সহজিয়া কড়চা-সংবিধান সংশোধন—খুউব সাবধান by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যেকোনো ব্যাপারে যে কাউকে উপদেশ ও পরামর্শ দেওয়ায় বাঙালির অরুচি ও আপত্তি নেই। উপযাচক হয়ে উপদেশ দিতেও বাঙালি অদ্বিতীয়। কেউ পরামর্শ চাইলে তো কথাই নেই। পরামর্শ জিনিসটি যদি কোনো বস্তু হতো, তাহলে তাকে তুলনা করা যেত একটি দড়ি বা বাঁশের সঙ্গে—যার এক প্রান্ত যিনি পরামর্শ চাইছেন তিনি, আরেক প্রান্ত যিনি পরামর্শ বা
প্রস্তাব প্রদান করছেন তিনি। পরামর্শ যিনি যাচনা করেন, তিনি তা তাঁরই কাছে করেন, যাঁকে তিনি মনে করেন নির্ভরযোগ্য। পরামর্শদানকারীর উপলব্ধি করা উচিত, তাঁর সুপারিশের ও মতামতের মূল্য আছে বলেই তাঁর কাছে তা চাওয়া হয়েছে। সুতরাং খুবই সতর্কতার সঙ্গে পরামর্শ দেওয়া উচিত, যাতে পরামর্শপ্রত্যাশী কিছুটা হলেও উপকৃত হন এবং পরামর্শ পেয়ে বিভ্রান্ত না হন।
কোনো বাঙালির কাছে কোনো ব্যাপারে মতামত চাইলে তার পোয়াবারো। এক পোয়া পরামর্শ চাইলে, মণ খানেক দিয়ে বসেন। এক ব্যাপারে বুদ্ধি চাইলে দশ ব্যাপারে পরামর্শ দেন। ওই বিষয়ে তাঁর অধিকার আছে কি নেই, তা তিনি ভেবে দেখেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মহাকাশবিজ্ঞানী যদি কোনো বাঙালিকে বলেন, আমরা নভোযান নিয়ে চাঁদে যাচ্ছি, আপনার কোনো পরামর্শ থাকলে দিন। যিনি কোনো কলেজে উইমেন্স স্টাডিজ পড়ান, তিনি বলবেন, চাঁদে তো যাচ্ছেন, ওখানে খানাখন্দ আছে বলে শুনেছি, বিল-বাঁওড় থাকাও সম্ভব। নৌকায় যাতায়াতের প্রয়োজন হতে পারে, খান কয়েক বৈঠা ও লগি নিয়ে যাবেন। স্বল্প পরিসরে নভোযানে লগি-বৈঠার বান্ডিল ধরবে কি না, সে কথা বিবেচনা করার প্রয়োজনও বাঙালি বোধ করে না। তা ছাড়া আদৌ লগি-বৈঠার দরকার আছে কি না, তাও ভেবে দেখে না।
বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। মামুলি সংশোধন নয়—মৌলিক সংশোধন। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকার ও সরকারি দলকেই নিতে হবে। কিন্তু এই গুরুদায়িত্ব তাদের একার কাজ নয়। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দল এবং সংসদের বাইরের বিভিন্ন দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের। প্রধান বিরোধী দলকে সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছে, পরামর্শ ও মতামত চেয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতিদের, সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীণ আইনজীবীদের, বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদের এবং শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকদের। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি-স্থানীয়দের এ পর্যন্ত যে পরিমাণ পরামর্শ জমা হয়েছে, তার সিকি পরিমাণও যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান হয়ে যাবে শাহনামার চেয়ে প্রকাণ্ড এক মহাগ্রন্থ।কোনো বাঙালির কাছে কোনো ব্যাপারে মতামত চাইলে তার পোয়াবারো। এক পোয়া পরামর্শ চাইলে, মণ খানেক দিয়ে বসেন। এক ব্যাপারে বুদ্ধি চাইলে দশ ব্যাপারে পরামর্শ দেন। ওই বিষয়ে তাঁর অধিকার আছে কি নেই, তা তিনি ভেবে দেখেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মহাকাশবিজ্ঞানী যদি কোনো বাঙালিকে বলেন, আমরা নভোযান নিয়ে চাঁদে যাচ্ছি, আপনার কোনো পরামর্শ থাকলে দিন। যিনি কোনো কলেজে উইমেন্স স্টাডিজ পড়ান, তিনি বলবেন, চাঁদে তো যাচ্ছেন, ওখানে খানাখন্দ আছে বলে শুনেছি, বিল-বাঁওড় থাকাও সম্ভব। নৌকায় যাতায়াতের প্রয়োজন হতে পারে, খান কয়েক বৈঠা ও লগি নিয়ে যাবেন। স্বল্প পরিসরে নভোযানে লগি-বৈঠার বান্ডিল ধরবে কি না, সে কথা বিবেচনা করার প্রয়োজনও বাঙালি বোধ করে না। তা ছাড়া আদৌ লগি-বৈঠার দরকার আছে কি না, তাও ভেবে দেখে না।
ভোজের বাড়িতে লুচির সঙ্গে আলুরদমটাই ভালো; পরোটার সঙ্গে ভুনা মাংস বা কাবাবই যথেষ্ট; পোলাওয়ের সঙ্গে কোর্মা, কালিয়া ও খাসির মাংসের রেজালা হলে চমৎকার। দাদখানি, যশোবালাম বা কাটারিভোগ চালের ভাতের সঙ্গে রুই, ভেটকি বা বোয়ালের দোপেঁয়াজা হলেই চলে; চিংড়ির মালাইকারি হলে তো কথাই নেই। কিন্তু লুচি-আলুরদম খেতে বসে যদি কেউ বলেন, পালংশাক কোথায়, নটেশাক ছাড়া খাব না; পোলাও-কোর্মা খেতে বসে কেউ যদি আবদার করেন, পুঁটি ও খলিশা মাছের চচ্চড়ি আনেন, তাহলে সে অনুরোধ রক্ষা করা যেমন গৃহকর্তার পক্ষে কঠিন, তেমনি ভোজনের গোটা পরিবেশই পণ্ড হয়ে যায়। বাহাত্তরে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের চরিত্র অনেকটা কাটারিভোগ চালের ভাত ও রুই-কাতলা-আইড় মাছের দোপেঁয়াজার মতো উপাদেয়, সুপাচ্য ও সিম্পল বা সাদাসিধা খানা। কিন্তু এর মধ্যে সেই ভাতের ভেতরে মেশানো হয়েছে কিছু কাঁকর এবং তরকারিতে পড়ে গেছে এক খাবলা লবণ ও হলুদ-মরিচবাটা। ফলে তা আর তৃপ্তিকর ও রসনারোচক নেই। এখন যা করা দরকার তা হলো, বিদ্যমান সংবিধানের ভেতর থেকে কাঁকরগুলো বেছে ফেলে দেওয়া এবং বাড়তি লবণ ও হলুদ-মরিচ অপসারণের ব্যবস্থা করা। তা না করে যদি আরও কিছু অতিরিক্ত মালমসলা ওতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। তখন তা শুধু বর্তমান বিরোধী দল নয়, অনাগত কোনো জনপ্রিয় দলও গ্রহণ করবে না। আবারও সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং তখন আক্রোশবশত এবারে যোগ করা কোনো কোনো ভালো বিধানও বাদ পড়তে পারে।
বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদেরও মতামতের জন্য ডাকা হয়েছিল। জনা বিশেক বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে আমার মতো অভাজনও ছিল। ওখানে সংবিধান সংশোধনে খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিশেষভাবে যে বিষয়গুলো আলোচনার জন্য নির্ধারণ করা হয়, তা হলো: সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়, বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচার বিভাগ, সংসদের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রোধকল্পে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দলিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির বিষয়। ‘এ বিষয়গুলোসহ সামগ্রিক বিষয়ের ওপর’ও মতামত চাওয়া হয়।
আমি মুখে বলা ছাড়াও সংক্ষেপে লিখিতভাবে কয়েকটি পয়েন্ট দিয়েছি। তাতে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ও ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি’ বর্জন করার পরামর্শ রয়েছে। সব আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি আছে। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৪৫ থেকে আর না বাড়ানোর কথাও আছে।
বাহাত্তরের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের আবেদন করেছি, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়ন ও সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা বিলোপের কথা বলা হয়েছে। ৩৮ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলেছি, যেখানে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যাভিসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ গঠন করার বা তার সদস্য হওয়ার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকবে না। এ ধারাটি গণতন্ত্রের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৭০ অনুচ্ছেদও সংশোধন করা উচিত।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অত্যন্ত জঘন্য রাজনীতি। তা উদার গণতান্ত্রিক আদর্শের শত্রু। তা মানুষে-মানুষে বিভেদের জন্ম দেয়। সংহত জাতি গঠনের পথে তা শক্ত বাধা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পৃথিবীর প্রতিটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রয়েছে। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি তো ইউরোপের দেশে দেশে আছেই, এখন সেসব দেশে খ্রিষ্টান ফ্যাসিবাদী দলের আবির্ভাব ঘটেছে। পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্বও আছে। বর্ণবাদী দলও আছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের জয়জয়কার। শ্রীলঙ্কায় হিন্দু-বৌদ্ধ-মৌলবাদী দল খুবই শক্তিশালী। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় মুসলিম লীগও রয়েছে। সংসদে তাদের প্রতিনিধি রয়েছে। মন্ত্রী পর্যন্ত আছেন। আমরা যত আস্ফাালনই করি না কেন, ভারত ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক হতে পারব না অদূর ভবিষ্যতে।
একটি কথা আমাদের স্মরণ রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং স্বাধীনতার পরও তা নিষিদ্ধই থাকে। তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল বলে নয়—তারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল বলে, পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার দালালি করেছিল বলে, পাকিস্তানিদের বাঙালি নিধনে অর্থাৎ গণহত্যায় সহযোগিতা করেছিল বলে। সেদিন মুসলিম লীগ ও জামায়াত-নেজাম নেতারা মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলে তাদের নিষিদ্ধ করা হতো না। ভারতে ভারতীয় জনতা পার্টির নামের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মের লেশমাত্র নেই, কিন্তু এটি ভয়াবহ হিন্দুত্ববাদী দল। বাংলাদেশেও মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আরোপ করে ঠেকানো যাবে না। উদার প্রগতিশীল রাজনীতি জোরদার হলে সংকীর্ণ ধর্মীয় রাজনীতি হালে পানি পাবে না, তা আপনা-আপনি কোণঠাসা হয়ে যাবে। তা ছাড়া বাস্তবতা হলো, এখনো ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থক বাংলাদেশে পাঁচ-ছয় শতাংশের বেশি নয়, যদিও সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি পর্যাপ্ত।
ইতিমধ্যেই সরকারকে ভূরি ভূরি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে ও বাস্তবায়িত হলে এক সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কেউ বুদ্ধি দিয়েছেন সংসদের আসনসংখ্যা ৬০০ করা হোক। তিন শ পঁয়তাল্লিশেই এলাকার মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, ডবল হলে তারা শ্বাসই ফেলতে পারবে না। তা ছাড়া ৬০০ সদস্য বসবেন কোথায়? লুই আই কানের ওই ধূসর ইমারতে ঠাঁই হবে না। অবশ্য যিনি প্রস্তাব করেছেন, তিনি জানেন, কোরাম না হওয়া দেশে একসঙ্গে শ দুয়েক যে উপস্থিত থাকবেন, সে সম্ভাবনা নেই। আসনসংখ্যা বাড়ালে রাষ্ট্রের যে খরচা বাড়বে, সেই অর্থ কে দেবে? সংসদ সদস্যরা জনগণের উপার্জিত টাকা থেকে বেতন-ভাতা নেন। আসনসংখ্যা ৬০০ বা ১২০০ করলে রাষ্ট্র ফতুর হলেও বিদেশি গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান খুশিতে লাফাবে।
কেউ বুদ্ধি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণও সংবিধানে যুক্ত করতে। তাঁদের যুক্তি, তাতে ইতিহাস বিকৃতি রোধ হবে। যে ভাষণ প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও মাইকে বাজে, যে ভাষণ মানুষের মুখস্থ, সেই ভাষণ একটি বইয়ের মলাটের মধ্যে আবদ্ধ রাখলে কী লাভ? আর ইতিহাস বিকৃতি? ইতিহাসই যদি বিকৃত না করব, তা হলে আমরা বাঙালি কেন? তবে ইতিহাস বিকৃতির জন্য সংবিধানে শাস্তির ব্যবস্থা রাখলে, তার সঙ্গে ইতিহাস বিকৃতির সংজ্ঞাও নির্ধারণ করতে হবে। যেকোনো দিক থেকেই তো ইতিহাস বিকৃত হতে পারে! আমি আমার প্রস্তাবে ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ সংবিধানের শুরুতে রাখার কথা বলেছি। ওতেই ইতিহাসের সব কথা আছে।
সংবিধানের বড় রকম পরিবর্তন একটি রাজনৈতিক ব্যাপার, দলীয় বিষয় নয়। তবে দলীয় নেতারাই তা করে থাকেন। সব দলেরই নিজস্ব নীতি-আদর্শ রয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক আদর্শ অভিন্ন। সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিএনপি-জাতীয় পার্টি স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। সংশোধনের পরে হাওয়া যেদিকে বইবে, তারা সেই দিকে ছুটবে। আমাদের রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ। জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো মানুষের শাসন মানে না। তারা আল্লাহর আইন চায়। অথচ মানুষ ও রাষ্ট্র নিয়েই সংবিধানের কারবার।
সরকার আদালতের রায়কেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করলে পারত। সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের কয়েকজন দ্বিতীয় সারির নেতা বেশি ঘোঁটা দিয়েছেন। বাম নেতাদের কণ্ঠস্বর অতি দরাজ। বিশেষ কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও প্রথম সারির নেতা। মূল সংবিধান আওয়ামী লীগেরই রচনা। কিন্তু জনগণ তা গ্রহণ করেছিল। এখন সংশোধনের দায়িত্বটিও তারাই স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে।
সংবিধান সংশোধন শুধু ভাষাগত কাটাকুটি নয়, চেতনাগত ও নীতিগত রাজনৈতিক বিষয়। সংবিধানের মূল কাঠামোতে হাত দেওয়া যাবে না। কারণ, যে অনুচ্ছেদগুলোকে বলা হয় structural pillars বা মূল কাঠামোগত স্তম্ভ, তা পরিবর্তনযোগ্য নয়। ওগুলোতে হাত দিলে সংবিধান ধসে পড়বে—ভূমিকম্পের পরে একটি বহুতল ভবনের যে দশা হয়।
চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী ছিল মহা ভুল। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে কথিত পরম বন্ধুদের পরামর্শে মুজিব সরকার, জিয়া সরকার ও এরশাদ সরকার সংবিধান পরিবর্তন করেছিল। তার ফল তাদের জন্যই অশুভ হয়েছিল। খেয়ালখুশিমতো পরিবর্তন এনে সামরিক শাসকদের শেষরক্ষা হয়নি। তাঁরা নিজেদের বৈধতা দিতে পারেননি। একই কথা রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জনগণের সমর্থন ছাড়া কস্মিনকালেও বৈধতা আসে না।
বাংলাদেশের মূল রাষ্ট্রদর্শন ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র সব মানুষের। সুতরাং সেখানে কোনো ধর্মীয় শ্লোক উৎকীর্ণ করার প্রয়োজন নেই। ধর্ম মহত্তম বিষয়, সে তার জায়গায় থাক। অবশ্যই ধর্মের নামে রাজনীতি নিরুৎসাহিত করা হোক—নিষিদ্ধ নয়। এসব বিবেচনা করে সংবিধান সংশোধন করুক, তবে খুউব সাবধান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments