সপ্তাহের হালচাল-বিএনপির কোর্টে আওয়ামী লীগ খেলবে? by আব্দুল কাইয়ুম
এখন আওয়ামী লীগ বলছে তিন মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন করতে না পারলে আগের সরকার ক্ষমতাসীন হবে। তখন তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। যদি তা-ই হবে, তাহলে আওয়ামী লীগ কেন ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এত হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলন করেছিল?
তারা তো এখনো দাবি করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তাদেরই আন্দোলনের ফসল। শেষ পর্যন্ত যদি দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হয়, তাহলে তারা কি সেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মালিকানার দাবি ছেড়ে দেবে? তারা কি বলবে যে তখন করেছিলাম, এখন আর দরকার নেই?
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, না, সেটা হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বর্তমান ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। কোনো পরিবর্তন নয়। তা-ই যদি হবে, তাহলে সেই ১৫ বছর আগে কেন তারা একরোখাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিল। আজ তারা যে দাবি করছে, ১৯৯৬ সালে সেটা করলে তো দেশ অনেক সংঘাত থেকে রক্ষা পেত। এখন কি তারা বলবে, ওই সময়ে করি নাই তো কী হয়েছে, এখন যা বলছি, তা-ই হবে?
কোনো ‘দলীয় প্রধান বিচারপতিকে’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হলে জনগণ তা মানবে না বলে বিএনপি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। ন্যায্য কথা। কিন্তু এই কথাটা ছয় বছর আগে কেন তাদের মনে পড়েনি? তাদের আমলে যদি বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো না হতো, তাহলে হয়তো ২০০৭ সালে এসে এক-এগারোর সেই ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধ্যায়ের সূচনা ঘটার সুযোগও থাকত না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে গত ১৫ বছরে দুই দল অবস্থান অদল-বদল করে নিল। আওয়ামী লীগ গেল প্রায় বিএনপির অবস্থানে, আর বিএনপি গেল আওয়ামী লীগের অবস্থানে। দুই দলের এই নাটকীয় অবস্থান পরিবর্তনে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ অনিশ্চিত। তাই ২০০৮ সালে বিপুল আসনে জয়লাভের পর থেকেই আওয়ামী লীগ বলতে শুরু করে, নির্বাচন কমিশন তো যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়েছে, এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দরকার কী? আরে বাবা, নির্বাচন কমিশন যদি এতই স্বাধীন, তাহলে তারা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে পারছে না কেন? কয়েকবার তো উদ্যোগ নিল। কিন্তু তারপর এই আইন, সেই আইন দেখিয়ে তাদের বিরত রাখা হচ্ছে কেন? এটা কি কেউ বোঝে না যে চট্টগ্রামে প্রতাপশালী নেতা ও সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ঢাকায় মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের আশা ক্ষীণ বলেই নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন নাকি খুব স্বাধীন। এমন স্বাধীন যে সরকারের মর্জি না হওয়া পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন করার এখতিয়ারটুকুও নেই।
হ্যাঁ, নির্বাচন কমিশন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন। কিন্তু এখনো অনেক বাকি। তাদের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হোক। কখন কোন নির্বাচন হবে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা নির্ধারণের ভার নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। সেখানে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের ফাঁক-ফোকর সব বন্ধ করা হোক। তবেই না বুঝব যে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী। ওই সবের বালাই নেই, অথচ আওয়ামী লীগ বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার ফুরিয়ে গেছে, এখন ওটা না থাকলেও চলে। বিএনপি সেটা মানবে কেন?
সুতরাং বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতেই হবে। এমনকি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বেই হতে হবে। বদলানোর কোনো দরকার নেই। কারণ তারা দেখেছে, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেখে যাওয়া ‘অব্যবহিত পূর্বে অবসর গ্রহণকারী’ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই তাদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল। তাহলে সমস্যা কী? আওয়ামী লীগ সরকারের যা অবস্থা। বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, অসহনীয় যানজট—সব মিলিয়ে সরকার তো নাকানিচুবানি খাচ্ছে। তাই তত্ত্বাবধায়কই ভালো। ইতিমধ্যেই তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছে। ২০০১ সালের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন তারা দেখতে শুরু করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯৯৪-৯৬ সালে যেসব রাজনৈতিক যুক্তি দিয়েছিল এবং পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত, অন্তত ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত দিয়েছে, সেগুলো এখন তারা নিজেরাই বাতিল করে দিচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপরিহার্যতার কথা আওয়ামী লীগের মুখে এখন তেমন শোনা যায় না। আর অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চলতে পারে না বলে বিএনপির তাত্ত্বিক বক্তব্যটিও এখন তারা বিসর্জন দিয়ে বসেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার সুবিধাটিই তাদের কাছে বড়। ব্যবস্থাটি না থাকলে এখন আওয়ামী লীগের সুবিধা, থাকলে বিএনপির সুবিধা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দুই দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের দৈন্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অথচ মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। তারা বেশ ভালোভাবেই জানে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছে। মানুষের আস্থার এই জায়গাটা যেন নষ্ট না হয়, সেটা দেখা দরকার। বরং কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে আরও একটু উন্নত করা যায়, সে চেষ্টা করা উচিত। ভবিষ্যতে যেন আবার কোনো এক-এগারো চেপে বসতে না পারে, সে জন্য যতটুকু দরকার তা করা যেতে পারে। যেমন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে, এ রকম বাধ্যবাধকতা আরোপ করা। এবং সেটা যে সম্ভব তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার সেদিন বেশ দৃঢ়ভাবেই বলেছেন। তার পরও যদি কোনো বাস্তব কারণে তিন মাসে করা সম্ভব না হয়, তাহলে আরও না হয় তিন মাস বাড়ানো যায়। কিন্তু এর মধ্যে করতেই হবে। শুধু এটুকু সংশোধনীই যথেষ্ট হওয়া উচিত। কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, ছয় মাসেও যদি করা না যায়, তখন কী হবে? আমরা বলব, এটা কোনো প্রশ্নযোগ্য প্রশ্ন নয়।
যদি পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে এখন আওয়ামী লীগের নজর দিতে হবে বিদ্যুতের সংকট সমাধানের দিকে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ আরেকটি বড় ব্যাপার। দলীয় কোন্দল বন্ধ করতে না পারলে সরকারের ভরাডুবি ঘটানোর জন্য আর কিছুর দরকার হবে না। সরকারের কিছু সুবিধা আছে। যেমন বিশ্বমন্দার মধ্যেও এবং মধ্যপ্রাচ্য ও লিবিয়া থেকে প্রচুর প্রবাসী চাকরিজীবীকে ফিরে আসতে হলেও, দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ মোটামুটি ভালো। এটা সম্ভব হয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায়। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে আমদানির ক্ষেত্রে একটি আইন শিথিল করায় এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেশে পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরির জন্য আমদানি করা উপাদানের (সুতা, কাপড় প্রভৃতি) মূল্য ৭০ শতাংশের বেশি না হলে তা শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দিয়েছে ইইউ। আগে এই সীমারেখা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশ এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন, ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার চেয়ে সস্তায় পোশাক ইউরোপে রপ্তানির সুযোগ পেয়েছে, কারণ ওই দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গণ্য নয়।
আওয়ামী লীগ যদি প্রাপ্ত সুযোগ দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগায়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করা সম্ভব। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া দিতে গেলে নানা প্রশ্ন উঠবে। সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি কীভাবে ও কার স্বার্থে ব্যবহার করছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির কোর্টে গিয়ে আওয়ামী লীগ খেলার চেষ্টা করে কোনো সুফল যে পাবে না, তা বলাই বাহুল্য। যদি সে রকম চেষ্টা করে, মানুষ তা পর্যবেক্ষণ করবে ও নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। অযৌক্তিক কিছুর বিরূপ ফলাফলের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, না, সেটা হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বর্তমান ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। কোনো পরিবর্তন নয়। তা-ই যদি হবে, তাহলে সেই ১৫ বছর আগে কেন তারা একরোখাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিল। আজ তারা যে দাবি করছে, ১৯৯৬ সালে সেটা করলে তো দেশ অনেক সংঘাত থেকে রক্ষা পেত। এখন কি তারা বলবে, ওই সময়ে করি নাই তো কী হয়েছে, এখন যা বলছি, তা-ই হবে?
কোনো ‘দলীয় প্রধান বিচারপতিকে’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হলে জনগণ তা মানবে না বলে বিএনপি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। ন্যায্য কথা। কিন্তু এই কথাটা ছয় বছর আগে কেন তাদের মনে পড়েনি? তাদের আমলে যদি বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো না হতো, তাহলে হয়তো ২০০৭ সালে এসে এক-এগারোর সেই ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধ্যায়ের সূচনা ঘটার সুযোগও থাকত না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে গত ১৫ বছরে দুই দল অবস্থান অদল-বদল করে নিল। আওয়ামী লীগ গেল প্রায় বিএনপির অবস্থানে, আর বিএনপি গেল আওয়ামী লীগের অবস্থানে। দুই দলের এই নাটকীয় অবস্থান পরিবর্তনে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ অনিশ্চিত। তাই ২০০৮ সালে বিপুল আসনে জয়লাভের পর থেকেই আওয়ামী লীগ বলতে শুরু করে, নির্বাচন কমিশন তো যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়েছে, এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দরকার কী? আরে বাবা, নির্বাচন কমিশন যদি এতই স্বাধীন, তাহলে তারা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে পারছে না কেন? কয়েকবার তো উদ্যোগ নিল। কিন্তু তারপর এই আইন, সেই আইন দেখিয়ে তাদের বিরত রাখা হচ্ছে কেন? এটা কি কেউ বোঝে না যে চট্টগ্রামে প্রতাপশালী নেতা ও সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ঢাকায় মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের আশা ক্ষীণ বলেই নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন নাকি খুব স্বাধীন। এমন স্বাধীন যে সরকারের মর্জি না হওয়া পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন করার এখতিয়ারটুকুও নেই।
হ্যাঁ, নির্বাচন কমিশন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন। কিন্তু এখনো অনেক বাকি। তাদের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হোক। কখন কোন নির্বাচন হবে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা নির্ধারণের ভার নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। সেখানে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের ফাঁক-ফোকর সব বন্ধ করা হোক। তবেই না বুঝব যে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী। ওই সবের বালাই নেই, অথচ আওয়ামী লীগ বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার ফুরিয়ে গেছে, এখন ওটা না থাকলেও চলে। বিএনপি সেটা মানবে কেন?
সুতরাং বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতেই হবে। এমনকি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বেই হতে হবে। বদলানোর কোনো দরকার নেই। কারণ তারা দেখেছে, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেখে যাওয়া ‘অব্যবহিত পূর্বে অবসর গ্রহণকারী’ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই তাদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল। তাহলে সমস্যা কী? আওয়ামী লীগ সরকারের যা অবস্থা। বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, অসহনীয় যানজট—সব মিলিয়ে সরকার তো নাকানিচুবানি খাচ্ছে। তাই তত্ত্বাবধায়কই ভালো। ইতিমধ্যেই তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছে। ২০০১ সালের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন তারা দেখতে শুরু করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯৯৪-৯৬ সালে যেসব রাজনৈতিক যুক্তি দিয়েছিল এবং পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত, অন্তত ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত দিয়েছে, সেগুলো এখন তারা নিজেরাই বাতিল করে দিচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপরিহার্যতার কথা আওয়ামী লীগের মুখে এখন তেমন শোনা যায় না। আর অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চলতে পারে না বলে বিএনপির তাত্ত্বিক বক্তব্যটিও এখন তারা বিসর্জন দিয়ে বসেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার সুবিধাটিই তাদের কাছে বড়। ব্যবস্থাটি না থাকলে এখন আওয়ামী লীগের সুবিধা, থাকলে বিএনপির সুবিধা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দুই দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের দৈন্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অথচ মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। তারা বেশ ভালোভাবেই জানে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছে। মানুষের আস্থার এই জায়গাটা যেন নষ্ট না হয়, সেটা দেখা দরকার। বরং কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে আরও একটু উন্নত করা যায়, সে চেষ্টা করা উচিত। ভবিষ্যতে যেন আবার কোনো এক-এগারো চেপে বসতে না পারে, সে জন্য যতটুকু দরকার তা করা যেতে পারে। যেমন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে, এ রকম বাধ্যবাধকতা আরোপ করা। এবং সেটা যে সম্ভব তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার সেদিন বেশ দৃঢ়ভাবেই বলেছেন। তার পরও যদি কোনো বাস্তব কারণে তিন মাসে করা সম্ভব না হয়, তাহলে আরও না হয় তিন মাস বাড়ানো যায়। কিন্তু এর মধ্যে করতেই হবে। শুধু এটুকু সংশোধনীই যথেষ্ট হওয়া উচিত। কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, ছয় মাসেও যদি করা না যায়, তখন কী হবে? আমরা বলব, এটা কোনো প্রশ্নযোগ্য প্রশ্ন নয়।
যদি পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে এখন আওয়ামী লীগের নজর দিতে হবে বিদ্যুতের সংকট সমাধানের দিকে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ আরেকটি বড় ব্যাপার। দলীয় কোন্দল বন্ধ করতে না পারলে সরকারের ভরাডুবি ঘটানোর জন্য আর কিছুর দরকার হবে না। সরকারের কিছু সুবিধা আছে। যেমন বিশ্বমন্দার মধ্যেও এবং মধ্যপ্রাচ্য ও লিবিয়া থেকে প্রচুর প্রবাসী চাকরিজীবীকে ফিরে আসতে হলেও, দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ মোটামুটি ভালো। এটা সম্ভব হয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায়। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে আমদানির ক্ষেত্রে একটি আইন শিথিল করায় এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেশে পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরির জন্য আমদানি করা উপাদানের (সুতা, কাপড় প্রভৃতি) মূল্য ৭০ শতাংশের বেশি না হলে তা শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দিয়েছে ইইউ। আগে এই সীমারেখা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশ এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন, ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার চেয়ে সস্তায় পোশাক ইউরোপে রপ্তানির সুযোগ পেয়েছে, কারণ ওই দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গণ্য নয়।
আওয়ামী লীগ যদি প্রাপ্ত সুযোগ দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগায়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করা সম্ভব। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া দিতে গেলে নানা প্রশ্ন উঠবে। সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি কীভাবে ও কার স্বার্থে ব্যবহার করছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির কোর্টে গিয়ে আওয়ামী লীগ খেলার চেষ্টা করে কোনো সুফল যে পাবে না, তা বলাই বাহুল্য। যদি সে রকম চেষ্টা করে, মানুষ তা পর্যবেক্ষণ করবে ও নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। অযৌক্তিক কিছুর বিরূপ ফলাফলের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments