নারীর অগ্রগতি-চার দেয়ালের বাইরে অপার বিস্ময় by সালমা খান
নারী নেতারা জানেন তাদের গণ্ডি কতটুকু_ একটু বাইরে গেলেই পুরুষতান্ত্রিক গোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। মন্ত্রণালয়গুলোতেও দেখা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেসব পদ থেকে হয়ে থাকে সেখানে নারীর সংখ্যা সীমিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্রও ভিন্ন নয়। অর্থনীতিতে এ খাতের ভূমিকা বেড়ে চলেছে।
ব্যাংক-বীমা সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু ম্যানেজার পদে ক'জন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে?
মাত্র কয়েকদিন আগেই আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছি। এ উপলক্ষে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অর্জন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধা এবং তা কাটিয়ে ওঠার পথও অনেকে চিহ্নিত করেছেন।
কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ আমার খুব ভালো লেগেছে। যেমন স্কুল পর্যায়ে নারী শিক্ষার প্রসার। গত দুই বছরে ১৩-১৪ লাখ ছাত্রী অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে চলেছে।
শ্রমবাজারে ঘটে যাওয়া একটি পরিবর্তনকেও আমরা গুরুত্ব না দিয়ে পারি না। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে এখন নারীই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সন্দেহ নেই যে, তৈরি পোশাক শিল্প এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। কিন্তু আরও কিছু খাতেও নারী শ্রমিকদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ওষুধ ও ইলেকট্রনিক্স খাতের কথা আমরা বলতে পারি। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নারীর জন্য রয়েছে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ৫০ জন করা হলেও সরাসরি নির্বাচন এখনও চালু হয়নি। কিন্তু স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনে নারী ও পুরুষ সবাই ভোট দিচ্ছে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে রয়েছেন একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান এবং তারাও নারী-পুরুষ সবার ভোটে নির্বাচিত। নারীদের 'পেশা'র ঘর পূরণের সময় সাধারণত লেখা হয় 'গৃহিণী'। কী করেন, জানতে চাইলে অনেকে লাজুকভাবে উত্তর দেন, 'কিছু না।' আরেক দল রয়েছে, যাদের আমরা বলি গৃহকর্মী। অর্থাৎ সব মিলিয়ে নারী ঘরে থাকবে, বাইরে খুব একটা যাবে না। চার দেয়ালে ঘেরা তাদের জীবন। পোশাক শিল্প এ বাধা ভেঙে দিয়েছে। এ খাতে বেশিরভাগ নারী কাজ করছে এবং তারা এসেছে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে। একই সঙ্গে তারা কিন্তু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর জন্যও বাইরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এক সময়ে কিছুসংখ্যক নারীকে রাজপথে কিংবা অফিসে দেখে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজপথে শিক্ষিত মুষ্টিমেয় নারীকে দেখেছি আমরা। সমাজে যে রক্ষণশীলতা, তার প্রভাব থেকে নারীসমাজ সাধারণভাবে মুক্ত ছিল না। কিন্তু এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। নারীর এ অর্জনের জন্য পোশাক খাতের প্রতি আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতা। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত নারীদের এর স্বীকৃতি দিতেই হবে_ তারা যা পারেনি, স্বল্প শিক্ষিত কিংবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত মেয়েরা তার পথ দেখিয়েছে।
জাতিসংঘ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এর পেছনে নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা যে ভূমিকা রেখে চলেছে, সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন 'বাস্কেট কেস', যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তার বিবেচনায় যে দেশের খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত, অবকাঠামো সুবিধা দুর্বল, কোটি কোটি নারী অবরোধবাসিনী_ সে দেশ
কীভাবে এগোবে?
কিন্তু গত চার দশকে আমাদের দেশ 'সম্ভাবনাহীন' অবস্থাই শুধু কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি, অনেক বিশেষজ্ঞ দেশটিকে অভিহিত করছেন উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কেবল দারিদ্র্য দূর করার কিছু প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ না করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগে গুরুত্ব দেওয়ায় তার সুফল মিলতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। খাদ্য অবশ্যই আমাদের চাই। কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য_ এসবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এখনও আছে। তারা ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলায় ভূমিকা রেখেছে, একই সঙ্গে তাকে সচেতন করেছে। ডায়রিয়া হলে শিশুকে ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে এবং সময়মতো টিকা দিতে হবে_ এ ধরনের সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর অবদান ভুলে গেলে চলবে না।
বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় এখনও কম। কিন্তু কেবল এ তত্ত্ব থেকে বাংলাদেশকে বিচার করলে চলবে না। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি। গড় আয়ু বাড়ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অগ্রগতি ঘটছে। জন্মহার কমছে। শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অনেকে বলেন, ইউরোপ যে অর্জনের জন্য ২০০ বছর ব্যয় করেছে, বাংলাদেশ তা করেছে দুই দশকে। এ কথায় অত্যুক্তি রয়েছে বলে মনে হয় না। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন করব, নারী প্রকৃতপক্ষে কী পেল? আমাদের বড় বড় অর্জনের পেছনে নারীর অবদান থাকলেও সমাজে কি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পাল্টাচ্ছে? আমরা চেষ্টা করেও নারী-পুরুষ-ধর্ম নির্বিশেষ অভিন্ন ফ্যামিলি কোড চালু করতে পারছি না। এ জন্য সমাজে জনমত সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু সে কাজে বাধা মিলছে পদে পদে। মুসলিম নারীরা তত্ত্বগতভাবে কিছু অধিকার ভোগ করলেও হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি ও বিবাহ সংক্রান্ত আইনে কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত হয়নি। তারা প্রাচীন আইনে আটকা
পড়ে আছে।
রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। দু'জন নারী দু'বার করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নিজ নিজ দলে তাদের রয়েছে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। কিন্তু তাদের পেছনে রয়েছে যে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী, তারা বেশিরভাগ পুরুষ। শীর্ষ পর্যায়ের নারী নেতারা জানেন তাদের গণ্ডি কতটুকু_ একটু বাইরে গেলেই পুরুষতান্ত্রিক গোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। মন্ত্রণালয়গুলোতেও দেখা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেসব পদ থেকে হয়ে থাকে সেখানে নারীর সংখ্যা সীমিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্রও ভিন্ন নয়। অর্থনীতিতে এ খাতের ভূমিকা বেড়ে চলেছে। ব্যাংক-বীমা সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু ম্যানেজার পদে ক'জন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বাংলাদেশে। কিন্তু সেখানেও নারীর বলিষ্ঠ উপস্থিতি কম। প্রকৃতপক্ষে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর জন্য স্থান করে দেওয়ার উদ্যোগ আমরা
কমই দেখছি।
দেশে নির্বাচন কমিশনসহ কয়েকটি সাংবিধানিক সংস্থা রয়েছে। সরকারের অনেক কমিশন ও কমিটি কাজ করছে। সেখানে নারীর স্থান উল্লেখ করার মতো অবস্থায় নেই। বিচারক-রাষ্ট্রদূতের পদেও একই চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন অর্ধশত ছাড়িয়েছে। কিন্তু উপাচার্য পদে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের জন্য এসব ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগ প্রদান অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক কথায় বলতে চাই, নারীর জন্য পরিধি অনেক বাড়িয়ে দিতে হবে, যাতে তারা সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারে।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে, আইনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষে ভেদ করা চলবে না। কিন্তু বাস্তবতা এই, আইনের আশ্রয় গ্রহণের অধিকার স্বীকৃত হলেও আইনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষে ভিন্নতা প্রকটভাবে লক্ষণীয়। বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার, বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করা প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে অধিকারে অসমতা বিদ্যমান। এক কথায় বলতে পারি, মৌলিক সত্তা নির্ধারণের জায়গাগুলোতে নারী পিছিয়ে রয়েছে। তারা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে পারে না।
বড় ধরনের পরিবর্তন যে রাতারাতি অর্জিত হবে না, সেটা জানি। এখনও তো স্বামীর হাতে স্ত্রীর আঙুল কাটা পড়ে কলেজে পড়তে চাওয়ার অপরাধে। পছন্দের ব্যক্তিকে বিয়ে করার জন্য ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছে বোন। শুধু স্বামী বা ভাই নয়, পরিবার ও সমাজও নারীর অনেক অধিকার মানছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার যে আইনি সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে নারীর জন্য, তা বাস্তবায়নে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলছে সমাজ।
আমরা জানি পরিবার সবকিছুর উৎস। নারীর প্রতি সম্মান দেখানো, তার জন্য যথাযথ স্থান করে দেওয়া, বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি_ এ জন্য সমাজে মূল্যবোধ থাকা চাই এবং তা গড়ে তোলার পেছনে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার থেকে তা ছড়াবে সমাজে এবং তার প্রভাব পড়বে রাষ্ট্রে। এভাবেই তৈরি হবে আইন। মূল্যবোধ হচ্ছে নীতি, আইন ও মানবাধিকারের ভিত্তি। আইন করাই শেষ কথা নয়, বাস্তবে তা প্রয়োগ হতে হবে। আইনে ইভ টিজিং নিষিদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে। যৌতুকের শিকার অনেকেই হয়। পড়তে চাইলে আঙুল কাটা পড়ে।
পরিশেষে আবারও বলব_ চার দশকে দেশের বড় বড় অর্জনের পেছনে নারীর যে বিপুল ভূমিকা ও অবদান তার সুফল তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পাচ্ছে না। পরিবার ও সমাজ থেকে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা যায় না বলেই এমনটি হয়ে থাকে। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই হবে এবং তার ভিত কিন্তু আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে রয়েছে। সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হবে। বাঙালি একটি অভিন্ন সত্তা, যার জন্ম একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে। আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।
সালমা খান : নারী নেত্রী, বিএমডিসির সাবেক মহাপরিচালক এবং সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন
মাত্র কয়েকদিন আগেই আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছি। এ উপলক্ষে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অর্জন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধা এবং তা কাটিয়ে ওঠার পথও অনেকে চিহ্নিত করেছেন।
কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ আমার খুব ভালো লেগেছে। যেমন স্কুল পর্যায়ে নারী শিক্ষার প্রসার। গত দুই বছরে ১৩-১৪ লাখ ছাত্রী অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে চলেছে।
শ্রমবাজারে ঘটে যাওয়া একটি পরিবর্তনকেও আমরা গুরুত্ব না দিয়ে পারি না। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে এখন নারীই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সন্দেহ নেই যে, তৈরি পোশাক শিল্প এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। কিন্তু আরও কিছু খাতেও নারী শ্রমিকদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ওষুধ ও ইলেকট্রনিক্স খাতের কথা আমরা বলতে পারি। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নারীর জন্য রয়েছে এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ৫০ জন করা হলেও সরাসরি নির্বাচন এখনও চালু হয়নি। কিন্তু স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনে নারী ও পুরুষ সবাই ভোট দিচ্ছে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে রয়েছেন একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান এবং তারাও নারী-পুরুষ সবার ভোটে নির্বাচিত। নারীদের 'পেশা'র ঘর পূরণের সময় সাধারণত লেখা হয় 'গৃহিণী'। কী করেন, জানতে চাইলে অনেকে লাজুকভাবে উত্তর দেন, 'কিছু না।' আরেক দল রয়েছে, যাদের আমরা বলি গৃহকর্মী। অর্থাৎ সব মিলিয়ে নারী ঘরে থাকবে, বাইরে খুব একটা যাবে না। চার দেয়ালে ঘেরা তাদের জীবন। পোশাক শিল্প এ বাধা ভেঙে দিয়েছে। এ খাতে বেশিরভাগ নারী কাজ করছে এবং তারা এসেছে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে। একই সঙ্গে তারা কিন্তু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর জন্যও বাইরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এক সময়ে কিছুসংখ্যক নারীকে রাজপথে কিংবা অফিসে দেখে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজপথে শিক্ষিত মুষ্টিমেয় নারীকে দেখেছি আমরা। সমাজে যে রক্ষণশীলতা, তার প্রভাব থেকে নারীসমাজ সাধারণভাবে মুক্ত ছিল না। কিন্তু এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। নারীর এ অর্জনের জন্য পোশাক খাতের প্রতি আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতা। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত নারীদের এর স্বীকৃতি দিতেই হবে_ তারা যা পারেনি, স্বল্প শিক্ষিত কিংবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত মেয়েরা তার পথ দেখিয়েছে।
জাতিসংঘ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এর পেছনে নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা যে ভূমিকা রেখে চলেছে, সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন 'বাস্কেট কেস', যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তার বিবেচনায় যে দেশের খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত, অবকাঠামো সুবিধা দুর্বল, কোটি কোটি নারী অবরোধবাসিনী_ সে দেশ
কীভাবে এগোবে?
কিন্তু গত চার দশকে আমাদের দেশ 'সম্ভাবনাহীন' অবস্থাই শুধু কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি, অনেক বিশেষজ্ঞ দেশটিকে অভিহিত করছেন উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কেবল দারিদ্র্য দূর করার কিছু প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ না করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগে গুরুত্ব দেওয়ায় তার সুফল মিলতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। খাদ্য অবশ্যই আমাদের চাই। কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য_ এসবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এখনও আছে। তারা ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলায় ভূমিকা রেখেছে, একই সঙ্গে তাকে সচেতন করেছে। ডায়রিয়া হলে শিশুকে ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে এবং সময়মতো টিকা দিতে হবে_ এ ধরনের সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর অবদান ভুলে গেলে চলবে না।
বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় এখনও কম। কিন্তু কেবল এ তত্ত্ব থেকে বাংলাদেশকে বিচার করলে চলবে না। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি। গড় আয়ু বাড়ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অগ্রগতি ঘটছে। জন্মহার কমছে। শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অনেকে বলেন, ইউরোপ যে অর্জনের জন্য ২০০ বছর ব্যয় করেছে, বাংলাদেশ তা করেছে দুই দশকে। এ কথায় অত্যুক্তি রয়েছে বলে মনে হয় না। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন করব, নারী প্রকৃতপক্ষে কী পেল? আমাদের বড় বড় অর্জনের পেছনে নারীর অবদান থাকলেও সমাজে কি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পাল্টাচ্ছে? আমরা চেষ্টা করেও নারী-পুরুষ-ধর্ম নির্বিশেষ অভিন্ন ফ্যামিলি কোড চালু করতে পারছি না। এ জন্য সমাজে জনমত সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু সে কাজে বাধা মিলছে পদে পদে। মুসলিম নারীরা তত্ত্বগতভাবে কিছু অধিকার ভোগ করলেও হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি ও বিবাহ সংক্রান্ত আইনে কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত হয়নি। তারা প্রাচীন আইনে আটকা
পড়ে আছে।
রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। দু'জন নারী দু'বার করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নিজ নিজ দলে তাদের রয়েছে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। কিন্তু তাদের পেছনে রয়েছে যে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী, তারা বেশিরভাগ পুরুষ। শীর্ষ পর্যায়ের নারী নেতারা জানেন তাদের গণ্ডি কতটুকু_ একটু বাইরে গেলেই পুরুষতান্ত্রিক গোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। মন্ত্রণালয়গুলোতেও দেখা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেসব পদ থেকে হয়ে থাকে সেখানে নারীর সংখ্যা সীমিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্রও ভিন্ন নয়। অর্থনীতিতে এ খাতের ভূমিকা বেড়ে চলেছে। ব্যাংক-বীমা সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু ম্যানেজার পদে ক'জন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বাংলাদেশে। কিন্তু সেখানেও নারীর বলিষ্ঠ উপস্থিতি কম। প্রকৃতপক্ষে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর জন্য স্থান করে দেওয়ার উদ্যোগ আমরা
কমই দেখছি।
দেশে নির্বাচন কমিশনসহ কয়েকটি সাংবিধানিক সংস্থা রয়েছে। সরকারের অনেক কমিশন ও কমিটি কাজ করছে। সেখানে নারীর স্থান উল্লেখ করার মতো অবস্থায় নেই। বিচারক-রাষ্ট্রদূতের পদেও একই চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন অর্ধশত ছাড়িয়েছে। কিন্তু উপাচার্য পদে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের জন্য এসব ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগ প্রদান অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক কথায় বলতে চাই, নারীর জন্য পরিধি অনেক বাড়িয়ে দিতে হবে, যাতে তারা সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারে।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে, আইনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষে ভেদ করা চলবে না। কিন্তু বাস্তবতা এই, আইনের আশ্রয় গ্রহণের অধিকার স্বীকৃত হলেও আইনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষে ভিন্নতা প্রকটভাবে লক্ষণীয়। বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার, বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করা প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে অধিকারে অসমতা বিদ্যমান। এক কথায় বলতে পারি, মৌলিক সত্তা নির্ধারণের জায়গাগুলোতে নারী পিছিয়ে রয়েছে। তারা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে পারে না।
বড় ধরনের পরিবর্তন যে রাতারাতি অর্জিত হবে না, সেটা জানি। এখনও তো স্বামীর হাতে স্ত্রীর আঙুল কাটা পড়ে কলেজে পড়তে চাওয়ার অপরাধে। পছন্দের ব্যক্তিকে বিয়ে করার জন্য ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছে বোন। শুধু স্বামী বা ভাই নয়, পরিবার ও সমাজও নারীর অনেক অধিকার মানছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার যে আইনি সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে নারীর জন্য, তা বাস্তবায়নে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলছে সমাজ।
আমরা জানি পরিবার সবকিছুর উৎস। নারীর প্রতি সম্মান দেখানো, তার জন্য যথাযথ স্থান করে দেওয়া, বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি_ এ জন্য সমাজে মূল্যবোধ থাকা চাই এবং তা গড়ে তোলার পেছনে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার থেকে তা ছড়াবে সমাজে এবং তার প্রভাব পড়বে রাষ্ট্রে। এভাবেই তৈরি হবে আইন। মূল্যবোধ হচ্ছে নীতি, আইন ও মানবাধিকারের ভিত্তি। আইন করাই শেষ কথা নয়, বাস্তবে তা প্রয়োগ হতে হবে। আইনে ইভ টিজিং নিষিদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে। যৌতুকের শিকার অনেকেই হয়। পড়তে চাইলে আঙুল কাটা পড়ে।
পরিশেষে আবারও বলব_ চার দশকে দেশের বড় বড় অর্জনের পেছনে নারীর যে বিপুল ভূমিকা ও অবদান তার সুফল তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পাচ্ছে না। পরিবার ও সমাজ থেকে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা যায় না বলেই এমনটি হয়ে থাকে। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই হবে এবং তার ভিত কিন্তু আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে রয়েছে। সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হবে। বাঙালি একটি অভিন্ন সত্তা, যার জন্ম একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে। আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।
সালমা খান : নারী নেত্রী, বিএমডিসির সাবেক মহাপরিচালক এবং সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন
No comments