বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

২৯৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এম মিজানুর রহমান, বীর প্রতীক সাহসী এক দলনায়ক এম মিজানুর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলেন শত্রুসেনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে। তুমুল গোলাগুলিতে গোটা এলাকা মুখরিত। শব্দে কান পাতা দায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল পাকিস্তানি সেনারা। তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ভেঙে পড়ার উপক্রম।


এম মিজানুর রহমান সহযোদ্ধাদের বললেন আরও সাঁড়াশি আক্রমণ চালানোর জন্য। তাঁর নির্দেশ পেয়ে সহযোদ্ধারা আবারও বড় আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। এমন সময় ঘটল দুর্ঘটনা। তাঁদের অধিনায়ক শত্রুর নিক্ষিপ্ত শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হলেন। এ ঘটনা কামালপুরে। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর।
কামালপুর জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত সীমান্ত ফাঁড়ি (বিওপি)। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেদিন (১৫ নভেম্বর) মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল কামালপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করে। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন এম মিজানুর রহমান। সব দলের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)।
১৪ ডিসেম্বর রাত তিনটা বা সাড়ে তিনটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের তিন পাশে অবস্থান নেন। এর আগে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু ওই গোলাবর্ষণে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী বাংকারের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভোর সাড়ে পাঁচটা বা তার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ শুরু করে সামনে এগোতে থাকেন।
এম মিজানুর রহমান তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে গুলি করতে করতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের একদম কাছে চলে যান। তাঁদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের যুদ্ধক্ষেত্রের অদূরে একটি তেঁতুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। এম মিজানুর রহমানের দলের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মেজর আবু তাহের বিজয় সন্নিকটে ভেবে এগিয়ে যান। তখন আনুমানিক সকাল নয়টা। এ সময় তাঁর সামনে শত্রুর ছোড়া একটি শেল বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরিত শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে আবু তাহের আহত হন এবং মাটিতে পড়ে যান। এ দৃশ্য দেখে সেখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। আবু তাহেরের আহত হওয়ার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় এম মিজানুর রহমান দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতেই মুক্তিযোদ্ধারা আবার মনোবল ফিরে পান এবং যুদ্ধ করতে থাকেন। আবু তাহের আহত হওয়ার পর এম মিজানুর রহমানই ওই যুদ্ধে সার্বিক নেতৃত্ব দেন।
এম মিজানুর রহমান ১৯৭১ সালে ঢাকায় একটি বিদেশি ব্যাংকে (আমেরিকান এক্সপ্রেস) কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চাকরিতে আর যোগ না দিয়ে ভারতে যান। পরে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ার কোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাব সেক্টরে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এম মিজানুর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩০। গেজেটে নাম মিজানুর রহমান মিয়া। প্রকৃত নাম এম মিজানুর রহমান।
এম মিজানুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। পরে সোনালী ব্যাংকে। বর্তমানে তিনি কানাডাপ্রবাসী। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার বড় মোকাম গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মজিবর রহমান। মা সুফিয়া খাতুন। স্ত্রী গুলশান আরা। তাঁদের চার ছেলে, দুই মেয়ে।
সূত্র: এম মিজানুর রহমান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.