যুগের বাণী-কী আমাদের ব্যর্থতা? by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
এই প্রশ্ন আমার মনে বাসা বেঁধেছে গত সোমবারের আচমকা ঘটনার কারণে। পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর এর প্রতিবেদন ছাপা হলো দেশের সব কয়টি দৈনিকের প্রথম পাতায় : গতকাল বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের এলাকা রাজধানীর কাকরাইল, বিজয়নগর ও পুরানা পল্টন যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জামায়াত-শিবিরকর্মীদের অনেকের মুখে কাপড় ও মাথায় হেলমেট ছিল।
তারা পুলিশের পাঁচটি গাড়িসহ (একটি প্রিজনভ্যান, একটি জিপ, একটি পিকআপ ও দুটি মোটরবাইক) ১৩টি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে এবং শতাধিক প্রাইভেট কার ভাঙচুর করেছে। রাস্তার পাশের শতাধিক দোকান ভাঙচুর করেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য ও পথচারী। কেন এই বিক্ষোভ আর ভাঙচুর?
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ ও সে বিচারে অভিযুক্ত নেতাদের ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে জামায়াত বিক্ষোভ মিছিলের যে কর্মসূচি দিয়েছিল, এটি ছিল তার প্রথম দিন।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আগেই হৈচৈ কেন? বিচার শেষ হলেই তো সেটা সঠিক না বেঠিক হয়েছে, প্রশ্নটি তোলা যায়। অবশ্য যৌক্তিক কারণে কিংবা একাধিক কারণের ভিত্তিতে। এটাই স্বাভাবিক পন্থা এবং তা অবশ্যই হবে আইনি কার্যক্রম অনুসরণ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধগুলো যথা_মানবতাবিরুদ্ধ অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অপরাধগুলোর বিচারের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত ১৯৭৩ সালের ১৯ নম্বর আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং আইনটিতে বিচারকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে অধিকারগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সর্বজনীন পূর্ণাঙ্গ অধিকার এবং তাতে আদৌ কোনো ঘাটতি নেই। আইনটির ১৭ ধারার অনূদিত উদ্ধৃতি এই : '১৭. বিচারকালে অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার_১. একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারকালে অধিকার থাকিবে তাহার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের প্রাসঙ্গিক কৈফিয়ত দেওয়া। ২. একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার থাকিবে ট্রাইব্যুনাল সমীপে নিজের ডিফেন্স (মামলা) পরিচালনা করিবার এবং আইনজীবীর সহায়তা লওয়া। ৩. একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার থাকিবে তাহার ডিফেন্সের (মামলা) সমর্থনে বিচারকালে সাক্ষ্য উপস্থিত করিবার এবং বাদীপক্ষ কর্তৃক তলব করা যেকোনো সাক্ষীকে জেরা করিবার।'
এ ছাড়া আইনটির ২১ ধারায় ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম ব্যবস্থাটি রাখা হয়েছে, যার সংশ্লিষ্ট অংশটির অনূদিত উদ্ধৃতি এই : '৩ ধারায় নির্দিষ্ট অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত এক ব্যক্তির বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এহেন দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করিবার অধিকার থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে এহেন আপিল দায়ের করা যাইবে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডের আদেশের ষাট দিনের মধ্যে।' যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি করেছিল তাদের জনগণের না চেনার কথা নয় কিংবা যারা অপরাধী তাদেরও সেটা না জানার কোনো কারণ নেই এবং সেহেতু সম্ভাব্য অভিযুক্তরা আগামই শুধু হৈচৈ করাচ্ছে না, ভয়াবহ পরিকল্পনা দ্বারা সেটা করাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে 'অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড' বইটির একটি মজার গল্পের কথা মনে পড়ল।
সংক্ষেপে ওই গল্পটি এখন বলছি : হাত নাড়তে নাড়তে রানি চিৎকার করে উঠলেন, 'আমার আঙুল দিয়ে রক্ত পড়ছে, ওফ্!' তাঁর আর্তনাদ যেন স্টিম ইঞ্জিনের বাঁশির মতো শোনাল। এত জোর আওয়াজ যে অ্যালিস দুই হাতে কান চাপা দিল। 'কী হলো, কী ব্যাপার?' অ্যালিস জিজ্ঞেস করল, 'তোমার আঙুলে কি কিছু ফুটে গেছে?' 'না না, এখনো কিছু ফুটেনি। তবে এবার ফুটবে_ও রে বাবা!' রানি আবার চিৎকার শুরু করলেন। 'কখন ফুটবে বলে তোমার মনে হয়?' অ্যালিস হাসি চেপে প্রশ্ন করল। 'যখন আমি গায়ে শাল জড়াব', রানি গোঙাতে শুরু করলেন, 'তখন ব্রোচের পিনটা আমার আঙুলে বিঁধে যাবে। ও রে বাপ রে, ও হো হো'_এই কথা বলা মাত্র ব্রোচটা খুলে গেল। রানি পাগলের মতো সেটা ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। পিনটা ফসকে গিয়ে রানির আঙুলে বিঁধে গেল।
'এরই জন্য রক্ত পড়ছে'_রানি অ্যালিসকে বললেন। 'কিন্তু তুমি এখন কাঁদছ না কেন?' অ্যালিস রানিকে প্রশ্ন করল। 'কেন, আমি তো যা কাঁদার আগেই কেঁদে নিয়েছি', রানি জবাব দিলেন। 'এখন আবার কেঁদে কী হবে তুমিই বলো?'
বোঝা গেল, কেন এই আগাম ভয়ংকর হৈচৈ। কিন্তু দুটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আজকের লেখাটির শিরোনাম নিয়ে। শিরোনামের আমরা কারা এবং কী তাদের ব্যর্থতা? আমরা কারা, এই প্রশ্নটির উত্তর ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে নেওয়া যাক : 'তন্ন তন্ন করে খুঁজে রাজাকার দলের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই বাজার লাগোয়া বসতিটা থেকে একটা চিৎকার আর শোরগোলের শব্দ ভেসে আসে। পরিষ্কার শোনা যায় একজনের গলার আওয়াজ, ধরেক ধরেক পালাল যে। উত্তেজিত কয়েকজনকে একটা লোককে টেনেহিঁচড়ে আনতে দেখা যায়। জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে? একজন বলে, 'এই রাজাকার পালাচ্ছিল গো, হামরা তাক ধরে ফেলছি।' বলে কী এরা! নিজেরাই ধরে ফেলেছে রাজাকার? মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যখন রাজাকাররা পালাচ্ছিল, তখন গ্রামবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের একজনকে ধরে ফেলেছে। মনে মনে বলি, সাবাস! জেগে উঠেছে অধিকৃত এলাকার মানুষ। এরা যেন তৈরি হয়েই ছিল মনেপ্রাণে। কেবল মুক্তিবাহিনীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল তারা। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকারদের নির্মম অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এরা আজ মরিয়া হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে।' (মাহবুব আলম, গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৪, সংক্ষেপিত)
যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রকাশ্যে বিচার হবে। মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য উপস্থাপিত হবে এবং সেগুলোর ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল রায় দেবেন। রায় সবার অবগতির জন্য ছাপা হবে। রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের হবে। আপিলের শুনানিও প্রকাশ্যে হয়ে রায়টি সবাই জানতে পারবে। তখন আর অভিযুক্তের নিযুক্ত দেশি-বিদেশি আইনজীবীরা হৈচৈ করার কারণ খুঁজে পাবেন না। তাই মোটা ফি পেয়ে আগাম হৈচৈ করছেন। ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষ এবং অতঃপর আপিলে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আদৌ পারছেন না। ঘৃণ্য অপরাধের বিচার ঠেকিয়ে রাখা কিংবা বাধাগ্রস্ত করাও গুরুতর অপরাধ। ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বিচারপতি লর্ড ডেনিং বলেছিলেন, 'গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষে মৌল যুক্তি এটাই নয় যে দণ্ডটি ওই অপরাধকে নিরোধ করে, বরং এটাই যে দণ্ডটি দ্বারা সমাজ ওই অপরাধের বিরুদ্ধে জোরালো সামাজিক ঘৃণা জ্ঞাপন করে।'
আমরা কারা_এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেছে যে আমরা হচ্ছি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা জনগণ। অতি দুঃখের বিষয়টি হচ্ছে, ১৯ সেপ্টেম্বর যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করল, যাদের চেহারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল, তাদের তো জন্মই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর পরে, অর্থাৎ তারা তো আমাদের উত্তরপুরুষ। সে ক্ষেত্রে তাদের এ আচরণ কেন? কারণ আগের অনুচ্ছেদে যে সহজ-সরল যৌক্তিক কথাগুলো লিখেছি, সেগুলো এদের বোঝাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি,
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ ও সে বিচারে অভিযুক্ত নেতাদের ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে জামায়াত বিক্ষোভ মিছিলের যে কর্মসূচি দিয়েছিল, এটি ছিল তার প্রথম দিন।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আগেই হৈচৈ কেন? বিচার শেষ হলেই তো সেটা সঠিক না বেঠিক হয়েছে, প্রশ্নটি তোলা যায়। অবশ্য যৌক্তিক কারণে কিংবা একাধিক কারণের ভিত্তিতে। এটাই স্বাভাবিক পন্থা এবং তা অবশ্যই হবে আইনি কার্যক্রম অনুসরণ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধগুলো যথা_মানবতাবিরুদ্ধ অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অপরাধগুলোর বিচারের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত ১৯৭৩ সালের ১৯ নম্বর আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং আইনটিতে বিচারকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে অধিকারগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সর্বজনীন পূর্ণাঙ্গ অধিকার এবং তাতে আদৌ কোনো ঘাটতি নেই। আইনটির ১৭ ধারার অনূদিত উদ্ধৃতি এই : '১৭. বিচারকালে অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার_১. একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারকালে অধিকার থাকিবে তাহার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের প্রাসঙ্গিক কৈফিয়ত দেওয়া। ২. একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার থাকিবে ট্রাইব্যুনাল সমীপে নিজের ডিফেন্স (মামলা) পরিচালনা করিবার এবং আইনজীবীর সহায়তা লওয়া। ৩. একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার থাকিবে তাহার ডিফেন্সের (মামলা) সমর্থনে বিচারকালে সাক্ষ্য উপস্থিত করিবার এবং বাদীপক্ষ কর্তৃক তলব করা যেকোনো সাক্ষীকে জেরা করিবার।'
এ ছাড়া আইনটির ২১ ধারায় ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম ব্যবস্থাটি রাখা হয়েছে, যার সংশ্লিষ্ট অংশটির অনূদিত উদ্ধৃতি এই : '৩ ধারায় নির্দিষ্ট অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত এক ব্যক্তির বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এহেন দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করিবার অধিকার থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে এহেন আপিল দায়ের করা যাইবে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডের আদেশের ষাট দিনের মধ্যে।' যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি করেছিল তাদের জনগণের না চেনার কথা নয় কিংবা যারা অপরাধী তাদেরও সেটা না জানার কোনো কারণ নেই এবং সেহেতু সম্ভাব্য অভিযুক্তরা আগামই শুধু হৈচৈ করাচ্ছে না, ভয়াবহ পরিকল্পনা দ্বারা সেটা করাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে 'অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড' বইটির একটি মজার গল্পের কথা মনে পড়ল।
সংক্ষেপে ওই গল্পটি এখন বলছি : হাত নাড়তে নাড়তে রানি চিৎকার করে উঠলেন, 'আমার আঙুল দিয়ে রক্ত পড়ছে, ওফ্!' তাঁর আর্তনাদ যেন স্টিম ইঞ্জিনের বাঁশির মতো শোনাল। এত জোর আওয়াজ যে অ্যালিস দুই হাতে কান চাপা দিল। 'কী হলো, কী ব্যাপার?' অ্যালিস জিজ্ঞেস করল, 'তোমার আঙুলে কি কিছু ফুটে গেছে?' 'না না, এখনো কিছু ফুটেনি। তবে এবার ফুটবে_ও রে বাবা!' রানি আবার চিৎকার শুরু করলেন। 'কখন ফুটবে বলে তোমার মনে হয়?' অ্যালিস হাসি চেপে প্রশ্ন করল। 'যখন আমি গায়ে শাল জড়াব', রানি গোঙাতে শুরু করলেন, 'তখন ব্রোচের পিনটা আমার আঙুলে বিঁধে যাবে। ও রে বাপ রে, ও হো হো'_এই কথা বলা মাত্র ব্রোচটা খুলে গেল। রানি পাগলের মতো সেটা ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। পিনটা ফসকে গিয়ে রানির আঙুলে বিঁধে গেল।
'এরই জন্য রক্ত পড়ছে'_রানি অ্যালিসকে বললেন। 'কিন্তু তুমি এখন কাঁদছ না কেন?' অ্যালিস রানিকে প্রশ্ন করল। 'কেন, আমি তো যা কাঁদার আগেই কেঁদে নিয়েছি', রানি জবাব দিলেন। 'এখন আবার কেঁদে কী হবে তুমিই বলো?'
বোঝা গেল, কেন এই আগাম ভয়ংকর হৈচৈ। কিন্তু দুটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আজকের লেখাটির শিরোনাম নিয়ে। শিরোনামের আমরা কারা এবং কী তাদের ব্যর্থতা? আমরা কারা, এই প্রশ্নটির উত্তর ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে নেওয়া যাক : 'তন্ন তন্ন করে খুঁজে রাজাকার দলের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই বাজার লাগোয়া বসতিটা থেকে একটা চিৎকার আর শোরগোলের শব্দ ভেসে আসে। পরিষ্কার শোনা যায় একজনের গলার আওয়াজ, ধরেক ধরেক পালাল যে। উত্তেজিত কয়েকজনকে একটা লোককে টেনেহিঁচড়ে আনতে দেখা যায়। জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে? একজন বলে, 'এই রাজাকার পালাচ্ছিল গো, হামরা তাক ধরে ফেলছি।' বলে কী এরা! নিজেরাই ধরে ফেলেছে রাজাকার? মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যখন রাজাকাররা পালাচ্ছিল, তখন গ্রামবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের একজনকে ধরে ফেলেছে। মনে মনে বলি, সাবাস! জেগে উঠেছে অধিকৃত এলাকার মানুষ। এরা যেন তৈরি হয়েই ছিল মনেপ্রাণে। কেবল মুক্তিবাহিনীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল তারা। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকারদের নির্মম অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এরা আজ মরিয়া হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে।' (মাহবুব আলম, গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৪, সংক্ষেপিত)
যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রকাশ্যে বিচার হবে। মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য উপস্থাপিত হবে এবং সেগুলোর ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল রায় দেবেন। রায় সবার অবগতির জন্য ছাপা হবে। রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের হবে। আপিলের শুনানিও প্রকাশ্যে হয়ে রায়টি সবাই জানতে পারবে। তখন আর অভিযুক্তের নিযুক্ত দেশি-বিদেশি আইনজীবীরা হৈচৈ করার কারণ খুঁজে পাবেন না। তাই মোটা ফি পেয়ে আগাম হৈচৈ করছেন। ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষ এবং অতঃপর আপিলে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আদৌ পারছেন না। ঘৃণ্য অপরাধের বিচার ঠেকিয়ে রাখা কিংবা বাধাগ্রস্ত করাও গুরুতর অপরাধ। ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বিচারপতি লর্ড ডেনিং বলেছিলেন, 'গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষে মৌল যুক্তি এটাই নয় যে দণ্ডটি ওই অপরাধকে নিরোধ করে, বরং এটাই যে দণ্ডটি দ্বারা সমাজ ওই অপরাধের বিরুদ্ধে জোরালো সামাজিক ঘৃণা জ্ঞাপন করে।'
আমরা কারা_এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেছে যে আমরা হচ্ছি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা জনগণ। অতি দুঃখের বিষয়টি হচ্ছে, ১৯ সেপ্টেম্বর যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করল, যাদের চেহারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল, তাদের তো জন্মই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর পরে, অর্থাৎ তারা তো আমাদের উত্তরপুরুষ। সে ক্ষেত্রে তাদের এ আচরণ কেন? কারণ আগের অনুচ্ছেদে যে সহজ-সরল যৌক্তিক কথাগুলো লিখেছি, সেগুলো এদের বোঝাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি,
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
No comments