আমায় ক্ষমো হে-অর্থনীতির 'অর্থ' নাই? by মামুন রশীদ
আমার বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তা প্রায় ২৫ বছর আগে। এখন একমাত্র কাজ ডাক্তারের কাছে আসা-যাওয়া। মাঝেমধ্যে অসুস্থতা বাড়লে হাসপাতালে কিছুদিন কাটানো আর প্রায় দিনব্যাপী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়া। আগের দিনের মুরবি্বদের মতো তিনি আবার পত্রিকায় ছাপানো সব খবর বা প্রতিবেদন বিশ্বাসও করেন। ব্যাংকার ছেলের কাছে তাঁর প্রশ্ন? কী হলো বাবা, ব্যাংকে নাকি টাকা নেই? উদ্যোক্তারা নাকি ঋণ পাচ্ছেন না?
নতুন কল-কারখানা নাকি গড়ে উঠছে না? তাহলে কিভাবে মানুষ চাকরি পাবে? তরুণরা তো তাহলে আরো বখাটে হয়ে যাবে। ডলারের দাম এত বাড়ছে কেন? ইত্যাদি অনেক অনেক প্রশ্ন আমার কাছে। আমি তাঁর শারীরিক যত্নের ওপর জোর দিয়ে, আমার ও আমার সন্তানের জন্য অনেক অনেক দোয়া চেয়ে তাঁর কাছ থেকে অনেকটা যেন ত্বরিত কেটে পড়লাম।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিকাশমান অনেক অর্থনীতির মতো চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে বর্তমানে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে প্রায় আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ মাত্র চার মাসেই ২০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। বৈদেশিক সাহায্য ছাড়করণ এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ বেশ কম। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মন্দাভাবের কারণে রপ্তানি রয়েছে সংশোধনের প্রক্রিয়ায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ নিম্নমুখী। অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহও কমে আসছে। স্থানীয় টাকার বিনিময় হারও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এসব কারণে দেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মুখে রয়েছে। তবে অর্থনীতিতে এসব চাপের বিপরীতে কিছু ইতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন_কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ছে এবং রাজস্ব আদায়ও সঠিক পথে রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ভালো হবে বলে এখনো আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের ধারায় রয়েছে।
যদিও দেশের নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্তারা অর্থনীতিকে জনপ্রিয়তা অর্জনের পথেই পরিচালিত করছেন, তবু কোথাও যেন এর তেমন একটা প্রভাব চোখে পড়ছে না। একদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয় তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, ব্যয় সংকোচন ও মুদ্রানীতি কঠোর করার যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন, অন্যদিকে কোনো কোনো নীতিনির্ধারক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতে অব্যাহতভাবে ভর্তুকি প্রদানের পক্ষে জোরালো মত দিয়ে যাচ্ছেন। 'রোম যখন পুড়ছে নীরোর তখন বাঁশি বাজানোর মতো' কেউ বা বাণিজ্যিক ব্যাংকে অধিক হারে নারীকর্মী নিয়োগ, সুন্দরবনের জন্য আরো ভোট আদায় বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে অর্থায়নের জন্য জনমত গঠনে রোডমার্চ নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কেউ বা আবার ইতিমধ্যে মন্দঋণে রেকর্ড অর্জনকারী গ্রাহককে ব্যাংকের ভল্ট খালি করে আরো নতুন ঋণ দেওয়া বা বিনা সুদে পল্লীঋণ বিতরণে ব্যস্ত রয়েছেন।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে ভর্তুকির জন্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় এবং এ জন্য অতিরিক্ত ২৭ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় এখন অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে অতিরিক্ত ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা পেতে অপেক্ষমাণ আছে, যা সংগ্রহ করা সরকারের পক্ষে কঠিন বৈকি। কারণ উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে তহবিলের প্রবাহ সেভাবে বাড়ছে না। পরিণতিতে সরকার বাধ্য হয়ে ব্যাংক খাত থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে ঋণ গ্রহণ এবং জ্বালানির দাম সমন্বয় করছে।
বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ মোট ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রাক্কলনে দেখা গেছে যে মোট ভর্তুকির পরিমাণ কমপক্ষে ৩১ হাজার ৫০০ কোটি থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। বাজেটে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য ভর্তুকি বাবদ তিন হাজার কোটি টাকা রাখা হলেও তা ২৮ হাজার ১৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকছে। কৃষি খাতে সার, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের জন্য ভর্তুকি বাবদ বাজেটে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখা হলেও সংশোধিত প্রাক্কলনে তা ছয় হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। খাদ্যে এক হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জন্য পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকার ভর্তুকি প্রয়োজন পড়বে। এ ছাড়া রপ্তানি খাতে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পাটকল সংস্থাসহ (বিজেএমসি) অন্যান্য খাতে তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকার ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে জাতীয় বাজেটের ২৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে বাজেট প্রস্তাবে ছিল ১২ শতাংশ। ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে এরই মধ্যে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা গত অর্থবছরের গোটা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সমান। চলতি অর্থবছরে ইতিমধ্যে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বছর শেষে তা লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ৬ শতাংশের বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে বেশ চাপ রয়েছে। সরকারও এ লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সিএনজির দাম বাড়িয়েছে। গত এক দশকে দেশে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেলেও তেল, বিদ্যুৎ, সিএনজির দামসহ মূল্যস্ফীতি, গণপরিবহনের ভাড়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যক্তিপর্যায়ে চাপ পড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবও পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। এদিকে ছয় মাসে তিন দফায় তেলের দাম বাড়ানোর পরে আরেকবার একই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। অতিরিক্ত পরিমাণ ভর্তুকি প্রদান এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে ইতিমধ্যে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকেই একমত হবেন যে সব মিলিয়ে আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি বেড়েছে এবং এতে অনেক মানুষ ফের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চ দামের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়ছে। এখন পর্যন্ত রপ্তানি খাতে সাড়ে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ইউরোপের সংকটের কারণে তা কমার আশঙ্কা রয়েছে। আমদানি কমার কারণে শুল্ক আদায় কমবে এবং পরিণতিতে সরকারের রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়বে।
পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে বা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ১২ শতাংশে উঠেছে। এবার আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমার আশা করা হলেও মুদ্রা সরবরাহ কমাতে তথা ব্যয়ের লাগাম টানতে না পারলে অর্থনীতিতেও সুখবর আসবে না।
সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১০ থেকে ১৩ টাকা দরে কেনে এবং গ্রাহকদের কাছে তা চার থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি করে থাকে। কেনাবেচার এই পার্থক্যটা মেটানো হয় ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে। যে কারণে পিডিবির লোকসান দিন দিন বাড়ছে এবং বিদ্যুৎ খাতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে এই সংস্থা ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো চালাতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। এতে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়ছে।
ভর্তুকির দায় মেটাতে সরকারকে সম্পদ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে এটি মেটানো সম্ভব নয়। এ কারণে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে, যা চূড়ান্ত পরিণতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করছে। এই অবস্থায় সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশে জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এতেও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়ছে। মূলত সরকার তেলনির্ভর রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের স্বল্পমেয়াদি নীতি হাতে নেওয়ার কারণেই তিন বছর ধরে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে।
এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর জন্য আর কোনো অপশন বা বিকল্প উপায় কি আমাদের সামনে আছে? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা কি ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে পারি না? ভর্তুকির জন্য যে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন সেটা কি আমরা এই দেশের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত করের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারি না? বন্ড ইস্যু করেও কি আমরা তহবিল সংগ্রহ করতে পারি না? এসব যুক্তির 'প্রচার মূল্য' থাকলেও বাজার মূল্য নেই। এগুলো অর্থনীতির বইয়ের কথাও নয়। তদুপরি দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, শাসন পরিচালনার মডেল বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে কাজগুলো করা সম্ভবও নয়। অর্থনীতিতে এসব কাজ সম্পাদন করা সময়সাপেক্ষও বটে। আমাদের বিশ্বাস, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, রেগুলেটর বা নিয়ন্ত্রকদের সদিচ্ছা এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত হলেই কেবল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের সামনে উন্নয়ন বাজেটে 'তেমন প্রয়োজনীয় নয়' প্রকল্প বাদ দিয়ে বাজেট কাটছাঁট করে ব্যাপক হারে ব্যয় সংকোচন এবং মুদ্রানীতি কঠোর করা ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প নেই। জনপ্রিয়তা অর্জনের অর্থনীতি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে বেশ কার্যকর হলেও এটি মূলত স্বাভাবিক সময়ে সরকারের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ও জনগণের ভোগান্তি বাড়ায় এবং বর্তমানে অন্তত সরকারের অগ্রযাত্রাকে সমস্যাসংকুল করে তুলছে। সে জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখনই মাঠে না নামলে পরিস্থিতি সামলাতে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিতে 'অর্থ' নেই, এটি হয়তো সত্য নয়; কিন্তু সমস্যা স্বীকার করে তড়িৎ সমাধানের ব্যবস্থা না নিলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিকাশমান অনেক অর্থনীতির মতো চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে বর্তমানে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে প্রায় আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ মাত্র চার মাসেই ২০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। বৈদেশিক সাহায্য ছাড়করণ এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ বেশ কম। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মন্দাভাবের কারণে রপ্তানি রয়েছে সংশোধনের প্রক্রিয়ায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ নিম্নমুখী। অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহও কমে আসছে। স্থানীয় টাকার বিনিময় হারও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এসব কারণে দেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মুখে রয়েছে। তবে অর্থনীতিতে এসব চাপের বিপরীতে কিছু ইতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন_কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ছে এবং রাজস্ব আদায়ও সঠিক পথে রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ভালো হবে বলে এখনো আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের ধারায় রয়েছে।
যদিও দেশের নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্তারা অর্থনীতিকে জনপ্রিয়তা অর্জনের পথেই পরিচালিত করছেন, তবু কোথাও যেন এর তেমন একটা প্রভাব চোখে পড়ছে না। একদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয় তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, ব্যয় সংকোচন ও মুদ্রানীতি কঠোর করার যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন, অন্যদিকে কোনো কোনো নীতিনির্ধারক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতে অব্যাহতভাবে ভর্তুকি প্রদানের পক্ষে জোরালো মত দিয়ে যাচ্ছেন। 'রোম যখন পুড়ছে নীরোর তখন বাঁশি বাজানোর মতো' কেউ বা বাণিজ্যিক ব্যাংকে অধিক হারে নারীকর্মী নিয়োগ, সুন্দরবনের জন্য আরো ভোট আদায় বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে অর্থায়নের জন্য জনমত গঠনে রোডমার্চ নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কেউ বা আবার ইতিমধ্যে মন্দঋণে রেকর্ড অর্জনকারী গ্রাহককে ব্যাংকের ভল্ট খালি করে আরো নতুন ঋণ দেওয়া বা বিনা সুদে পল্লীঋণ বিতরণে ব্যস্ত রয়েছেন।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে ভর্তুকির জন্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় এবং এ জন্য অতিরিক্ত ২৭ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় এখন অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে অতিরিক্ত ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা পেতে অপেক্ষমাণ আছে, যা সংগ্রহ করা সরকারের পক্ষে কঠিন বৈকি। কারণ উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে তহবিলের প্রবাহ সেভাবে বাড়ছে না। পরিণতিতে সরকার বাধ্য হয়ে ব্যাংক খাত থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে ঋণ গ্রহণ এবং জ্বালানির দাম সমন্বয় করছে।
বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ মোট ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রাক্কলনে দেখা গেছে যে মোট ভর্তুকির পরিমাণ কমপক্ষে ৩১ হাজার ৫০০ কোটি থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। বাজেটে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য ভর্তুকি বাবদ তিন হাজার কোটি টাকা রাখা হলেও তা ২৮ হাজার ১৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকছে। কৃষি খাতে সার, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের জন্য ভর্তুকি বাবদ বাজেটে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখা হলেও সংশোধিত প্রাক্কলনে তা ছয় হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। খাদ্যে এক হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জন্য পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকার ভর্তুকি প্রয়োজন পড়বে। এ ছাড়া রপ্তানি খাতে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পাটকল সংস্থাসহ (বিজেএমসি) অন্যান্য খাতে তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকার ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে জাতীয় বাজেটের ২৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে বাজেট প্রস্তাবে ছিল ১২ শতাংশ। ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে এরই মধ্যে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা গত অর্থবছরের গোটা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সমান। চলতি অর্থবছরে ইতিমধ্যে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বছর শেষে তা লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ৬ শতাংশের বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে বেশ চাপ রয়েছে। সরকারও এ লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সিএনজির দাম বাড়িয়েছে। গত এক দশকে দেশে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেলেও তেল, বিদ্যুৎ, সিএনজির দামসহ মূল্যস্ফীতি, গণপরিবহনের ভাড়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যক্তিপর্যায়ে চাপ পড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবও পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। এদিকে ছয় মাসে তিন দফায় তেলের দাম বাড়ানোর পরে আরেকবার একই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। অতিরিক্ত পরিমাণ ভর্তুকি প্রদান এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে ইতিমধ্যে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকেই একমত হবেন যে সব মিলিয়ে আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি বেড়েছে এবং এতে অনেক মানুষ ফের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চ দামের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়ছে। এখন পর্যন্ত রপ্তানি খাতে সাড়ে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ইউরোপের সংকটের কারণে তা কমার আশঙ্কা রয়েছে। আমদানি কমার কারণে শুল্ক আদায় কমবে এবং পরিণতিতে সরকারের রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়বে।
পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে বা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ১২ শতাংশে উঠেছে। এবার আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমার আশা করা হলেও মুদ্রা সরবরাহ কমাতে তথা ব্যয়ের লাগাম টানতে না পারলে অর্থনীতিতেও সুখবর আসবে না।
সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১০ থেকে ১৩ টাকা দরে কেনে এবং গ্রাহকদের কাছে তা চার থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি করে থাকে। কেনাবেচার এই পার্থক্যটা মেটানো হয় ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে। যে কারণে পিডিবির লোকসান দিন দিন বাড়ছে এবং বিদ্যুৎ খাতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে এই সংস্থা ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো চালাতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। এতে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়ছে।
ভর্তুকির দায় মেটাতে সরকারকে সম্পদ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে এটি মেটানো সম্ভব নয়। এ কারণে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে, যা চূড়ান্ত পরিণতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করছে। এই অবস্থায় সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশে জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এতেও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়ছে। মূলত সরকার তেলনির্ভর রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের স্বল্পমেয়াদি নীতি হাতে নেওয়ার কারণেই তিন বছর ধরে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে।
এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর জন্য আর কোনো অপশন বা বিকল্প উপায় কি আমাদের সামনে আছে? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা কি ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে পারি না? ভর্তুকির জন্য যে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন সেটা কি আমরা এই দেশের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত করের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারি না? বন্ড ইস্যু করেও কি আমরা তহবিল সংগ্রহ করতে পারি না? এসব যুক্তির 'প্রচার মূল্য' থাকলেও বাজার মূল্য নেই। এগুলো অর্থনীতির বইয়ের কথাও নয়। তদুপরি দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, শাসন পরিচালনার মডেল বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে কাজগুলো করা সম্ভবও নয়। অর্থনীতিতে এসব কাজ সম্পাদন করা সময়সাপেক্ষও বটে। আমাদের বিশ্বাস, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, রেগুলেটর বা নিয়ন্ত্রকদের সদিচ্ছা এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত হলেই কেবল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের সামনে উন্নয়ন বাজেটে 'তেমন প্রয়োজনীয় নয়' প্রকল্প বাদ দিয়ে বাজেট কাটছাঁট করে ব্যাপক হারে ব্যয় সংকোচন এবং মুদ্রানীতি কঠোর করা ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প নেই। জনপ্রিয়তা অর্জনের অর্থনীতি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে বেশ কার্যকর হলেও এটি মূলত স্বাভাবিক সময়ে সরকারের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ও জনগণের ভোগান্তি বাড়ায় এবং বর্তমানে অন্তত সরকারের অগ্রযাত্রাকে সমস্যাসংকুল করে তুলছে। সে জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখনই মাঠে না নামলে পরিস্থিতি সামলাতে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিতে 'অর্থ' নেই, এটি হয়তো সত্য নয়; কিন্তু সমস্যা স্বীকার করে তড়িৎ সমাধানের ব্যবস্থা না নিলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments