বিশেষ সাক্ষাৎকার-বিশ্ব শ্রমবাজার অভিবাসী শ্রমিকদের পক্ষে আনা সম্ভব by তাসনীম সিদ্দিকী
ড. তাসনীম সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৬৯ সালে, ঢাকায়। ঢাকার হলিক্রস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক সমাপ্ত করে প্রবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন।
ফুলব্রাইট পান যুক্তরাষ্ট্রের কার্বনডেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। এ ছাড়া তিনি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন।
আইএলও, জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ডিসেন্ট ওয়ার্ক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেবার মাইগ্রেশন ফ্রম বাংলাদেশ, মার্চেন্ট অব মাইগ্রেশন, ফিমেল লেবার মাইগ্রেশন অব বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা; ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেবার মাইগ্রেশন অব ওমেন ফ্রম বাংলাদেশ প্রভৃতি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো প্রায় ৩৫ হাজার অভিবাসী লিবিয়া থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য কী করা উচিত?
তাসনীম সিদ্দিকী রামরুর মাধ্যমে পরিচালিত অনলাইন সমীক্ষায় দেখা যায়, লিবিয়াফেরত ৮৫ শতাংশই ঋণ করে গিয়েছিল এবং বড় অংশই এখন ঋণ পরিশোধের চাপে আছে। এখন সবার আগে তাঁদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসন দরকার। এ বিষয়ে আমাদের পর্যালোচনা থেকে চারটি প্রস্তাব উঠে এসেছে: ১. পরবর্তী সময়ে তাঁদের আবার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, ২. স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান করা, ৩. এককালীন বা বিনা সুদে ঋণ দিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং ৪. পুনরায় প্রশিক্ষণ দেওয়া। যেমন—অনেকে হয়তো সেখানে ইমারত নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন; এখন তাঁদের গাড়ি চালানো বা ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ শেখানোর জন্য তিন মাসের প্রশিক্ষণ ও ভাতা দেওয়া যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সরকারকে তহবিল দিতে চায়। তারা চায় শ্রমিকদের এককালীন ৪০ হাজার টাকা দিয়ে দায় মিটিয়ে ফেলতে, বাকি টাকা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) দিয়ে দিতে। এতে হয় টাকাটা খরচ হবে অথবা পাওনাদারেরা নিয়ে যাবে। তাই বলি, এটা ভালো হলো না। টাকা যাতে নষ্ট না হয়ে কাজে লাগে, সে জন্যই ওপরের চারটা উপায়ের প্রস্তাব আমরা করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাংকগুলোসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় টাকা দিতে আগ্রহী। এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনও বলেছে, তারা দায়িত্ব নিতে রাজি। এর জন্য শর্তযুক্ত বিদেশি ঋণ দরকার নেই।
প্রথম আলো লিবিয়া বা তিউনিসিয়ার ঘটনায় দেখা গেল, সরকার সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনায় অনেকটা অপ্রস্তুত। যুদ্ধ বা অশান্তির পটভূমিতে কোনো দেশ থেকে বাংলাদেশিদের জরুরিভাবে ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকারের কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী অভিবাসন পরিচালনার বেলায় জরুরি স্থানান্তর পরিকল্পনা থাকতে হবে। ১৯৮২ সালের অভিবাসন আইনে এ বিষয়ে কোনো কথা ছিল না, সুতরাং এই অপ্রস্তুতি। নতুন যে খসড়া ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ২০১১ করা হয়েছে, তাতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি তহবিলও থাকা চাই। সেই তহবিল প্রবাসীকল্যাণ তহবিল থেকে নয়, সরকারের পকেট থেকে দিতে হবে।
প্রথম আলো অভিবাসন আইন নতুন করে প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। নতুন আইনের সুবিধা বিষয়ে কিছু বলবেন?
তাসনীম সিদ্দিকী আগের আইনটির প্রধান দুর্বলতা ছিল যে তা অধিকারভিত্তিক ছিল না। নতুন আইনটিকে অভিবাসীদের অধিকারভিত্তিক করা হয়েছে। রামরু, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ল কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। ১৯৮২ সালের অভিবাসন অর্ডিন্যান্স যে পটভূমিতে তৈরি হয়েছিল, সেই পটভূমি বদলে গেছে। শ্রমিকদের শোষণ করা বা ঠকানোর ধরনও বদলে গেছে। আগের আইনে দালালদের উল্লেখই ছিল না। অথচ অনেকেই এজেন্সির দালালদের মাধ্যমে বিদেশে যান এবং প্রতারিতও হন। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা অস্বীকার করে। মাঠপর্যায়ে যত রকম প্রতারণা হয়, সেগুলো আমলে নিয়ে দালালদের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই আইনে সাব-এজেন্ট বা দালালদের আইডি নম্বর দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে কে কোথায় কার মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন, সেটা সরাসরি ধরা যাবে, রিক্রুটিং এজেন্সিও তখন আর পার পাবে না। আগের আইনে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ, প্রত্যাবাসিত ব্যক্তিদের সেবাদান, দুর্যোগকালে জরুরি প্রত্যাহার—এসব বিষয়ও ছিল না। আগে বিচার চাইতে হলে বিএমইটিতে (শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরো) যেতে হতো। এতে অনেক ফাঁকির সুযোগ থাকে। বিএমইটি তো শুধু ঢাকায়, এর বাইরে সারা দেশে যে চারটি শ্রম আদালত আছে, গ্রামের দরিদ্র মানুষের পক্ষে কি খুঁজে খুঁজে সেখানে যাওয়া সম্ভব? আবার সেখানে যে সুবিচার পাবেন, তার নিশ্চয়তা কী? নতুন আইন বাস্তবায়িত হলে যেকোনো আদালতেই অভিবাসীরা বিচার চাইতে পারবেন। এটা বিশাল পরিবর্তন। নতুন আইনে নারী অভিবাসীর নিরাপত্তার বিষয়টিও এসেছে।
প্রথম আলো কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কম মজুরিসহ হরেক রকম প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হন। এটা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিকভাবে কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী আন্তর্জাতিক পরিসরে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা বা কোনো দেশে শ্রমবাজার বিস্তারের জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় শ্রমের ক্রেতা দেশ প্রতিশ্রুতি রাখে না। কিন্তু আমরা যদি বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় যাই, শ্রমিক পাঠানো সবগুলো দেশের সরকার যদি একজোট হয়, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। এখন ফিলিপিন ৪০০ ডলারে, ভারত ২৭৫ ডলারে, শ্রীলঙ্কা ২২৫ ডলারে শ্রমিক পাঠায়। অথচ বাংলাদেশ-নেপালের শ্রমিকদের ১০০-১২৫ ডলারের বেশি দিতে চায় না। সার্ক কাঠামোর মধ্যে অথবা আরও বড় আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রম-বিক্রেতা দেশগুলো একজোট হয়ে দর-কষাকষি করলে ক্রেতা দেশগুলো এত সুবিধা নিতে পারত না। এ জন্যই বহুপক্ষীয় কাঠামোয় যাওয়া দরকার। কয়েক বছর ধরে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) ইনিশিয়েটিভে ১৬০টি দেশ অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে শ্রমিক প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী দুই ধরনের দেশই আছে। এখানে সব প্রেরক দেশ একজোট হয়ে চাপ দিতে পারে। সম্প্রতি সরকার অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারসংক্রান্ত ১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক কনভেনশন কোনো শর্ত ছাড়াই অনুমোদন করেছে। এখন এই আইনে দেওয়া অধিকারগুলো জাতীয় সব আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সমন্বিত করতে হবে। যে ৪৫টি দেশ এই আইনে সই করেছে, তাদের সবাই শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ। এদের সবাইকে নিয়ে একটা বৈশ্বিক ফোরাম হওয়া দরকার। কলম্বো প্রসেসে প্রধানমন্ত্রী অভিবাসী শ্রমিক খাতকে থ্রাস্ট সেক্টর বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিল হলো, কলম্বো প্রসেস এখনো আইওএম প্রভাবিত। তাই এখানে রাষ্ট্রগুলোকে মুখ্য হতে হবে, তাহলে আমরা আমাদের কী অধিকার লাগবে, তা তুলতে পারব। এর জন্য আন্তর্জাতিক সচিবালয়ও দরকার। ছয় মাসে পররাষ্ট্র/প্রবাসীমন্ত্রী এবং বছরে একবার সরকারপ্রধানদের বৈঠক হতে হবে। ওপেক গঠন করে যেমন তেল উৎপাদক দেশগুলো তেলের বাজারকে বিক্রেতাদের বাজারে পরিণত করেছে, তেমনি আমরা একজোট হলে শ্রমের বাজারকেও বিক্রেতাদের বাজারে পরিণত করতে পারব। অর্থাৎ, শ্রম যিনি বেচবেন, বাজার থাকবে তাঁর অনুকূলে।
প্রথম আলো এই আন্তর্জাতিক সমঝোতা তৈরির দায়িত্বটি কার—শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, নাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের?
তাসনীম সিদ্দিকী বর্তমানে জিএফএমডির বৈঠকের সব চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেষ দিন পর্যন্ত চিঠি ধরে রেখেছিল। জেনেভায় নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী কমিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে এটি করে। সময়ের অভাবে, আগে না জানানোয় আমরা সেখানে গিয়ে চাপ দিতে পারিনি। অথচ আগে জানলে আমরা প্রস্তুত হতে পারতাম। অনেক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যাঁরা যান, বিশেষজ্ঞ না হওয়ার কারণে তাঁরা যথেষ্ট দর-কষাকষি করতে পারেন না। অথচ প্রবাসী শ্রমিকবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী প্রতিনিধি জেনেভায় থাকা আবশ্যক। অন্যদিকে জাতিসংঘের নয়টি সংস্থা মিলে গ্লোবাল মাইগ্রেশন গ্রুপ গঠিত হয়েছে, সেখানেও প্রতিনিধিত্ব করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমরা মনে করি, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করা জরুরি। সেখান থেকে অভিবাসী বিষয়ে সব প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগ দেওয়া যাবে। এ জন্য সমগ্র রেমিট্যান্সের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাজেটে দেওয়ার প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। অপ্রশিক্ষিত লোক দিয়ে বাজার বিস্তার কিংবা অধিকার রক্ষা, কোনোটাই ভালো হওয়ার নয়। লোকবল সৃষ্টি এবং তার ব্যবহার যথাযথ হলে বৈশ্বিক ফোরামে আমাদের অবস্থানও শক্ত হবে। আমাদের জিডিপির ১৩ শতাংশ আসে প্রবাসী শ্রমিকদের থেকে। গত ১০ বছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। সুতরাং একে অবহেলা করা মোটেই ন্যায়সংগত হবে না।
প্রথম আলো অনেকের ধারণা, বিদেশিরা দয়া করে আমাদের শ্রমিকদের কাজ দেন। এই ধারণার সত্যতা কতটুকু?
তাসনীম সিদ্দিকী বাংলাদেশ শ্রম-উদ্বৃত্ত দেশ। অন্যদিকে বিশ্বজুড়েই চলছে বিরাট আকারের শ্রমের ঘাটতি। পরিস্থিতি হলো, আমাদের অসংখ্য মানুষ রয়েছে এবং বিশ্বে রয়েছে প্রচুর কাজ। এটা আমাদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা। কিন্তু বিশ্ববাজার পরিণত হয়েছে শ্রমের ক্রেতাদের বাজার হিসেবে। অথচ আশির দশকেও এই বাজার ছিল শ্রম বিক্রেতাদের বাজার। তখন মধ্যপ্রাচ্যের নিয়োগকারীরা শ্রমিকের বেতন, প্লেনের খরচ ইত্যাদি এবং রিক্রুটিং এজেন্সিকে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে নিজ গরজে লোক নিত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হলো যে, কে কত কমে লোক দিতে পারে। ফলে নিয়োগকর্তারা সুযোগ পেয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল ভিসা বিক্রির ব্যবসা। এখানে সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্রেতাদের বাজারকে আবার বিক্রেতাদের বাজারে বদলে দিতে হলে ওপেক বা ইইউর মতো জোট দরকার। তাদের শ্রমিক নিতেই হবে। আমরা একজোট হলে যেখানে সবাই ৪০০ ডলারেই শ্রমিক পাঠাতে পারব, সেখানে কেন ১০০ ডলারে পাঠাব?
প্রথম আলো সরকার প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যাংকের দেওয়া ঋণের অপব্যবহার ঠেকাতে কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী প্রথমত এমন নীতি তৈরি করতে হবে, যাতে ঋণের রাজনৈতিক বণ্টন কঠিন হয়ে যায়। বর্তমানে তিনটি ব্যাংক বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ঋণ দিচ্ছে, কিন্তু তারা ঋণ নেওয়ার লোক খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ লোকজন চড়া সুদে ধারদেনা করে বিদেশে যাচ্ছেন। তার মানে ব্যাংকগুলো সত্যিকার গ্রাহকদের পাচ্ছে না। গ্রাহকেরাও তাদের পায় না। এখানে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাংক-এনজিও অংশীদার গড়ে তুলতে হবে। ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে, এর ২ শতাংশ পাবে প্রবাসীদের নিয়ে কর্মরত এনজিওগুলো। তাহলে এই এনজিওগুলোকে আর বিদেশি ডোনারনির্ভর থাকতে হবে না। এনজিওরা আগে কেবল গভর্ন্যান্স দিত, কিন্তু ব্যাংক-এনজিও অংশীদার হলে তারা তৃণমূল পর্যায়ে সেবা প্রদানকারী হিসেবে বদলে যাবে। এনজিওগুলোর কাজ হবে গ্রামে গ্রামে অভিবাসী অধিকার রক্ষা দল গঠন করা। এর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে ঋণের জন্য সুপারিশও যেমন করবে, তেমনি ঋণের জামিনদারও হবে। তারা হবে ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের কর্মী। ভুল লোকের কাছে ঋণ চলে গেলে বা ঋণ আদায় না হলে তার দায় তারাও নেবে। এভাবে এনজিওর সুবিধাবাদ এবং ডোনার-নির্ভরতা কমে তা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
প্রথম আলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও অনেকে অভিবাসী হচ্ছেন বা হবেন। এখান থেকেই জলবায়ু-শরণার্থী এবং তাঁদের অধিকারের কথাটা আসছে। আন্তর্জাতিক আইনে এটা স্বীকৃত না হলে বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। এ বিষয়ে আপনার সুপারিশ কী?
তাসনীম সিদ্দিকী সরকার ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জলবায়ুর কারণে অভিবাসনের সম্ভাবনাকে আন্তর্জাতিক স্তরে একটা হুমকি বা আতঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে দেখিয়ে টাকা আনা হচ্ছে। এটা অভিবাসীর মানবাধিকার-পরিপন্থী। অভিবাসীরা পরিস্থিতির শিকার, তাঁদের জীবিকা বদলের সুযোগ দেওয়া সবারই কর্তব্য। অভিবাসন তাঁকে সেই সুযোগ করে দিতে পারে। এটা তাঁর অধিকার এবং তাঁকে এই সুযোগ দিতে হবে। এ জন্যই আমরা বলছি, দুর্গত এলাকা থেকে বেশি করে অভিবাসী রিক্রুট করুন। কেবল মধ্যপ্রাচ্যে বা মালয়েশিয়ায় নয়, গরিবদের ইউরোপ-আমেরিকাতেও পাঠান। জায়গায় জায়গায় সুযোগ সৃষ্টি করুন। পশ্চিমা সমাজে যেসব নিম্ন দক্ষতার শ্রমের ঘাটতি আছে, তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েই আমাদের মানুষদের আমরা সেসব কাজের জন্য উপযোগী করে পাঠাতে পারি। একটি গবেষণায় দেখিয়েছি, অভিবাসন যেখানে, উন্নয়নও সেখানে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
তাসনীম সিদ্দিকী ধন্যবাদ।
আইএলও, জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ডিসেন্ট ওয়ার্ক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেবার মাইগ্রেশন ফ্রম বাংলাদেশ, মার্চেন্ট অব মাইগ্রেশন, ফিমেল লেবার মাইগ্রেশন অব বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা; ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেবার মাইগ্রেশন অব ওমেন ফ্রম বাংলাদেশ প্রভৃতি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো প্রায় ৩৫ হাজার অভিবাসী লিবিয়া থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য কী করা উচিত?
তাসনীম সিদ্দিকী রামরুর মাধ্যমে পরিচালিত অনলাইন সমীক্ষায় দেখা যায়, লিবিয়াফেরত ৮৫ শতাংশই ঋণ করে গিয়েছিল এবং বড় অংশই এখন ঋণ পরিশোধের চাপে আছে। এখন সবার আগে তাঁদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসন দরকার। এ বিষয়ে আমাদের পর্যালোচনা থেকে চারটি প্রস্তাব উঠে এসেছে: ১. পরবর্তী সময়ে তাঁদের আবার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, ২. স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান করা, ৩. এককালীন বা বিনা সুদে ঋণ দিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং ৪. পুনরায় প্রশিক্ষণ দেওয়া। যেমন—অনেকে হয়তো সেখানে ইমারত নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন; এখন তাঁদের গাড়ি চালানো বা ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ শেখানোর জন্য তিন মাসের প্রশিক্ষণ ও ভাতা দেওয়া যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সরকারকে তহবিল দিতে চায়। তারা চায় শ্রমিকদের এককালীন ৪০ হাজার টাকা দিয়ে দায় মিটিয়ে ফেলতে, বাকি টাকা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) দিয়ে দিতে। এতে হয় টাকাটা খরচ হবে অথবা পাওনাদারেরা নিয়ে যাবে। তাই বলি, এটা ভালো হলো না। টাকা যাতে নষ্ট না হয়ে কাজে লাগে, সে জন্যই ওপরের চারটা উপায়ের প্রস্তাব আমরা করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাংকগুলোসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় টাকা দিতে আগ্রহী। এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনও বলেছে, তারা দায়িত্ব নিতে রাজি। এর জন্য শর্তযুক্ত বিদেশি ঋণ দরকার নেই।
প্রথম আলো লিবিয়া বা তিউনিসিয়ার ঘটনায় দেখা গেল, সরকার সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনায় অনেকটা অপ্রস্তুত। যুদ্ধ বা অশান্তির পটভূমিতে কোনো দেশ থেকে বাংলাদেশিদের জরুরিভাবে ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকারের কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী অভিবাসন পরিচালনার বেলায় জরুরি স্থানান্তর পরিকল্পনা থাকতে হবে। ১৯৮২ সালের অভিবাসন আইনে এ বিষয়ে কোনো কথা ছিল না, সুতরাং এই অপ্রস্তুতি। নতুন যে খসড়া ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ২০১১ করা হয়েছে, তাতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি তহবিলও থাকা চাই। সেই তহবিল প্রবাসীকল্যাণ তহবিল থেকে নয়, সরকারের পকেট থেকে দিতে হবে।
প্রথম আলো অভিবাসন আইন নতুন করে প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। নতুন আইনের সুবিধা বিষয়ে কিছু বলবেন?
তাসনীম সিদ্দিকী আগের আইনটির প্রধান দুর্বলতা ছিল যে তা অধিকারভিত্তিক ছিল না। নতুন আইনটিকে অভিবাসীদের অধিকারভিত্তিক করা হয়েছে। রামরু, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ল কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। ১৯৮২ সালের অভিবাসন অর্ডিন্যান্স যে পটভূমিতে তৈরি হয়েছিল, সেই পটভূমি বদলে গেছে। শ্রমিকদের শোষণ করা বা ঠকানোর ধরনও বদলে গেছে। আগের আইনে দালালদের উল্লেখই ছিল না। অথচ অনেকেই এজেন্সির দালালদের মাধ্যমে বিদেশে যান এবং প্রতারিতও হন। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা অস্বীকার করে। মাঠপর্যায়ে যত রকম প্রতারণা হয়, সেগুলো আমলে নিয়ে দালালদের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই আইনে সাব-এজেন্ট বা দালালদের আইডি নম্বর দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে কে কোথায় কার মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন, সেটা সরাসরি ধরা যাবে, রিক্রুটিং এজেন্সিও তখন আর পার পাবে না। আগের আইনে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ, প্রত্যাবাসিত ব্যক্তিদের সেবাদান, দুর্যোগকালে জরুরি প্রত্যাহার—এসব বিষয়ও ছিল না। আগে বিচার চাইতে হলে বিএমইটিতে (শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরো) যেতে হতো। এতে অনেক ফাঁকির সুযোগ থাকে। বিএমইটি তো শুধু ঢাকায়, এর বাইরে সারা দেশে যে চারটি শ্রম আদালত আছে, গ্রামের দরিদ্র মানুষের পক্ষে কি খুঁজে খুঁজে সেখানে যাওয়া সম্ভব? আবার সেখানে যে সুবিচার পাবেন, তার নিশ্চয়তা কী? নতুন আইন বাস্তবায়িত হলে যেকোনো আদালতেই অভিবাসীরা বিচার চাইতে পারবেন। এটা বিশাল পরিবর্তন। নতুন আইনে নারী অভিবাসীর নিরাপত্তার বিষয়টিও এসেছে।
প্রথম আলো কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কম মজুরিসহ হরেক রকম প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হন। এটা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিকভাবে কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী আন্তর্জাতিক পরিসরে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা বা কোনো দেশে শ্রমবাজার বিস্তারের জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় শ্রমের ক্রেতা দেশ প্রতিশ্রুতি রাখে না। কিন্তু আমরা যদি বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় যাই, শ্রমিক পাঠানো সবগুলো দেশের সরকার যদি একজোট হয়, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। এখন ফিলিপিন ৪০০ ডলারে, ভারত ২৭৫ ডলারে, শ্রীলঙ্কা ২২৫ ডলারে শ্রমিক পাঠায়। অথচ বাংলাদেশ-নেপালের শ্রমিকদের ১০০-১২৫ ডলারের বেশি দিতে চায় না। সার্ক কাঠামোর মধ্যে অথবা আরও বড় আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রম-বিক্রেতা দেশগুলো একজোট হয়ে দর-কষাকষি করলে ক্রেতা দেশগুলো এত সুবিধা নিতে পারত না। এ জন্যই বহুপক্ষীয় কাঠামোয় যাওয়া দরকার। কয়েক বছর ধরে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) ইনিশিয়েটিভে ১৬০টি দেশ অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে শ্রমিক প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী দুই ধরনের দেশই আছে। এখানে সব প্রেরক দেশ একজোট হয়ে চাপ দিতে পারে। সম্প্রতি সরকার অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারসংক্রান্ত ১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক কনভেনশন কোনো শর্ত ছাড়াই অনুমোদন করেছে। এখন এই আইনে দেওয়া অধিকারগুলো জাতীয় সব আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সমন্বিত করতে হবে। যে ৪৫টি দেশ এই আইনে সই করেছে, তাদের সবাই শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ। এদের সবাইকে নিয়ে একটা বৈশ্বিক ফোরাম হওয়া দরকার। কলম্বো প্রসেসে প্রধানমন্ত্রী অভিবাসী শ্রমিক খাতকে থ্রাস্ট সেক্টর বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিল হলো, কলম্বো প্রসেস এখনো আইওএম প্রভাবিত। তাই এখানে রাষ্ট্রগুলোকে মুখ্য হতে হবে, তাহলে আমরা আমাদের কী অধিকার লাগবে, তা তুলতে পারব। এর জন্য আন্তর্জাতিক সচিবালয়ও দরকার। ছয় মাসে পররাষ্ট্র/প্রবাসীমন্ত্রী এবং বছরে একবার সরকারপ্রধানদের বৈঠক হতে হবে। ওপেক গঠন করে যেমন তেল উৎপাদক দেশগুলো তেলের বাজারকে বিক্রেতাদের বাজারে পরিণত করেছে, তেমনি আমরা একজোট হলে শ্রমের বাজারকেও বিক্রেতাদের বাজারে পরিণত করতে পারব। অর্থাৎ, শ্রম যিনি বেচবেন, বাজার থাকবে তাঁর অনুকূলে।
প্রথম আলো এই আন্তর্জাতিক সমঝোতা তৈরির দায়িত্বটি কার—শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, নাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের?
তাসনীম সিদ্দিকী বর্তমানে জিএফএমডির বৈঠকের সব চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেষ দিন পর্যন্ত চিঠি ধরে রেখেছিল। জেনেভায় নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী কমিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে এটি করে। সময়ের অভাবে, আগে না জানানোয় আমরা সেখানে গিয়ে চাপ দিতে পারিনি। অথচ আগে জানলে আমরা প্রস্তুত হতে পারতাম। অনেক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যাঁরা যান, বিশেষজ্ঞ না হওয়ার কারণে তাঁরা যথেষ্ট দর-কষাকষি করতে পারেন না। অথচ প্রবাসী শ্রমিকবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী প্রতিনিধি জেনেভায় থাকা আবশ্যক। অন্যদিকে জাতিসংঘের নয়টি সংস্থা মিলে গ্লোবাল মাইগ্রেশন গ্রুপ গঠিত হয়েছে, সেখানেও প্রতিনিধিত্ব করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমরা মনে করি, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করা জরুরি। সেখান থেকে অভিবাসী বিষয়ে সব প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগ দেওয়া যাবে। এ জন্য সমগ্র রেমিট্যান্সের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাজেটে দেওয়ার প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। অপ্রশিক্ষিত লোক দিয়ে বাজার বিস্তার কিংবা অধিকার রক্ষা, কোনোটাই ভালো হওয়ার নয়। লোকবল সৃষ্টি এবং তার ব্যবহার যথাযথ হলে বৈশ্বিক ফোরামে আমাদের অবস্থানও শক্ত হবে। আমাদের জিডিপির ১৩ শতাংশ আসে প্রবাসী শ্রমিকদের থেকে। গত ১০ বছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। সুতরাং একে অবহেলা করা মোটেই ন্যায়সংগত হবে না।
প্রথম আলো অনেকের ধারণা, বিদেশিরা দয়া করে আমাদের শ্রমিকদের কাজ দেন। এই ধারণার সত্যতা কতটুকু?
তাসনীম সিদ্দিকী বাংলাদেশ শ্রম-উদ্বৃত্ত দেশ। অন্যদিকে বিশ্বজুড়েই চলছে বিরাট আকারের শ্রমের ঘাটতি। পরিস্থিতি হলো, আমাদের অসংখ্য মানুষ রয়েছে এবং বিশ্বে রয়েছে প্রচুর কাজ। এটা আমাদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা। কিন্তু বিশ্ববাজার পরিণত হয়েছে শ্রমের ক্রেতাদের বাজার হিসেবে। অথচ আশির দশকেও এই বাজার ছিল শ্রম বিক্রেতাদের বাজার। তখন মধ্যপ্রাচ্যের নিয়োগকারীরা শ্রমিকের বেতন, প্লেনের খরচ ইত্যাদি এবং রিক্রুটিং এজেন্সিকে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে নিজ গরজে লোক নিত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হলো যে, কে কত কমে লোক দিতে পারে। ফলে নিয়োগকর্তারা সুযোগ পেয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল ভিসা বিক্রির ব্যবসা। এখানে সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্রেতাদের বাজারকে আবার বিক্রেতাদের বাজারে বদলে দিতে হলে ওপেক বা ইইউর মতো জোট দরকার। তাদের শ্রমিক নিতেই হবে। আমরা একজোট হলে যেখানে সবাই ৪০০ ডলারেই শ্রমিক পাঠাতে পারব, সেখানে কেন ১০০ ডলারে পাঠাব?
প্রথম আলো সরকার প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যাংকের দেওয়া ঋণের অপব্যবহার ঠেকাতে কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী প্রথমত এমন নীতি তৈরি করতে হবে, যাতে ঋণের রাজনৈতিক বণ্টন কঠিন হয়ে যায়। বর্তমানে তিনটি ব্যাংক বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ঋণ দিচ্ছে, কিন্তু তারা ঋণ নেওয়ার লোক খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ লোকজন চড়া সুদে ধারদেনা করে বিদেশে যাচ্ছেন। তার মানে ব্যাংকগুলো সত্যিকার গ্রাহকদের পাচ্ছে না। গ্রাহকেরাও তাদের পায় না। এখানে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাংক-এনজিও অংশীদার গড়ে তুলতে হবে। ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে, এর ২ শতাংশ পাবে প্রবাসীদের নিয়ে কর্মরত এনজিওগুলো। তাহলে এই এনজিওগুলোকে আর বিদেশি ডোনারনির্ভর থাকতে হবে না। এনজিওরা আগে কেবল গভর্ন্যান্স দিত, কিন্তু ব্যাংক-এনজিও অংশীদার হলে তারা তৃণমূল পর্যায়ে সেবা প্রদানকারী হিসেবে বদলে যাবে। এনজিওগুলোর কাজ হবে গ্রামে গ্রামে অভিবাসী অধিকার রক্ষা দল গঠন করা। এর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে ঋণের জন্য সুপারিশও যেমন করবে, তেমনি ঋণের জামিনদারও হবে। তারা হবে ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের কর্মী। ভুল লোকের কাছে ঋণ চলে গেলে বা ঋণ আদায় না হলে তার দায় তারাও নেবে। এভাবে এনজিওর সুবিধাবাদ এবং ডোনার-নির্ভরতা কমে তা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
প্রথম আলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও অনেকে অভিবাসী হচ্ছেন বা হবেন। এখান থেকেই জলবায়ু-শরণার্থী এবং তাঁদের অধিকারের কথাটা আসছে। আন্তর্জাতিক আইনে এটা স্বীকৃত না হলে বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। এ বিষয়ে আপনার সুপারিশ কী?
তাসনীম সিদ্দিকী সরকার ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জলবায়ুর কারণে অভিবাসনের সম্ভাবনাকে আন্তর্জাতিক স্তরে একটা হুমকি বা আতঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে দেখিয়ে টাকা আনা হচ্ছে। এটা অভিবাসীর মানবাধিকার-পরিপন্থী। অভিবাসীরা পরিস্থিতির শিকার, তাঁদের জীবিকা বদলের সুযোগ দেওয়া সবারই কর্তব্য। অভিবাসন তাঁকে সেই সুযোগ করে দিতে পারে। এটা তাঁর অধিকার এবং তাঁকে এই সুযোগ দিতে হবে। এ জন্যই আমরা বলছি, দুর্গত এলাকা থেকে বেশি করে অভিবাসী রিক্রুট করুন। কেবল মধ্যপ্রাচ্যে বা মালয়েশিয়ায় নয়, গরিবদের ইউরোপ-আমেরিকাতেও পাঠান। জায়গায় জায়গায় সুযোগ সৃষ্টি করুন। পশ্চিমা সমাজে যেসব নিম্ন দক্ষতার শ্রমের ঘাটতি আছে, তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েই আমাদের মানুষদের আমরা সেসব কাজের জন্য উপযোগী করে পাঠাতে পারি। একটি গবেষণায় দেখিয়েছি, অভিবাসন যেখানে, উন্নয়নও সেখানে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
তাসনীম সিদ্দিকী ধন্যবাদ।
No comments