায়ে খাটুনি হয় খুব। ব্যবসা হয় সিজন মতো। মাঘ-ফাগুন থেকে ভাদ্র। এরপর কোনো ব্যবসা নেই। কখনো লোকসান হয় না? প্রশ্ন শুনে লুৎফর হতাশ হলেন—‘ম্যাগ লাগলে আর জান থাকে না। মানুষ কুলফি টানে না। বরফ গলে পানি হলেই শ্যাষ। তখন লসের পর লস হয়। তা ছাড়া আপনাকে কী বুলব। আগের মতো নাই, ব্যবসাডা বিলে হয়ে গ্যাছে। কুমারখালীতে কম করি হলিও ২০০ মানুষ এ কারবার করছেন। দিনকে দিন কারবারডা ছোড হয়া যাচ্চে। দুধ-বরফের দাম বাড়তি। আগের মতন কামাই হয় না।’ একটানে কথাগুলো বলে মাথায় হাঁড়ি তুলে নিলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাঁড়ি টানতে ঘাড়ে টান লাগে না?’ বেদনা ছাপিয়ে মুচকি হাসলেন, ‘দ্যাকেন, লাব তো হয় ওই গতরের উপর। এ তো বাবুগিরি ব্যবসা না, মাথার ঘাম পায় ফেলি তবে প্যাটের ভাত পাই।’ লুৎফর চলে যাচ্ছেন। বেলায় বেলায় বেচতে না পারলে তো সব পানি হয়ে যাবে। আমি বসেই থাকলাম। নিঃশব্দ ঘাটে এখন কেউ নেই। একটাই গান শোনা যাচ্ছে, ‘ধন্য ধন্য বলি তারে।’
আজাদুর রহমান
No comments