সার্ধশততম জন্মবার্ষিক-রবীন্দ্রনাথ ও একটি প্রশ্ন by ভীষ্মদেব চৌধুরী
আগামী পঁচিশে বৈশাখ দেশে-বিদেশে মহাসমারোহে উদ্যাপিত হবে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম (১২৬৮-১৪১৮) জন্মবার্ষিক অনুষ্ঠান। জাতিক, আন্তর্জাতিক এবং আন্তর্দেশীয় নানা উদ্যোগ-আয়োজনে ওই দিন মুখরিত হবে কবি-বন্দনায়।
প্রকাশিত হবে শত শত স্মারকগ্রন্থ, সমালোচনাগ্রন্থ, নানামুখী সংকলন; অনূদিত হবে রচনাসম্ভার; শিল্পীর তুলিতে অঙ্কিত হবে কবির হাজারো পোর্ট্রেট আর রবীন্দ্র-অনুষঙ্গী বিচিত্রিত চিত্রপট; সেলুলয়েডে মূর্ত হবে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা তথ্যচিত্র; মঞ্চস্থ হবে নাটক, রাবীন্দ্রিক মুদ্রা ও গায়কীতে নিবেদিত হবে নৃত্যগীতধারা; চলচ্চিত্রায়িত হবে তাঁর কথা ও কবিতার শিল্পিতা; গীত হবে গান, আবৃত্ত হবে অজস্র কবিতা। সর্বোপরি একুশ শতকের বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা ও চিরকালীনতা নিয়ে বক্তৃতায়-আলোচনায় ব্যক্ত হবে নানা প্রত্যয়; শ্রদ্ধায়-সম্মানে পুনরাভিষিক্ত হবেন কথাকোবিদ ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালা এই আয়োজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতের জনপ্রিয়তার (স্মরণীয়, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ) প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন রাষ্ট্রগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক ইতিবাচক অভিব্যক্তি। কবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরও এ এক অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। শ্রেষ্ঠ কবির সৃষ্টিসম্ভার যে বিশ্বমানবের উত্তরাধিকারের অংশ, এমন স্থাপিত দৃষ্টান্ত শুভচেতনায় উজ্জীবিত করবে সাধারণ মানুষকে। মানবধর্মের বাণীবাহক রবীন্দ্রনাথের প্রতি এটি আমাদের ঋণ শোধ নয়, ঋণগ্রস্তের বিনম্র স্বীকৃতি। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এমন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিজ নিজ দেশের জন-আকাঙ্ক্ষাকেই যে সম্মানিত করেছে, তা বলা বোধ করি বাহুল্য। আর সম্মানিত জনতার অন্তস্তলের পুঞ্জীভূত শ্রদ্ধা-ভালোবাসাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমর্পিত হবে কবির উদ্দেশে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে, ওই উদ্যোগের অংশীদার বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের, বিশেষত সরকারপ্রধানকে জানাই কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।
তবে কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষপূর্তি উদ্যাপনের সমারোহের আড়ালে একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন বিবেচনার বাইরে থেকে গেল আমাদের! আমরা হিসাব করে দেখিনি যে, দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রই একটি সুনির্দিষ্ট তারিখকে শিরোধার্য করে প্রকৃতপক্ষে স্বতন্ত্র দুটি দিনে ১৫০তম এই পঁচিশে বৈশাখকে বরণ করে নেবে। কিন্তু একজন রক্ত-মাংসের মানুষ কি দুই দিন জন্মগ্রহণ করতে পারে? ‘দ্বিজ’ বলে সংস্কৃত থেকে আগত একটি শব্দ আছে বটে বাংলা ভাষায়। কিন্তু তার অর্থ যতটুকু শাস্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মানবজন্মের বাস্তবতা থেকে তা অনেক দূরবর্তী। তাহলে, কীভাবে আমরা একটি স্মরণীয় জন্ম-তারিখকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছি? শুধুই কি একটি তারিখ? নানা উপলক্ষে আয়োজনে আমরা শত শত তারিখকেই কি দ্বিখণ্ডিত করছি না? আমরা কি অক্ষত রাখতে পেরেছি পয়লা বৈশাখকে? ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার এই আনন্দময় জাতীয় উৎসবকে? নাগরিক বর্ষবরণ আর গ্রামীণ হালখাতার উদ্বোধন কি একই সূর্যোদয়ে সর্বত্র সম্পন্ন হয়? কৃষকজীবনের আনন্দময় বাস্তবতা আর নাগরিক মধ্যবিত্তের নান্দনিক উৎসবময়তাকে বিভাজিত করার কী প্রয়োজন আমাদের? আমরা তো এখনো পারিনি জাতিসত্তার সংহতির স্মারক বর্ষবরণের এই দিনটিকে সাংবিধানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে?
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মতিথিকেও আমরা দুই দেশের নাগরিকেরা স্বতন্ত্র দুই সূর্যোদয়ের পারিবেশিকতায় বিভিন্ন করে রাখি। দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় একটি ভুলকে পরমানন্দে গ্রহণ করেছিলেন বিষণ্ন অন্নদাশঙ্কর রায়। লিখেছিলেন: ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল। /এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/ বাঙালি বলতে একজন আছে/ দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।’ কিন্তু আমরা কবিকে জাতীয় কবির সম্মানে অভিষিক্ত করেও জন্মদিন উদ্যাপনের ক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর-কথিত ওই ভুলটুকু এক আকস্মিক সিদ্ধান্তে সংশোধন করে নিয়েছি!
দিন-গণনার হিসাব এবং জ্ঞানতাপস মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-নিরূপিত পঞ্জিকার বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্য-উপাত্ত আমার সঞ্চয়ে নেই। আমি শুধু এইটুকু বুঝি যে, তাঁর চব্বিশ পরগনার জন্মস্থান আর জ্ঞান-কর্মযজ্ঞের তীর্থস্থান ঢাকায় শহীদুল্লাহর জন্মদিন উদ্যাপিত হয় স্বতন্ত্র দুটি দিনে। তাই গুরুতর ওই প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থেকে যায়। কিন্তু এর নিরাকরণ কি অসম্ভব? একজন মানুষের স্বতন্ত্র দুটি দিনে জন্মদিন উদ্যাপন কি একুশ শতকের এই প্রাগ্রসর বিশ্বে যুক্তিসিদ্ধ? বিকশিত সভ্যতার, পরিশীলিত শিক্ষার সহায়ক? কোমলমতি কোনো শিশু যদি আপাত উত্তরহীন এই প্রশ্ন উত্থাপন করে বসে, কী উত্তর দেব আমরা তাকে?
সংক্ষিপ্ত এই পরিসরে আমি শুধু প্রশ্নটিকেই জাতির সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। এর গ্রহণযোগ্য কোনো মীমাংসা আমার ভান্ডারে নেই। পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞ, গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে অভিমত প্রদানের দাবিদার। আমি শুধু এইটুকু বুঝি যে, একটি দিনকে দুটি দিনে বিভাজিত করার ফলে সৃষ্ট জটিলতার নিরাকরণ প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিক অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে এই গুরুতর প্রশ্নটি উত্থাপনের প্রাসঙ্গিকতা কীভাবে অস্বীকার করি?
ভীষ্মদেব চৌধুরী: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালা এই আয়োজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতের জনপ্রিয়তার (স্মরণীয়, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ) প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন রাষ্ট্রগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক ইতিবাচক অভিব্যক্তি। কবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরও এ এক অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। শ্রেষ্ঠ কবির সৃষ্টিসম্ভার যে বিশ্বমানবের উত্তরাধিকারের অংশ, এমন স্থাপিত দৃষ্টান্ত শুভচেতনায় উজ্জীবিত করবে সাধারণ মানুষকে। মানবধর্মের বাণীবাহক রবীন্দ্রনাথের প্রতি এটি আমাদের ঋণ শোধ নয়, ঋণগ্রস্তের বিনম্র স্বীকৃতি। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এমন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিজ নিজ দেশের জন-আকাঙ্ক্ষাকেই যে সম্মানিত করেছে, তা বলা বোধ করি বাহুল্য। আর সম্মানিত জনতার অন্তস্তলের পুঞ্জীভূত শ্রদ্ধা-ভালোবাসাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমর্পিত হবে কবির উদ্দেশে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে, ওই উদ্যোগের অংশীদার বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের, বিশেষত সরকারপ্রধানকে জানাই কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।
তবে কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষপূর্তি উদ্যাপনের সমারোহের আড়ালে একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন বিবেচনার বাইরে থেকে গেল আমাদের! আমরা হিসাব করে দেখিনি যে, দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রই একটি সুনির্দিষ্ট তারিখকে শিরোধার্য করে প্রকৃতপক্ষে স্বতন্ত্র দুটি দিনে ১৫০তম এই পঁচিশে বৈশাখকে বরণ করে নেবে। কিন্তু একজন রক্ত-মাংসের মানুষ কি দুই দিন জন্মগ্রহণ করতে পারে? ‘দ্বিজ’ বলে সংস্কৃত থেকে আগত একটি শব্দ আছে বটে বাংলা ভাষায়। কিন্তু তার অর্থ যতটুকু শাস্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মানবজন্মের বাস্তবতা থেকে তা অনেক দূরবর্তী। তাহলে, কীভাবে আমরা একটি স্মরণীয় জন্ম-তারিখকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছি? শুধুই কি একটি তারিখ? নানা উপলক্ষে আয়োজনে আমরা শত শত তারিখকেই কি দ্বিখণ্ডিত করছি না? আমরা কি অক্ষত রাখতে পেরেছি পয়লা বৈশাখকে? ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার এই আনন্দময় জাতীয় উৎসবকে? নাগরিক বর্ষবরণ আর গ্রামীণ হালখাতার উদ্বোধন কি একই সূর্যোদয়ে সর্বত্র সম্পন্ন হয়? কৃষকজীবনের আনন্দময় বাস্তবতা আর নাগরিক মধ্যবিত্তের নান্দনিক উৎসবময়তাকে বিভাজিত করার কী প্রয়োজন আমাদের? আমরা তো এখনো পারিনি জাতিসত্তার সংহতির স্মারক বর্ষবরণের এই দিনটিকে সাংবিধানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে?
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মতিথিকেও আমরা দুই দেশের নাগরিকেরা স্বতন্ত্র দুই সূর্যোদয়ের পারিবেশিকতায় বিভিন্ন করে রাখি। দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় একটি ভুলকে পরমানন্দে গ্রহণ করেছিলেন বিষণ্ন অন্নদাশঙ্কর রায়। লিখেছিলেন: ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল। /এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/ বাঙালি বলতে একজন আছে/ দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।’ কিন্তু আমরা কবিকে জাতীয় কবির সম্মানে অভিষিক্ত করেও জন্মদিন উদ্যাপনের ক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর-কথিত ওই ভুলটুকু এক আকস্মিক সিদ্ধান্তে সংশোধন করে নিয়েছি!
দিন-গণনার হিসাব এবং জ্ঞানতাপস মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-নিরূপিত পঞ্জিকার বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্য-উপাত্ত আমার সঞ্চয়ে নেই। আমি শুধু এইটুকু বুঝি যে, তাঁর চব্বিশ পরগনার জন্মস্থান আর জ্ঞান-কর্মযজ্ঞের তীর্থস্থান ঢাকায় শহীদুল্লাহর জন্মদিন উদ্যাপিত হয় স্বতন্ত্র দুটি দিনে। তাই গুরুতর ওই প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থেকে যায়। কিন্তু এর নিরাকরণ কি অসম্ভব? একজন মানুষের স্বতন্ত্র দুটি দিনে জন্মদিন উদ্যাপন কি একুশ শতকের এই প্রাগ্রসর বিশ্বে যুক্তিসিদ্ধ? বিকশিত সভ্যতার, পরিশীলিত শিক্ষার সহায়ক? কোমলমতি কোনো শিশু যদি আপাত উত্তরহীন এই প্রশ্ন উত্থাপন করে বসে, কী উত্তর দেব আমরা তাকে?
সংক্ষিপ্ত এই পরিসরে আমি শুধু প্রশ্নটিকেই জাতির সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। এর গ্রহণযোগ্য কোনো মীমাংসা আমার ভান্ডারে নেই। পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞ, গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে অভিমত প্রদানের দাবিদার। আমি শুধু এইটুকু বুঝি যে, একটি দিনকে দুটি দিনে বিভাজিত করার ফলে সৃষ্ট জটিলতার নিরাকরণ প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিক অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে এই গুরুতর প্রশ্নটি উত্থাপনের প্রাসঙ্গিকতা কীভাবে অস্বীকার করি?
ভীষ্মদেব চৌধুরী: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments