রাজনীতি-বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র নয় by আবদুল মান্নান
একবার এক বাংলাদেশফেরত ডাচ সাংবাদিককে স্থানীয় বাঙালিরা প্রশ্ন করল, ‘কেমন দেখলে আমাদের দেশ?’ সেই সাংবাদিকের উত্তর, ‘তোমাদের দেশে না গেলে বোঝা যেত না একটা দেশ কত উত্তেজনাপূর্ণ বা রোমাঞ্চকর হতে পারে।’ শুনে বাঙালি শ্রোতারা তো অবাক। যে দেশ নিয়ে বিদেশেও তারা এত উদ্বেগের মধ্যে থাকে, সেখানে একজন ভিনদেশি ঝানু সাংবাদিক কী এমন সব উত্তেজনাপূর্ণ বা রোমাঞ্চকর বিষয় দেখতে পেলেন?
সাংবাদিকপ্রবর বিষয়টি খুলেই বললেন। বললেন, ‘আমাদের দেশে কাল বা পরশু অথবা পরের সপ্তাহ বা পরের মাসে কী ঘটবে বা ঘটবে না তা আগাম বলে দেওয়া যায়। বাংলাদেশে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা একেবারেই অসম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো কয়েক ঘণ্টার সময় দিয়ে একটি হরতাল ডেকে দিতে পারে। রিকশাচালকেরা কোনো নোটিশ না দিয়ে সড়কে এলোপাতাড়ি রিকশা রেখে যান চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে, আবার সবকিছু দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্বাভাবিকও হয়ে যেতে পারে। আর কোনো কারণে রাজনৈতিক দলগুলো যদি চুপচাপ থাকে তাহলে তোমাদের পত্রপত্রিকাগুলো কোনো একটা বিষয় নিয়ে কয়েক দিন তোলপাড় লাগিয়ে দিতে পারে। এসবের কোনোটাই আমাদের দেশে সম্ভব নয়। সে কারণেই আমাদের দেশের জীবনযাত্রা কেমন যেন একঘেয়ে। জীবনে যদি একটু বৈচিত্র্যই না থাকল তাহলে সে জীবনের কোনো অর্থ হয় না।’
এই খবরটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই খবর নিয়ে বহু দিন চিন্তা করেছি এবং দেখেছি সেই বিদেশি সাংবাদিকের মন্তব্য কোনো অংশে অসত্য নয়। যেমন ধরুন, সম্প্রতি দু-একটি পত্রিকায় এবং কোনো কোনো টিভি টক শোতে বাংলাদেশ ব্যর্থরাষ্ট্রবিষয়ক একটি সংবাদ নিয়ে কয়েক দিন কী একটা তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটল!
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রকাশিত ফরেন পলিসি সাময়িকীটির বয়স প্রায় চার দশকের বেশি। প্রথম প্রকাশ ১৯৭০ সালে একাডেমিক জার্নাল হিসেবে। উনিশ শ নব্বইয়ের দশকে তা একটি পাক্ষিক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। ২০০৫ সাল থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ড ফর পিসের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ব্যর্থরাষ্ট্র সূচক (Failed State Index) প্রস্তুত শুরু করে। এটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ৯/১১-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরবর্তীকালে তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখার একটি প্রচেষ্টা। তারা তাদের সূচক প্রস্তুতকালে যেসব মাপকাঠি ব্যবহার করে, তা প্রচলিত ধারণার বাইরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একটি এলাকাকে রাষ্ট্র (যথার্থ অর্থে) হিসেবে আখ্যায়িত করতে কতগুলো পূর্বশর্ত দিয়ে তাকে যাচাই করেন। এর মধ্যে আছে একটি নির্দিষ্ট এলাকা, এলাকাটির সার্বভৌমত্ব, একটি কার্যকর সরকার। কার্যকর সরকার বলতে বোঝায়, সেই রাষ্ট্রে কার্যকর আইনসভা, বিচারব্যবস্থা এবং নির্বাহী ব্যবস্থা আছে কি না। সার্বিক অর্থে সুশাসন। ইদানীং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বাধীন গণমাধ্যম। এই শর্তগুলো যদি কোনো দেশ পূরণ করে তাহলে বলা যেতে পারে, সে দেশ একটি সম্পূর্ণভাবে সফল রাষ্ট্র। তার ব্যত্যয় ঘটলে সম্পূর্ণ সফল রাষ্ট্র হতে তা দূরে সরে যায়। অন্যদিকে ফরেন পলিসি তাদের ব্যর্থরাষ্ট্র তালিকা প্রস্তুতের সময় ভিন্ন তিনটি মাপকাঠি ব্যবহার করে। এর মধ্যে আছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। পরিমাপের এই তিনটি সূচকের অধীন তারা আরও কিছু উপসূচক ব্যবহার করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জনসংখ্যার চাপ, বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, সমষ্টিগত অসন্তুষ্টি, মানবাধিকার, অসম উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অবনতি, রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, মানবাধিকার, নিরাপত্তাব্যবস্থা, সমাজে উঁচু শ্রেণীর মধ্যে বিভাজন এবং বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ। এই মাপকাঠির আলোকে তারা বিশ্বের দেশগুলোকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে। প্রথম সংকটাপন্ন, দ্বিতীয় বিপদগ্রস্ত, তৃতীয় মাঝামাঝি (অনেকটা বিপদাপন্ন), চতুর্থ স্থিতিশীল এবং পঞ্চম সর্বাধিক স্থিতিশীল।
তাদের হিসাব অনুযায়ী যদি ব্যর্থরাষ্ট্র বলতেই হয়, তাহলে যেসব রাষ্ট্র সংকটাপন্ন সেগুলোকেই ব্যর্থরাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যেগুলো বিপদগ্রস্ত, সেগুলোকে ধরতে হবে ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যেমন শুরু থেকেই সোমালিয়া ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকার একেবারে শীর্ষে। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। ২০১০-এ তারা ১০ নম্বরে ছিল। এর অর্থ হচ্ছে আগের বছরের তুলনায় পাকিস্তান এই বছর দুই ধাপ নিচে নেমেছে এবং তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পাকিস্তানকে যদি সোমালিয়ার জায়গায় পৌঁছাতে হয় তাহলে তাদের আরও ১০ দেশের দুরবস্থা অতিক্রম করতে হবে। যাদের মধ্যে আছে আইভরি কোস্ট, ইরাক, আফগানিস্তান, সুদান প্রভৃতি দেশ। ২০১১ সালের যে সূচক প্রস্তুত করা হয়েছে, সেই সূচক অনুযায়ী ২০টি দেশকে বলা হয়েছে, সংকটাপন্ন, যার মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১২তম, সর্বশেষ ইথিওপিয়া। বাংলাদেশ হচ্ছে বিপদগ্রস্ত এবং আমাদের অবস্থান ২৫তম। ২০০৮-এ ছিলাম ১২তম, ২০০৯-এ ১৯তম, ২০১০-এ ২৪তম এবং বর্তমানে ২৫তম। এর সহজ-সরল উপসংহার হচ্ছে অনেক বাধা-বিপত্তি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নানামুখী আর্থসামাজিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সার্বিক অবস্থা খুব ধীরগতিতে হলেও উন্নতি হচ্ছে।
২০০৫ সাল থেকে যখনই ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন তাদের এই সূচক প্রস্তুত শুরু করে, বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক ছিল না, যেমনটি আমাদের দেশের একশ্রেণীর সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম তা দেখাতে বেশ উৎসাহিত বোধ করে। ২২ জুন বাংলাদেশে অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক সংবাদটি শুধু সংবাদ হিসেবে ছেপেছে, একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত ইংরেজি ডেইলি স্টার। তারা শুধু বলেছে, ব্যর্থরাষ্ট্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। একটিতে প্রথম পৃষ্ঠায় রিভার্স হেডিং দিয়ে লিড হিসেবে বলেছে ‘সবচেয়ে ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের নতুন র্যাংকিং।’ অথচ শুরু থেকে বাংলাদেশ কখনো সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল না। অথচ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পণ্ডিত গবেষক তাঁদের এ ধরনের সূচক মানতে নারাজ। যেমন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৯ সালে চীন ৫৭ নম্বরে বিপদাপন্ন দেশ ছিল। ইরান, শ্রীলঙ্কা সব সময় তাদের প্রথম ষাটটি দেশের তালিকায় ছিল। তার ওপরে যেসব রাষ্ট্রকে ব্যর্থ আখ্যায়িত করা হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলোই ব্যর্থ হওয়ার পেছনে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার অবদান কম নয়। যেমন ইরাক, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ইয়েমেন। বাংলাদেশকে এ বছর বিপদগ্রস্ত দেশের তালিকায় রাখার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি পাঁচজনের দুজন এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং সমুদ্রের উচ্চতা আর এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ জমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
এখানে বাংলাদেশ কী করতে পারে? এ অবস্থার জন্য তো সবচেয়ে বেশি দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ঐতিহাসিক। এটা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি এবং রাতারাতি দূরও হবে না। তবে যেদিন এই সংবাদটি প্রকাশিত হলো, ঠিক তার পরের দিন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এই তথ্য প্রকাশ করেছে—২০১০-এর তুলনায় বর্তমান বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমে বর্তমানে ৩১ দশমিক ৫-এ এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সেখানেও স্বীকার করা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে আয়বৈষম্য তেমন একটা কমেনি। গত তিন দশকে দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে অনেক সামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন, মাথাপিছু আয়, শিক্ষিতের হার উন্নয়নে, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেক সফলতা এসেছে। একই দিন ব্রিটিশ ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত দুই দশকে ২৪টি দেশের মধ্যে যে নয়টি দেশ সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ যত দূর যাওয়ার কথা ছিল, তত দূর যেতে পেরেছি কি? হয়তো সব ক্ষেত্রে পারেনি এবং এই না পারার কারণ কিন্তু আমরা অনেকটা নিজেরাই সৃষ্টি করেছি। প্রথমে বাংলাদেশের চলার পথে প্রথম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে সামরিক শাসন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর বাংলাদেশ পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সামরিক শাসনের অধীনে থেকে দুনিয়ার কোনো দেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে, তেমন নজির নেই। শুধু ৪০ বছরের ব্যবধানে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে বোঝা যাবে তারা যা পেরেছে আমরা তা পারিনি কেন। মূলত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব। ভিশন না থাকলে স্টেটসম্যান হওয়া যায় না। ওই মহামূল্যবান গুণটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে হারানো ছিল জাতির জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
মনে করা হয়েছিল নব্বইয়ের এরশাদ পতনের পর আমাদের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হবে। তাও হয়নি। আমাদের রাজনীতি এখনো একটি সীমিত গণ্ডির বাইরে আসতে পারেনি। এখন তো আবার রাজনীতি হরতালনির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ আমাদের যেসব জাতীয় সমস্যা আছে, তা সমাধানের অযোগ্য কোনো সমস্যা নয়। প্রয়োজন ছিল একটু দূরদর্শিতা, সংবেদনশীলতা এবং ধৈর্য। আমাদের আইনসভা এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। নির্বাহী বিভাগ অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং ব্যক্তি ও আত্মকেন্দ্রিক। রাজনীতি এখন অনেকটা অরাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। সমাজে ধান্ধাবাজ, ফেরেববাজ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অসৎ মানুষের কদর বেড়েছে বহুগুণ। রাষ্ট্রের এসব বিষফোড়া দূর করতে পারলে বাংলাদেশে এক দশকের পথ এক বা দুই বছরে অতিক্রম করতে পারবে। শেখ হাসিনা যে সংখ্যক সাংসদ নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, তিনি যদি পরিস্থিতি পাল্টাতে না পারেন তাহলে অন্যরা কীভাবে পারবেন? তাঁর পিতা যদি একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে পারেন, কেন তিনি পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারবেন না? মানুষ নয়, তার কীর্তিই ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে ।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই খবর নিয়ে বহু দিন চিন্তা করেছি এবং দেখেছি সেই বিদেশি সাংবাদিকের মন্তব্য কোনো অংশে অসত্য নয়। যেমন ধরুন, সম্প্রতি দু-একটি পত্রিকায় এবং কোনো কোনো টিভি টক শোতে বাংলাদেশ ব্যর্থরাষ্ট্রবিষয়ক একটি সংবাদ নিয়ে কয়েক দিন কী একটা তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটল!
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রকাশিত ফরেন পলিসি সাময়িকীটির বয়স প্রায় চার দশকের বেশি। প্রথম প্রকাশ ১৯৭০ সালে একাডেমিক জার্নাল হিসেবে। উনিশ শ নব্বইয়ের দশকে তা একটি পাক্ষিক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। ২০০৫ সাল থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ড ফর পিসের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ব্যর্থরাষ্ট্র সূচক (Failed State Index) প্রস্তুত শুরু করে। এটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ৯/১১-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরবর্তীকালে তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখার একটি প্রচেষ্টা। তারা তাদের সূচক প্রস্তুতকালে যেসব মাপকাঠি ব্যবহার করে, তা প্রচলিত ধারণার বাইরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একটি এলাকাকে রাষ্ট্র (যথার্থ অর্থে) হিসেবে আখ্যায়িত করতে কতগুলো পূর্বশর্ত দিয়ে তাকে যাচাই করেন। এর মধ্যে আছে একটি নির্দিষ্ট এলাকা, এলাকাটির সার্বভৌমত্ব, একটি কার্যকর সরকার। কার্যকর সরকার বলতে বোঝায়, সেই রাষ্ট্রে কার্যকর আইনসভা, বিচারব্যবস্থা এবং নির্বাহী ব্যবস্থা আছে কি না। সার্বিক অর্থে সুশাসন। ইদানীং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বাধীন গণমাধ্যম। এই শর্তগুলো যদি কোনো দেশ পূরণ করে তাহলে বলা যেতে পারে, সে দেশ একটি সম্পূর্ণভাবে সফল রাষ্ট্র। তার ব্যত্যয় ঘটলে সম্পূর্ণ সফল রাষ্ট্র হতে তা দূরে সরে যায়। অন্যদিকে ফরেন পলিসি তাদের ব্যর্থরাষ্ট্র তালিকা প্রস্তুতের সময় ভিন্ন তিনটি মাপকাঠি ব্যবহার করে। এর মধ্যে আছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। পরিমাপের এই তিনটি সূচকের অধীন তারা আরও কিছু উপসূচক ব্যবহার করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জনসংখ্যার চাপ, বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, সমষ্টিগত অসন্তুষ্টি, মানবাধিকার, অসম উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অবনতি, রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, মানবাধিকার, নিরাপত্তাব্যবস্থা, সমাজে উঁচু শ্রেণীর মধ্যে বিভাজন এবং বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ। এই মাপকাঠির আলোকে তারা বিশ্বের দেশগুলোকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে। প্রথম সংকটাপন্ন, দ্বিতীয় বিপদগ্রস্ত, তৃতীয় মাঝামাঝি (অনেকটা বিপদাপন্ন), চতুর্থ স্থিতিশীল এবং পঞ্চম সর্বাধিক স্থিতিশীল।
তাদের হিসাব অনুযায়ী যদি ব্যর্থরাষ্ট্র বলতেই হয়, তাহলে যেসব রাষ্ট্র সংকটাপন্ন সেগুলোকেই ব্যর্থরাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যেগুলো বিপদগ্রস্ত, সেগুলোকে ধরতে হবে ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যেমন শুরু থেকেই সোমালিয়া ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকার একেবারে শীর্ষে। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। ২০১০-এ তারা ১০ নম্বরে ছিল। এর অর্থ হচ্ছে আগের বছরের তুলনায় পাকিস্তান এই বছর দুই ধাপ নিচে নেমেছে এবং তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পাকিস্তানকে যদি সোমালিয়ার জায়গায় পৌঁছাতে হয় তাহলে তাদের আরও ১০ দেশের দুরবস্থা অতিক্রম করতে হবে। যাদের মধ্যে আছে আইভরি কোস্ট, ইরাক, আফগানিস্তান, সুদান প্রভৃতি দেশ। ২০১১ সালের যে সূচক প্রস্তুত করা হয়েছে, সেই সূচক অনুযায়ী ২০টি দেশকে বলা হয়েছে, সংকটাপন্ন, যার মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১২তম, সর্বশেষ ইথিওপিয়া। বাংলাদেশ হচ্ছে বিপদগ্রস্ত এবং আমাদের অবস্থান ২৫তম। ২০০৮-এ ছিলাম ১২তম, ২০০৯-এ ১৯তম, ২০১০-এ ২৪তম এবং বর্তমানে ২৫তম। এর সহজ-সরল উপসংহার হচ্ছে অনেক বাধা-বিপত্তি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নানামুখী আর্থসামাজিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সার্বিক অবস্থা খুব ধীরগতিতে হলেও উন্নতি হচ্ছে।
২০০৫ সাল থেকে যখনই ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন তাদের এই সূচক প্রস্তুত শুরু করে, বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক ছিল না, যেমনটি আমাদের দেশের একশ্রেণীর সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম তা দেখাতে বেশ উৎসাহিত বোধ করে। ২২ জুন বাংলাদেশে অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক সংবাদটি শুধু সংবাদ হিসেবে ছেপেছে, একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত ইংরেজি ডেইলি স্টার। তারা শুধু বলেছে, ব্যর্থরাষ্ট্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। একটিতে প্রথম পৃষ্ঠায় রিভার্স হেডিং দিয়ে লিড হিসেবে বলেছে ‘সবচেয়ে ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের নতুন র্যাংকিং।’ অথচ শুরু থেকে বাংলাদেশ কখনো সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল না। অথচ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পণ্ডিত গবেষক তাঁদের এ ধরনের সূচক মানতে নারাজ। যেমন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৯ সালে চীন ৫৭ নম্বরে বিপদাপন্ন দেশ ছিল। ইরান, শ্রীলঙ্কা সব সময় তাদের প্রথম ষাটটি দেশের তালিকায় ছিল। তার ওপরে যেসব রাষ্ট্রকে ব্যর্থ আখ্যায়িত করা হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলোই ব্যর্থ হওয়ার পেছনে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার অবদান কম নয়। যেমন ইরাক, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ইয়েমেন। বাংলাদেশকে এ বছর বিপদগ্রস্ত দেশের তালিকায় রাখার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি পাঁচজনের দুজন এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং সমুদ্রের উচ্চতা আর এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ জমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
এখানে বাংলাদেশ কী করতে পারে? এ অবস্থার জন্য তো সবচেয়ে বেশি দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ঐতিহাসিক। এটা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি এবং রাতারাতি দূরও হবে না। তবে যেদিন এই সংবাদটি প্রকাশিত হলো, ঠিক তার পরের দিন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এই তথ্য প্রকাশ করেছে—২০১০-এর তুলনায় বর্তমান বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমে বর্তমানে ৩১ দশমিক ৫-এ এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সেখানেও স্বীকার করা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে আয়বৈষম্য তেমন একটা কমেনি। গত তিন দশকে দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে অনেক সামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন, মাথাপিছু আয়, শিক্ষিতের হার উন্নয়নে, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেক সফলতা এসেছে। একই দিন ব্রিটিশ ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত দুই দশকে ২৪টি দেশের মধ্যে যে নয়টি দেশ সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ যত দূর যাওয়ার কথা ছিল, তত দূর যেতে পেরেছি কি? হয়তো সব ক্ষেত্রে পারেনি এবং এই না পারার কারণ কিন্তু আমরা অনেকটা নিজেরাই সৃষ্টি করেছি। প্রথমে বাংলাদেশের চলার পথে প্রথম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে সামরিক শাসন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর বাংলাদেশ পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সামরিক শাসনের অধীনে থেকে দুনিয়ার কোনো দেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে, তেমন নজির নেই। শুধু ৪০ বছরের ব্যবধানে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে বোঝা যাবে তারা যা পেরেছে আমরা তা পারিনি কেন। মূলত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব। ভিশন না থাকলে স্টেটসম্যান হওয়া যায় না। ওই মহামূল্যবান গুণটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে হারানো ছিল জাতির জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
মনে করা হয়েছিল নব্বইয়ের এরশাদ পতনের পর আমাদের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হবে। তাও হয়নি। আমাদের রাজনীতি এখনো একটি সীমিত গণ্ডির বাইরে আসতে পারেনি। এখন তো আবার রাজনীতি হরতালনির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ আমাদের যেসব জাতীয় সমস্যা আছে, তা সমাধানের অযোগ্য কোনো সমস্যা নয়। প্রয়োজন ছিল একটু দূরদর্শিতা, সংবেদনশীলতা এবং ধৈর্য। আমাদের আইনসভা এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। নির্বাহী বিভাগ অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং ব্যক্তি ও আত্মকেন্দ্রিক। রাজনীতি এখন অনেকটা অরাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। সমাজে ধান্ধাবাজ, ফেরেববাজ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অসৎ মানুষের কদর বেড়েছে বহুগুণ। রাষ্ট্রের এসব বিষফোড়া দূর করতে পারলে বাংলাদেশে এক দশকের পথ এক বা দুই বছরে অতিক্রম করতে পারবে। শেখ হাসিনা যে সংখ্যক সাংসদ নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, তিনি যদি পরিস্থিতি পাল্টাতে না পারেন তাহলে অন্যরা কীভাবে পারবেন? তাঁর পিতা যদি একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে পারেন, কেন তিনি পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারবেন না? মানুষ নয়, তার কীর্তিই ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে ।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments