সরল গরল-পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন থেকে শিক্ষা by মিজানুর রহমান খান
যে কবিতা শুনতে জানে না, সে মানুষ খুন করতে পারে। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো কবিতা পছন্দ করেন। তিনি কীভাবে নন্দীগ্রামে মানুষ খুনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রশ্ন রেখেছিলাম বুদ্ধদেব-বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। সুনীল বললেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে বুদ্ধদেব নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মূলত নন্দীগ্রাম থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বাম বিদায়ের দামামা বাজে। পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করে। সেই বাতাস নির্বাচনী প্রচারণায় নানা মাত্রা নিলেও তার জোর ও জেরে জেরবার বামরা।
বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। তারাই ভারতের একমাত্র বামশাসিত রাজ্য নয়। কেরালা ও ত্রিপুরায় বামরা সরকার করতে পারে। কিন্তু টানা তিন দশকের অভিজ্ঞতা শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই। সে কারণেই প্রায় সব মহল থেকে একটা অভিন্ন আওয়াজ উঠেছে, ‘পরিবর্তন চাই। একদলীয় শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে। এটা চলতে পারে না।’
তৃণমূলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম ১০০ দিনে কী করা হবে, প্রথম ১০০০ দিনে কী করা হবে তার নির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে। তবে সেসব কথা তৃণমূল বা কংগ্রেস তাদের জনসভাগুলোতে বলে না। বামদের ব্যর্থতা তুলে ধরাসহ কুৎসা ও নিন্দাই প্রকট। নিজেরা এলে কী করবে, তার নির্দিষ্ট কোনো চিত্র ভাষণে থাকে না।
বামফ্রন্টের জনসভা ও সংবাদ সম্মেলনগুলোতেও দেখি নির্বাচনী ইশতেহার ধরে নির্দিষ্ট বক্তব্য ছিটেফোঁটা। বিরোধীদের নিন্দা ও গালমন্দই প্রকট। বামদের প্রস্তাবিত বড় ধরনের সংস্কার সেখানে নেই। তাদের শুদ্ধীকরণের স্বরূপ বোঝা যায় না। আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব বলছেন, এবার সরকারে গিয়ে তাঁরা না শোধরালে দলই টিকবে না। ভেঙে যাবে। কিন্তু তাঁরা কী করবেন এবং এখন তা করা থেকে কেন বিরত, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বরং নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁরা যেটা বলতে পছন্দ করছেন সেটা হলো, তাঁরা ক্ষমতায় এলে দরিদ্র মানুষকে রেশন দেবেন। দুই টাকা কেজি দরে চাল দেবেন। বিরোধীরা বলছেন, এটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসূচি। তাঁরা কেন কৃতিত্ব নিচ্ছেন। তবে বুদ্ধদেব স্পষ্ট করেছেন, চালের সঙ্গে আরও দু-তিনটি বিষয় কম দামে দেওয়া হবে। শুনে মনে হয়, এটা প্রলুব্ধকরণ।
সোনিয়ার কংগ্রেস মমতাকে জয়যুক্ত করতে সম্ভবত অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় মরিয়া। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারণায় ভীষণ সক্রিয়। তৃতীয় পর্যায়ের ভোটের আগ মুহূর্তে দিল্লি থেকে কলকাতায় উড়ে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। বলেন, পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি পুরো ভারতের মধ্যে নিকৃষ্ট। তিনি অবশ্য অন্যান্য রাজ্যের কী অবস্থা, তার তথ্য প্রকাশ করেননি।
সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিং, প্রণব মুখার্জি, পি চিদাম্বরম প্রমুখ এক সুরে বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস জোটকে জয়যুক্ত করুন। তাঁদের কথাবার্তায়ও ভোটারদের লোভ দেখানোর মতো একটা অভিব্যক্তি স্পষ্ট। লুকোছাপা সামান্যই।
পশ্চিমবঙ্গে এসে মুসলিম কার্ড খেললেন মনমোহনও। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে মমতার সখ্য সুবিদিত। বিজেপির সঙ্গে মন্ত্রিত্বও করেছেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন বলছেন, তৃণমূলের বিজয়ের কেতনে তিনি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের স্বাদ পাচ্ছেন। আর মনমোহন এসে বললেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা গুজরাটের মুসলমানদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। তিনি লিখিত বক্তব্যে এই মন্তব্য করেন।
বামদের জন্য দুটো বাণ। একটি নন্দীগ্রাম, অন্যটি সাচার কমিটির রিপোর্ট। বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্ট বামদের বেশ বিব্রত করে। কারণ, ওই রিপোর্টে দেখানো হয়, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা ভীষণ কষ্টে আছে, পিছিয়ে আছে। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, মাদ্রাসাগুলোই জঙ্গিদের আখড়া। এ কথা তিনি পরে ভুলতে সচেষ্ট হন। নতুন করে মাদ্রাসা স্থাপন ও তার আধুনিকায়নে তিনি মনোযোগী হন।
২০০৫ সালে মনোমোহন বলেছিলেন, বুদ্ধদেব ভারতের শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। অবশ্য তাঁর আগে বুদ্ধদেবকে ওই অভিধায় অভিষিক্ত করেছিলেন শীর্ষ ধনকুবের আজিম হাশিম প্রেমজি। শিল্পপতি পুর্ণেন্দু চ্যাটার্জি ও রতন টাটারাও তা-ই মনে করেন। একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক আমাকে বলেন, ‘এতে নীতি-নৈতিকতা খুঁজবেন না। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা বলেছিলেন। কেন্দ্রে তখন বামদের সমর্থন দরকার ছিল।’ মনমোহন বলেছিলেন, ‘আমি ওঁর (বুদ্ধদেব) ভীষণ অনুরাগী। তাঁর মস্তিষ্ক ও হূদয়ের ছোঁয়ায় আমি বিমোহিত। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রতি তাঁর রয়েছে অসাধারণ অঙ্গীকার। তাঁর মতো স্বপ্নদ্রষ্টা ও সাহসী নেতৃত্বই ভারতের প্রয়োজন। আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি সম্যক ওয়াকিবহাল।’
২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী কার্যত বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনায় সোনিয়া গান্ধীর ‘দেউলিয়া’ রাজ্যের অভিমতই পুনর্ব্যক্ত করেন। বামফ্রন্ট অকর্মা। তার আর দরকার নেই। মনমোহনের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি। সাক্ষরতায় ১৮তম অবস্থানে থাকা রাজ্য আরও দুই ধাপ নিচে নেমেছে। মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের চেয়েও তারা নিচে নেমেছে।’ অবশ্য সম্প্রতি মনমোহন নিজ হাতেই পশ্চিমবঙ্গকে একটি সাফল্যের জন্য পুরস্কৃত করেন।
বামবিরোধী হাওয়া বেশ জোরেই বইছিল। কিন্তু মাস দুয়েক হলো, সেটা কিছুটা ভিন্ন দিকে বইতে শুরু করে। আনন্দবাজার পত্রিকাসহ এ পর্যন্ত যতগুলো জনমত জরিপ হয়েছে, তার সব কটিতেই বামফ্রন্টের শাসন আমলের প্রায় ভরাডুবির ইঙ্গিত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও একই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
কলকাতার গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ অব্যাহতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য কামনা করছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার হাসিম আবদুল হালিম মিডিয়ার ভূমিকায় ভীষণ ক্ষুব্ধ বললেও কম বলা হয়। বললাম, প্রেস তো ফোর্থ এস্টেট। স্পিকার বলেন, ‘ফোর্থ এস্টেট না ছাই। থার্ড গ্রেড! জ্যোতি বাবুরও সেই মত ছিল। ওরা চিরকাল বামদের পতন কামনা করেছে।’ কিন্তু কেন? স্পিকারের চাঁচাছোলা উক্তি, ‘পুঁজিবাদের ভাইরাস। আমেরিকার ভূতে ধরেছে।’
বামফ্রন্টের মধ্যেও কেউ কেউ বলেন, তাঁদের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। এমনকি সাবেক অর্থমন্ত্রী বর্ষীয়ান বাম নেতার কথায়, জমিদারি মেজাজে পেয়েছে। উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত। সুশীল সমাজের প্রভাবশালীরাও তা মানেন। বলেন, ‘৩৪ বছর সরকারে থেকে তাঁদের মধ্যে আত্মঅহমিকা ও ঔদ্ধত্যের জন্ম হয়েছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। লক্ষ করলাম, বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বামফ্রন্টের বিজয় চান, তাঁরাও তাঁদের নিরঙ্কুশ বিজয় আশা করেন না। সুতরাং বামফ্রন্ট যে এবার হেসেখেলে মহাকরণ দখল করতে পারবে না, সেটা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। তবে সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে যদি বামফ্রন্ট টেনেটুনে আরেকবার মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারে, তা হলেও আমি তাতে খুব অবাক হব না।’
এবার নিজেদের জন্য একটা কথা বলি। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে কথার বাগাড়ম্বর আছে, কুৎসা আছে, রটনা আছে, কালো টাকা ও দুর্নীতির কাহিনি আছে। অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু যেটা অনুপস্থিত সেটা হলো, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত না করা। কোনো পক্ষই নির্বাচনকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি যদি তুলতেই হয়, সেটা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী শিবিরের তোলা উচিত। টানা ৩৪ বছরের শাসনের ‘দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি’ বলে কথা। এমনও নয় যে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ভারতের অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন। তাঁরা কেউ নির্বাচন ক্যাডারের কর্মকর্তা নন। মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকসহ অনধিক অর্ধডজন পদস্থ আইএএস কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁদের চাকরিও প্রেষণে রাজ্য সরকারে ন্যস্ত। মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক সুনীল কুমার গুপ্তা জানালেন, এই পদে তাঁর নিয়োগের প্রস্তাব গেছে বাম সরকারের কাছ থেকেই। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন তাতে সায় দিয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রত্যেকেই বামফ্রন্টের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে চাকরি পেয়েছেন।
‘তাহলে তো আপনাদের জবাবদিহি চূড়ান্ত অর্থে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছেই।’ উত্তরে যুগ্ম মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক দিব্যেন্দু সরকার বলেন, ‘আইনগতভাবে বিষয়টি কিন্তু তেমনই।’
যেটা দেখার সেটা হলো, তৃণমূল নেত্রী মমতা অহর্নিশ বাম শিবিরে তোপ দাগাচ্ছেন। কিন্তু একটি জায়গা বাঁচিয়ে। সেটি হলো নির্বাচন কমিশন। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ কেউ করছে না। পোস্টাল ব্যালট উদ্ধার হলো সিপিআইএমের কর্মীর কাছ থেকে। কিন্তু সে জন্য কোনো নির্বাচন কর্মকর্তার আচরণকে ইঙ্গিতেও আহত করা হলো না। কেউ বলেননি, বামদের তাঁবেদার কিংবা ঘাপটি মেরে থাকা বাম এজেন্টরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য গত ১৮ এপ্রিল প্রথম দফা নির্বাচনের পরে তৃণমূল মুখপাত্র পার্থকে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলতে শুনেছিলাম, সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বামদের অনুকূলে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। পরের ১০ দিন কলকাতায় থাকাকালে আমি এর স্বরূপ ধরতে পারিনি। কারণ, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই নির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠেনি।
পার্থর কথা শুনে আমার মনে একটা পরিহাস খেলা করেছিল। ভেবেছিলাম ইউরেকা। বলা যাবে, তোমরা তো আমাদের পণ্য নেবে না। এবার তবে আমদানি করো ‘আদি মোহিনী মোহন’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিধানসভায় কংগ্রেস দলের নেতা মানস ভূঁঁইয়ার কাছে জানতে চাইলাম, পার্থর ওই অভিযোগের মানে কী? তিনি পাত্তা দেননি। বললেন, ‘ওটা ওঁদেরকেই জিজ্ঞেস করুন।’ ভারত ও বাংলাদেশের সংবিধানে থাকা একটি মিল উল্লেখ করতেই হয়। উভয় সংবিধান একই শব্দ ও বাক্যে নির্বাচন কমিশনকে ‘দায়িত্ব পালনের’ স্বাধীনতা দিয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। তারাই ভারতের একমাত্র বামশাসিত রাজ্য নয়। কেরালা ও ত্রিপুরায় বামরা সরকার করতে পারে। কিন্তু টানা তিন দশকের অভিজ্ঞতা শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই। সে কারণেই প্রায় সব মহল থেকে একটা অভিন্ন আওয়াজ উঠেছে, ‘পরিবর্তন চাই। একদলীয় শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে। এটা চলতে পারে না।’
তৃণমূলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম ১০০ দিনে কী করা হবে, প্রথম ১০০০ দিনে কী করা হবে তার নির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে। তবে সেসব কথা তৃণমূল বা কংগ্রেস তাদের জনসভাগুলোতে বলে না। বামদের ব্যর্থতা তুলে ধরাসহ কুৎসা ও নিন্দাই প্রকট। নিজেরা এলে কী করবে, তার নির্দিষ্ট কোনো চিত্র ভাষণে থাকে না।
বামফ্রন্টের জনসভা ও সংবাদ সম্মেলনগুলোতেও দেখি নির্বাচনী ইশতেহার ধরে নির্দিষ্ট বক্তব্য ছিটেফোঁটা। বিরোধীদের নিন্দা ও গালমন্দই প্রকট। বামদের প্রস্তাবিত বড় ধরনের সংস্কার সেখানে নেই। তাদের শুদ্ধীকরণের স্বরূপ বোঝা যায় না। আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব বলছেন, এবার সরকারে গিয়ে তাঁরা না শোধরালে দলই টিকবে না। ভেঙে যাবে। কিন্তু তাঁরা কী করবেন এবং এখন তা করা থেকে কেন বিরত, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বরং নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁরা যেটা বলতে পছন্দ করছেন সেটা হলো, তাঁরা ক্ষমতায় এলে দরিদ্র মানুষকে রেশন দেবেন। দুই টাকা কেজি দরে চাল দেবেন। বিরোধীরা বলছেন, এটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসূচি। তাঁরা কেন কৃতিত্ব নিচ্ছেন। তবে বুদ্ধদেব স্পষ্ট করেছেন, চালের সঙ্গে আরও দু-তিনটি বিষয় কম দামে দেওয়া হবে। শুনে মনে হয়, এটা প্রলুব্ধকরণ।
সোনিয়ার কংগ্রেস মমতাকে জয়যুক্ত করতে সম্ভবত অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় মরিয়া। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারণায় ভীষণ সক্রিয়। তৃতীয় পর্যায়ের ভোটের আগ মুহূর্তে দিল্লি থেকে কলকাতায় উড়ে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। বলেন, পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি পুরো ভারতের মধ্যে নিকৃষ্ট। তিনি অবশ্য অন্যান্য রাজ্যের কী অবস্থা, তার তথ্য প্রকাশ করেননি।
সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিং, প্রণব মুখার্জি, পি চিদাম্বরম প্রমুখ এক সুরে বলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস জোটকে জয়যুক্ত করুন। তাঁদের কথাবার্তায়ও ভোটারদের লোভ দেখানোর মতো একটা অভিব্যক্তি স্পষ্ট। লুকোছাপা সামান্যই।
পশ্চিমবঙ্গে এসে মুসলিম কার্ড খেললেন মনমোহনও। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে মমতার সখ্য সুবিদিত। বিজেপির সঙ্গে মন্ত্রিত্বও করেছেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন বলছেন, তৃণমূলের বিজয়ের কেতনে তিনি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের স্বাদ পাচ্ছেন। আর মনমোহন এসে বললেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা গুজরাটের মুসলমানদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। তিনি লিখিত বক্তব্যে এই মন্তব্য করেন।
বামদের জন্য দুটো বাণ। একটি নন্দীগ্রাম, অন্যটি সাচার কমিটির রিপোর্ট। বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্ট বামদের বেশ বিব্রত করে। কারণ, ওই রিপোর্টে দেখানো হয়, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা ভীষণ কষ্টে আছে, পিছিয়ে আছে। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, মাদ্রাসাগুলোই জঙ্গিদের আখড়া। এ কথা তিনি পরে ভুলতে সচেষ্ট হন। নতুন করে মাদ্রাসা স্থাপন ও তার আধুনিকায়নে তিনি মনোযোগী হন।
২০০৫ সালে মনোমোহন বলেছিলেন, বুদ্ধদেব ভারতের শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। অবশ্য তাঁর আগে বুদ্ধদেবকে ওই অভিধায় অভিষিক্ত করেছিলেন শীর্ষ ধনকুবের আজিম হাশিম প্রেমজি। শিল্পপতি পুর্ণেন্দু চ্যাটার্জি ও রতন টাটারাও তা-ই মনে করেন। একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক আমাকে বলেন, ‘এতে নীতি-নৈতিকতা খুঁজবেন না। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা বলেছিলেন। কেন্দ্রে তখন বামদের সমর্থন দরকার ছিল।’ মনমোহন বলেছিলেন, ‘আমি ওঁর (বুদ্ধদেব) ভীষণ অনুরাগী। তাঁর মস্তিষ্ক ও হূদয়ের ছোঁয়ায় আমি বিমোহিত। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রতি তাঁর রয়েছে অসাধারণ অঙ্গীকার। তাঁর মতো স্বপ্নদ্রষ্টা ও সাহসী নেতৃত্বই ভারতের প্রয়োজন। আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি সম্যক ওয়াকিবহাল।’
২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী কার্যত বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনায় সোনিয়া গান্ধীর ‘দেউলিয়া’ রাজ্যের অভিমতই পুনর্ব্যক্ত করেন। বামফ্রন্ট অকর্মা। তার আর দরকার নেই। মনমোহনের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি। সাক্ষরতায় ১৮তম অবস্থানে থাকা রাজ্য আরও দুই ধাপ নিচে নেমেছে। মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের চেয়েও তারা নিচে নেমেছে।’ অবশ্য সম্প্রতি মনমোহন নিজ হাতেই পশ্চিমবঙ্গকে একটি সাফল্যের জন্য পুরস্কৃত করেন।
বামবিরোধী হাওয়া বেশ জোরেই বইছিল। কিন্তু মাস দুয়েক হলো, সেটা কিছুটা ভিন্ন দিকে বইতে শুরু করে। আনন্দবাজার পত্রিকাসহ এ পর্যন্ত যতগুলো জনমত জরিপ হয়েছে, তার সব কটিতেই বামফ্রন্টের শাসন আমলের প্রায় ভরাডুবির ইঙ্গিত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও একই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
কলকাতার গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ অব্যাহতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য কামনা করছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার হাসিম আবদুল হালিম মিডিয়ার ভূমিকায় ভীষণ ক্ষুব্ধ বললেও কম বলা হয়। বললাম, প্রেস তো ফোর্থ এস্টেট। স্পিকার বলেন, ‘ফোর্থ এস্টেট না ছাই। থার্ড গ্রেড! জ্যোতি বাবুরও সেই মত ছিল। ওরা চিরকাল বামদের পতন কামনা করেছে।’ কিন্তু কেন? স্পিকারের চাঁচাছোলা উক্তি, ‘পুঁজিবাদের ভাইরাস। আমেরিকার ভূতে ধরেছে।’
বামফ্রন্টের মধ্যেও কেউ কেউ বলেন, তাঁদের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। এমনকি সাবেক অর্থমন্ত্রী বর্ষীয়ান বাম নেতার কথায়, জমিদারি মেজাজে পেয়েছে। উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত। সুশীল সমাজের প্রভাবশালীরাও তা মানেন। বলেন, ‘৩৪ বছর সরকারে থেকে তাঁদের মধ্যে আত্মঅহমিকা ও ঔদ্ধত্যের জন্ম হয়েছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। লক্ষ করলাম, বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বামফ্রন্টের বিজয় চান, তাঁরাও তাঁদের নিরঙ্কুশ বিজয় আশা করেন না। সুতরাং বামফ্রন্ট যে এবার হেসেখেলে মহাকরণ দখল করতে পারবে না, সেটা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। তবে সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে যদি বামফ্রন্ট টেনেটুনে আরেকবার মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারে, তা হলেও আমি তাতে খুব অবাক হব না।’
এবার নিজেদের জন্য একটা কথা বলি। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে কথার বাগাড়ম্বর আছে, কুৎসা আছে, রটনা আছে, কালো টাকা ও দুর্নীতির কাহিনি আছে। অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু যেটা অনুপস্থিত সেটা হলো, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত না করা। কোনো পক্ষই নির্বাচনকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি যদি তুলতেই হয়, সেটা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী শিবিরের তোলা উচিত। টানা ৩৪ বছরের শাসনের ‘দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি’ বলে কথা। এমনও নয় যে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ভারতের অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন। তাঁরা কেউ নির্বাচন ক্যাডারের কর্মকর্তা নন। মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকসহ অনধিক অর্ধডজন পদস্থ আইএএস কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁদের চাকরিও প্রেষণে রাজ্য সরকারে ন্যস্ত। মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক সুনীল কুমার গুপ্তা জানালেন, এই পদে তাঁর নিয়োগের প্রস্তাব গেছে বাম সরকারের কাছ থেকেই। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন তাতে সায় দিয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রত্যেকেই বামফ্রন্টের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে চাকরি পেয়েছেন।
‘তাহলে তো আপনাদের জবাবদিহি চূড়ান্ত অর্থে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছেই।’ উত্তরে যুগ্ম মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক দিব্যেন্দু সরকার বলেন, ‘আইনগতভাবে বিষয়টি কিন্তু তেমনই।’
যেটা দেখার সেটা হলো, তৃণমূল নেত্রী মমতা অহর্নিশ বাম শিবিরে তোপ দাগাচ্ছেন। কিন্তু একটি জায়গা বাঁচিয়ে। সেটি হলো নির্বাচন কমিশন। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ কেউ করছে না। পোস্টাল ব্যালট উদ্ধার হলো সিপিআইএমের কর্মীর কাছ থেকে। কিন্তু সে জন্য কোনো নির্বাচন কর্মকর্তার আচরণকে ইঙ্গিতেও আহত করা হলো না। কেউ বলেননি, বামদের তাঁবেদার কিংবা ঘাপটি মেরে থাকা বাম এজেন্টরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য গত ১৮ এপ্রিল প্রথম দফা নির্বাচনের পরে তৃণমূল মুখপাত্র পার্থকে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলতে শুনেছিলাম, সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বামদের অনুকূলে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। পরের ১০ দিন কলকাতায় থাকাকালে আমি এর স্বরূপ ধরতে পারিনি। কারণ, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই নির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠেনি।
পার্থর কথা শুনে আমার মনে একটা পরিহাস খেলা করেছিল। ভেবেছিলাম ইউরেকা। বলা যাবে, তোমরা তো আমাদের পণ্য নেবে না। এবার তবে আমদানি করো ‘আদি মোহিনী মোহন’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিধানসভায় কংগ্রেস দলের নেতা মানস ভূঁঁইয়ার কাছে জানতে চাইলাম, পার্থর ওই অভিযোগের মানে কী? তিনি পাত্তা দেননি। বললেন, ‘ওটা ওঁদেরকেই জিজ্ঞেস করুন।’ ভারত ও বাংলাদেশের সংবিধানে থাকা একটি মিল উল্লেখ করতেই হয়। উভয় সংবিধান একই শব্দ ও বাক্যে নির্বাচন কমিশনকে ‘দায়িত্ব পালনের’ স্বাধীনতা দিয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments